আমাদের শিক্ষাঙ্গনে অবকাশ

নির্ঝর অলয় এর ছবি
লিখেছেন নির্ঝর অলয় [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ১১/০৪/২০১৪ - ৯:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গত পরশু সকালে কলেজে গিয়েই শুনলাম সেকন্ড ইয়ারের একটা ছেলে কলেজের ১৫ তলার ছাত থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। একজন শিক্ষক দেখে ফেলায় ছেলেটি প্রাণে বেঁচে যায়। ছেলেটির আত্মহননের চেষ্টার কারণ পড়াশোনার তীব্র চাপ, বায়োকেমিস্ট্রির একগাদা পেন্ডিং আইটেম(মেডিকেল কলেজের ক্লাস-টেস্ট তথা টিউটোরিয়াল)। মনটা ভারী হয়ে গেল। আইটেম নেয়ার ফাঁকে এ নিয়ে ছাত্রদের সাথে দু-একটা কথা বললাম। স্কুল থেকেই চলছে এই অসুস্থ মধ্যবিধ সম্প্রদায়ের অসুস্থ ইঁদুর-দৌড়। আমাদের শৈশব-কৈশোর এতটা নির্মম ছিল না। এতটা ইঁদুর-কল ছিল না স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। এখনকার স্কুল-কলেজ-মেডিকেল কলেজ পড়ুয়াদের জীবন দেখলে আমি বিহ্বল হয়ে পড়ি। বাস্তবিক পক্ষে এদের কোন ছুটি নেই। স্কুল যদি কোন কারণে লম্বা ছুটি দিচ্ছে তো স্কুলেই কোচিং ক্লাস চলছে। এস,এস,সির পর কলেজ ভর্তি কোচিং, এইচ,এস,সির পর বুয়েট-মেডিকেল-ভার্সিটি ভর্তির কোচিং, পাশ করার পর সাত রাজার ধন এক মানিক- চাকরী মেলার পর বস তথা কর্পোরেট-দালালদের তুষ্ট করার জন্য রোবটের মত কাজ করে অফিসকে নিজের ডেরা বানানো- মোটামুটি এই দাঁড়িয়ে গেছে আমাদের জীবন। তরুণ ডাক্তারদের অবস্থা তো জঘন্য, ঢাকায় জীবন-ধারণের টাকাটা উপার্জন করতে তাঁদের সপ্তাহে ৭২-৮৪ ঘণ্টা কাজ করতে হয় এবং এই থেকে তাঁদের আয় হয় ৩০-৩২ হাজার টাকা- যে টাকাটা তাঁদের সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টাতেই প্রাপ্য। এই অসুস্থ বিদ্যা-ব্যবসা আমাদের জন্য শুভ নয়। শিক্ষার নামে মানবিকতা বর্জিত এই বিরামহীন নিষ্পেশনযন্ত্র আমাদের কিছু কলের মানুষ উপহার দেবে, মানুষ নয়। কিছু শিক্ষার্থী নিজ যোগ্যতায় মানুষ হবে ঠিকই কিন্তু এই কৃষ্ণগহ্বর তাদের গ্রাস করে নেবে। সমাধানের পথ ভাবা উচিত এখনই।

