আমার পায়ের কাছ থেকে বলটা কুড়িয়ে নিয়ে বদরুল ফিরে তাকায়, ‘স্যার, এখনো কিছু টের পান নাই?’
‘না তো! কী টের পাব?’
ছেলেটা অবাক হয়ে তাকায়, ‘কিছুই টের পান নাই?’
‘না! কী বলতে চাইছ বলো তো তুমি?’
বদরুল মাথা নাড়ে, ‘কিছু না স্যার, এমনি জিগাইসিলাম। আচ্ছা, আসি।’ সে কপালে হাত ঠেকিয়ে সালাম করে আবার ছুটে চলে যায় মাঠে। ক্লাস নাইন-টেনের অন্য সব ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য। ফুটবলে একটা লাথি বসিয়ে বদরুল খেলায় ফিরে যায়। আমি চাদরটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ঘাসে ঢাকা পথ বেয়ে হাঁটতে থাকি। এরই মধ্যে কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। মাঠের ওই প্রান্তটা কেমন ধোঁয়াটে মনে হয়। যেমন মনে হয় বদরুলের কথাগুলো। কাল সকাল সকাল স্কুলে গিয়ে বদরুলকে ধরতে হবে। সে কী কথা গোপন করতে চাইছে আসলে?
ভবডাঙ্গা সরকারী হাইস্কুলের ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে আমি যোগ দিয়েছি দিন কয়েক হলো। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাদেক স্যার খুবই অমায়িক মানুষ। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম যখন শুনলাম আমার থাকার জন্য গাঁয়ের শেষ প্রান্তে পুরো একটা বাড়ি তিনি ঠিক করেছেন। একা মানুষ। পুরো বাড়ি দিয়ে আমি কী করব? কোমরসমান আধভাঙ্গা দেয়ালঘেরা পুরনো ধাঁচের ছায়াময় বাড়িটা ঘুরে ফিরে দেখে আমি বিস্ময় চাপতে পারলাম না। ছোটবড় সব মিলিয়ে পাঁচটা ঘর। রান্নাঘরটা বারান্দার এক কোনে। চাইলে উনোন নামিয়ে নিয়ে উঠোনেও রান্না করা যায়। দুটো ঘরে খাট আছে, আবার দুটো ঘরে চেয়ার টেবিলও পাতা। উঠোনের এক কোনে ছায়া ফেলেছে একটা তেঁতুল গাছ। রান্নাঘরের পাশ ঘেঁষে রেলিংভাঙ্গা সিঁড়ি দিয়ে সোজা ছাদে যাওয়া যায়। মাথার ওপর খোলা আকাশ। আশে পাশের জমিগুলোয় ধান কাটা হয়ে গেছে, এখন চারদিকে শুধু ফাঁকা মাঠ। বিকেলগুলো ছাদের ওপর চেয়ার পেতে কাটিয়ে দেয়া যাবে। এ তো না চাইতেও স্বর্গ! কিন্তু এমন একটা বাড়িতে কোন বাসিন্দা নেই কেন?
সাদেক স্যার খুবই আমতা আমতা করতে লাগলেন, ‘না মানে ঐ...যাদের বাড়ি তারা তো আর নেই, গেছে সব চলে। গ্রামের মানুষের তো এইসব বাড়িতে থাকা পোষায় না তাই এমনই খালি পড়ে আছে। আপনি এসেছেন এখন আমরা বিদ্যুতের লাইন লাগিয়ে দেব। এই কয়টা দিন একটু কষ্ট করে থাকেন, বুঝলেন কিনা?’
বোঝাবুঝির আর কী আছে? দীর্ঘদিন চাকরি-বাকরি না পেয়ে আমি ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। এখন আর চিন্তা কী? সারাদিনই স্কুলে কাটিয়ে দিই। মোবাইলের চার্জও হয় এখানেই। তবে বাসায় গিয়ে নেটওয়ার্ক পাই না। কখনো ছাদে গিয়ে, কখনো উঠোনে গিয়ে মোবাইল হাতড়াই। মা-বাবা কেউ নেই। নিজের বলতে আছে শুধু খালাতো বোন আর তার পরিবার।
‘মামা...কেমন আছ?’ ভাগ্নীর কচি গলা শুনি।
‘আছি মামা। তুমি কেমন আছ?’
