আপনারা নিশ্চয়ই ঋত্বিক ঘটকের “মেঘে ঢাকা তারা” দেখেছেন! এই ছবিতে চালচুলোবিহীন ছেলেটি নদীর ধারে, বটের মূলে যে গান গেয়ে বেড়ায় তা ক্ল্যাসিকেল গান নামে পরিচিত। একথা লিখে বিদগ্ধ জনের বিরক্তির পাত্র হব সেটা জানি, কিন্তু বাস্তব হচ্ছে, আমাদের প্রজন্মের অনেকের কাছেই ক্ল্যাসিকেল গান একটি বিভ্রান্তিকর বিষয়। অনেকেই রবীন্দ্র-নজরুল, মায় হেমন্ত-কিশোরের গানকেও ক্ল্যাসিকেল গান ভাবেন এবং তা “সর্বোৎকৃষ্ট” অর্থে নয়, বরং “সনাতনী” অর্থে। এরা এটা জানে না যে, ক্ল্যাসিকেল অঙ্গে অনেক গান রচনা করলেও রবীন্দ্রনাথের ধারা ছিল সনাতনী প্রথাবদ্ধতার বিপরীত এবং বাংলা আধুনিক গানের জনক রবীন্দ্রনাথ। নজরুলের বাংলা খেয়াল ও ভজনগুলোকে ক্ল্যাসিকেল বলা যায় কিন্তু ঢালাওভাবে নজরুল সঙ্গীতকে ক্ল্যাসিকেল গান বলা ভুল আর হেমন্ত বা কিশোরের রাগাঙ্গের গান একেবারেই নগণ্য যদিও পৃথক অর্থে এগুলো সবই ক্ল্যাসিকেল পর্যায়ভুক্ত। উস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর জন্মভূমি বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বর্তমান অবস্থা মুমূর্ষু এবং ভবিষ্যৎ চিরপ্রস্থানের আশঙ্কায় বেপথুমান! আধুনিক, পপ-রক এমনকী রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতির শিল্পীদের একটা বড় অংশের কাছেই উচ্চাঙ্গসঙ্গীত হচ্ছে “বেসিক” তথা গলা তৈরির ব্যায়ামমাত্র। এতে বোঝা যায় যে, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভুল একটা তথ্য শিল্পীমহলে চালু হয়ে গেছে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সঙ্গীতের একটা বিস্তৃত শাখা যেটা ভালোভাবে শিখলে যেকোন সঙ্গীত পরিবেশনার কিঞ্ছিদাধিক অধিকার জন্মে, কিন্তু এটা কখনোই নিছক ব্যাকরণ নয়, বরং এটা শিল্পসৌকর্যমণ্ডিত গান। ধ্রুপদ-খেয়াল কম্পোজিশনগুলো গোটা পৃথিবীর মেলোডিভিত্তিক গানবাজনার মধ্যে সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় এবং অমিত বিস্তৃতির সম্ভাবনাময়। এই আশ্চর্য সুরেলা সঙ্গীত যদি কতিপয় অল্পশিক্ষিত গুরুর বুড়োমির কল্যাণে নিছক ব্যায়াম ও অন্য রকম গানের “বেসিক” হিসেবে তরুণসমাজে পরিচিত হয় তবে এর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। তাই প্রয়োজন যথার্থ ফর্মে শাস্ত্রীয় তথা রাগসঙ্গীতের শিক্ষা, প্রচার ও পরিবেশনা।
বর্তমানে দেশে প্রচলিত সঙ্গীতশিক্ষায় ক্ল্যাসিকেলকে বিশাল গুরুত্ব দেয়া হয়! বলা হয় ক্ল্যাসিকেল বেইজটাই নাকি আসল, সব গানের বেসিক! তাই সব উঠতি বয়সের বাচ্চাকেই কোন কম্পোজিশন না শিখিয়ে এন্তার সরগম-পাল্টা-মীড়খণ্ড সাধানো হয়। কিন্তু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বা ধুরপদ-খ্যাল যে আসলে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি বা রকগানের মতই গানের একটি ধারা – একথাটা শেখানো হয় না এবং প্রায় কাউকেই ধ্রুপদ-খেয়াল-ঠুমরী শিল্পী হিসেবে পেশাদার হতে উৎসাহিত করতে দেখা যায় না। যেহেতু নজরুলের অনেক গান সরাসরি বিখ্যাত খেয়াল-বন্দিশের ভাঙা গান, কাজেই নজরুলগীতির শিল্পীদের মধ্যেই শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের চর্চা সর্বাধিক, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নজরুলগীতির “বেসিক” হিসেবেই। যেহেতু শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের কোন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা নেই এবং প্রচারমাধ্যমগুলোও শাস্ত্রীয়সঙ্গীত প্রচারে একেবারেই অনাগ্রহী, সেহেতু আগ্রহী ও প্রতিভাবান তরুণ খেয়ালিয়ারাও বাধ্য হন রুজি-রুটির তাগিদে নজরুলগীতির শিল্পী হিসেবে প্রফেশনাল হতে। শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের যাঁরা হর্তা-কর্তা তাঁদের অনেকেই অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল, প্রথাবদ্ধ এবং কর্তৃত্বপরায়ণ! এদের অনেকেরই কর্কশ কণ্ঠ এবং বিদঘুটে অঙ্গভঙ্গি তরুণ প্রজন্মকে এই অনিন্দ্য-সুন্দর সঙ্গীতের প্রতি বিতৃষ্ণ করে তোলে। এদের অনেকেই স্বঘোষিত “উস্তাদ” এবং “পণ্ডিত”- যদিও এই উপাধিগুলো দেবার জন্য কমপক্ষে আটজন স্বীকৃত সঙ্গীতগুণীর সামনে সঙ্গীত পরিবেশন করা জরুরী যা বাংলাদেশে বর্তমানে অসম্ভব। মুখে ফৈয়াজ-খাঁ, আব্দুল করিম, আমীর খাঁ আর হাতি-ঘোড়ামারা বাতচিত করা এই অথোরিটারিয়ানদের অডিশন নেয়া জরুরী সবার আগে! জাজ করা উচিত উপমহাদেশের প্রথিতযশা সঙ্গীতশিল্পীদের। হ্যাঁ সঙ্গীতে জাতীয়তাবাদভিত্তিক সংকীর্ণতা অবশ্যই দুষণীয়।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিক্ষার মূলবিষয়গুলো বাংলাদেশে অত্যন্ত অবহেলিত। কিছুদিন আগে ময়মনসিংহ ও ঢাকায় গেয়ে গেলেন বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী পণ্ডিত অরুণ ভাদুড়ী। সাধারণ শ্রোতাদের অনুদার সমালোচনা না করে আমি তথাকথিত বোদ্ধাদের দুটি চিত্র তুলে ধরছি। অরুণ ভাদুড়ী ঢাকায় জাদুঘরের অনুষ্ঠানে গাইলেন রাগ মিয়াঁ কি মলহার, অথচ পরদিন “প্রথম আলো”র প্রতিবেদনে ছাপা হোল, তিনি গেয়েছেন “মেঘমল্লার,” বুঝুন তাহলে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার সঙ্গীতপ্রতিবেদকের জ্ঞানবুদ্ধির দৌড় কতখানি! পণ্ডিত অরুণ ভাদুড়ীর সাথে তানপুরা বাজিয়েছেন ছায়ানটের এক শিক্ষক, সঙ্গত কারণেই নাম করছি না! ইনি