সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রমণ সমগ্র-২: দানব ও দেবতা

নির্ঝর অলয় এর ছবি
লিখেছেন নির্ঝর অলয় [অতিথি] (তারিখ: শনি, ২১/০৯/২০১৩ - ৬:৫২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই বইটার দ্বিতীয় অংশ নিয়ে আলোচনা শুরু করতে অনেক দেরি হয়ে গেল। জীবন যাপনের গ্লাণি, অবসাদ, আলস্য, অনেক কিছুই এর কারণ। যাই হোক প্রারব্ধ কাজটা এই বেলা সেরে নেয়া যাক। সঞ্জীবের ভ্রমণসমগ্রের দ্বিতীয় বইটি নিছক ভ্রমণ কাহিনী নয়। এতে আছে বিশ্বরাজনীতির কূটকচালবর্জিত সার-সংক্ষেপ, মায়া সভ্যতার নানান বিস্ময়, স্প্যানিশদের দক্ষিণ আমেরিকায় জবরদখল, লুঠতরাজ ও বর্বরতা আর সর্বোপরি আছে লেখকের আশ্চর্য সারল্য ও নিজেকে নিয়ে রসিকতা করার বিরল সাহসী মানসিকতা।

আন্দামান ভ্রমণের মত লেখকের এবারের ভ্রমণও অকারণে নয়। এবারে তিনি নেহেরু পরিবারের কনিষ্ঠতম জ্যোতিষ্ক রাজীব গান্ধীর ভ্রমণসঙ্গী। শুরুতেই আণবিক বোমা আর স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, দানবের উল্লাস। সেখান থেকে আরেক দানবীয় অভিশাপের গল্প- জাতিবিদ্বেষ। লেখকের ভাষায় –“ আরেক পরমাণু বোমা মানুষের ঘৃণা। মানুষের প্রতি মানুষের বিদ্বেষ। পরমাণু বোমা একবারে একলপ্তে মারে। বর্ণবিদ্বেষ মারে ধীরে ধীরে, তিলে তিলে। নিয়তই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সাদা চামড়ার হাতে মরছে কালো মানুষ। তাদের হাটে মারা হচ্ছে, তাদের ভাতে মারা হচ্ছে। কে যেন প্রশ্ন করেছিলেন, পৃথিবীটা মানবের না দানবের!”

শুরুতেই বিস্তর ঝামেলা পুইয়ে লেখক কোলকাতা থেকে দিল্লীতে। তাঁর ভাষায় “সাতশো বছর আগে দিল্লী ছিল মোগল সংস্কৃতির পীঠস্থান। নাচ, গান, বাজনা, কবিতার। এখন আমলা, এম,পি আর সন্ত্রাসবাদীদের বিচরণভূমি। কোথায় ঠুমরির চলন, কোঠায় ঘুংরুর বোল।” পরবর্তী গন্তব্য লন্ডন, বর্ণবাদ-বিরোধী কনফারেন্সে যোগ দিতে, রাজীবের সহচর হয়ে। “ তোমরা কালো, তোমরা আফ্রিকান এই বোধটা কারা তৈরি করল, সাদা চামড়া, সাদা দুনিয়ার মানুষ। আধুনিক আফ্রিকার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ভাগ্য বিড়ম্বনার সবচেয়ে মর্মান্তিক দিক হল ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদ ডেঁড়েমুশে শোষণ তো করলই আর সর্বাঙ্গে দেগে দিল একটি শব্দ, ‘আফ্রিকা’। ষোড়শ শতকে ইউরোপীয় মানচিত্র প্রণেতা জেরহার্ড মার্কেটারের মানচিত্র জাতিবৈষম্যের এক নতুন ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত রাখল। এখানে দেখানো হল পৃথবী উত্তরগোলার্ধের দেশগুলো দক্ষিণ গোলার্ধের চেয়ে অনেক বড় আর এখানকার মানুষও শক্তিতে, বুদ্ধিতে শ্রেয়তর! সারা পৃথিবীতে নানাভাবে ছড়িয়ে আছে এই জাতিবৈষম্যের পৈশাচিক থাবা। তাই আশ্চর্য শ্লেষমিশ্রিত কণ্ঠে সঞ্জীব বলেন, “ ইংল্যান্ডের আপেল আর ভারতের আপেলে বিশেষ ফারাক নেই। অথচ ইংল্যান্ডের মানুষ (বইতে আছে আপেল!) আর ভারতের মানুষের কত তফাত।”