‘আমি...তোমার...একটা...হবে?’
‘শুনতে পাই না মামা। পরে কথা বলব।’ আমি মোবাইল কোম্পানিকে মনে মনে কয়েকটা গাল দিয়ে ফোনটা কেটে দেই।
গাঁয়ের পথে কয়েকজন বৌ-ঝি উঁকিঝুঁকি মেরে আমাকে দেখে আবার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আমি বাড়ির কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে পড়ি। আধো-অন্ধকারে বাড়িটা যেন জুবুথুবু বুড়োর মতো বসে আছে। আমি দেয়াল দিয়ে ঘেরা উঠোনে ঢুকে পড়ি। এই আবছা অন্ধকারে তো চাবি খোঁজাও মুশকিল। চার-পাঁচটা চাবির মধ্যে থেকে এখন কোন চাবিটা লাগবে তালায়? আমি বারান্দায় উঠে চাবির গোছা হাতড়াই। হঠাৎ উঠোনের কোন থেকে একটা আবছা ছায়া এগিয়ে আসে আমার দিকে।
‘কে?’
‘আমি ছার! ইদ্রিস।’
‘ও! তা আপনি এই উঠোনে বসে ছিলেন কেন?’
‘কী করি ছার? আপনি কতক্ষণে আসেন- তাই ওই গাছটার নিচে বইসা ছিলাম।’
ইদ্রিস আলী আমাদের স্কুলের দপ্তরী। সাদেক স্যার আমাকে দেখেশুনে রাখার বাড়তি দায়িত্ব তাকে দিয়েছেন। আমার ধারণা না দিলেও নিজে থেকেই সে এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিত। ইদ্রিস আলী ফস করে একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে সামনে ধরে, ‘ছার, চাবিটা বাইর করেন।’
আমি জংধরা তালাটা খুলে ঘরে পা রাখি। দিয়াশলাইয়ের হলদে আলোয় পলেস্তারা খসা দেয়ালে দেয়ালে লাফিয়ে বেড়ায় আমাদের ছায়া। ইদ্রিস একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে টেবিলের ওপর গলানো মোমে দাঁড় করায়। ‘ছার, রাত্রের জন্য খিচুড়ি আনছি আমার বাসা থেইকা। গরম গরম খান।’
‘আহা, আমি নিজেই তো রেঁধে নিতে পারতাম। আবার আপনি কষ্ট করতে গেলেন কেন?’
‘কোন কষ্ট নাই ছার। আমার বউ মুসুরীর ডাইলের খিচুড়ি রান্ধে ভালো। ডিম ভাজি আর আলু ভাজিও আনছি।’
ইদ্রিস আলীর কথা শুনে মনটা ভরে যায়। এই ভর শীতের সন্ধ্যায় খিচুড়ি আর ডিমের কথা শুনে খুশি হবে না এমন মানুষ কোথায় আছে? আমি হ্যারিকেনের খোঁজে ঘুরে হাঁটতে যাই- হঠাৎ খসখস শব্দ হয়ে ওঠে।
‘ও কী? কীসের শব্দ?’ ইদ্রিস আলী চমকে ওঠে।
আমি তাকিয়ে দেখি পায়ের নিচে কয়েকটা সাদা কাগজ পড়ে আছে। ‘এই গুলান কী? এখানে ক্যান?’ ইদ্রিস আলীর গলা শুকনো।
আমি কাগজগুলো তুলে নিলাম, ‘আমার টেবিল থেকে এসে পড়েছে। এই যে এই টেবিলের ওপর ছিল।’
ইদ্রিস একটু সহজ হয়, ‘হ্যাঁ, ইন্দুরেও ফেলতে পারে।’ সে একটু এগিয়ে আসে, ‘ছার, এইটা রাখেন। রাত্রে বাইরে যাইতে গেলে সঙ্গে রাখবেন।’ ইদ্রিস দিয়াশলাইয়ের একটা বাক্স এগিয়ে দেয় আমার দিকে, ‘আপনি তো বিড়ি-সিগারেট খান না। ম্যাছ রাখার অভ্যেস নাই। এইটা সাথে রাখা ভালো।’
‘কেন?’