“There’s no point in bringing a baby into the world if all that it’s going to do is work to go on living, to go on living and work to go on living again. If that’s all the point of life then what are we here for?” – প্রোফেসর রিচার্ড ডকিন্সের একটা লেকচারে এই কথাগুলো খুব মনে ধরেছিল। অথচ এর ঠিক উল্টোটাই হয় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়। আমাদের স্কুলে একটি কুখ্যাত আইন করা হয়েছিল- “বিদ্যালয় প্রাঙ্গণের কোথাও কোন ধরণের খেলাধূলা করা যাবে না।“ মনে আছে স্কুল ছাড়ার দিন ডায়াসে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়ে আমি আবেগে ভেসে না গিয়ে স্কুলের এই কালা-কানুনসহ কয়েকটি অসঙ্গতির তীব্র সমালোচনা করি। এখন সেভেন পড়ুয়া ছোট ভাই অর্জুনের মুখে শুনতে পাই বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কালা-কানুনটি রদ করেছে। কিন্তু ছাত্রদের এখন আর খেলার সময় নেই একদম! আমি যে সময়কার কথা বললাম তখন আমাদের এই স্কুলটি কাগজে-কলমে দেশের সেরা স্কুল নির্বাচিত হয়েছিল তৃতীয়বারের মত। গত বছর গরমের সময় অর্জুনকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোদের গরমের ছুটি-টুটি দেয়?”
“হ্যাঁ দেয় তো! এই মাস তো প্রায় পুরোটাই ছুটি।“
-তাহলে দিনরাত ব্যাগ নিয়ে কোথায় ছুটছিস?
-কেন ছুটির মধ্যে কোচিং হবে স্কুলে।
আমি প্রমাদ গুণলাম। এ কেমনতর ছুটি? 'ছুটির দিনে ছুটোছুটি'র বদলে কোচিং! এর চেয়ে আমাদের সেই সাত দিনের নিশ্চিন্ত “আমের ছুটি”ই ভালো ছিল। ২০ দিনের ছুটির নামে এরা পেল কোচিং এর জাঁতাকল। অজানতেই পুঁজির কাঁচামাল হয়ে গেল কচি-কাঁচার দল!
মেডিকেল কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় আমাদের এনাটমির ব্যাচ-টিচার ফাতেমা ম্যাডাম বলেছিলেন, “ছুটি ছুটি করেই আমাদের জাতটা গেল। বাইরের ওরা খালি কাজ আর কাজ করে।” আমি তখন মৃদু প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গিয়েছিলাম পণ্ডশ্রম হবে ভেবে। কেন আমাদের ছুটির জন্য এত ছোঁক-ছোঁক? আমরা কি ভেবে দেখেছি? বৈধ ছুটি কম বলেই কিন্তু এত অঘোষিত ছুটি, ক্যাম্পাসে অটো-ভ্যাকেশন ইত্যাদির প্রাদুর্ভাব! ‘বাইরের’ মতো কিন্তু আমাদের ১ মাসের টানা কোন ক্রিসমাসের ছুটি নেই। আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, মেডিকেল কলেজগুলো, সব সরকারী স্কুল-কলেজ সপ্তাহে ৬ দিন খোলা থাকে। ৬দিন খোলা থাকলে শেষ দিনটি হাফ-ডে হবার রীতিটিও মেডিকেল কলেজে মানা হয় না। স্কুলে আমাদের সময় মানা হত। এখন কী হয় জানি না। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, নটর ডেম কলেজ, হোলি ক্রস কলেজ, বি,এফ শাহীন কলেজ এবং একমাত্র মেডিকেল কলেজ হিসেবে আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ সপ্তাহে ৫ টি কর্মদিবসের প্র্যাকটিস অত্যন্ত সফলভাবে করে চলেছে। নটর ডেম কলেজে আমাদের সব সময়ই উইকেন্ডের জন্য পড়া না জমিয়ে উইকেন্ড ‘ইনজয়’ করার পরামর্শ দিতেন প্রোফেসাররা। ‘বাইরে’ কিন্তু আমাদের জন্মেরও আগে থেকে সপ্তাহে ২ দিন ছুটির চল (মোটামুটি পাঁচ এর দশক থেকেই!) এবং কোন মূল্যেই উইকেন্ড মাটি করতে রাজি হতে চায় না ‘বাইরের’ লোকেরা। আমাদের দেশে ঈদ-পুজো-বড়দিন-বৌদ্ধ পূর্ণিমা ও জাতীয় দিবসগুলোতে যে ছুটিগুলো থাকে সেগুলোর ইফেক্টিভিটি কিন্তু ‘বাইরে’র লম্বা সামার ভ্যাকেশনের মত না। টানা কোন ছুটিই আমাদের দেশে নেই। ভারতে বেশ লম্বা পুজোর ছুটি আছে। আর সপ্তাহে একদিন ছুটি আসলে কোন ছুটিই না। ওই একদিন মানুষ তার যাবতীয় ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রয়োজনগুলো মেটানোর চেষ্টা করে। কাজেই এই নিয়মে প্র্যাকটিক্যালি কোন বিশ্রামই সে পায় না। আর্গোনমিক্সের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা স্বাস্থ্যের জন্য এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক- খুব বেশি বিপজ্জনক। ছাত্রদের তো কোন নৈমিত্তিক ছুটি বা অর্জিত ছুটি নেই। এই ছুটকো-ছাটকা ছুটি কিন্তু টানা ১ মাস ছুটির বা দুইদিন উইকেন্ডের কোন বিকল্প নয়। বাধ্য হয়েই তাদের মন বিদ্রোহ করে বসে, শুরু হয় অনুপস্থিতি কিংবা সবাই মিলে ‘অটো!’ কাজেই দুনিয়ার তাবৎ কাজ ‘বাইরে’র লোকে করে আর আমাদের দেশের লোকে শুধু ভেরেন্ডা ভাজে- এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা। আমাদের ফাঁকিবাজি বেশি, কিন্তু তার কারণ কেউ ভাবে না।

আমরা কি এটা ভেবে দেখেছি যে, বৈধ ছুটির অভাব কিন্তু ছাত্রদের ক্লাস ফাঁকি এবং কর্মচারীদের কাজ-ফাঁকির প্রধানতম কারণ। মানুষ যখন কাজের ন্যায্য মূল্য পায় না, কাজ যখন তার ব্যক্তিগত জীবন কেড়ে নেয় তখনই কিন্তু সে ফাঁকি দেয়া শুরু করে। পড়াশোনা বা কাজের জন্য বাড়ি থেকে কয়েকশো মাইল দূরে থাকা ছাত্র বা লোকটি মাসে অন্তত ১-২ বার বাড়িতে অসুস্থ পিতামাতাকে দেখতে যেতে পারবে না- এটা কোন সুস্থ নিয়ম হতে পারে না। আজকাল লোকে বই পড়া ছেড়ে দিয়েছে, জাফর ইকবাল স্যার তাঁর একটি অনবদ্য কলামে এ নিয়ে আক্ষেপ করেছেন। ভালো বই পড়তেও প্রয়োজন অবকাশ। ছাত্রদের মধ্যে এখন নাট্যচর্চা, বিতর্ক, ফিল্ম-ফেস্টিভ্যাল, ছবি-আঁকা, ভালো গানবাজনা শোনা –এসব প্রায় হারিয়েই যাচ্ছে। ছাত্ররাজনীতির প্রাণ ছাত্রসংসদগুলো অনির্দিষ্টকাল ধরে বন্ধ পড়ে আছে। কাজেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড স্তিমিত হয়ে পড়েছে। আমরা কিন্তু প্রায়ই সংস্কৃতির সংজ্ঞা ভুলে যাই। সংস্কৃতি কিন্তু জীবনের সর্বাঙ্গীন রূপ- নিছক কিছু কালচারাল প্রোগ্রাম মাত্র নয়! মানুষের যে সীমাবদ্ধ সামাজীকিকরণের প্রক্রিয়া আমাদের দেশে চলছে তার পরিণাম শুভ নয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুলে ঢুকতে কোচিং, অতঃপর ভর্তিযুদ্ধ, কচি কচি পিঠে পাহাড়পরিমাণ ব্যাগের বোঝা, পি,এস,সি, জে,এস,সি- স্কুল-ব্যাচ-কোচিং-দম ফেলার সময় পায় না ছেলে-মেয়েগুলো। তারপর মহাযুদ্ধ- এস,এস,সি! এস,এস,সির পরও ফুরসৎ নেই, কলেজে ভর্তিযুদ্ধ! কলেজে ঝোড়োগতির দেড় বছর শেষে এইচ,এস,সি এবং তারপর আবার ৩-৪ মাসের দীর্ঘ কোচিং শেষে “জীবনযুদ্ধ” অর্থাৎ বুয়েট-মেডিকেল-বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। অর্থাৎ চলমান প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা রোবটের মত বিরামহীন খেটে যায়, তাদের ‘কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ’ও মূল্যহীন, তাদের কোন ছুটি নেই, খেলতে তাদের মানা, তারা কোথাও বেড়াতেও যেতে পারে না। অথচ পাশের দেশেই পড়াশোনার তীব্র চাপের মধ্যেও শিক্ষার্থীরা সামার বা পুজোর ছুটিতে দেশ চষে ফেলছে। জয়েন্ট এন্ট্রান্স তারা নিয়ে ফেলছে এইচ,এস,সির দু সপ্তাহ পরই। অর্থাৎ ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি তারা নিচ্ছে উচ্চমাধ্যমিকের সমান্তরালেই। কাজেই জয়েন্টের পর বেশ ঝাড়া-হাত-পা হয়ে কাশ্মীর থেকে আন্দামান ছুটে বেড়ানোর একটা সুযোগ থাকে। তারপরও সেখানে শিক্ষাসংক্রান্ত আত্মহত্যা কম নয়। আমাদের মত সিস্টেম হলে তো ওদের বাঁচিয়ে রাখাই মুশকিল হত! উন্নত দেশগুলোর কথা বাদই দিলাম। তবে ওরা কিন্তু এমনিতেই উন্নত হয় নি। যৌক্তিক পদ্ধতিগুলোর নিয়মতান্ত্রিক অনুশীলনের মাধ্যমেই তারা উন্নতি করেছে। কাজেই ওটা পাশ্চাত্যের, এখানে বাতিল- এই মানসিকতা থেকে যেমন বেরিয়ে আসতে হবে তেমনি অন্ধ অনুকরণও বন্ধ করতে হবে।