শেষদিকে তানপুরার চারটি তারের মাত্র দুটি বাজিয়ে এক অভূতপূর্ব নজির স্থাপন করেছেন যা আমার পোড়া চোখে অত্যন্ত দৃষ্টিকটু লেগেছে। উনি হয়তো বলবেন, ইলেকট্রিক তানপুরা তো ছিলই, ওসব বোঝা যায় না- তার উত্তরে বলব, তাহলে থোবড়া দেখানোর জন্য ওনাকে তানপুরা নিয়ে পেছনে বসানোর কী দরকার ছিল? গানবাজনা কি রাজনীতি নাকি যে, ফেস-ভ্যালু বাড়াতে হবে? ঠিকভাবে তানপুরা মেলাতে ও বাজাতে না শিখে বড় বড় গুণীদের পেছনে বাজাতে বসে এরা দেশের মানসম্মানের বারোটা বাজাচ্ছেন! এর চেয়ে একজন রকব্যান্ডের গিটারিস্ট কিন্তু অনেক বেশি নিষ্ঠাবান। তাঁরা যেটুকু জানেন, উজাড় করে বাজান- আর তাই মানুষ তাদের ভালোবাসে! আপনারা নোংরা রাজনীতিতে না গিয়ে দয়া করে রেয়াজ করুন। তানপুরা টিউনিং এবং বাদন শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শিক্ষার্থী ও শিল্পীর জন্য অপরিহার্য অথচ এই অপরিহার্য বিষয়টি অনেক সেরা সঙ্গীতবিদ্যালয়েই উপেক্ষিত! শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তানপুরা যন্ত্রটি অপরিহার্য কেননা এই অনন্য যন্ত্রটির গুঞ্জন থেকেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে ব্যবহৃত ২২টি শ্রুতি বা ওভারটোন পাওয়া যায় যেগুলো ছাড়া রাগের অস্তিত্বই থাকে না। হারমোনিয়ম বা কীবোর্ডে ভৈরোঁর আন্দোলিত অতিকোমল রেখাব, আন্দোলিত নিখাদাশ্রিত ধৈবত বা দরবারীর গান্ধার বাজানো অসম্ভব। তাই মোটামুটি টিনেজার বয়সের সূচনা থেকেই তানপুরা মেলানো, বাজানো এবং তানপুরার সঙ্গতে গায়ন-বাদনের প্রশিক্ষণ অপরিহার্য।
বাংলাদেশ এবং সমগ্র উপমহাদেশেই ক্ল্যাসিকেল ও অন্যান্য ধারার সঙ্গীতশিল্পীদের মধ্যে একটা চাপা ও প্রকাশ্য-বিদ্বেষ দেখতে পাওয়া যায় যা মূলত অজ্ঞতা ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত। আবার কেউ কেউ উদারতা দেখিয়ে বলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতই সকল সঙ্গীতের ভিত্তি। অবশ্য সঙ্গীতকে একেবারে মাতৃজঠরে নিয়ে ফেললে সব সঙ্গীতের সাধারন উৎপত্তিস্থল নির্ণয় সম্ভব কারণ গোটা সভ্য মানবজাতির উদ্ভব আফ্রিকার একটি ছোট্ট গোত্র থেকে! কিন্তু নিকট-অতীতের সঙ্গীতের ধারাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, শাস্ত্রীয়সঙ্গীত সকল সঙ্গীতের জন্মদাতা কথাটি নিছক অতিশয়োক্তি। বর্তমানে প্রচলিত শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের ফর্মগুলো হচ্ছে, ধ্রুপদ, খেয়াল, তারানা এবং ত্রিবট। এগুলোকে ভাব-ভাষা ও পরিবেশনের আঙ্গিকে কিছুটা পরিবর্তন করে তৈরী হয়েছে উপশাস্ত্রীয় টপ্পা, ঠুমরী-দাদরা, কাজরী, চৈতী। গজলের পরিশীলিত গায়কীর জন্য আমরা উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খান, বরকত আলী খান, বেগম আখতার এবং মেহেদী হাসান এর কাছে ঋণী, এবং গজলের এই ধারাটিও উপশাস্ত্রীয়সঙ্গীত। কিন্তু আধুনিক সঙ্গীতের ধারাগুলো কোনভাবেই শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের সন্তান নয়। যেকোন গান গাইতে হলেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখতেই হবে একথা আমি মনে করিনা, কিন্তু এটা ঠিক যে, কোন সাহিত্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তি সঠিক পদ্ধতিতে সদগুরুর অধীনে ধুরপদ-খ্যালের জন্য গলা তৈরি করলে তার পক্ষে যেকোন গান গাওয়া অত্যন্ত সহজ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কিংবদন্তীপ্রতীম শিল্পী মান্না দের কথা। তিনি যেমন বসন্ত-বাহার রাগে পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর সঙ্গে ডুয়েট গাইতে পারেন, তেমনি উপমহাদেশের প্রথম ‘রক এন্ড রোল” “আও টুইস্ট করে” গানটিও তার গাওয়া; আবার আইরিশ লোকগীতির সুরে কফিহাউজের আড্ডাও অমর হয়ে আছে তাঁর কণ্ঠে! শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিক্ষার অভাবেই হেমন্ত ও কিশোর পুরোপুরি ভার্সেটাইল হয়ে উঠতে পারেননি অপূর্ব প্রকৃতিদত্ত কণ্ঠমাধুর্য সত্ত্বেও। এটা তাঁদের অবমাননা নয়। হেমন্ত ও কিশোর দুজনই সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কারণে ক্ল্যাসিকেল শিখতে পারেননি। কিশোরের ক্ষেত্রে তাঁর বাপের বাধা ছিল। এই দুই জিনিয়াস শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখলে আমাদের সঙ্গীতাঙ্গন আরো সমৃদ্ধ হত। এ শিক্ষা তাঁদের সীমাবদ্ধ করত- এ আসঙ্কা অমূলক। শিক্ষা প্রতিভাবানদের সীমাবদ্ধ করে না, বিস্তৃতি দেয়। শুধুমাত্র কূপমণ্ডুকরাই শিক্ষার ফলে সংকীর্ণ হয়ে পড়ে, প্রতিভাবানরা নয়।