‘না, মানে আন্ধার রাইত। কখন কী দরকার পড়ে। আর রাত্রে ঘুমানোর আগে দরজা জানলা ভালো কইরা দেইখা নিয়েন।’
‘বলেন কী? চোর-টোর আসে নাকি?’
‘জে...মানে না, আসলে না সাবধান থাকাই ভালো ছার।’
কোন চোরের ছায়াও দেখি না। নিরুপদ্রবে লেপমুড়ি দিয়ে রাত কেটে যায় আমার। শুধু ভোর রাতে একটা কী একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘামে ভিজে গেছে শরীর। ঘুম ভাঙ্গার পরে আর মনেও করতে পারি না আমি কী স্বপ্ন দেখছিলাম।
স্কুলের লাইব্রেরীতে আমি চায়ের কাপ নিয়ে আমি বসে থাকি। একটা ক্লাস শেষ হয়েছে। ঘন্টা দেড়েক পরে আরেকটা ক্লাস আছে। একটু শক্তি সঞ্চয় করা দরকার।
‘স্যার! কী রাত্রে ঘুম ভালো হয় নাই?’
জাকের স্যারের কথা শুনে চমক ভাঙ্গে। কী ব্যাপার, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নাকি? ‘না, ঘুম হয়েছে তো!’
‘তা চোখ এমন লাল কেন?’
‘কই, তাই নাকি?’ আমি চোখ কচলাই।
‘হুম!’ পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসেন জাকের স্যার, ‘সব কিছু লুকানো যায়, শরীর-স্বাস্থ্যের বিষয় কি লুকানো যায় নাকি? আমি আপনাকে একটা জিনিস দেই, সব সময় সঙ্গে রাখবেন বুঝলেন?’ জাকের স্যার হাতের মুঠো খোলেন। একটা দেড় ইঞ্চি লোহার পেরেক তাঁর হাতের তালুতে!
‘কী করব এটা দিয়ে?’
‘সঙ্গে রাখবেন।’ জাকের স্যার মাথা নাড়েন, ‘লোহা সঙ্গে থাকা ভালো। অনেক দোষ কাটা যায়।’
বিজ্ঞানের শিক্ষকের এমন মন্তব্য শুনলে আমার ভীষণ বিরক্তিবোধ হয়, ‘দোষ কাটা যায় মানে কী? লোহা দিয়ে আবার...?’
‘আহা, রাখেন তো?’ জাকের স্যার আমার শার্টের বুক পকেটে পেরেকটা ছেড়ে দেন। ‘শোনেন, আল-কুরআনের ৫৭ নাম্বার সুরাটির নাম হাদিদ যার বাংলা অর্থ লোহা। লোহার গুণের কথা সেইখানে আছে। জ্যোতিষ শাস্ত্রেও বলেছে অষ্টধাতুর একটা হচ্ছে লৌহ। আয়রন তো মানুষের দেহের জন্য খুবই উপকারী। এই যেমন ধরেন কলিজা কিংবা তরমুজের পুষ্টি গুণের একটা বড় অংশ হচ্ছে আয়রন। শরীরের ভিতরের আয়রনের চাহিদা খাদ্য থেকে পূরণ হয়।' জাকের স্যার টেবিল চাপড়ান, 'তাই থেকেই তো শরীরে শক্তি আসে। বাইরে থেকেও আয়রন আমাদের শক্তি দিতে পারে যদি ঠিকমতো সেটা ইউটিলাজ করা যায়, তাই না? গ্রামদেশের মানুষের কাছে লোহা কিন্তু বিশেষ জরুরী। রাত্রে তারা লোহা নিয়ে তারপর বাইরে বের হয়। যেমন ধরেন...’ জাকের স্যার অনর্গল অনেক কথা বলে বলে যান। আমি বিরক্ত হয়েও মনোযোগ দিয়ে শোনার ভান করে তাকিয়ে থাকি। লাইব্রেরীর জানালা দিয়ে অনেকখানি আকাশ দেখা যায়। আকাশের অনেক উঁচুতে গাঢ় রঙের একটা চিল ডানা মেলে ভেসে আছে। শীতকালের বিষণ্ণ আকাশ। মরা মরা রোদের দিকে তাকিয়ে মনটা অন্য রকম হয়ে যায় আমার। আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে জাকের স্যারের দিকে তাকিয়ে বলি, ‘স্যার, আপনাদের লাইব্রেরীতে কি জীবনানন্দের কবিতা আছে?’
