ছেলেবেলায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের 'পথে প্রবাসে' গ্রন্থ থেকে 'পারী' পড়েছিলাম মাধ্যমিক পরীক্ষার পাঠ্যসূচীতে। তখনকার তরুণ মনের চোখে সত্যিই প্রবন্ধটি মায়াপুরীর অঞ্জন এঁকে দিয়েছিল। আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল 'পথে প্রবাসে' বইটি পড়ার। কিন্তু সেই দশম শ্রেনী থেকে শুরু করে দশটি বছর খুঁজেও বইটি পাইনি। তাই গতমাসে যখন ময়মনসিংহের 'আজাদ অঙ্গনে' বইটি আবিস্কার করলাম তখন আমার দশা হাতে চাঁদ পাবার মত। পাইরেট করা জেরক্স কপি-তাই দামই একশ কুড়ি টাকা-এক পয়সাও কম নেবে না। আমার পকেটে তখন খুচরো টুচরো মিলিয়ে একশ পঁচিশ টাকা ছিল। গুনে গুনে একশ কুড়ি টাকা দিয়ে বইটা বগলদাবা করে, ঘণ্টা তিনেক ডেরায় আড্ডা দিয়ে রিকশার বদলে কিছুটা পথ ব্যাটারি চালিত অটোতে আর কিছুটা পথ হেঁটে বাসায় ফিরলাম। দেরি করে ফেরার জন্য গিন্নীর গঞ্জনা সয়ে রাতের খাবার খেয়ে বইটা হাতে নিলাম। বইতো নয়,যেন সরস আনন্দের কলস্রোতা নিরর্ঝরিনী। স্বচ্ছ নদীর মতই এই বইয়ের ভাষা, কল্লোলিত স্রোতধারার মতই বহতা তার গতি-আর অশ্বমেধের ঘোড়ার মতই সর্বত্রগামী লেখকের মন। স্বচ্ছন্দ, উচ্ছল ভাষা এবং সরস উপলব্ধি ও মনস্বীতায় হ্মগ্ধ এমন ভ্রমনকাহিনী বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ।
পথে প্রবাসে অন্নদাশঙ্কর রায়ের প্রথম বই। বইয়ের ভূমিকায় প্রমথ চৌধুরী যথার্থই লিখেছেন- 'আমি যখন 'বিচিত্রা' পত্রিকায় প্রথম 'পথে প্রবাসে' পড়ি তখন আমি সত্য সত্যই চমকে উঠেছিলুম। কলম ধরেই এমন পাকা লেখা লিখতে হাজারে একজনও পারেন না।' অন্নদাশঙ্করের বুদ্ধিদীপ্ত, শানিত, ছন্দোময় গদ্য পড়তে পড়তে কবিতার আবেশ পাওয়া যায়। এ গদ্য কবিতা নয় কিন্তু কাব্যগুণে কবিতার বাড়া। বইয়ের সূচনাটাই কাব্যময়- 'আমার পথের আরম্ভ হল শ্রাবনের এক মধ্যরাতে-তিথি মনে নেই, কিন্তু শুক্লপক্ষের চাঁদ ছিল না'। লেখকের অসামান্য পর্যবেক্ষন শক্তির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে তাঁর অনুপম ভাশাশৈলী, যা মনের কথাকে অবিকল ছেপে দিচ্ছে লেখনীর মাধ্যমে। তাই 'পথে প্রবাসে' নিছক ভ্রমন কাহিনী নয়। আবার মুহম্মদ হাইয়ের 'বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন' এর মত বিবৃতিমূলক উপদেশ শাস্ত্রও নয়। স্বভাবতই ইউরোপ ও ভারতবর্ষের তুলনামূলক আলোচনা এসেছে। কিন্তু সে আলোচনাও নবোঢ়া বধুর চকিত চাহনির মত-সলাজ কিন্তু মধুর। কাঠখোট্টা অধ্যাপকের চশমা দিয়ে নয়, বরং ইউরোপকে তিনি দেখেছেন আজন্ম তিয়াসী এক তরুনের মুগ্ধ চোখে, অন্তর দিয়ে অনুভব করতে চেয়েছেন ইউরোপীয় মানব সমাজ ও সংস্কৃতির হৃৎস্পন্দন।