হেমন্ত ও কিশোরের উদাহরণ থেকেই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, দিনরাত সরগম-পাল্টা না সাধলেও অবশ্যই সার্থকভাবে সঠিক সুরে-তালে গান করা সম্ভব। বরং গলা তৈরির জন্য পাশ্চাত্যসঙ্গীতের পদ্ধতিগুলো আরো বেশি বিজ্ঞানসম্মত। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত-পড়ুয়া যেসব শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে লাইট সং গাইতে চান তাদের দিনরাত ক্ল্যাসিকেল নিয়ে পড়ে থাকার দরকার নেই। অজয় চক্রবর্তী যেমন বলেছেন, “ কবিতা কৃষ্ণমূর্তি আমার কাছে শিখতে এলে, তাঁকে মালকোষের বন্দিশ শিখিয়ে কী লাভ হবে? বরং গানের ভাব অনুযায়ী নানা রকম ভয়েস থ্রোয়িং শেখাটা তাঁর জন্য জরুরী।" কাজেই কেউ আধুনিক বা রক গাইতে চাইলে তার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখা অপরিহার্য নয়, তবে তা জ্ঞান বৃদ্ধির সহায়ক হতে পারে। রবীন্দ্রনাথের অজস্র ধ্রুপদ-ভাঙা গান এবং কিছু খ্যাল-ঠুমরী-টপ্পা-তরানা অঙ্গের গান থাকলেও সেগুলো কখনোই শাস্ত্রীয় পদ্ধতিতে গাওয়া হয় না এবং গাইলে লোকে মারতে আসবে। কাজেই খুব বেশি তালিম না থাকলেও এসব গান গাওয়া সম্ভব, তার নজির দেবব্রত বিশ্বাস। ওয়াসিফুদ্দিন ডাগর বা গুন্দেচা ভ্রাতৃদ্বয়কে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ালে পাবলিক ক্ষেপে যাবে। অজয় চক্রবর্তী বা ফাল্গুনী মিত্রের রবীন্দ্রসঙ্গীতও তেমন জনপ্রিয় নয়! নজরুলের খেয়াল অঙ্গের গানগুলোও খেয়ালের সব অঙ্গ না শিখেও সুরে-তালে গাওয়া সম্ভব। কাজেই দেখা যাচ্ছে শুধু গলা তৈরীর মাধ্যম হিসেবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা সময়ের নিদারুণ অপচয়, কারণ যেকোন গানের গলা তৈরি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রীতির ওপর নির্ভরশীল নয়। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে মোট ২২ টি শ্রুতির অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও সুচারু প্রয়োগ একে ১২ টি স্ট্যাটিক স্বরের ওপর প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য সঙ্গীত থেকে পৃথক করে। তাই মেলোডির ভিত্তিতে বিচার করলে এখানে দশটি অতিরিক্ত শ্রুতি এবং অভিনব স্বরসঙ্গতি রাগসঙ্গীতকে অনন্ত সৃষ্টির সম্ভাবনাময় একটি সঙ্গীতধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। কাজেই যারা সঠিক পদ্ধতিতে ধ্রুপদ-খেয়াল-ঠুমরী গাইবার জন্য গলা তৈরী করেন তারা সুরের ওপর নিখুঁত দক্ষতা অর্জনের বাইপ্রোডাক্ট হিসেবেই অন্যান্য মেলোডি-নির্ভর গানেও পারদর্শীতা দেখাতে পারেন, কিন্তু তারজন্য অবশ্যই চাই কাব্যবোধ এবং গানের ভাব অনুযায়ী fortissimo-piansimo effect এবং মড্যুলেশনের দক্ষতা – যা স্বভাবতই বিরল। যেমন অজয় চক্রবর্তী ধ্রুপদ থেকে শুরু করে পল্লীগীতি পর্যন্ত এবং মায় কান্ট্রিসং পর্যন্ত অবলীলায় গাইতে পারেন। এখানে বলে রাখি, রাগসঙ্গীত পল্লীগীতিরই সুসংবদ্ধ ও রীতিবদ্ধ রূপ! উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খান সাহেবের অনিন্দ্য এবং সর্বত্রগামী কণ্ঠে পৃথিবীর তাবৎ গান সম্ভব। কিন্তু জেমস বা আইয়ুব বাচ্চুর গলায় বা হেমন্ত-কিশোরের গলায় ললিত-ভৈরোঁ-পূর্বীর অতুল বৈভব প্রকাশ অসম্ভব। এর মানে এই নয় যে রকসংগীত খাটো, কিন্তু মেলোডি ও তালের বিচারে আসলেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সুবিস্তৃত পরিসর বাকি সব সঙ্গীতকে আত্মসাৎ করার ক্ষমতা রাখে।
কাজেই সময় এসেছে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতকে গান হিসেবেই চর্চা করবার, ব্যাকরণ বা ব্যায়াম হিসেবে নয়! এভাবে চর্চা করলে বোধসম্পন্ন শিল্পীরা অন্য গান-বাজনাও বুঝতে ও পারফর্ম করতে পারবেন। সত্যজিৎ রায় বা কুমারপ্রসাদ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য –উভয় ধারার সঙ্গীতেই সত্যিকারের ব্যুৎপত্তির অধিকারী ছিলেন। কোন দেশের ক্ল্যাসিকেলই সব রকম সঙ্গীতের জননী নয়। বরং আধুনিক সঙ্গীতের অনেক ধারাই ক্ল্যাসিকেল সঙ্গীতের বিপরীতধর্মী। যেমন বাংলা আধুনিক কাব্যধর্মী গানের কথা-নির্ভরশীলতা রাগসঙ্গীতের বিপরীতধর্মী! কাজেই যারা আধুনিক, রক ইত্যাদি গাইতে চান তাদের জন্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা বাধ্যতামূলক নয়- পাশ্চাত্য ঘরানার ও আবৃত্তির কন্ঠশীলন বরং বেশি উপযোগী। রবীন্দ্র-নজরুল ও তিনকবির গান গাইতে ক্ল্যাসিকেলের সার্বিক প্রায়োগিক দক্ষতা না থাকলেও চলবে যদি গানের ভাব ও সুর অক্ষত থাকে। যাঁরা নিখুঁতভাবে রাগসঙ্গীত শিখবেন আশা করা যায় চাইলে তারা যেকোন গানে মানোত্তীর্ণ হতে পারবেন। শ্রোতাদের রুচি নেই বলে গণমাধ্যমগুলো রাগসঙ্গীতের প্রচার করতে চায় না। কিন্তু প্রচার ও প্রসার ছাড়া কোন শিল্পমাধ্যমই টেঁকে না। জনরুচির জন্য শিল্পী ও প্রচারমাধ্যমও দায়ী। “পাবলিক খায় না বলে ভালো গান গাই না”- এমন দাবি আজকাল অনেক শিল্পীই করেন। গানকে যারা ‘খাদ্য’ হিসেবে বিচার করেন তাদের শিল্পীসত্ত্বা নিয়েই প্রশ্ন জাগে! আবার এটাও সত্যি যে, জনতার রুচিবিকৃতির জন্য ওই শিল্পীরাই দায়ী! গণমাধ্যমগুলোর উচিত শিল্প-সংস্কৃতির কোন ধারাকেই প্রতিহত না করে সমান সুযোগ করে দেওয়া। একদিন পিক আ’রে রক শো দেখালে আরেকদিন মানসম্পন্ন দেশি বা ভারতীয় বা পাকিস্তানী রাগসঙ্গীত শিল্পীর অনুষ্ঠান দেখানো উচিত, বিটিভির মত রাত এগারোটার পর পাঁচ মিনিটের খেয়াল এর জন্য যথেষ্ট নয়। আমি বিশ্বাস করি, যাদের মেলোডি ভাল লাগে, তাদের সুরেলা গলার খেয়াল-ধ্রুপদ-ঠুমরী ভালো লাগবেই। আমার রুম-মেট যে কোনদিন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শোনেনি, সে বড়ে গুলাম আলীর “আয়ে না বালাম”এর প্রেমে পড়ে গিয়েছিল প্রথম শ্রবণেই। কাজেই আগে দরকার মানসম্পন্ন রাগসঙ্গীতের প্রচার। এর জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে ফিউসনের গুরুত্বও অনেক। কারণ একেবারে অপরিচিত সঙ্গীত বোঝা কঠিন। রাগসঙ্গীতের প্রসারে বেঙ্গল-আইটিসির যৌথ উদ্যোগ প্রসংশনীয়, তবে তা আরো বিস্তৃত আকারে পুরো দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। টিভি, ইউটিউব, সিডি ও ডিভিডিতে প্রতিটি অনুষ্ঠান ধারন ও বাজারজাত করতে হবে; বের করতে হবে প্রচুর তালিম পর্যায়ের সিডি ও ডিভিডি। ছায়ানট ও অন্যান্য সঙ্গীতবিদ্যালয়গুলোতে প্রায়োগিক শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের রেয়াজের সময় ও গুণগত মান বাড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সঙ্গীতবিভাগ খোলার মধ্য দিয়েই শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের প্রসার সম্ভব নয়। প্রচার মাধ্যমের নিরুৎসাহিতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীতবিভাগের সেরা ছাত্র-ছাত্রীটিও বাধ্য হয় রবীন্দ্র-নজরুল-আধুনিক গানকেই বৃত্তি হিসেবে নিতে। এ অবস্থা চলতে থাকলে উস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ ও উস্তাদ বিলায়েত খাঁর জন্মভূমিতে শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের অপমৃত্যু অতি নিকট এবং সেটা হবে নিতান্ত পরিতাপের বিষয়।
অলয়
মন্তব্য
ভাল লাগলো পড়ে।
শুধু বাংলাদেশের রাগ-সংগীত চর্চার একটা ধারাবাহিক ইতিহাস যদি পোস্ট আকারে দিতেন তাহলে খুব ভাল হতো।
অনেক কিছু আলোচনা করা যেতো প্রাসঙ্গিকভাবে।আপনার পোস্টের মূল সুরটা বোঝা যাচ্ছে কিন্তু কোন কিছুর গভীরে গেলেন না।বাংলা গানে রাগের প্রভাব কবে থেকে আছে তার ইতিহাস যদি দেখেন তাহলে পোস্টের স্ববিরোধী অংশগুলো পরিস্কারভাবে বোঝা যাবে।তবে আপনার আশঙ্কার সাথে আমি খানিকটা ভিন্নমত পোষণ করি... শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের অপমৃত্যু তো দূরের কথা,মৃত্যু হওয়ারও কোন সম্ভাবনা নাই।তবে জনপ্রিয় হবার সম্ভাবনা সবসময়ই কম।
লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ
ধন্যবাদ। ওই বিশাল কাজটি পোস্ট আকারে দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমি খুবই মামুলী মাপের একজন শ্রোতা, এবং সঙ্গীত কোনভাবেই আমার পেশা নয়। আপনি যেটা চাইছেন সেটা বিস্তৃত আকারে বর্ণিত হয়েছে অজয় সিংহ রায়ের একটি বইয়ে যার নামটা সঠিকভাবে এখন মনে পড়ছে না। ওতে বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতচর্চার বিস্তৃত ইতিহাস পেয়ে যাবেন। ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম এই চারটি মূল কেন্দ্রের কথাই পেয়ে যাবেন।
পোস্টের ঠিক কোন অংশটুকু স্ববিরোধী বললেন কৃপা করে দেখিয়ে দিলে কৃতার্থ হব। বাংলা গানে রাগের প্রভাব আছে -একথা সবাই জানে। আমি যেটা স্পষ্টভাবে বলেছি তা হচ্ছে ,যেকোন বাংলা গানই শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের সন্তান- এই কথাটা অতিশয়োক্তি। আধুনিক গানের জন্মই হয় ক্ল্যাসিকেলের ট্র্যাডিশন থেকে একটু করে সরে গিয়ে। বাংলা গানে রাগের প্রভাব নেই - একথা কি আমি বলেছি? বাংলায় রাগপ্রধান গানের একটা স্বতন্ত্র বিস্তীর্ণ জগৎ আছে যেখানে জ্ঞান গোঁসাই, ভীষ্মদেব চাটুয্যে, চিন্ময় লাহিড়ী থেকে মান্না দে, মানবেন্দ্র, প্রসূন ব্যানার্জি এবং অজয় চক্রবর্তী অসামান্য অবদান রেখেছেন। কিন্তু রাগ-প্রধান গানে রাগই প্রধান তার ধারা আধুনিক গানের মতো নয়। আধুনিক গানে রাগ ব্যবহৃত হলেও তা কথার সাথে আপোস করে বদলে যায়। কাজেই রাগের ছোঁয়া লাগা আধুনিক গান গাইতে ওই রাগের ওপর খুব বেশি দখল না থাকলেও চলে।
ভারতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। অসাধারণ সব তরুণ শিল্পী উঠে আসছেন। অর্কুটে ও বিভিন্ন ফোরামে এ নিয়ে বিপুল আগ্রহ-উদ্দীপনা এবং আলোচনা। বাংলাদেশের তরুণ সমাজে এর জনপ্রিয়তা না থাকারই সামিল এবং এভাবে ধুঁকে ধুঁকে টিঁকে থাকাকে আমি বাঁচা বলি না। একটু চেষ্টা আর ভালো গানের প্রচার হলেই ওই কম সম্ভাবনা থেকেই ফুল ফুটবে। এটা ঠিক এই গান দরবারে ঢোকার পর থেকেই জনসাধারণের সাথে যোগাযোগ হারায়। কিন্তু বর্তমানে রেকর্ড ও ইন্টারনেটের যুগে এমন কোন সীমাবদ্ধতা নেই। তাহলে কেন আমরা এই অপূর্ব সুরলহরীতে আরো বেশি মানুষকে স্নান করাব না?
গভীর গবেষণামূলক প্রবন্ধ এটা নয়। তবে সরেজমিন অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি বাংলাদেশে সঠিকভাবে চর্চার ভীষণ অভাব।
অলয়
লেখক রাইগা আছেন মনে হয়। বহু কিছু একসাথে হয়া আছে। কিন্তু কিছু কথা ঠিক বলছেন।
আমার মূল পয়েন্ট হইল শাস্ত্রীয় সঙ্গীত একটা শাস্ত্র। এইটা সকলের আয়ত্তে থাকবে না। থাকবে না দেইখাই লোক বনাম শাস্ত্র একটা বিভাজন আছে। কিন্তু লোক আর শাস্ত্রের সম্পর্ক গভীর।
আলুতে রাগসঙ্গীত বুঝার লোক থাকার কথা না। কারণ তারা কোনো ালই বুঝে না। খালি জ্ঞান্দিতে চায়। কানে শুইনা মেঘমল্লার আর মিয়াঁ কি মল্লার আলাদা না করতে পারলে তার কলম ধরার দরকার কি! মেঘমল্লার নাহয় বুঝলাম খুব একটা শুনা যায় না। কিন্তু মিয়াঁ কি মল্লারের চেয়ে কমন রাগ তো কমই আছে। এট লিস্ট মিয়াঁ কি মল্লার যে না, সেইটা বুঝার ক্ষমতা থাকা উচিৎ।
সকল শিল্প অশিক্ষিৎ মাফিয়া হইতে মুক্ত হউক। শিক্ষিৎ মাফিয়ার সাথে লড়াই হইলেও করা যায়।
পুনশ্চ:
আরেকটু বিশ্লেষণ ছাড়া আপনার এই বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হইল না।
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
খুব বেশি রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কি?