শিক্ষার পরিবেশকে আরো সহনশীল ও জীবনঘনিষ্ঠ করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মান একটুও না কমিয়ে তাদেরকে অবকাশ দেয়া সম্ভব। সারা দুনিয়া যেটা পারে আমরা কেন পারব না? আমাদের শিক্ষার্থীরা, আমাদের তরুণরা মেধায় কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই। সাকিবের 'অরেঞ্জ জুস তত্ত্ব' এখানে বিফল! প্রথমত, অবিলম্বে সব সরকারী-বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সপ্তাহে ২ দিন ছুটি চালু করা উচিত। প্রতিদিনের ক্লাস এক ঘণ্টা বাড়িয়ে খুব সহজেই এটা করা সম্ভব। এতে করে শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে একটা দিন অন্তত বিশ্রাম পাবে। অবসর ছাড়া কোন সৃজনশীলতা হয় না। দ্বিতীয়ত, স্কুলগুলোতে অন্তত পক্ষে ৭ দিনের গ্রীষ্মকালীন ছুটি দেয়া বাধ্যতামূলক করা উচিত। এ সময়ে স্কুল-কর্তৃপক্ষের কোচিং করানো নিষিদ্ধ করা দরকার। তৃতীয়ত, সম্মিলিত ভর্তি পরীক্ষার দিকে যেতেই হবে। পাবলিক পরীক্ষার দুই সপ্তাহের মধ্যে সম্মিলিত ভর্তি-পরীক্ষা শুরু হবে এবং ১ মাসের মধ্যেই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তিপরীক্ষা শেষ করতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় মাত্র ৩-৪ দিনে ভর্তিপরীক্ষা নেয়া সম্ভব। নিবন্ধন সবই অনলাইন করা উচিত। অযথা সারা দেশে ফর্ম জমা দেয়ার জন্য ছুটে বেড়ানোর পাগলামো বন্ধ হবে।