জাকের স্যার কথা থামিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন, ‘জীবনানন্দ?’
কবে যে বাড়িটায় ইলেক্ট্রিসিটির সংযোগ দেয়া হবে কে জানে? একটু একটু করে পুরো বাড়িতে কালো ছায়াগুলো জমে দানা বেঁধে ওঠে। হ্যারিকেনের আলোয় সন্ধ্যা কাটানো খুব কষ্টকর। রাত নটার মধ্যে খেয়ে দেয়ে হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়ি। গ্রামাঞ্চলের ঠাণ্ডা কাকে বলে তা হাড়ে হাড়ে টের পাই। লেপের তলায় শুয়েও হাত পা জমে যায় যেন। হ্যারিকেনের আবছা আলোয় ঘরটাকে অদ্ভুত লাগে। দেয়ালের পলেস্তারা খসা অংশগুলো দেখে মনে হয় কারা যেন লেপ্টে আছে ওখানে। আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসবে দেয়াল বেয়ে...।
কখন ঘুমিয়ে গেছি বুঝতে পারি নি। আধো ঘুম আধো জাগরণে মনে হয় ঘরের ভেতর কী যেন খসখসে একটা শব্দ। কোথায় কোন ঘরে একটা টিকটিকি ডেকে ওঠে। ফাঁকা ঘরগুলোতে তার প্রতিধ্বনি। মশাদের পনপন শব্দ জানালার বাইরে। বহুদূর থেকে কাটা ফসলের মাঠ পেরিয়ে ভেসে আসে শেয়ালের দীর্ঘ ডাক। আমি বালিশের আশেপাশে হাতড়ে দিয়াশলাইটা খুঁজে পাই না। কোথায় রাখলাম? ঘরের খসখসে শব্দটা এখন আমার খাটের নিচে এসে জড়ো হয়েছে। মনে হয় আমি যদি নামতে চাই তো একটা হাত খাটের তলা থেকে এগিয়ে এসে আমার পা চেপে ধরবে। হঠাৎ ঠক-ঠক শব্দে আমার পিলে চমকে যায়। কীসের শব্দ এখানে?
‘ও-ও-ও-ও-জাগো!!’
চৌকিদারের গলা। গ্রামের চৌকিদার বাড়ির কাছ দিয়ে যায় তার হাতের লাঠিটা মাটিতে ঠুকতে ঠুকতে। মানুষের সাড়া পেয়ে আমার দেহে যেন প্রাণ ফিরে আসে। আমি পাশ ফিরে শোয়ার শক্তি পাই এবার। লেপটা সরিয়ে মশারীর এক প্রান্তে খাটে পা ঝুলিয়ে বসি। কেউ যদি আমার পা টেনে ধরতে চায় তো ধরুক। সেই ছোটবেলায় এমন এক ধরনের ভয় কাজ করত। আমি খাট থেকে লাফ দিয়ে অনেক দূরে গিয়ে পড়তাম- কেউ হাত বাড়িয়ে গোড়ালি চেপে ধরতে পারত না। এখন মিনিট পাঁচেক বসে থেকেও কিছু হলো না।
আমি দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। হালকা কুয়াশাভেজা জ্যোৎস্না উঠোনে। ছাদে ওঠার রেলিংভাঙ্গা সিঁড়ির বাঁকে কে দাঁড়িয়ে আছে?