ইউরোপ ভ্রমণের ও ইউরোপকে জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা সত্ত্বেও অন্নদাশঙ্কর মনেপ্রাণে ভারতীয়। "পথে প্রবাসে"র প্রথম পরিচ্ছেদেই তিনি লিখেছেন- "ভারতবর্ষের মাটির ওপর থেকে শেষবারের মতো পা তুলে নিলুম আর সদ্যোজাত শিশুর মতো মায়ের সঙ্গে আমার যোগসূত্র এক মুহূর্তে ছিন্ন হয়ে গেল। একটি পদক্ষেপে যখন সমগ্র ভারতবর্ষের কক্ষচ্যুত হয়ে অনন্ত শূণ্যে পা বাড়ালুম তখন যেখান থেকে পা তুলে নিলুম
সেই পদ-পরিমাণ ভূমি যেন আমাকে গোটা ভারতবর্ষেরই স্পর্শ-বিরহ অনুভব করিয়ে দিচ্ছিল। প্রিয়জনের আঙুলের ডগাটুকুর স্পর্শ যেমন প্রিয়জনের সকল দেহের সম্পূর্ণ স্পর্শ অনুভব করিয়ে দেয়, এও তেমনি। এই বিপুল স্বদেশপ্রেম সত্ত্বেও ইউরোপের রঙ, রূপ ও কর্মমুখর জীবন সর্বান্তঃকরণে উপভোগ করেছেন লেখক। তাঁর ভ্রমণসঙ্গীর জন্য ইউরোপ নির্বাসনতূল্য হলেও অন্নদাশঙ্করের জন্য কিন্তু মোটেই সেরকম ছিল না! ইউরোপকেও তিনি ভালোবেসেছিলেন। তাই স্বদেশ-প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে তিনি লিখছেন, "ইউরোপ থেকে বিদায় আমার পক্ষে বিরহের শেষ নয়, শুরু।"
"পথে প্রবাসে"র প্রতিটি ছত্রে বর্ণিত হয়েছে ইউরোপের দুর্বার গতিসম্পন্ন জীবন, ঋতুবদলের সাথে সাথে নানা রঙের পসরা সাজিয়ে প্রকৃতির নিত্য বেসাতি। অনন্যসাধারণ অন্নদাশঙ্করের বর্ণনাশৈলী। প্রথম লন্ডন দেখা প্রসঙ্গে তিনি শুরু করেছেন এভাবে, "লন্ডনের সঙ্গে আমার শুভদৃষ্টি হলো গোধূলি লগ্নে। হ'তে না হ'তেই সে চক্ষু নত করে আঁধারের ঘোমটা টেনে দিলে। প্রথম পরিচয়ের কুমার-বিস্ময় গোড়াতেই ব্যাহত হয়ে যখন অধীর হয়ে উঠল তখন মনকে বোঝালুম, এখন এ তো আমারি। আবরণ এর দিনে দিনে খুলব।" - এমনই বুদ্ধিদীপ্ত, শাণিত, কোমল-কঠোর উপমায় সমৃদ্ধ গোটা বইয়ের নিটোল গদ্য। হাইলাইট করে ফেলেছি প্রায় পুরো বইটাই এবং পুরো বইটাই উদ্ধৃত করতে ইচ্ছে করছে! ইংল্যান্ডের মানুষের সময় ও নিয়ম-অনুবর্তিতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, লড়িয়ে মানসিকতা- তথা সামগ্রিক জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির খণ্ডিত, কিন্তু আকর্ষণীয় ছবি এঁকেছেন লেখক।
অন্নদাশঙ্করের ভাষায় অশ্বমেধের ঘোড়ার মতোই তাঁর চোখজোড়া ভু-প্রদক্ষিণে বেরিয়েছে। সেই সর্বগ্রাসী চোখ দিয়েই আমরাও দেখি সমগ্র ইউরোপের ছবি। আমাদের চোখে স্বপ্ন হয়ে ধরা পড়ে লন্ডনের 'ছিঁচকাঁদুনে ছোকরার কান্নার মত' অবিরাম বৃষ্টি, সুই'জারল্যান্ডের হিমেল রোদের তুষারপ্লাবিত উজ্জ্বল দিন; লেজাঁর তুষারময় স্বপ্ন; রোমা রোলাঁর তপোবন সদৃশ কুটীর। রোমা রোলাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় আমরা লেখকের সাহিত্যবোধ ও মননশীলতার পরিচয় পাই। দীর্ঘ একটি পরিচ্ছেদ জুড়ে রয়েছে পৃথিবীর