মেডিকেল কলেজগুলোতে সপ্তাহে ৬ দিন ক্লাস মোটেই যৌক্তিক কিছু নয়। অনেকেই ভাবে বিদেশে সপ্তাহে ৫ দিন ক্লাস নেয় বলেই ওদের ৬-৮ বছর সময় লাগে। এসব ধারণা অজ্ঞতা ও ভুল প্রচারের ফসল। ৮ বছরে কোর্সগুলো আসলে ৪+৪ অর্থাৎ আন্ডারগ্র্যাড প্লাস গ্র্যাজুয়েট কোর্স এবং সেই বিশাল কোর্স তারা সপ্তাহে ৫ দিনে শেষ করছে। আমাদের আন্ডারগ্র্যাড মেডিকেল কারিকুলাম বিলেতের অনুকরণে গড়া। ওরা কিন্তু সপ্তাহে ৫দিন ক্লাস নিয়ে, উইকেন্ডে নেচে-গেয়ে-পার্টি করে দিব্যি শেষ করে ফেলছে। আমরা কেন পারব না? আমাদের দেশেই আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজে প্রতিদিন ৮টা-আড়াইটার পরিবর্তে ৩টা পর্যন্ত ক্লাস নিয়ে দিব্যি কোর্স শেষ করছে। ইংল্যান্ডের সেরা মেডিকেল স্কুলগুলোতে টিপিক্যালি ৮টা-৪টা বা ৯টা-৫টা ক্লাস নিয়ে ৫ দিনে চালাচ্ছে। রাতে ওয়ার্ড নেই। সকালে প্রফেসরের রাউন্ডের সময় ওয়ার্ডে ক্লাস! বিলেতের হাসপাতালগুলোতে ৯টা-৫টা, সপ্তাহে ৫দিন (৭দিনই হাসপাতাল খোলা, কিন্তু মাসের অধিকাংশ সপ্তাহে ডাক্তার-নার্সরা ২দিন ছুটি পান), উইকেন্ড ও নাইট রোটার ভিত্তিতে। শুধুমাত্র চেম্বারের সুবিধার জন্যই আমাদের চিকিৎসকরা ৬ দিন আড়াইটা পর্যন্ত অফিস-টাইম মেনে নিয়েছেন। বেতন বাড়িয়ে দিয়ে এই প্রক্রিয়া নিরুৎসাহিত করা উচিত। আরেকটা মজার তথ্য উল্লেখ করি, আমাদের মেডিকেল কলেজগুলোতে কারিকুলামে উল্লেখিত ক্লাস আওয়ারের প্রায় পৌনে দ্বিগুণ পরিমাণ বেশি ক্লাস নেয়া হয়! যেমন আমার বিভাগে টিউটোরিয়াল হবার কথা মাসে দুটো, আমরা ছাত্র-শিক্ষককে কলুর বলদ জ্ঞান করি। তাই আমরা নিই দুটোর জায়গায় চারটে টিউটোরিয়াল! লেকচারও তথৈব চ! ডাক্তারদের বাধ্যতামূলক কর্মঘণ্টা পৃথিবীর সব দেশেই অন্য পেশার সমান শুধু আমাদের দেশেই ডাক্তারদের কর্মঘণ্টার কোন সীমারেখা নেই। এটা অন্যায়। এর উল্টোপিঠ হচ্ছে, কাজের স্ট্রেসের অজুহাতে কিন্তু অনেক চিকিৎসকই কিন্তু পেশাগত দুর্ব্যবহারকে জাস্টিফাই করে নেন। এটাও গ্রহণযোগ্য নয়। যে সব হাসপাতালে পর্যাপ্ত সংখ্যক ডাক্তার আছেন, সেখানে সহজেই রোটা অনুযায়ী ৫দিন ও ৪০ ঘণ্টার স্ট্যান্ডার্ড কর্মসপ্তাহ বাস্তবায়ন সম্ভব। যেখানে লোকবল কম সেখানে নিয়োগ বাড়িয়ে এটা বাস্তবায়ন করা দরকার। এতে করে কিন্তু চিকিৎসক ও শিক্ষকদের অঘোষিত, অযাচিত ভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার প্রবণতা কমবে।
এই বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হলে এই উপকারগুলো হবে।
- বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর সাশ্রয়
- অনুপস্থিতি ও ফাঁকিবাজি কমবে
- সাফল্য ও উৎপাদনশীলতা বাড়বে
- সৃজনশীলতার বিকাশ
- কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের সমন্বয় বাড়বে।
- পড়াশোনা ও কাজে মনোযোগ বাড়বে।
- কর্মে সন্তোষ বাড়বে।
- অযাচিত ছুটি ও ফাঁকিবাজি কমবে ফলে উৎপাদন বাড়বে, কাজের গতি বাড়বে।
- স্ট্রেস কমবে কাজেই অসুস্থতা ও আহত হবার সম্ভাবনা কমবে। স্ট্রেস-রিলেটেড সাইকিয়াট্রিক ডিস্টারব্যান্স কমবে।
- ট্র্যাফিক জ্যাম কমবে।

সুমন চাটুয্যের একটা গান মনে পড়ছে –
“স্কুলের ব্যাগটা বড্ড ভারী
আমরা কি আর বইতে পারি?
এও কি একটা শাস্তি নয়?
কষ্ট হয়, কষ্ট হয়!
আমার কষ্ট বুঝতে চাও
দোহাই পড়ার চাপ কমাও
কষ্ট হয়, কষ্ট হয়।।
পড়ার চাপে চেপ্টে গিয়ে,
কী করব এই শিক্ষা নিয়ে?
অমুক হও, তমুক হও, মমুক হও, তমুক হও-
কেউ বলে না মানুষ হও।
এত্ত রকম পরীক্ষায়
আমার খালি কান্না পায়,
কে করল রে এ নিয়ম?
লোকটা বোধ হয় খেলার যম!
খেলবে কেন, অঙ্ক করো,
যোগ্য হবার রাস্তা ধরো।
কোথায় রাস্তা কোথায় যাবো?
কোথায় গেলে শুনতে পাবো-
একটু পড়া, অনেক খেলা
গল্প শোনা সন্ধ্যেবেলা।
রাতের হাওয়ায় বুকের কাছে
স্বপ্ন দেখার গল্প আছে।।"
প্রতিদিন সকালে মাস্টারি করতে যাবার সময় আমি এবং আমার পত্নী নানারকম ব্যাগের ভারে নুয়ে পড়া শিশুগুলোকে দেখি। বাইকের পেছনে বসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়া মেয়েকে দেখলে আমাদেরই কান্না পায়। আমরা নিজেরাই কি মানুষ? কবে আমরা মানুষ গড়ার সিস্টেম গড়ব? রোবট গড়ার নয়?

(লেখাটি তানিম এহসান ভাইকে উৎসর্গ করা হল)


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

বৈধ ছুটির অভাব কিন্তু ছাত্রদের ক্লাস ফাঁকি এবং কর্মচারীদের কাজ-ফাঁকির প্রধানতম কারণ। মানুষ যখন কাজের ন্যায্য মূল্য পায় না, কাজ যখন তার ব্যক্তিগত জীবন কেড়ে নেয় তখনই কিন্তু সে ফাঁকি দেয়া শুরু করে।

এভাবে কখনও ভেবে দেখিনি মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নির্ঝর অলয় এর ছবি

একটু ভাবুন। চিন্তিত

সবজান্তা এর ছবি

পুরো লেখার সঙ্গেই একমত, তবে একটা অংশের সঙ্গে প্রবলভাবে একমত, সেটা হচ্ছে, টানা লম্বা ছুটি না পাওয়া।