"শাস্ত্রীয় সঙ্গীত একটা শাস্ত্র"- আপনার এই মত আমি পুরোপুরি মানতে পারছি না। শাস্ত্র সব বিষয়েরই হয় এমনকি সৌন্দর্যতত্ত্বের মত আপেক্ষিক, বিমূর্ত বিষয় নিয়েও। শাস্ত্রীয়সঙ্গীতে শাস্ত্র অবশ্যই আছে কিন্তু তা নিষ্প্রাণ, অস্তিত্বহীন নয়। শাস্ত্রের প্রতিটা নিয়মের শিল্পসুষমামণ্ডিত প্রায়োগিক রূপ আছে বলেই এই শাস্ত্র মনোরঞ্জক। আর রঞ্জক বলেই তা রাগ বা রঙ। যেমন শ্রূতিগুলোর আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই , ঠিক যেমনটি আছে স্ট্যাটিক স্বরগুলোর। শ্রূতিগুলোকে শুধুমাত্র রাগের যথার্থ গায়ন-বাদনেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। রাগসঙ্গীত আপামর জনসাধারণের মনের গান হয়ে উঠবে- এই উচ্চাভিলাষ আমি কখনোই ব্যক্ত করিনি। আমি শুধু বলেছি, যে যারা এর চর্চা করেন তারা যেন নিষ্ঠার সাথে খাঁটি জিনিসের চর্চা ও প্রচার করেন। মেকী ও ভুল ভাবনাগুলোকে এড়িয়ে চলেন। এটা খুব বড় চাওয়া নয়। পাশের দেশ ভারতে এটা খুব ভালো করেই হচ্ছে। মিডিয়ায় সুযোগ পাবে না ভেবে কোন রাগসঙ্গীত অনুরাগী তরুণ-তরুণী যেন অন্য গানে যেতে বাধ্য না হন- এটা নিশ্চয়ই অন্যায় কোন ইচ্ছে নয়?
কিন্তু আলুর একটা রিপোর্টের জনমনে প্রতিক্রিয়া অনেক! বুরবকরা লিখলে চলবে কেন?
আপনি কী ধরনের বিশ্লেষণ চাইছেন এবং আপনার চর্চার ধরন না জেনে বিশ্লেষণ করতে যাওয়া মুশকিল। সাধারণ ভাবেই রাগসঙ্গীতের পুরানো দিনের কতিপয় শিক্ষক অনেক ভুল শিক্ষার প্রচলন করেছেন। যেমন ভোরে উঠতেই হবে, কোমর জলে দাঁড়িয়ে খড়জ ভরতে হবে, সিংহাসনে বসে জিহ্বা বের করে কুত্তার মত হা হা করতে হবে, টক, কলা -ইত্যাদি খাওয়া যাবেনা ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব রীতিমত ভিত্তিহীন। এর তুলনায় অপেরা সিঙ্গারদের কণ্ঠমার্জনার কৌশল অনেক বিজ্ঞানসম্মত এবং কণ্ঠশীলনে ওরাই এগিয়ে! যেমন যদি আপনি আর,ডি, বর্মনের কোন ওয়েস্টার্ন ধারার গান গাইতে চান এবং ওই ধারার গানেই পেশাদার হতে চান তাহলে আপনার জন্য পাশ্চাত্যের পপ ও কান্ট্রিসং এর উপযোগী কণ্ঠশীলনই উপযুক্ত।
ধন্যবাদ
অলয়
একটি কথা খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় বলতে চাই। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত-চিত্রকলা- সাহিত্য কখনোই জনপ্রিয় নয় বা ছিলোনা। একথা সত্য যে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বোঝা বা এপ্রেশিয়েট করার রুচি সর্বসাধারণের কাছ থেকে আশা করা ঠিক নয়। চিরকালই কিছু মানুষের আদান-প্রদানের মধ্যে এ সীমাবদ্ধ থেকে এসেছে।
বাংলাদেশের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত নিয়ে আপনার উৎকন্ঠার জায়গাটা আমি ধরতে পেরেছি-কিন্তু সমাধানের জায়গাটা সমর্থন করতে পারিনা!
"বাংলা আধুনিক কাব্যধর্মী গানের কথা-নির্ভরশীলতা রাগসঙ্গীতের বিপরীতধর্মী"--বিপরীতধর্মী কি আসলেই?
আপনার ব্যাখ্যা শুনতে আগ্রহী!
পোস্টটা জরুরী, আপনার কাছ থেকে পরবর্তীতে যদি আরো বিস্তারিত আলোচনা আসে রাগ-সঙ্গীত নিয়ে খুব ভালো লাগবে।
'
----------------------------------------------
We all have reason
for moving
I move
to keep things whole.
-Mark Strand
ধন্যবাদ সুচিন্তিত মন্তব্যের জন্য। হ্যাঁ উচ্চাঙ্গের শিল্প কখনোই খুব বেশি জনপ্রিয় ছিল না। জীবনানন্দ দাশ তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন, জনসাধারণ কবিতা বুঝবে এতটা আশা করা বাড়াবাড়ি। কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতার কারণ অবশ্যই বিশ্লেষণ করা জরুরী। জনপ্রিয় শিল্প-সাহিত্য কখনো ভালো কখনো খারাপ। ফৈয়াজ খান বা আব্দুল করিমের গান অসামান্য লোকপ্রিয় হয়েছিল, সেসময় এগুলো প্রচার হত এবং লোকে বুঝত বলেই। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত যখন গড়ে ওঠে তখন তা যথেষ্টই জনপ্রিয় ছিল। অবশ্য স্বভাবতই লোকসঙ্গীতের মত জনপ্রিয় নয়। দরবারী পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করার পরই এই গান জনমানুষের সংস্রব হারায় এবং শুধু রাজা-নবাব ও অমাত্যবৃন্দই এর সমঝদারীর সুযোগ পান। কিন্তু ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রাক্কাল থেকেই মূলত কোলকাতা ও মহারাষ্ট্রে সাধারণ্যে রাগসঙ্গীতের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটে। এরপর স্বাধীনতার পর দেশভাগের ফলে অধিকাংশ শিল্পীই ভারত বা পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় বাংলাদেশের রাগসঙ্গীত চর্চা স্বভাবতই ব্যাহত হয়। আজ সেই রাজ-রাজড়ার যুগ নেই। রাগসঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ সম্পদ্গুলো প্রচার করলে সবাই ভালোবাসবে তা নয়। আমি বলেছি সত্যিকারের সুরবোধসম্পন্ন শ্রোতাদের অবশ্যই ভালো লাগবে। সুরবোধসম্পন্ন ব্যক্তিদের অনেক প্রকারভেদও আছে। আবার সুরকানা লোকেরও অভাব নেই। আমি কিন্তু ঘুরিয়ে আপনার কথাটাই বলেছি! সুর ও মেলোডির বোধসম্পন্ন শ্রোতা সর্বসাধারণের মধ্যে খুব সুলভ নয়।
সমাধানের জায়গাটা আপনার মতে কী হওয়া উচিত?