‘এই কে ওখানে?’ আমি জোর গলায় বলতে চাইলেও গলাটা কেমন ভেঙ্গে যায়। সিঁড়ির ওপর শরীরটা কেমন যেন দুলছে এদিক ওদিক। আমি পকেট হাতড়াই দিয়াশলাইয়ের খোঁজে। না, দিয়াশলাইটা নেই। হাতে একটা শক্ত কী যেন বাঁধে। পেরেক! আমি হাতের মুঠোয় পেরেকটা তুলে নেই। অনেকটা অস্ত্রের মতো হাত বাড়িয়ে পেরেকটা নিয়ে এগিয়ে যাই। কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই বুঝতে পারি আমার সামনের ওই জিনিসটা আসলে মানুষ নয়। সিঁড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা তেঁতুল গাছের ডাল আর তার জ্যোৎস্নামাখা ছায়া। এই দেখে ভয় পাওয়ার কী আছে? আমি হাঁফ ছেড়ে শ্বাস নেই। এত কুয়াশায় সব কিছু দেখাও যায় না ঠিকমতো। হাতের মুঠো খুলে দেখি। পেরেকটা পকেটে নিয়ে শুয়েছিলাম? ঘুমের ঘোরে দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। আমি সিঁড়িটার ওপর একটু বসব কিনা ভাবছি- উঠোনের এক কোন থেকে কী যেন নড়ে ওঠে।
সেকী? কী গড়াচ্ছে ওটা উঠোনে? যেন হাত-পা ছাড়া একটা মানুষ গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে আসছে এদিকে। আস্তে আস্তে শব্দ করছে। আমি হঠাৎ একটা জোর চিৎকার ছাড়ি- ‘ইদ্রিস!’
কালো রঙের একটা কুকুর উঠোনে গড়াগড়ি করতে থাকে। ঠিক কুকুরছানা নয় আবার পূর্ণ বয়স্ক কুকুরও নয়। এটা এখানে কী চায়? শীতের রাতে তো কুন্ডুলী পাকিয়ে ঘুমানোর কথা!
আমি আর দাঁড়াই না, ঘরে ফিরে নিভে যাওয়া হ্যারিকেনটা জ্বালাই। চটাওঠা সিমেন্টের মেঝেতে ঘরময় ছড়ানো কাগজ। টেবিলের ওপর থেকে দুটো ইঁদুর পায়া বেয়ে নেমে ছুটে পালায়। আলো না থাকলেই সমস্যার শুরু। কিন্তু আমি ইদ্রিসকে ডাকলাম কেন হঠাৎ? ইদ্রিস তো থাকে স্কুলের পাশে নিজের ঘরে!
‘স্যার! এখনও টের পান নাই কিছু?’
বদরুলের প্রশ্ন শুনে আমি হাসি, ‘কী টের পাব?’
‘মানে, বাড়িতে কিছু দেখেন নাই? কোন ছায়া-টায়া?’
আমি মাথা নাড়ি, ‘না, কিছু তো দেখলাম না!’
বদরুল একটা লাথি দিয়ে বলটা মাঠের মাঝখানে পাঠিয়ে দেয়। ‘স্যার, ওই বাড়ির ধারে কাছে কেউ যায় না। কারণ জানেন?’
‘না। কী হয়েছিল?’
বদরুল মাথা চুলকায়, ‘বাড়ির প্রায় সবাই কলেরায় মারা গেছে। ছয়জন মারা যাওয়ার পরে বাকিরা বাড়ি থেকে পালাইছে। এক রাত্তিরেই মরছিল তিন জন!’
‘তাই নাকি? কত দিন আগে?’