আমার খুব আগ্রহের একটা জায়গা হচ্ছে হিমালয় সংলগ্ন অঞ্চল, এবং সেখানকার মানুষজন, সংস্কৃতি ইত্যাদি। সচল ওডিন এবং আরো কিছু লোকজনসমেত ২০১০ এর দিকে লাদাখ যাওয়ার একটা পরিকল্পনা করছিলাম দীর্ঘদিন ধরেই। আমি মাঝেমধ্যেই ওডিনের বাসায় যেয়ে হাজির হতাম, আর দুজন মিলে একসঙ্গে ম্যাপের দিকে তাকিয়ে নানা প্ল্যান করতাম। আমার কম্পিউটারের একটা ফোল্ডার বোঝাই শুধু নানা পিডিএফ, আর ছবি ছিলো লে-লাদাখের। সে সময় একটা বহুজাতিক টেলিকম কোম্পানিতে কামলা দেই। বসকে আগের থেকেই বলে রেখেছিলাম লম্বা ছুটি নিবো, সে তখন রাজিও ছিলো। অথচ যখন সময় আসলো, সে মুখের উপর বলে দিলো ১৬-১৭ দিন ছুটি দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। অথচ আমার ন্যায্য প্রাপ্য ছুটি ২১ দিন, এবং আমি শুধু লাদাখের জন্যেই সারা বছর একদিনও অফিস কামাই করিনি- জ্বর নিয়েও অফিস গিয়েছি। বসের কথা শুনে মুখটা একদম তিতা হয়ে গিয়েছিলো। অবশ্য পরে চিন্তা করে দেখেছি, বসেরও তেমন দোষ নাই। আমাদের সিস্টেমটাই এমন।

নিজেকে পুরাপুরি রিসেট করার জন্য যে এমন লম্বা ছুটির দরকার হয় মাঝেমধ্যে, সেটা কেউ বুঝতে চায় না।

নির্ঝর অলয় এর ছবি

ধন্যবাদ।

আসলে সিস্টেম আমাদের গাধা মনে করে। আর মানুষের অমিত সম্ভাবনার দিকটিকে আমরা তুচ্ছ করি। আমরা ধরেই নিই মানুষের ক্ষমতা কম, গাধার মত না খাটলে সে পারবে না। এভাবে আদতে মানুষগুলো গাধাই হয়ে যায়।

আমাদের দেশে একসাথে লম্বা ছুটি চাকরি জীবনে মুশকিল, কারণ দুটো ঈদ, পুজো, বড়দিন। তারপর আবার বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে গড়ে উঠেছে ৪৮ ঘণ্টা বাধ্যতামূলক কর্মঘণ্টার এক অসভ্য সংস্কৃতি। ডাক্তারদের খুব কম লোকই বোঝে যে, তাদের একটা দিন অর্থাৎ ৮টি ঘণ্টা বেশি খাটিয়ে নেয়া হচ্ছে কোন পয়সা না দিয়েই। আরো বেশ কিছু কোম্পানীতেও এই বর্বর প্রথা রয়েছে। ৬ দিন কাজ করলে শেষ দিনটি যে হাফ হতে হয়- সেটিও ইমপ্লয়াররা অগ্রাহ্য করছেন।

ডাক্তার ও নার্সদের ৪৮ ঘণ্টা করতে গিয়ে অনেক হাসপাতালেই প্রতি সপ্তাহে ২টা নাইট ডিউটি করতে হয়। অর্থাৎ মাসে ৮টা নাইট। একটা ১০ বছরের কোহর্ট স্টাডি বলছে যে, মাসে ৩টার বেশি নাইট করলে মহিলা কর্মীদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি মডারেটলি বেড়ে যায়। হ্যাঁ মডারেটলি! পুরুষের বিভিন্ন ক্যান্সারের সম্ভাবনাও বাড়ে। মেলাটোনিন সাপ্রেশনের কারণে এটা হয়।

ওয়র্ক স্ট্রেসের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বেশ মারাত্মক। জীবনে যে স্পেসও দরকার হয়- মানুষ সেটা বোঝে না। ইসেনশিয়াল সার্ভিস ৭ দিনই খোলা থাকবে, কিন্তু একজন কর্মচারীকে যেন ৫ দিনের বেশি প্রতি সপ্তাহেই খাটানো না হয়- এটা কিন্তু এখন সারা বিশ্বেই প্র্যাক্টিস করা হচ্ছে। আমরাও আগামী ৫ বছরে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে চাই।

ওডিনদা সেলফ-ইমপ্লয়ড, কাজেই উনি এইসব নিয়মের ঊর্ধ্বে। কিন্তু ফেসিবাদী শিশুরা তাঁকে ছাড় দেয় না!

শামীমা রিমা এর ছবি

আসলে আমাদের পড়াশোনার সিস্টেম এতোটাই খারাপ যে কোনো মন্তব্য করাটাও বেশ কঠিন । অথচ যাদের এসব নিয়ে চিন্তা করা উচিত তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চিন্তায় ব্যস্ত । আর মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করার পর আমি প্রতিজ্ঞা করেছি আমার ছেলেমেয়েদের আমি কখনো মেডিকেল কলেজে পড়াব না ,এটা নরক বৈ আর কিছু নয় ।

লেখা ভালু পাইলাম চলুক

নির্ঝর অলয় এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

শাফায়েত এর ছবি

লেখার সাথে ১০০% একমত। যত দিন যাচ্ছে কোচিং-প্রাইভেট পড়া তত বাড়ছে, আমি নিজেও কলেজ থেকে ফিরেই প্রাইভেট পড়তে দৌড়েছি। আমাদের বাচ্চাদের জীবনে আনন্দ খুব কম, উইকএন্ডের ছুটিতেও একটা ঘুরতে যাবার জায়গা নেই ঢাকা শহরের বেশিভাগ ছেলেমেয়ের, এটার ফল কখনোই ভালো হতে পারে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর থেকে সপ্তাহে ২দিন ছুটি করা হয়েছে, আপনার তালিকায় নাই দেখে জানালাম।