মার্লবরো হাউজের কনফারেন্সের বিষয় গুরুতর। বর্ণবৈষম্যের নীতির কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হবে কিনা, সেটাই আলোচ্য। মার্লবরো হাউজের উলটো দিকের ফুটপাথে ফেস্টুন হাতে প্রতিবাদ করছেন কিছু বিবেকবান ইংরেজ। “ডিসম্যান্টল অ্যাপার্থিড, ডাউন উইথ অ্যাপার্থিড, ফাইট অ্যাপার্থিড, ফ্রি সাউথ আফ্রিকা।‘’ রাস্তা বন্ধ করে নয় বরং শান্তিপূর্ণ উপায়ে ফুটপাথে চলে তাদের আন্দোলন।
জাতিবিদ্বেষ প্রসঙ্গে যৌক্তিক ভাবেই এলেন মার্টিন লুথার কিং। আততায়ীর বুলেটে তাঁর মৃত্যুর পর সহিংস হয়ে উঠল কৃষ্ণাঙ্গরা। সঞ্জীব বলছেন, “সারা জীবন যিনি ছিলেন অহিংসার পূজারি, তাঁর মৃত্যুকে তাঁর ভালোবাসার মানুষেরা বরণ করে নিল হিংসার পথে। এ যেমন দুঃখের তেমনি পরিহাসের। দেশ যাদের নরক ছাড়া কিছু দিতে পারেনি, যে বস্তির অন্ধকারে অসন্তোষ এতকাল ধোঁইয়াচ্ছিল সেই অসন্তোষ সারা জাতির ওপর ফেটে পড়ল একটি মাত্র বুলেটে। এত বড় মারমুখী আন্দোলন আমেরিকার মানুষ আগে কখনো দেখেনি।“ ্কথা প্রসঙ্গে এল উইনস্টন চার্চিলের শ্বেত-দুনিয়ার স্বাধীনতার দলিল আটলান্টিক চার্টার, রুজভেল্টের তুলনামূলক উদার দৃষ্টিভঙ্গি। দক্ষিণ আফ্রিকার বুক থেকে ভারতবর্ষের বুকে অহিংসা আর মুক্তির বাণী নিয়ে আবির্ভূত হলেন মহাত্মা গান্ধী –সবই বিধৃত হয়েছে সঞ্জীবের কলমে। আফ্রিকায় ইউরোপীয়দের নির্মম শোষণ, আর আফ্রিকানদের মুক্তির সংগ্রাম আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। সমান্তরালে বয়ে চলে ভ্রমণ, লন্ডনের কর্মব্যস্ত জীবন, আলোকিত রাত্তির, উন্নত কাজের পরিবেশ ইত্যাদি নিত্যদিনের কড়চা।

পরবর্তী গন্তব্য মেক্সিকো। সৌন্দর্যে, তারুণ্যে উচ্ছ্রিত মেক্সিকো। মায়া সভ্যতার পীঠস্থান মেক্সিকো। স্প্যানিশ সাম্রাজ্যবাদের বর্বর শিকার মেক্সিকো। মেক্সিকোর জীবনোচ্ছ্বাস লেখকের ভাষায় ধরা পড়ে এভাবে- “ বেশ বোঝা যাচ্ছে, এ রাত শেষ হবে না। তারা জাগছে, জাগছে সমুদ্র, জেগে আছে প্রেম। যতদিন জীবন আছে, নেচে যাও, প্রেম করে যাও।” সম্মেলনে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কিজের অতুলনীয় সাহিত্যিক ভাষণ, ঠিক তার পরই কার্ল সাগানের তথ্যবহুল বক্তৃতার বিবরণ আমাদের চমৎকৃত করে।