‘তা অনেক দিন আগে। আমার জন্মই হয় নাই তখন।’ বদরুল খেলায় ফিরে যাবে কি না ভাবছে, ‘আমি শুনছি বাড়ির উপর বাণ মারা হইছিল, তারপর থেকে সবাই মারা গেছে। কত জনের কত শত্রু আছে না?’
আমি মাথা নাড়ি, ‘তা তো আছেই। তাহলে সবাই ভয় পায় কিসে, বাড়িটাকে না বাড়ির মানুষগুলোকে?’
‘কী জানি স্যার! একজন তো শুনছি, ফাঁসি দিয়ে মরছিল ওই বাড়ির তেঁতুল গাছে। পুরানা বাড়ি, কেউ থাকে না। অনেকেই ভয় পায়- তাই সবাই ভয় পায়।’ বদরুলের সঙ্গীরা হাত নেড়ে ডাকছে। সে দৌড়ে চলে যায় মাঠে।
সন্ধ্যা নামছে। আমি ঘাসে ঢাকা পথ বেয়ে হাঁটতে থাকি। গাঁয়ের মানুষরা কেউ কেউ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নেই ভালো করে। চাদরের নিচে হাতের মুঠোয় নতুন কেনা টর্চ। ধীরে ধীরে কুয়াশা নেমে আসে চোখের সামনে। আমি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াই। কালচে শ্যাওলা ঢাকা বাড়িটা যেন আমার প্রতীক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কী আশ্চর্য নীরবতা চারদিকে! কোথাও কেউ নেই।
বাতাসে অল্প অল্প নড়ছে তেঁতুল গাছের পাতা।
মন্তব্য
জনপ্রিয় এক কিশোরপত্রিকার সম্পাদক জোর করেই আমাকে দিয়ে ঈদ সংখ্যার গল্প লিখিয়ে নিলেন। এই লেখাটা মূলতঃ সচলায়তনের বন্ধুদের জন্য নয়। সচলের বন্ধুদের দীর্ঘদিন ফাঁকি দিয়ে এসেছি। ভাবলাম, গল্পটা পাতে দিয়ে যদি একটু পাপমোচন হয়! সচল বন্ধুরা কে কী বলবেন জানি না। তবে সব কথার শেষ কথা হচ্ছে- 'ডরাইলেই ডর !'
হা হা। আপনার কমিক নিয়ে লেখার অনুরোধ করতেই এই লেখা ! দারুণ, চলুক
facebook
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
ভাই, এটা ছোটদের গল্প
লাস্টে পাঞ্চ লাইন দিলেন না ? নাকি আমি মিস করলাম কোথাও?
তবে আপনার গল্পের ভাষা তরতরিয়ে চলে
সাই-ফাই কই ?
দেশে এত গাছ থাকতে তেঁতুলগাছের নাম কেন মাথায় এলো তাই ভাবছি!!
পাঞ্চ লাইন ভাবলে, পাঞ্চ লাইন। না ভাবলে নয়।
সাই-ফাই আসছে শিগগিরি।
ভাল লাগলো, আরও লিখুন।
আব্দুল্লাহ এ এম
ধন্যবাদ। নিশ্চয়ই লিখব।
গল্পটা কি এখানেই শেষ? বেশ তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু।
ভালো কথা, "ঘাসে" বানানটা "ঘাষে" হয়ে গেছে।
খুব চোখ তো আপনার! একটা মাত্র বানান ভুল ধরে ফেললেন?
চলুক, জোরকদমে।
------------------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ
চলবে
এই ভর দুপুরবেলা একা ঘরে কেমন গা ছমছম করছিল আপনার গল্পটা পড়তে । অনেকদিন পর কৈশোরের স্বাদ পেলাম।
কী দারুণ ইন্সপায়ারিং লাইনটা দিলেন দিদি! অনেক ধন্যবাদ।
ঠিকমত গা ছম ছম করার আগেই শেষ। অবশ্য তাতে গল্পকারের দোষ নেই, সঙ্কট আমার গা-এর। কৈশোর মন ঢাকা পড়েছে তেঁতুল গাছের ছায়ায়। মনও তার অনুগামি। গল্প ভালো লেগেছে।
স্বয়ম
গপ্পটা কিশোরদের জন্য কি না!