শিল্প-রাজধানী পারী তথা প্যারিস। পারী-মুগ্ধ লেখক এক কথায় পারী সমবন্ধে বলেছেন, "অর্ধেক নগরী তুমি, অর্ধেক কল্পনা।" যুগে যুগে শিল্প-সাহিত্য, স্থাপত্যকলা, আন্দোলন-বিদ্রোহের পীঠস্থান এই প্যারিস। অত্যন্ত অল্প কথায় পারীর অতুলনীয় সৌন্দর্য, ফরাসীদের কর্মমুখর জীবনের সমান্তরালে বয়ে চলা সৃজনশীল আড্ডার স্রোত, গীর্জা, থিয়েটার, জগদ্বিখ্যাত লুভর মিউজিয়াম - সবই উঠে এসেছে লেখকের বর্ণনায়। ফরাসীদের ইতিহাসপ্রীতি থেকে লেখক অনুপ্রেরণা নিয়েছেন এভাবে "...চোখ পাকবে কিন্তু মন পাকবে না, প্রতিদিন একটু করে বড় হবো কিন্তু বুড়ো হবো না, আমার প্রাচীন দেশের পরিপক্ক শিক্ষাকে আমার চির-তরুণ অন্তরে ধারণ করব এবং প্রতি দেশের নিজস্ব শিক্ষাকে আমার নিজস্ব শিক্ষার মধ্যে গ্রহণ করব।" কসমোপলিটান পারী নগরী সম্পর্কে লেখকের চূড়ান্ত মূল্যায়ণ- "পারীই তো আধুনিক সভ্যতার সত্যিকারের রাজধানী, অগ্রসরদের তপস্যাস্থল, অনুসারকদের তীর্থ।"
জার্মানীর বিখ্যাত শহরগুলোও লেকহকের বর্ণনায় রূপ-রস-গন্ধ-দৃশ্যসমেত উঠে এসেছে। জার্মান জাতির সঙ্গে ভারতীয়দের আত্মিক সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন লেখক। যন্ত্রশিল্পে জার্মানির উৎকর্ষের প্রশংসা ও সমালোচনা করেছেন লেখক। একই রকম ঋজু ভঙ্গিতে বর্নিত হয়েছে ভিয়েনা, ব্রাসেলস, হল্যান্ড, রোম, ভেনিস, ফ্লোরেন্স প্রভৃতি বিখ্যাত নগরীগুলো।
লেখক অন্তর দিয়ে অনুভব করতে চেয়েছেন ইউরোপীয় মানুষের প্রাণের ধর্মকে এবং সে ধর্ম একান্তভাবে ইউরোপীয়, ক্রিশ্চিয়ানিটি নয়। 'পথে প্রবাসে' এক অনন্য সাংস্কৃতিক আলেখ্য, কারণ সংস্কৃতি শব্দটিই মানব সমাজ ও জীবনের সম্পূর্ণতম ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম। অনন্য কথাশিল্পী অন্নদাশঙ্কর তাই লেখার শেষে জানাচ্ছেন- 'যেদিন আমি বিদেশ যাত্রা করেছিলুম সেদিন শুধু দেশ দেখতে যাইনি। গেছলুম মানুষ দেখতে, মানুষের সঙ্গে মিশতে, তাদের সঙ্গে সম্বন্ধ পাতাতে। দেশের প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট সৌন্দর্যের চেয়ে দেশের মানুষ সুন্দর।'
রবীন্দ্রনাথের মতে ভারত যদি হয় মহামানবের সাগরতীর, তবে অন্নদাশঙ্করের মতে ইউরোপ হচ্ছে মহামানবের মানস সরোবর। ইউরোপই গোটা পৃথিবীর অজানা মহাদেশগুলোর আবিষ্কারকর্তা ও আধুনিক বিজ্ঞানের সূতিকাগার। তাই ইউরোপকে অন্তর দিয়ে গ্রহন করবার আহবান লেখকের। পৃথিবী জুড়ে দেশ ও জতিগুলোর মহামিলনের উজ্জ্বল স্বপ্ন নিয়ে শেষ হয় তাঁর ভ্রমনকাহিনী। বাংলাভাষায় এমন প্রাঞ্জল অথচ মনস্বী, গভীর, অথচ গতিশীল ভ্রমনকাহিনী অত্যন্ত দুর্লভ।
অলয়
মন্তব্য
রিভিউ সুন্দর হয়েছে। তবে দেখুন, অন্নদাশঙ্কর যত যাই ঘুরুন, মেসির সঙ্গে তো আর দেখা হয় নি!