নির্ঝর অলয় এর ছবি

ভাই আমি জানতাম না। লোকজনকে ফোন করে তথ্য নিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরটা নিশ্চিত ছিলাম না। সব স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজও ৫দিন খোলা রাখা উচিত প্রতিদিনের সময়টা একটু বাড়িয়ে। হাসপাতাল ৭ দিন খোলা রাখলেও জনবল বেশি থাকলে রোটা অনুযায়ী কর্মচারীদের ৫ দিন কাজ নিশ্চিত করা সম্ভব। টারশিয়ারী লেভেলের অনেক হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগে ২০-২৫ জন পর্যন্ত মেডিকেল অফিসার থাকে। এদের সবারই সব সময় কাজ থাকে না। ছুটি নেই বলে এরা নানা ভাবে 'ম্যানেজ' করে ব্যক্তিগত কাজ সারে! তেমনি যে উপজেলায় ২৫-৩০ জন মেডিকেল অফিসারের পোস্টিং থাকে তাঁরা সপ্তাহে গড়ে ৪ দিন গিয়ে ম্যানেজ করেন। এতে কিন্তু সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় যেখানে চিকিৎসক একেবারেই যান না, বা পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসকের পোস্টিং দেয়া হয় না। পর্যাপ্ত নিয়োগ দিয়ে সপ্তাহে ৬ দিনের জায়গায় ৫ দিন করে আমরা চিরতরে এই 'ম্যানেজের' সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। আর বেসরকারী খাতে ডাক্তারদের ওপর ৪৮ ঘণ্টা ও সপ্তাহে ২ নাইটের জুলুম বন্ধ করতে হলে এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
সমস্যা হল আরব আর ভারত- আমাদের দুই প্রিয় দেশ! এসব দেশে এখনো ৬ দিন আছে। ভারতে অবশ্য হাফ আছে, আরবে তাও নেই!

অনিকেত এর ছবি

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটা এমন যে এইখান থেকে আমরা বেঁচে থেকে পাশ করে বেরিয়ে আসতে পেরেছি--এইটা ভাবলে বিমলানন্দ হয়। কিন্তু আনন্দটা বেশিখন টেকে না যখন খুব দ্রুতই আমাদের কাছে ধরা পড়ে যায় যে এই 'বেঁচে থেকে পাশ করে' বেরিয়ে আসতে পারার জন্যে আমাদের অনেককেই চড়া দামের মাসুল গুনতে হয়েছে বাকী জীবন জুড়ে।

শিক্ষার নামে মানবিকতা বর্জিত এই বিরামহীন নিষ্পেশনযন্ত্র আমাদের কিছু কলের মানুষ উপহার দেবে, মানুষ নয়। কিছু শিক্ষার্থী নিজ যোগ্যতায় মানুষ হবে ঠিকই কিন্তু এই কৃষ্ণগহ্বর তাদের গ্রাস করে নেবে। সমাধানের পথ ভাবা উচিত এখনই।

সর্বতোভাবে সহমত!

নির্ঝর অলয় এর ছবি

বিমল আনন্দে জাগো রে! হাসি

বড়দা, প্রশ্ন হচ্ছে, এগুলো বাস্তবায়ন হবে কীভাবে? আমাদের দেশে তো মন্ত্রণালয়ে ইমেইল করে কোন ফল হয় না। আছেন সবেধন নীলমণি জাফর ইকবাল স্যার। ওনার সাথেও কোন পরিচয় নেই। কোনভাবে যদি স্যার পর্যন্ত এই কথাগুলো পৌঁছে দিতে পারতাম!

সাস্ট এ কী পদ্ধতি চলছে সেটাও জানি না। সাস্টের কেউ কি আছেন? যদি একটু জানান- খুব ভালো হয়।

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

সপ্তাহে পাঁচদিন টানা ক্লাস করার পর বৃহস্পতিবার রাতটাকে মনে হতো ঈদের রাত!! আসলেই এটা প্র্যাকটিস করা উচিৎ। শৈশবে যদি খেলাধূলা বা অন্যরকম ইজি কাজে বিজি নাই থাকলো তবে তাদের শৈশবের আর আনন্দ রইলো কী? আমাদের শিশুদের শৈশব কেড়ে নিয়ে আমরা তাদেরকে যন্ত্র বানানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত!

____________________________

নির্ঝর অলয় এর ছবি

খুবই চমৎকার বলেছেন।

আমাদের প্রায়ই বৃহস্পতিবার রাতে ওয়ার্ডে পরীক্ষা দিয়ে শনিবার সকালে ক্লাসে ৪-৫টা আইটেম পরীক্ষা দিতে হত! থার্ড ইয়ারে সপ্তাহে ৬ দিন প্রতিদিন ১১ ঘণ্টা করে ক্লাস হত। পাশবিক একটা রুটিন ছিল।

