কেবিনের জানালা দিয়ে পিউলি বাইরে তাকায়। বৃষ্টিভেজা কালচে পিচের রাস্তায় দু চারটে রিকশা যায়। হর্ণ বাজিয়ে চলে যায় একটা সাদা গাড়ি। একপাশে ভ্যান রেখে আইসক্রীমওয়ালা মাথার চুল মোছে। হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় বেচারা ভিজে গেছে একদম। সে কি এখন গায়েই শুকাবে তার ভেজা গেঞ্জিটা? নাকি আর কোথাও শুকনো জামা আছে? গ্রিলে কপাল ঠেকিয়ে খুব মন দিয়ে পিউলি আইসক্রীমওয়ালাকে দেখে। খেয়াল করে নি, কখন বাবা এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।
‘আইসক্রীম খাবে মা?’
‘খাব না। ’ মাথা নাড়ে পিউলি, ‘বাবা, আমরা কতক্ষণ থাকব এখানে?’
‘তুমি চলে যেও বাসায়। আমরা পরে আসব। কালকে নয় তো পরশু।’
হাসপাতালের জানালা দিয়ে পিউলি শেষ বিকেলের আকাশ দেখে। মাকে কবে ছাড়বে এখান থেকে? আইসক্রীমওয়ালা তার ভ্যান চালিয়ে চলে যায়। অল্প অল্প করে বাজে তার ঠুনঠুন ঘণ্টি।
দিন দুয়েক আগেও মা সঙ্গে ছিল। এখন পিউলি একা। না, একা তো নয়! বাবা আছে। মামা আছে। আর কেউ আসতে পারে নি তাদের বাসায়। হরতাল চলছে তো, ঢাকার বাইরে থেকে কোন গাড়ি আসছে না এখন।
সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে পিউলি চোখ কচলাতে থাকে। আজকে ইংরেজি পরীক্ষা। মা থাকলে রুটি বানিয়ে দিত। নিজের হাতে খাইয়ে দিত। এখন সে সব হবে না। ব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে সে মুখে ঢুকিয়ে সোফায় গিয়ে বসে থাকে। মামা পাউরুটিতে জেলী মাখাচ্ছে, ‘কটা খাবি? তিনটা?’
‘খেতে ইচ্ছে করছে না, মামু।’
‘হেই ! চা খাবি না হরলিকস?’
একটু মাথা চুলকালো পিউলি, ‘চা।’
বাথরুমের বেসিনে মুখ-টুখ ধুয়ে এসে দেখে মামা চায়ের কাপ হাতে চুপ করে টেবিলে বসে আছে। কী ভাবছে শুকনো মুখে? একবারও চায়ে চুমুক দেয় নি। কাপটা ভরা একদম।
‘মামা। কী ভাবছ এত?’
‘কিছু না!’ মামা চমকে উঠে কাপে চুমুক দেয়, ‘তোর চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। খেয়ে নে তাড়াতাড়ি।’
টুংটাং করে কোথায় যেন মিষ্টি একটা ঘণ্টি বেজে উঠল- ‘ডা. আহমেদ। আপনাকে খোঁজা হচ্ছে। চারশ পাঁচে আপনার উপস্থিতি আশা করছি। ডা. আহমেদ।’
গোলগাল ফর্সা মতো এক অল্পবয়সী ডাক্তার হন্তদন্ত হয়ে রুম নাম্বার চারশ পাঁচের দিকে ছুটল। বাবা খুব অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছেন। পিউলী বাবার জামাটা আঁকড়ে ধরে, ‘আমাদের পেশেন্টের নাম্বার কত বাবা?’
‘ভয় পেও না মা। আমাদের চারশ উনিশ।’
‘আমি ভয় পাচ্ছি না।’
‘গুড। সোনা মামনী! ভয়ের কিচ্ছু নেই।’
পিউলী বাবার হাত ধরল। বাবার হাতটা অল্প অল্প কাঁপছে।
একই রঙের জামা পরা, একই বয়সী কয়েকশ বাচ্চার ভেতর থেকে মামা খুঁজে বের করল পিউলিকে। চারদিকে চিৎকার চেঁচামেচিতে কান পাতা যায় না।
‘মামা, কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছ?’ পিউলি চেঁচায়।
‘আমি বাসায় যাই নি তো! বসে ছিলাম ওই গাছতলায়।’
‘বাসায় যাওনি কেন?’ পিউলি আরো জোরে চিৎকার করে, ‘বাসায় রান্না করবে কে?’