ভুল বানানগুলো কাঁটার মতো চোখে বিঁধছে! হ্যাঁ সেই সৌভাগ্য কি সবার হয়? পৃথিবীর সব মহান লোক সংযুক্ত হতে পারলে আসলে ভালো হোত।
অলয়
আমিও পথে প্রবাসে হাতে নিলাম দিনকয়েক আগেই, রিভিউটা আগুনে ঘি ঢালার মতোই কাজে দেবে। খুব সুন্দর রিভিউ হয়েছে। আপনার কাছ থেকে আরও রিভিউ আশা করছি ভবিষ্যতে
হিল্লোল
ধন্যবাদ। বেশ কিছু বানান ভুল রয়ে গেছে দেখছি। এর জন্যে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। বিক্ষিপ্ত টাইপিং এবং ওয়ার্ড প্যাডে অনভ্যস্ততার কারণে এটা হয়েছে। রিভিউ আসলে শেয়ার করার জন্য লিখি।
অলয়।
আপনার লেখাটি পড়ে খুবই ভালো লাগলো। "পথে প্রবাসে" আমার ও পড়ার মনোবাসনা ছিলো কিন্তু আপনার মতো নানা কারনে তা হয়ে ওঠেনি। কিন্ত তাতে কি তার স্বাধ তো আপনার লেখা থেকে পেলাম। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এমন সুন্দর একটি লেখা আমদেরকে উপহার দেবার জন্যে।
শাহিদ
রিভিউ চমৎকার লাগলো।
ভ্রমণকাহিনী এমনিতে আমার খুব ভালো লাগে, কিন্তু বাংলা ভ্রমণকাহিনীতে যা হয়- খাইলাম-গেলাম-করলাম-চড়লাম- আর সাথে একটু সোশিওপলিটিকাল কমেন্টারি- এর বাইরে আর কিছু আজকাল চোখে পড়ে না। অন্নদাশঙ্করের এত চমৎকার লেখার লিগেসি পরে খুব কম লোকই আগায়া নিতে পারছে- এইখানেই যা আফসোস!
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
ধন্যবাদ। হুম! শুধু খাওয়া-যাওয়া-করা-চড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও চলত, সবচেয়ে বিরক্তিকর ওই সোশিও-পলিটিক্যাল কমেন্টারিটাই। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মুহম্মদ আবদুল হাই সাহেবের "বিলেতে সাড়ে সাতশ' দিন!" যত্রতত্র নীতিকথার বর্ষণ এবং হাহুতাশ ছিল রীতিমত বিরক্তিকর। অনেক জায়গায়ই ছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে খুশি করার নিরুপায় চেষ্টা! সুনীলের ভ্রমণকাহিনী দুর্দান্ত! রাহুল সাংকৃত্যায়ণও অসাধারণ, যদিও তিনি বাঙালি নন!
অলয়
ভালো লাগল---
facebook
ধন্যবাদ। কিন্তু আমার তো এই বইএর মধ্য দিয়েই ভ্রমণ। পেশাটাই খারাপ। আর সত্যিকারের ভ্রমণপিপাসু লোকও বিরল। বাংলাদেশের ডাক্তারদের ৪০-৪৫ বছর বয়স কাটে বিদ্যার পেছনে। বাকিটা অর্থের লোলুপতায়, অধিকাংশের ক্ষেত্রে। যে বেরসিকদের ভ্রমণের সুযোগ ঘটে সরকারী ও বিদেশী পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের অধিকাংশই নানান দেশে গিয়ে আদিখ্যেতার পরিচয় দেন।
অলয়
ভাল্লাগলো রিভিউ।

লিখুন নিয়মিত।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
Nice review. বই টা পড়া দরকার।
বই টা পড়া দরকার।
খুব ভালো লাগলো। লেখার ধরনটা অসাধারন, পড়ার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। নিয়মিত লেখা চালিয়ে যাবি এ আশাই করছি। শুভকামনা থাকলো।
আশিস
আরে ওস্তাদ তুই?
টেক্সাস গিয়ে তো আমাদের ভুলেই গেলি? খবর কী? তোর লেখার লিঙ্ক পাঠাস।
অলয়
লেখাটি পড়ে আমি ভাবচ্ছিলাম এত সুন্দর করে গুছিয়ে একটি বইয়ের সম্পর্কে কি করে বলা যায়!! এক কথায় আপনার লেখা অসাধারণ সুন্দর।
নতুন মন্তব্য করুন