ইকসতাফায় লেখকের ভ্রমণসঙ্গী হন মায়া সভ্যতার ওপর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী মার্কিন তরুণী অ্যান। স্বভাবতই কথাচ্ছলে আমাদের সামনে মায়া সভ্যতার বিপুল ঐশ্বর্য আর মায়ানদের সরল কিন্তু ঋদ্ধ, ঋজু কিন্তু মহীয়ান জীবনের এক অপরূপ ছবি ফুটে উঠেছে। মায়া সভ্যতার ওপর স্প্যানিয়ার্ডদের ভ্যান্ডালিজম মানুষের মূর্খতা ও অসূয়ার এক অসুস্থ নিদর্শন। কনকুইস্তাদর কর্টেস আসার আগের সেন্ট্রাল মেক্সিকোর লোকসংখ্যা ছিল আড়াই কোটি, ৩০ বছরে তা নেমে গেল ষাট লাখে। কিন্তু যুগে যুগে এ রকমই হয়ে এসেছে। বিজয়ীর তরবারির রক্ততৃষা ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে মানুষের বিপুল অর্জন। সভ্যতা প্রায়ই পশ্চাদগামী হয়। এই আশঙ্কা যাদের বুকে থাকে না, তারাই বিলুপ্ত হয়। অ্যানের সাথে লেখকের এক অদ্ভুৎ প্লেটোনিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, কখনো মায়ের মত, কখনো প্রিয়ার মত, কখনো বন্ধুর মত, কখনো অভিভাবকের মত।

সঞ্জীবের অন্যান্য লেখার মতই এই বইয়ের গুণ তাঁর নিটোল হাস্যরস, কখনো শ্লেষাত্মক তীর্যক বাক্যের সার্থক ব্যবহার। নিজেকে নিয়ে রসিকতা করায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। পুরীর বিশাল ঢেউয়ে নাজেহাল পাড়ার বোকাদার দুর্দশার বিবরণ তিনি দেন, “ তৃতীয় ঢেউ আবার তুলে আছাড়। শরীরের সব খিল খুলে গেল। গিয়েছিল বীরপুঙ্গব, ফিরে এল ঝুলঝুলে নাচের পুতুল হয়ে।“” আবার একই সঙ্গে ইঙ্গিত দিচ্ছে গভীর জীবনবোধ, “দেশ মানে তটভাগে আছড়ে পড়া সমুদ্র নয়, একসার মাথা উঁচু গাছ নয়, কয়েক হাজার ঢ্যাঙা আধুনিক বাড়ি নয়। বিশাল হোটেল, ক্লাব, সুন্দরী রমণীর নৃত্য নয়, বহুতল বিপণিতে ঢুকে পাগলের মতো কেনাকাটা নয়। দেশ মানে যন্ত্রণা। যন্ত্রণা থেকে উদ্ভূত আনন্দ। দেশ যেন মা। কত যন্ত্রণায় জন্ম নেয় বর্তমান। পরিচারিকা, সেবিকা এসে মাতার ললাটের স্বেদ মুছিয়ে দিয়ে বর্তমান নামক শিশুটিকে তুলে ধরেন। হাসি ফোটে মায়ের মুখে। দেশ মানে ধূলিকণায় শুকিয়ে থাকা বিজেতা ও বিজিতের রক্ত। দেশ মানে নিগৃহীতের ক্রন্দন ও নিগ্রহকারীর নিষ্ঠুর উল্লাস মিশে উত্থিত এক সঙ্গীত।”

বইটার মূল দুর্বলতা আমার মতে প্রগলভতা। অনেক কিছুই এত বেশি বিস্তৃত ও ফেনিল হয়ে গেছে যে, মূল ঘটনায় ফিরে আসা কিছুটা দুস্কর হয়ে পড়ে। ভাষার প্রসাদগুণে পড়তে মন্দ না লাগলেও এতে রচনার গাঁথুনী দুর্বল হয়ে পড়ে। ভ্রমণকাহিনী ইতিহাস নয়। ইতিহাস এখানে আলো দেবে, মেঘমুক্ত সূর্যের মত, কিন্তু উত্তাপে না পোড়ালেই ভালো।

সব কিছু মিলিয়ে বইটা বেশ ভালোই লাগে। তবে লেখকের শর্ত মেনে নিয়ে এঁকে স্রেফ ভ্রমণকাহিনী হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। তাহলে বেজায় ঠকতে হবে!