আলবাত! আমি বিস্তৃত আলোচনায় যাবো না। আপনি হয়তো রবীন্দ্রনাথের "সঙ্গীতচিন্তা" পড়েছেন। এ নিয়ে বিস্তর বাদানুবাদ হয়েছে রবিঠাকুর, ধুর্জটিপ্রসাদ আর দিলীপকুমার রায়ের মধ্যে। এটা প্রায় সবাই মানেন যে কাব্যসঙ্গীতে কথাটাই প্রধান। আমার আগের একটা পোস্ট- সোলসের অপ্রকাশিত ইন্টারভিউতে পার্থ বড়ুয়াও এমন ভাবনাই ব্যক্ত করেছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত কথা-সুরের মণিকাঞ্চন যোগ। কিন্তু কবিতা থেকে করা গানগুলোতে কথারই প্রাধান্য, যেমন, তুমি কি কেবলি ছবি, কৃষ্ণকলি, দুই পাখি ইত্যাদি। এজন্যেই রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গানগুলো বাদে অন্য কোন গানে কোন রাগকে অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায় না। এটি রাগসঙ্গীতের স্পিরিটের বিপরীত। রাগসঙ্গীতে কথা সুরের বাহন মাত্র। অতীতে খেয়াল গানের কথা ছিল খুবই তুচ্ছ। পরবর্তীতে পণ্ডিত রতনজনকর এবং জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ সাহিত্যিক মানসম্পন্ন বন্দিশ রচনা করেন। কিন্তু সেখানেও রাগের ভাবই প্রধান কবিতা সেই ভাবের বাহন। রাগসঙ্গীতে কখনোই সুর কথার আজ্ঞাবাহী নয়। তরানা এবং যন্ত্রসঙ্গীত কথার ওপর প্রতিষ্ঠিতই নয়, অবশ্য উস্তাদ আমীর খান তরানায় সুপ্ত আধ্যাত্মিকতার খোঁজ করতেন।
পোস্টটার গুরুত্ব অনুধাবন করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
অলয়
বেসিক হিসাবে চর্চা হলেও, অন্তত চর্চাটা তো হবে বা হচ্ছে। রাগপ্রধান বাংলা গানের ব্যাখ্য শুনেছিলাম; যিনি গান তিনি রাইগ্যা গান, যিনি শোনেন তিনি রাইগ্যা যান। সত্যি কারের রাগ করে দেখিয়েছেন ইত্যাদির হানিফ সংকেত; তারে-ধইরা-কিলায়-নাকা-হাড্ডি-গুড্ডি-ভাঙ্গে-নাকা। উচ্চাঙ্গ সংগীত নিয়ে জনপ্রিয় প্রচার মাধ্যমে এই ধরণের ব্যাংগ করার চেয়ে যে কোন কারণে গাইলে তো দোষের কিছু দেখি না।
বাংলাদেশে একটা যন্ত্র বাজিয়ে গল্ড মেডেল প্রাপ্ত এক গুনীর সাথে আড্ডার সুযোগ হয়েছিল গানেরই। আমি একটা যন্ত্র বাজানোর খুব চেষ্টা করি, কিন্তু পারি না। তো সে যন্ত্র নিয়ে ঐ গুনীর সাথে বসে বাজানোর খুব সাধ হল। শুধু যন্ত্র বাজালে সাধারণ ভাবে আশা থাকে হয়তো উচ্চাঙ্গ সংগীতই বাজবে। তিনি তিন তালের একটা জনপ্রিয় রবীন্দ্র সংগীত ধরলেন।
কোন ভাবে ভদ্রলোকের তাল ধরতে না পেরে কাহার্বা বাজালাম। গোল্ড মেডেল পাওয়া একটা শিল্পী; আমাদের গানের তালি খালি, তেহাই-এর মত বেসিক বিষয় জানে না। তাল গুনে এক-দুই, এক-দুই করে। যদিও তিনি হাওয়াইন গীটারই বাজাচ্ছিলেন। কিন্তু মেলডিটা তো বাংলা।
সে জন্যই বলি; যে কারণেই হোক অন্তত আমাদের গানের বেসিক কিছু বিষয় তো শিখছে বা শিখবে।
লেখাটা ভাল লেগেছে। গান নিয়ে আলোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে উচ্চাঙ্গ সংগীত আমাদের দেশে ভীষণ ভাবে অবহেলিত। সে জন্য আক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। যত গীটার বিক্রি হচ্ছে তত সেতার-সারদ-সারেঙ্গী বিক্রি হচ্ছে না। সচলায়তনে স্বগতম।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
ঠিকই বলেছেন। টি,ভি প্রোগ্রামগুলো রাগসঙ্গীতকে অত্যন্ত বিকৃতভাবে প্রকাশ করেছে। কিছু লোক মূর্খতা জাহির করে এক রকম আনন্দ পায়!
আমার মতে বেসিক হিসেবে চর্চা চলুক। তবে মূল জিনিসটা কী- সেটাও যেন একটু করে শেখানো হয়।
বুঝুন তাহলে, এরা গোল্ড মেডেল কীভাবে পায়!