‘তুই করবি! তোকে এখন নিয়ে যাব বাসায়। রান্না করবি, খেয়েদেয়ে তারপর হাসপাতালে যাব।’
পিউলি হেসে উঠল, ‘হ্যাঁ। চল রান্না করি গিয়ে! কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম আমরা এখান থেকেই হাসপাতালে যাব।’
‘তোর স্কুলের ব্যাগ নিয়ে? পাগল হয়েছিস নাকি তুই?’ মামাকে বিরক্ত দেখায়, ‘বাসায় গিয়ে খেয়েদেয়ে তারপর যাব। এখানকার ক্যান্টিনের বার্গার খেলাম। কী বিশ্রি! তুই কি এইসব খাস নাকি এখানে?’
‘না! আমি বাসা থেকে টিফিন নিয়ে আসি না?’ পিউলি মাথা নাড়ে, ‘আজকে তো পরীক্ষা ছিল। টিফিন কী নিয়ে আসব?’
‘তোর পরীক্ষা কেমন হলো?’
‘হয়েছে তো ভালোই। একটা শুধু আনসীন দিতে পারিনি।’
মামা হেসে ওঠে, ‘আরে, যেটা কোন দিন দেখিসই নি, সেটার উত্তর দিবি কী? ভালো হয়েছে দিস নি।’
‘হুম।’
‘এখন জলদি একটা রিকশা নিতে হবে। তোর স্কুলের বাচ্চারা অযথা এত চেঁচায় কেন রে? কান রাখা যাচ্ছে না! ধুর!’
টুলের ওপর বসে থাকা লোকটা ঝিমাচ্ছে। পিউলি খুব মনোযোগ দিয়ে লোকটাকে দেখে। এই ফ্লোরের গার্ড। কী পাহারা দেয় কে জানে? ঝিমানোটাই কি এর চাকরী?
শেষ বিকেলের হালকা আলো এসে পড়েছে গার্ডের পেছনের দেয়ালে। সেখানে হালকা নীল রং। পিউলি তার রঙের বাক্সের কথা মনে করে। নীল আকাশ আর নীল নদী। এই দুটো ছাড়া আর কোথাও নীল ব্যবহার করা যায় না। পিউলি অবশ্য মাঝির গায়ের জামায়, কৃষাণীর শাড়িতে, ঘরের টিনের চালে আরো কত জায়গায় নীল রং দিয়ে দেয়। তার যদি একটা বোন হয়- নাম দেবে... নীলু...নীলি...নীলা! যদি ভাই হয়? হোক, তবু এই নামগুলোই দেবে।
মাথায় সাদা ক্যাপ পরা একটা আন্টি এসে বাবাকে বলে, ‘পেশেন্ট চারশ উনিশের এটেন্ডেন্ট কে? এই ইঞ্জেকশনগুলো লাগবে।’
বাবা একটু ব্যস্তসমস্ত হয়ে ওঠে, ‘পেশেন্টের অবস্থা কী?’
ক্যাপ পরা আন্টি একটু চুপ থেকে মাথা নাড়ে, ‘ভালোই আছে।’
বাসা থেকে পিউলিকে নিয়ে বেরিয়ে মামা আর ট্যাক্সি খুঁজে পায় না। একের পর এক সিএনজি-ট্যাক্সি চলে যাচ্ছে। সব কটাতে যাত্রীভরা। বিকেল হয়ে এসেছে। হরতালের দিনে বিকেলের পরে বাস আর সিএনজি-ট্যাক্সি চলাচল কমে আসে। এখন রিকশা নিয়ে যেতে তো অনেক সময় লাগবে।
‘কী করি বল তো?’
‘রিকশায় করে যাই চলো।’
‘তা যাওয়া যায় কিন্তু সময় লাগবে অনেক।’
‘বাসে যাবে? চলো যাই।’
‘তোর মা তো তোকে বাসে উঠতেই দেয় না।’
‘ভীড় যে অনেক। আজকে তো আর নিষেধ করতে পারবে না! চলো বাসে যাই।’ পিউলি আঙ্গুল তোলে, ‘ওইদিকের বাস স্ট্যান্ড থেকে বাস নিলে সীট পাওয়া যাবে।’
‘বৃষ্টি আসছে মনে হয়। আর বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যাবে না।’ মামা আকাশের দিকে তাকায়, ‘চল যাই। যা থাকে কপালে।’
মায়ের বিছানার পাশে পিউলি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মা কি ঘুমিয়ে পড়ল? বাবা পকেট থেকে চশমা বের করে চুপচাপ হাসপাতালের কাগজপত্রগুলো দেখেন। মাথার ওপরে টিভির স্ক্রীণে খবর চলছে। হরতালে কোথায় কোথায় বাসে আগুন লাগানো হয়েছে সেই খবর চলছে। কিন্তু টিভির সাউন্ড ভলিউম বন্ধ করে রাখায় পুরো খবরই নিঃশব্দ। শুধু মায়ের মাথার কাছের এসিটা গুঞ্জণ তুলেছে একনাগাড়ে।
দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল ক্যাপ পরা এক আন্টি, সঙ্গে করে ঠেলে নিয়ে এসেছে একটা হুইল চেয়ার। ফট ফট করে চাকা ঠিক করে সে মাকে ঠেলে তোলে, ‘ওঠেন, সময় হয়ে গেছে। একা উঠতে পারবেন?’