বেশি ঝাল দেয়াটা ঠিক নয়।
অনেক দিন পর লিখলেন।
সচলে নিয়মিত হওয়ার একটা উপায় বের করে ফেলেছি।
১২ পর্বের একটা কিশোর উপন্যাস নিয়ে হাজির হবো
সচলে নিয়মিত হলে আগামী বইমেলায় উপন্যাসটা দেয়া যাবে।
সাব্বাস!
..................................................................
#Banshibir.
ছায়াময়!!! নামটা কেমুন চেনা চেনা লাগতেছে! কেমুন যেন চেনা চেনা!!! -- মুগ্ধ অভিযাত্রিক
বুঝিনি! ব্যাপারটা কী বলুন তো!
পাকা গাথুনির গল্প। সাবলিল বর্ণনা। অসাধারণ! আপনার কি প্রকাশিত বই আছে?
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
ধন্যবাদ।
এ বছর বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে কিশোরগল্প সংকলন- আমার মায়ের মুখ। প্রকাশ করেছে উত্তরণ (মাওলা ব্রাদার্সের সহযোগী প্রতিষ্ঠান)। আর এর আগে বের হয়েছে গোটা পাঁচেক অনুবাদ/রূপান্তর। সে সব তেমন ধর্তব্যের বিষয় নয়।
হ্যাঁ, লালন সাঁই নামে জীবনীভিত্তিক একটা কমিকস প্রকাশিত হয়েছে ২০০৯-এ। খুব চমৎকার ছবি এঁকেছিলেন সুমন ওয়াহিদ।
দেশে গেলে বইটা সংগ্রহ করবো।
রকমারির কল্যাণে আপনার বইগুলোর তালিকা পেয়ে গেলাম।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
তাই তো দেখছি !!
এই তালিকায় বাদ গেছে জ্যাক লন্ডনের হোয়াইট ফ্যাং (কিশোর ক্লাসিক)
রকমারীতে সেটাও পাওয়া যায় বলেই জানতাম।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
চমৎকার গল্প, ঠাস বুনোট। কিন্তু কেন যেন মনে হল, শেষ হল না। একটা শেষ লাইন বা কিছু একটা থাকতে পারত। আমি চাবির গোছা বের করি পকেট থেকে, পেরেকটা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিয়ে পা বাড়াই। এরকম কিছু?
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
শেষাংশ নিয়ে অনেকেরই আপত্তি আছে দেখছি! সচলের বাইরেও একজন আমাকে বললেন সেটা। কিন্তু আমার কাছে তো ঠিক আছে বলে মনে হচ্ছে। আমি কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাইনি আসলে। যার যেভাবে খুশি বুঝে নিক।
সেটা তো অবশ্যই। আপনি আপনার মতই লিখবেন। আর ব্লগ যেহেতু পাঠকও প্রতিক্রিয়াও শুনতে হবে, তবে সেটা গ্রহণ করবেন কিনা সে বিবেচনা তো অবশ্যই গল্পকারের
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
শেষাংশ আমার খুব ভালো লেগেছে। যাকে বলে পারফেক্ট "শেষ হইয়াও হইলো না শেষ"।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
কেমন জানি ভয় ভয় লাগে
ইসরাত
আমি কিন্তু ওই বাড়ি - ন্যাড়া ফসলের মাঠ - শীতের শেষ বিকেলের আলোছায়ার খেলা সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। গল্প ভাল লেগেছে।
একজনের মন্তব্যের জবাব আরেকজনের ভাগে গিয়ে পড়ছে কেন?
থ্যাংক্যু
ভয় খাইছি। আপনার বর্ণনা ভঙ্গী দারুণ।
আরে ব্বস!
দারুণ! দারুণ!!
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
চমৎকার গল্প! পুরো পাঁচতারা।
আপনার বইগুলো জোগাড় করতে হবে দেখছি।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
নতুন মন্তব্য করুন