(ভবঘুরে সম্রাট তারেক অণুদাকে ব্লগটি উৎসর্গ করছি)


মন্তব্য

Emran  এর ছবি

বইটার মূল দুর্বলতা আমার মতে প্রগলভতা।

সহমত। এই বৈশিষ্ট্য (lack of economy) সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের আরও কিছু লেখায় লক্ষ্য করেছি; যেমন, লোটাকম্বল (২য় খণ্ড)।

 মেঘলা মানুষ এর ছবি

লোটাকম্বল ২ অনেকটাই 'কেমন কেমন যেন ঘটনাটা' করে পড়েছি, অনেক বেশি পরিমাণে ম্যাজিকের আধিক্য বইটাকে লৌকিক দুনিয়া থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

সহমত। সঞ্জীবের পরিমিতিবোধ কম। তবে ওঁর "নবেন্দুর দলবল" সত্যি অপূর্ব। যদিও ওখানেও হঠাৎ করে গল্পের উত্তম পুরুষ বদলে যায় কোন ইঙ্গিত ছাড়াই!

তানিম এহসান এর ছবি

ভাল লাগলো লেখাটা।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ তানিম ভাই। বইটার আয়তন অনুযায়ী রিভিউ লিখতে আসলে বেশ বেগ পেতে হয়েছে।

গান্ধর্বী এর ছবি

বইটা পড়তে ফেলতে হবে দেখছি!

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

(ভবঘুরে সম্রাট তারেক অণুদাকে ব্লগটি উৎসর্গ করছি)

অ্যাঁ এমন ডিসিপ্লিন্ড ভবঘুরে জীবনে দেখি নাই

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

শৃঙ্খলাবদ্ধ উচ্ছৃংখল! অ্যাঁ

মন মাঝি এর ছবি

কোন কোন লেখক অনেক সময় নিজেই নিজের কথার বুদ্ধিদীপ্ততা বা রসদীপ্ততা-র প্রেমে পড়ে যান। ফলশ্রুতি - প্রগল্‌ভতা। সঞ্জীবের প্রগল্‌ভতা কি সেরকম কিছু মনে হয়েছে?

****************************************

এক লহমা এর ছবি

ঠিক তাই, সঞ্জীবের প্রগল্‌ভতা আমার বরাবর সেরকমই লেগেছে। তাই প্রথম দিকে যতটা পছন্দ করতাম, পরে সেটা কমে গিয়েছিল।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, অত্যন্ত সুচিন্তিত একটি প্রসঙ্গ উত্থাপনের জন্য।

সঞ্জীবের কিছু কথকতা সত্যি অপূর্ব রসদীপ্ত। কিন্তু কথার তোড়ে প্রায়ই গল্প যায় ভেসে। লোটাকম্বলটা শেষ করতে পারিনি- কিছু অংশ খুব বিরক্ত করছিল। আমার চেখভ (উচ্চারণটা ঠিক হোল কি?) আর সত্যজিৎ ভীষণ ভালো লাগে। চেখভের মতে সংক্ষিপ্ততা প্রতিভার জননী।

শুধু কথার দীপ্তিতে মাতিয়েছেন রবিঠাকুর তাঁর গদ্যে। প্রমথ চৌধুরী, প্রমথনাথ বিশী, যাযাবর এবং মুজতবা আলীর বাক্যগুলো মনে একেবারে মুক্তোর মতো জমে থাকে। আমার তো পানরাজ শিব্রাম আর নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ও অপূর্ব লাগে। ইংরেজিতে কোনান ডয়েলের বাক্যগুলো বেশ মনে থাকে।

আসলে সাহিত্য নিয়ে আমার মতো আকাটের বিশ্লেষণাত্মক মন্তব্য করার যোগ্যতা নেই একেবারেই! মন খারাপ

এক লহমা এর ছবি

সঞ্জীবের লেখা নিয়ে আপনার লেখা ভাল লাগল।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। তবে এ লেখাটা আসলেই দায়সারা হয়ে গেছে। সেজন্যে দুঃখিত।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।