বাবা এক হাত ধরে আছেন। মা উঠে আস্তে আস্তে হুইল চেয়ারে গিয়ে বসে। চাকা ঘুরিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার সময় মা হাতটা তোলে, ‘একটু দাঁড়ান, এক মিনিট... মা, পিউলি?’
জানালার বাইরে মেঘ গুড়গুড় করে ওঠে। ডাক শুনে পিউলি মায়ের পাশে এসে দাঁড়ায়। মা হাত তুলে পিউলির গালে হাত বুলিয়ে দেয়, ‘লক্ষ্মী হয়ে থেক মা, বাবার কথা শুনো।’
পিউলির গলার কাছটায় কী যেন আটকে আছে। ও শুধু মাথা নাড়ে। খুব লক্ষ্মী হয়ে থাকবে। সবার কথা শুনবে। কিন্তু সেই সবার মধ্যে ওর মাকেও তো থাকতে হবে।
সে শূন্য কেবিনের জানালায় গিয়ে দাঁড়ায়। বৃষ্টিভেজা রাস্তায় কয়েকটা রিকশা চলে যায়। আইসক্রীমওয়ালা ভেজা গেঞ্জি পরেই তার ভ্যান নিয়ে চলে যায়। খালি রাস্তায় অনেক্ষণ ধরে শোনা যায় তার ঠুনঠুন ঘন্টি।
মন্তব্য
পিউলির বোন কই? ক’দিন পরে আসবে বুঝি?
দেবদ্যুতি
ভেবেছিলাম গল্পটা লিখে শেষ করব পিউলির বোন এলে, তবেই।
কিন্তু কী যে হলো, বোন আসার আগেই পিউলিকে অপেক্ষায় রেখে গল্প শেষ হয়ে গেল।
এই অভিজ্ঞতা আমার প্রথম।! গল্প আমার কথা মতো চলে নি !
নিজেই নিজের সমাপ্তি টেনেছে
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
বাহ, বেশ লাগল পড়তে।
থ্যাঙ্কু
ভালো লাগলো পড়তে। হরতালসহ কিছু প্রসঙ্গিকতা আসায় ঠিক বুঝতে পারছি না যে পিউলির কী হয়েছে।
স্বয়ম
হরতালটা এই সময়ের অনুষঙ্গ। মূল গল্পের সঙ্গে তার কোন সংশ্রব নেই।
পড়তে ভালো লাগাটাও তো লেখকের দিক থেকে এক ধরনের সার্থকতা।
লেখকই হয়তো বোঝেননি পুরোটা
ভাইরে লেখাটাইতো ভাল লাগছে।
স্বয়ম
লেখা ঝরঝরে, মনকাড়া, যেমন আশা করা যায় আপনার কাছে। কিন্তু, খানিকটা দিশাহীন লেগেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধরে নেন, এটা আবারও একটা ওয়ার্ম আপ লেখা।
ঠিক হয়ে যাবে পরে।
এটাই তো ভাল। অকারণ মেদহীন, প্রাণের ভেতর থেকে আসা।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
আপনার জন্যে একগুচ্ছ ধনেপাতা।
পড়তে ভাল লেগেছে কিন্তু ঠিক গল্প মনে হয়নি।
মনে হল কিছুটা অগোছালো কথামালা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
মাকে ঘিরে আর একটু বনর্না থাকলে ভালো লাগতো। ভালো লেগেছে তবুও। কিন্তু শেষটা কেমন যেন! হ্যা, ছোটগল্পের ধরনই 'শেষ হইয়াও হইলো না শেষ' মানি। তবে এ গল্পের শেষটা দায়সারা লেগেছে।
কিরো
নতুন মন্তব্য করুন