অনেকেই বলেন, "ডাক্তার হতে গেলে এসব করতেই হবে। সারা দুনিয়ায় একইরকম সিস্টেম"- আমরা স্যারদের এই কথা সরল মনে মেনে নিতাম। পরে যখন নিজে শিক্ষক হলাম, কর্মসূত্রে সেন্টার ফর মেডিকেল এজুকেশনে গতায়াত করলাম এবং স্টাডি করলাম- দেখলাম যে, আমাদের স্যারেরা এসব ব্যাপারে হয় নিজেরাই জানতেন না, নয়তো জেনে শুনে মিথ্যে বলতেন। প্রথমত, দিনে ১১ ঘণ্টার এই আজগুবি রুটিন বাংলাদেশেরই আর কোন মেডিকেল কলেজে চালু নেই। দ্বিতীয়ত, আমাদের স্যাররা সব ব্যাপারে বিলেতের দোহাই দিতেন। মেডিকেল কলেজের সব সিস্টেমই নাকি হুবহু ব্রিটিশ মডেলের! পড়াশোনা করে দেখলাম, পুরোপুরি ভুল বা মিথ্যে কথা। বিলেতের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে এম,বি,বি,এস শিক্ষাপদ্ধতি আমাদের চেয়ে অন্তত একশো বছর এগিয়ে গেছে। আমরা শুধুই বেশি বেশি রোগি আর বেশি ডেডবডির গীত গাই। অথচ কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় যে, হাতে কলমে শব-ব্যবচ্ছেদ শেখার জন্য কোন মেডিকেল কলেজেই দুটোর বেশি বডি থাকে না এবং অধিকাংশ ছাত্রই কোন ইনসিশন (সঠিক উচ্চারণটা বাংলায় লেখা যায় না) দেবার সুযোগ পায় না এনাটমি ক্লাসে। অথচ ডিসেকশন নোট তাদের মুখস্থ করতে হয় কাজ না করেই। বিলেতে স্কিন-প্যাডে হলেও কাজটা শেখায়, বডি কম বলে তারা উদ্ভাবন করেছে "সাইবার-এনাটমি" নামক অসামান্য থ্রি-ডি সফটওয়্যার, যাতে শরীরের যে কোন অংশের ত্রিমাত্রিক ছবি যেকোন অ্যাংগল থেকে ব্যবচ্ছেদ করে দেখা সম্ভব। বেশ কিছু গবেষণাপত্র বলছে যে, এই সিম্যুলেশনগুলোর যথার্থ প্রয়োগ হলে সেই শিক্ষার মান প্রথাগত শিক্ষার চেয়ে অনেক বেশি। বাস্তবে কখনোই আন্ডারগ্র্যাডের ছাত্রকে লিভারের পেছনের সব স্ট্রাকচার কেটে দেখানো সম্ভব না, কারণ এত শব কোথায়? তৃতীয়ত, বিলেতে কোন ছুটি নেই শুধু পড়া আর পড়া- এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে। কেমব্রিজের বেশ কিছু মেডিকেল কলেজের ভিডিও আছে ইউটিউবে। শনি-রবি উইকেন্ডে তারা নিয়মিত পাবে-ডিস্কোতে যায়! বিলেতের সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের মত মেডিকেল কলেজও সপ্তাহে ৫ দিন। হাসপাতালেও কাউকেই লাগাতার কোন মাসে ৫দিন ও ৪০ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয় না। ইম্পেরিয়াল কলেজের রুটিনে দেখা যায় যে, থার্ড ইয়ারে প্রতিদিন ৮টা-৪টা ক্লাস- ওর মধ্যেই সকালে ওয়ার্ড। রাতে আবার ওয়ার্ড কিসের? ছাত্ররা পড়বে কখন? আর সব কি চামচে করে গিলিয়ে দিতে হবে নাকি? সেলফ-লার্নিং বলে কিছুই থাকবে না?

আরো মজার বিষয় হচ্ছে বিলেতের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা বি,ম্যাট কিংবা ইউকে,ক্যাট - কোনটাতেই মুখস্থবিদ্যার বিন্দুমাত্র স্থান নেই। খুবই বুদ্ধিনির্ভর পরীক্ষা যার ভিত্তি গণিত এবং ভার্বাল রিজনিং। বেশ কঠিন পরীক্ষা। যার প্রথম অংশের ফরম্যাট এমনঃ
SECTION 1 Aptitude and Skills 20 minutes
SECTION 2 Scientific Knowledge and Applications 10 minutes
SECTION 3 Writing Task 30 minutes
রাইটিং সেকশনের নমুনা প্রশ্ন এমনঃ
Our genes evolved for a Stone Age life style. Therefore, we must adopt Stone Age habits if we are to be healthy.
Write a unified essay in which you address the following:
Explain the logical connexion between the two sentences.
What might be the practical implications if we were to agree with the reasoning?
Discuss the extent to which the argument is valid.

কাজেই দেখা যাচ্ছে, আমাদের কিছু রোবটস্বভাবের পলিসি-মেকার অদ্ভুত কিছু নিয়ম বানিয়ে সেগুলো বিলেতের নামে চালাচ্ছেন- যেটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন!

স্কুল-কলেজ স্রেফ হরতাল-অবরোধের অজুহাতে ৬ দিন খোলা রাখার যুক্তি কি? নিয়মগুলো কি বর্বর প্রথার সঙ্গে আপোস করে তৈরি করা জরুরী? এতে কি নৈরাজ্যসৃষ্টিকারীদেরই পরোক্ষভাবে মদদ দেয়া হচ্ছে না?

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

মন খারাপ

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

লেখাটা খুব ভালো লাগলো। যখনই আমি আমার শৈশবের সাথে অধুনা শিশুদের শৈশবের তুলনা করি, খুবই কষ্টবোধ হয়। আমাদের শৈশবে স্কুলের সাপ্তাহিক ছুটি ছিলো দেড় দিন। শুক্রবার হাফ আর রবিবার পুরো দিন। পরে এরশাদের আমলের প্রথম দিকে ছুটি করা হলো আজব টাইপের দুই দিন- শুক্র ও রবি এবং মাঝে শনিবার খোলা। এই আজব সিস্টেম সামান্য কয়েকদিন চালু ছিলো। পরে ছুটি হলো শুক্র ও শনিবার এবং রবিবার বাদ। আমি জানিনা কবে সেই নিয়ম বাতিল হয়ে আবার সপ্তাহের ৬ দিন শিক্ষাঙ্গণ চালু রাখার নিয়ম হয়েছে।

এখনকার শিশুদের শিক্ষাপদ্ধতি সম্পর্কে আমার ধারনা খুবই কম। যেটুকু দেখি তাতে আমি মহা ক্ষুব্দ। আমাদের স্কুল জীবনে আমরা পড়াশুনা করেছি, দাপিয়ে খেলাধুলা করে বেড়িয়েছি, কালচারাল অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নিয়েছি, দেয়াল পত্রিকা বের করেছি। আর এখন স্কুল আছে হাজারে হাজারে কিন্তু মাঠ নেই। একটা হারমোনিয়াম সব স্কুলেই রাখা থাকে কেবলমাত্র জাতীয় সঙ্গীতের সময় বাজানোর জন্য। তুলনায় গ্রামের স্কুলগুলোতে এক্সট্রা কারিকুলা এখনও টিকে আছে।