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
অলয়
গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যু নিয়ে লিখেছেন বলে প্রথমেই ধন্যবাদ জানিয়ে রাখছি। আমার মনে হয় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত বা আরও ভাল করে বলতে গেলে উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত বোঝানোর জন্য একে ''ক্ল্যাসিক্যাল গান'' টার্মটা ব্যবহার করাটা যথাযোগ্য নয়। চিরকালীন গান তো লালনের গানও। হেমন্ত, শচীন, কিশোর, সতীনাথ, শ্যামল, মান্না, ধনঞ্জয়, ভূপেন, গীতা দত্ত, লতা, সন্ধ্যা--- এদের সবার অনেক গানই কালোত্তীর্ণ, চিরকালীন, আজ থেকে একশ-দুইশ বছর পরও যাদের সুরে মাতোয়ারা হবে শ্রোতারা। এক্ষেত্রে এঁদের অনেক গানকেই ''ক্ল্যাসিক্যাল'' পর্যায়ে ফেলাই যায়, তবে সেসব গান হয়ত উত্তর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত বা মার্গ সংগীত নয়।
একটা জিনিস কি, অনিন্দ্য ভাই যা বলেছেন শাস্ত্রীয় সংগীত আসলেই সাধারণ মানুষের বোধগম্যতার বাইরে। মেঘ মল্লার বা দরবারী কানাড়ার চলন শুনেই যদি বুঝে ফেলা যেত এটা কোন রাগ তবে তো কথাই ছিলনা। ভারতীয় বা পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সংগীত ছিল রাজা-রাজরাদের পৃষ্ঠপোষকতার উপর নির্ভরশীল। মোজার্ট বলুন আর তানসেন সবাই রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন। সাধারণ মানুষের জন্য সেই অর্থে শাস্ত্রীয় সংগীত রচনা করাও হয়না। আমাদের দেশের নব্বই ভাগ লোকের সাধারণ নন্দনতাত্ত্বিক রুচিই যেখানে খুব একটা উচ্চাঙ্গের না, সেখানে শাস্ত্রীয় সংগীত জনপ্রিয় হবে কীকরে? এই মার্গ সংগীত বেশ দীর্ঘ, এ সংগীত উপভোগের জন্য যথেষ্ঠ ধৈর্য্য ও জ্ঞানের প্রয়োজন। মানুষের হাতে অত সময় কোথায়? গান বোঝার জন্য মানুষকে দশ/আটচল্লিশ ঠাট, ধ্রুপদ-ধামার-দাদরা, তীব্রা-কুমুদ্বতী-ছন্দা, কোমল আর কড়ির পার্থক্য, বা মীড়-গমক-পকড়-তান-সম-ফাঁক বুঝে আসতে হবে এটা জানা থাকলে কজন এই সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হবে সেটা বলাই বাহুল্য। এছাড়া রয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদীদের মার্গ সংগীতের বিরুদ্ধে অবিরাম প্রচার করে যাওয়া প্রোপাগাণ্ডা।
চট্টাগ্রামে '' সদারঙ্গ '', '' রূপক '', '' সুরতীর্থ '' এরকম কিছু মার্গ সংগীতের স্কুল সারাদেশের উচ্চাংগ সংগীত শিল্পীদের দিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করিয়ে থাকে। উদ্দেশ্য এই সংগীতের পরিচিতি বাড়ানো এবং সংগীতটাকে আরো মানুষের কাছে কীকরে জনপ্রিয় করে তোলা যায় তা। ঢাকায়ও নিশ্চয় অনেক প্রতিষ্ঠানই চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে তারপরও শুধুমাত্র পূর্ণাঙ্গ আলাদা একটি সাংগীতিক ধারা হিসেবে মার্গ সংগীত আমাদের দেশে তেমন জনপ্রিয় হচ্ছে না। এটার জন্য আসলে দায়ী অনেকগুলো ব্যাপার। শিক্ষা, রাজনীতি, পশ্চিমা রক সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ, শিল্পীদের দূর্বল পরিবেশনা ইত্যাদি।
আরেকটা জিনিস, যে দেশে গুণীর কদর নেই, সেই দেশে গুণও জন্ম নেই না। বারীণ মজুমদারের মত উঁচুমাপের একজন শিল্পী, যিনি বাংলাদেশের প্রথম মিউজিক কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁকেও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জেলে যেতে হয়, যেখানে মার্গ সঙ্গীত নিয়েও রেষারেষি, দলাদলি, তুমি আমার থেকে বেশী বোঝ? টাইপের মানসিকতা বিরাজ করে শিল্পীদের মাঝে, সেখানে এটা যে কতদিন টিকতে পারবে কে জানে?
অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।
ধন্যবাদ।
উত্তর ভারতে "ক্ল্যাসিকেল গান" বলতে বলতে উত্তর ভারতীয় তথা হিন্দুস্থানী সঙ্গীত পদ্ধতিকেই বোঝায়। আরো বড় অর্থে ভারতীয় রাগসঙ্গীত বা ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিকেল মিউজিক বলতে উত্তরভারতীয় ও কর্ণাটকী সঙ্গীত উভয়কে বোঝায়। আপনি যে "কালোত্তীর্ণ" বা "চিরকালীন" অর্থে "ক্লাসিকেল" শব্দের প্রয়োগ করেছেন তা যথার্থ। কিন্তু আমি যাদের কথা বলেছি অর্থাৎ আমার বন্ধু, ছোটভাই ও বড় ভাইয়েরা এই অর্থে প্রয়োগ করত না- তা কিন্তু আমি স্পষ্ট করে বলেছি!
এখানে সনাতনী বলতে আমি মার্গসংগীতকেই বুঝিয়েছি এবং সামান্য মুড়কি -খটকা থাকলেই তারা গানকে এই জাতীয় "ক্ল্যাসিকেল" পর্যায়ভুক্ত করত!
সঙ্গীত জগতের নোংরা রাজনীতি সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল। কিন্তু এসব থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে।
বারীন মজুমদার তাঁর যোগ্য সম্মানও পাননি এবং তাঁর পুত্রও পিতার তুলনায় খুবই সামান্য এক শিল্পী -একথা বোদ্ধামাত্রই বলবেন। বাপ্পা অবশ্য সৎভাবে স্বীকার করেছেন যে তালিম অসম্পূর্ণ থাকার কারণেই তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে আসার সাহস করেননি।
চট্টগ্রামের স্বর্ণময়বাবু একজন বড় গুণী- তাঁকে ক'জন চেনে।
আমি কিন্তু আপামর জনসাধারণ বোদ্ধা হবে- তা বলিনি। আমি শুধু এটুকু চেয়েছি যে যারা শেখে তারা যেন সঠিকটা শেখে আর যারা সুর বা মেলোডি ভাল বোঝেন শুধু তাদেরই এ গান ভালো লাগবে- সেকথাও কিন্তু বলেছি।
আপনার সাথে ভবিষ্যতে সাঙ্গীতিক আড্ডার ইচ্ছে রইল।
অলয়
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত কোনকালেই খুব জনপ্রিয় ছিল না। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের স্বর্ণযুগ বলে যেই কালগুলোকে চিহ্নিত করা যাবে সেই কালেও এর চর্চ্চা ও অনুষ্ঠান ধনীলোকের দরবার/বৈঠকখানা/আসরে সীমাবদ্ধ ছিল। আমজনতা তখনও এবং এখনো নিবিড়ভাবে লোকসঙ্গীতের চর্চ্চা করে যাচ্ছে।
এটা ঠিক যে একটা সময়ে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চ্চার জন্য যে পরিমাণ ব্যক্তিপর্যায়ের পেট্রন/স্পন্সর পাওয়া যেতো এখন অমনটা পাওয়া যায় না। তবে এখন অনেক কিছুই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় বা সংঘের তত্ত্বাবধানে চলে এসেছে। সুতরাং পৃষ্ঠপোষকতার কায়দাটা পালটে গেছে কেবল। সবচে' বড় যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা হচ্ছে, সব শ্রেণীর মানুষ যেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত উপভোগ করতে পারে এমন ব্যবস্থাটা হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ব্যাপারটা এখনো একটু পিছিয়ে আছে আছে (অবশ্য কবেই বা এগিয়ে ছিল!), তবে সে অবস্থার ধণাত্মক পরিবর্তনই ঘটবে। এটা আশাবাদ নয়, স্বাভাবিক নিয়মেই হবে।
অটঃ অরুণ ভাদুড়ী আর অজয় চক্রবর্তী নিয়ে আলোচনায় মনে হল তাঁদের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের অনুষ্ঠানগুলো আপনি সম্ভবতঃ অ্যাটেন্ড করেছেন। আহা! সেই অনুষ্ঠানগুলোতে আমিও ছিলাম।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আপনার সাথে একমত। হ্যাঁ খুব জনপ্রিয় ছিল না। কিন্তু সূচনালগ্নে পল্লীগীতির পরই ছিল জনপ্রিয়তায় এর স্থান। আমি হাভেলি সঙ্গীতের এবং প্রবন্ধগানের যুগের কথা বলছি, অর্থাৎ প্রাক-ধ্রুপদ যুগের কথা। তানসেন ধ্রুপদের মূল ধারক এবং সম্রাট আকবর তাঁর পৃষ্ঠপোষক হবার পর ধ্রুপদ দরবারে বেশি জনপ্রিয় হয়, যদিও তার আগেও দরবারী সঙ্গীতের অস্তিত্ব ছিল, মূলত গোয়ালিয়রের রাজদরবারে।
স্বাভাবিক নিয়মে হবে না। তানপুরোর দুই তার বাজানো এবং ঘণ্টা দেড়েক বাজিয়ে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক ঘটনা। আপনি কি অরুণবাবুর প্রোগ্রামে এটা খেয়াল করেছিলেন? অরুণ বাবুর ইন্টারভিউ মিস করেছি তরিঘড়ি পিএস,সির ফর্ম জমা দিতে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় এসে। এই আফসোস এ জীবনে কাটবে না!
অজয় চক্রবর্তীর অনুষ্ঠানের খবরই পাইনি। বুঝুন প্রচার মাধ্যমের ঋণাত্মক ভূমিকা! আমার এক বন্ধুর কাছে পাস ছিল। সে হেলায় সুযোগ হারিয়েছে, কারণ অজয় চক্রবর্তী কী বালাই তা সে জানে না! আমরা যখন নটর ডেম কলেজে ছিলাম তখন অজয় চক্রবর্তীর খেয়াল ও বাংলা রাগপ্রধান গানের অ্যালবাম বায়তুল মোকাররমেও খুব সহজলভ্য ছিল। এখন গিয়ে বাজার-চলতি ক্লোজ আপ ওয়ান ইত্যাদি অয়ালবাম ছাড়া কিছু পাওয়া ভার।
আমি তানপুরাবাদনের যে নমুনা দেখলাম এবং ছায়ানটের অনেক ভালো গাইয়েরও জ্ঞানের ও গুণের যে সমস্ত ঘাটতি দেখেছি তাতে আশা করতে ভয় পাই। তবে কিছু অসাধারণ তরুণ শিল্পীকে চিনি। এরা যদি তালিম পায় তো দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। তবে সত্যি কথা বলতে টি,ভির ভূমিকা আরো ভালো হত হবে। দেখুননা , বেঙ্গলের প্রোগ্রামগুলো আদৌ প্রচারের মুখ দেখে কিনা! ওরা বলছে টিভিতে প্রচার হলেই ওরা ইউটিউবে ছাড়বে এবং সিডি বাজারজাত করবে!
অলয়
চমৎকার লেখা। আরো চাই। সচলায়তনে স্বাগতম।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
চমৎকার লেখা। এক নিমিষে পড়ে ফেলার মত।
অপাত্রে প্রশংসা করলেন।
আর বলবেন না, যতগুলো লেখা দিয়েছি প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু প্রথম দিকের চার-পাঁচটা লেখা বেনামে যাওয়াতে বোধহয় অতিথি হিসেবেও সচল হতে পারিনি এখনো। নীচে নাম লেখার কায়দাটা রপ্ত করেছি কিছুদিন হোল।
ধন্যবাদ
অলয়
সেরেছে! বিগত তিনটি লেখাও অর্ধেক নাম দিয়ে পোস্ট করেছি। এখন মডুপ্যানেলের মেইল চেক করে দেখলাম পুরো নাম ব্যবহার করেছি।
নির্ঝর অলয়
অনেক বলেওতো গোপন রেখে দেয়া গেল পিতৃ-মাতৃ প্রদত্ত নামপরিচয়। আমিও কাউকে না বলে আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই। শুরু হতে পারে
তে আপনার সদয় একটি চিঠি দিয়ে। সম্ভব? একটা আরজি আছে। একটা নিমন্ত্রণও জানাবার পথ খুঁজছি।
আমি ষষ্ঠ- পাণ্ডব এর কথার সাথে একমত। আসলে আমি মনে করি, বেশির ভাগ মানুষই classical music এর সরগম, পাল্টা, মীড় তালিম নেয় গলার flexibility বাড়ানোর জন্য, যাতে notation, patterns এবং range এর সাথে easily adapt করতে পারে।এগুলো চর্চা করলেই যে সংগীত জ্ঞান যথাযত হবে তার surety দেয়া যায় কি? এমন সঙ্গিতজ্ঞ কেও জানি যে অনেক বছর চর্চা করে গলা দিয়ে গলাবাজি করলেও শ্রবনেন্দ্রিয় এর তেমন উন্নতি ঘটাতে পারেনি।
এগুলো চর্চা করলেই যে সংগীত জ্ঞান যথাযত হবে তার surety দেয়া যায় কি? এমন সঙ্গিতজ্ঞ কেও জানি যে অনেক বছর চর্চা করে গলা দিয়ে গলাবাজি করলেও শ্রবনেন্দ্রিয় এর তেমন উন্নতি ঘটাতে পারেনি।
দেখুন এ বিষয়ে কোন নিশ্চয়তা আমি দিই নি। কারণ তা দেয়া যায় না। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁ সাহেব বলতেন, "ইয়ে হাওয়া কি সাথ খেলনা। হাওয়া কিসিকে বসমে নেহি রেহতা"- অর্থাৎ সুর কারো পোষা গোলাম নয়। অনেক সময় বহু সাধনায়ও তা আয়ত্ত্বে আসে না।
প্রথমত, সঙ্গীতশিক্ষা আসলে তাদেরই প্রকৃত উপকারে আসে, যারা প্রকৃতিপ্রদত্ত সুর ও লয়বোধের দুর্লভ ক্ষমতার অধিকারী। এটা আর কিছুই না। অনেক বাচ্চাকেই দেখবেন, যেটা শুনছে হুবহু গলায় অনুকরণ করছে বা হাতে তালি দিচ্ছে ছন্দের সাথে। এটা খুব বেশি বাচ্চা পারে না। অনেক বাচ্চাই সঙ্গীতপ্রিয় হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ একদম সুরে গায়, কেউ কেউ মোটামুটি সুরে গায়, কেউ কেউ বেসুরো। -এই তৃতীয় গোত্রের শিশুরা বহু তালিম পেলেও আসলে প্রকৃত শিল্পী বা বোদ্ধা হওয়া প্রায় অসম্ভব। আবার বহু লোক আছে যারা সুর-বধির। তারা স্রেফ ফ্যাশনের তাগিদে সঙ্গীতচর্চা করেন। তাদেরকেও শিখিয়ে আসলে কোন লাভ নেই কারণ এরা সুর-তালের মজাই বুঝবে না, সুর এদের কাছে বিরক্তিকর।
আচ্ছা, বহু বছর চর্চা করেও যে শ্রবণেন্দ্রিয়ের উন্নতি ঘটাতে পারে নি- এমন সঙ্গীতমূর্খ ও সুরবধিরকে "সঙ্গীতজ্ঞ" বলার কারণ কী? এমন অনেকেই আছেন। এটা তাদের দুর্ভাগ্য। এরা আসলে নিজেদের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখে না।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
লেখাটি আমাদের আসন্ন শাস্ত্রীয় সংগীত সম্মিলনের স্মরণিকায় ছাপবার ব্যাপারে লেখকের সাথে কথা বলতে চাই। # ০১৭১২-৯৬১-৪৭১
নতুন মন্তব্য করুন