আমরা সম্ভবত শিশুদের শৈশব থেকে আনন্দের পরিমান কমিয়ে দিয়ে ওদের পাঠ্যবইয়ের বোঝা বাড়িয়ে দিচ্ছি। নামেমাত্র চিত্রাঙ্কনের ক্লাস দিয়ে ওদের আর কতটুকু বিনোদন আসতে পারে? শৈশব আনন্দময় ও উপভোগ্য করতে না পারলে ওদের যৌবনে জাতি কতকগুলো রোবট উপহার পাবে। আর আমি ব্যাক্তিগতভাবে সপ্তাহের ২ দিন ছুটির পক্ষে। আমাদের অনেক বন্ধুই সপ্তাহের ৫ দিন ক্লাস করে, ব্যাচে-কোচিঙ্গে না পড়ে অনেক ভালো রেজাল্ট করে ভালোভাবে দেশে বিদেশে করে ধরে খাচ্ছে।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

নির্ঝর অলয় এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ ভাই।
আমাদের সময় স্কুল ছুটি ছিল দেড় দিন- বৃহস্পতিবার হাফ।

আমার অধিকাংশ বন্ধু এবং বড় ও ছোট ভাইই এঞ্জিনিয়ার। প্রায় সবাইই বুয়েট অল্প কয়েকজন কুয়েট এবং চুয়েটের। আমি ছাত্রজীবন থেকেই ভাবছি যে, ওদের সাথে মেডিকেলের ছাত্রদের জীবনযাত্রার মৌলিক পার্থক্য কোথায়? এঞ্জিনিয়ারিং এও পড়ার চাপ সাংঘাতিক এবং মেডিকেলের মত জঘন্যভাবে না হলেও যথেষ্টই মুখস্থ করতে হয় বেশ কিছু কোর্সে। তারপরও তো ওরা এত অখুশি না। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখলাম, ওরা উইকেন্ডে প্রাণ ভরে মুভি দেখে, ফিল্ম-ফেস্টিভ্যাল করে, দল বেঁধে বেড়াতে যায়। অথচ আমরা মাত্র একদিন ছুটির কারণে কোথাও নড়তে পারি না। উল্লেখ্য মেডিকেল কলেজে বৃহস্পতিবার রাতেও ওয়ার্ড থাকে। এত ক্লাসের আসলেই কোন দরকার নেই এবং কারিকুলামেও আসলে নেই। এগুলো শিক্ষকদের মান্ধাতার আমলের মানসিকতার ফল। কাজেই কার্যত মেডিকেল ছাত্রদের কোন উইকেন্ডই নেই। কাজেই জীবনটা খুবই পানসে হয়ে পড়ে। আমার জানামতে অধিকাংশ দেশেই এখন মেডিকেল কলেজে সপ্তাহে ৫ দিন ক্লাস। স্কুল-কলেজও অধিকাংশ দেশেই তাই।

এই রোবটের সংস্কৃতি আর কত দিন? একটা পোল করা যায় কি? পত্রিকায় লেখা উচিত এ বিষয়ে। কিন্তু সেই এক জাফর ইকবাল স্যার ছাড়া আর কে আছেন? দ্বিজেন শর্মা স্যার?

অতিথি লেখক এর ছবি

আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বাচ্চাদের উপর পড়ার চাপ দেখলে ভাষা হারিয়ে ফেলতে হয়। তাদের শৈশব বলতে আর কিছু নেই এখন। বড়দের কথা কী আর বলবো।
তামান্না ঝুমু

নির্ঝর অলয় এর ছবি

এই অবস্থার জন্য অভিভাবকরাও দায়ী। তাছাড়া সমাজে যখন অর্থই একমাত্র মানদণ্ড হয়ে যায় তখন আর ভালো কোন কিছুরই কোন মূল্য থাকে না। অর্থ মানুষের প্রয়োজন কিন্তু সেটাই একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হতে পারে না!

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুন এবং জরুরি পোষ্ট। সহমত আপনার প্রস্তাবে।

মাসুদ সজীব

নির্ঝর অলয় এর ছবি

ধন্যবাদ ভাই।

পুলিস বিভাগেও নিয়োগ বাড়িয়ে এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। অর্থাৎ উইকেন্ড ও বড় ছুটিগুলোতে আলাদা রোস্টার থাকবে। জঘন্য নিয়মগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন। মিজান, পিষে ফ্যালো

অতিথি লেখক এর ছবি

এখানেও সহমত। আমি যেখানে চাকরি করি সেখানেও বছরে মোট চল্লিশ দিন ছুটি আছে। দশ দিন ক্যাজুয়াল আর ত্রিশ দিন আর্ন লিভ। এখন ত্রিশ দিনতো দূরের কথা ওই দশ দিন ছুটি কাটাতে চাইলেও রিমান্ডের মত কঠিন একখান জেরা পার হয়ে আসতে হয়। ফলে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় বাধ্য হয়ে, বেশিভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় না বলে অফিসে আসে না কলিগরা, পরে ফোন দেয় অসু্স্থ। আমিও এমন করি না যে তা নয়। আমার পাওনা ছুটি আমাকে দিবে না কেন? নিয়মে আছে অথচ দিবে না এটা কেমন কথা। আমার মনে হয় প্রতিটি বেসরকারী অফিসে বড় কর্তাগুলো এক একজন সামরিক জেনারেল, এরা শুধু আইন প্রণয়ন করে আর সে আইন নিজেই ভাঙ্গে। এইসব দেখতে আর ভালোলাগে না। মন খারাপ

মাসুদ সজীব

এক লহমা এর ছবি

চলুক
অবকাশের প্রয়োজন খুব-ই।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নির্ঝর অলয় এর ছবি

আরো লিখুন না, বিষয়টা নিয়ে। আর কত- এই মানুষ নিংড়ানো? মন খারাপ

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আপনার লেখাটায় যে উৎকন্ঠা প্রকাশ পেয়েছে তার সাথে আমি একমত।
হ্যাঁ, এখনই সময় সিস্টেম পাল্টে ফেলার। চলুক

নির্ঝর অলয় এর ছবি

লিখুন, লিখুন, লিখুন। অসির চেয়ে মসী বড়। লিখে লিখে ব্লগ, পত্রিকা, ফেসবুক, টুইটার ছেয়ে ফেলুন। একদিন পাল্টাবেই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।