বাংলাদেশে প্রতিবছরই বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নদের স্ট্রাইক পরিলক্ষিত হয়। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইন্টার্নদের স্ট্রাইকের কারণ “কর্তব্যরত চিকিৎসকদের লাঞ্ছনা এবং নিরাপত্তার অভাব।” আমাদের দেশের মিডিয়া সবসময়ই অত্যন্ত একপেশেভাবে এই স্ট্রাইকের খবর দেয় এবং প্রায় সবসময়ই ডাক্তারদের খলনায়ক বানিয়ে রোগীদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরার একটা জনপ্রিয় প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। এটা প্রায় কখনোই লেখা হয় না যে, জরুরীবিভাগ, আই,সি,ইউ, ইমার্জেন্সি অপারেশন, ইনডোর সেবা ইত্যাদি সবই চালু থাকে। ইন্টার্ন ছাড়াও টারশিয়ারি লেভেল হাসপাতালে অনেক মিড-লেভেল চিকিৎসক থাকেন যাঁরা কর্তব্য পালন করেন। সেটাও চেপে যাওয়া হয়, বোধহয় পাবলিক “খাবে না” ভেবে! আরো একটা ব্যাপার- অনেকেরই ধারণা যে, শুধু আমাদের দেশেই ডাক্তাররা ধর্মঘট করে এবং পৃথিবীর আর কোন দেশেই ডাক্তারদের ধর্মঘট নেই। কেউ কেউ তো মনে করেন যে, উন্নত দেশগুলিতে নাকি ডাক্তারদের ধর্মঘট আইনত নিষিদ্ধ। কাজেই দেখা যাক চিকিৎসক ধর্মঘটের বৈশ্বিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। এর থেকে বৈশ্বিক চিত্রের সাথে আমাদের চিকিৎসক আন্দোলনগুলোর একটা তুলনামূলক প্রতিচিত্র আমরা পাবো। মডেল হিসেবে আমরা বিশ্বের কয়েকটি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসক ধর্মঘটগুলোর প্রেক্ষাপট আলোচনা করব।
প্রথমেই আসি বিলেতের কথায়- যুক্তরাজ্য- আমাদের বড় স্যারদের বড়ই প্রিয় দেশ! তরুণ চিকিৎসকদের ও ছাত্রদের ওপর যেকোন নিগ্রহমূলক নিয়ম চাপিয়ে দিয়ে সবসময়ই বিলেতের দোহাই তাঁরা দেন। পরে আন্তর্জাল ঘেঁটে সেগুলোর উলটো প্রমাণ পেলে তাঁরা বলেন, “ওদের ওইসব নিয়ম আমাদের দেশে চলবে না।”- এরকম একটা নিয়ম হচ্ছে নাইট ডিউটির পর ডে অফ- যেটা বাংলাদেশে কিছু অধ্যাপক এবং সহকারী রেজিস্ট্রার প্রায় উঠিয়েই দিয়েছেন! যাইহোক, উন্নত কাজের পরিবেশ, ৪০ ঘণ্টার পর ওভারটাইম এবং ৪৮ ঘণ্টার সর্বোচ্চ কর্মসপ্তাহ, ভালো সম্মানী, ২৮ দিনের ক্যাজুয়াল লিভ ছাড়াও ৭ দিনের স্টাডি লিভ এবং বিশেষ অনুদান, অত্যন্ত সংগঠিত ট্রেনিং- ইত্যাদি নানা কারণে যুক্তরাজ্য চিকিৎসকদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্মক্ষেত্র। অথচ এমন যে বিলেত- সেখানেও স্ট্রাইক? ভাবা যায়? হ্যাঁ, তাই হয়েছিল যখন ১৯৭৫ সালের জানুয়ারী থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত কনসালট্যান্টরা সব ধরনের “নন-ইমারজেন্সি,” “ওভার-টাইম বা গুড-উইল” সেবা বন্ধ রেখেছিলেন। তাঁরা এটা করেছিলেন প্রস্তাবিত একটি নতুন চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ। তাঁদের মতে এটা তাঁদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস পরিত্যাগ করতে বাধ্য করত। (অবশ্য প্রাইভেট প্র্যাক্টিস যুক্তরাজ্যে এখনো খুবই কঠিন নিয়মের মধ্যে করতে হয় NHS এ কর্মরত চিকিৎসকদের)। আন্দোলনের মুখে ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বহাল থাকে। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসে কর্মঘণ্টা কমানোর দাবীতে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্মঘট শুরু হয়। গার্ডিয়ান পত্রিকার ভাষায় “Later that year junior doctors took action against the following problems: rotas that enforced working 120 hours one week and 80 the next while being paid for a 40-hour week; appalling conditions in their on-call rooms; and having to provide care for "their" consultants' private patients, which took them away from NHS commitments.” উল্লেখ্য এই আন্দোলনের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এই আন্দোলনের পর জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে EU Work Directive এর বাস্তবায়নের ফলে গোটা ইউরোপের মত যুক্তরাজ্যেও ডাক্তারদের নিয়মিত কর্মঘণ্টা সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টায় এবং বেসিকের ৪০% ওভারটাইম সাপেক্ষে সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। অধিকাংশ হাসপাতালেই এটি বাস্তবায়িত হয়েছে। রয়েল কলেজ অফ সার্জারির কর্তাদের চেঁচামেচিও এটা বন্ধ করতে পারেনি। কারণ এখন পর্যন্ত কোন স্টাডিই পেশেন্ট সেফটি ও ট্রেনিং এর গুণগত মান কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রমাণ করেনি। বরং ডাক্তারদের জীবনযাত্রার মান(Quality of Life) এবং কাজ ও জীবনের সমন্বয় (Work-Life balance) অনেক বেড়ে যাবার কথা প্রতিটি স্টাডিই উচ্চকণ্ঠে বলছে। জেনারেল মেডিকেল কাউন্সিল অফ ইউকে যদিও বলছে যে এটা ট্রেনিং এর মান ক্ষুণ্ণ করছে কিন্তু সেটা কিন্তু কর্মঘণ্টা কমানোর জন্য নয়। আরো অনেক ফ্যাক্টর জড়িত। তাদের প্রকাশনার মতে জুনিয়র ডাক্তারদের ট্রেনিং এর জন্যই রাখা উচিত, সার্ভিসের জন্য কম। “In addition, the training issues raised by the directive do not suggest that junior doctors can’t be trained in 48 hours, says the report; for example, doctors in Norway are restricted to 40 working hours a week, yet training is considered adequate because of the emphasis placed on continuing professional development, the favourable doctor to patient ratio, and the efficiency of medical staff.” এই ইতিবাচক উত্তরণের পটভূমি হিসেবে ১৯৭৫ এর ধর্মঘটকে মূল কারণ বলে মনে করেন অনেকেই। এরপর দীর্ঘ ৩৭ বছর পর ২০১২ সালের ২১ জুন যুক্তরাজ্যের বেস্ট পেইড পাবলিক সার্ভেন্ট অর্থাৎ ডাক্তাররা পরিবর্তিত পেনশন স্কিমের প্রতিবাদে স্ট্রাইক করে। উল্লেখ্য যুক্তরাজ্যের প্রতিটি স্ট্রাইকই ছিল সর্বাত্মক এবং স্ট্রাইকের প্রস্তাব ব্রিটিশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাধারণ সভায় ব্যালটের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ভোটে পাশ হতে হয়। লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, বিবিসি গার্ডিয়ান বা টেলিগ্রাফ কারো প্রতিবেদনেই কিন্তু রোগীদের “জিম্মি” করা বা দুর্ভোগের ব্যাপারটাকে খুব ফলাও করে প্রচার করা হয় নি। বরং বারবার লেখা হয়েছে যে, ইমার্জেন্সি, ক্রিটিক্যাল কেয়ার, ক্যান্সার-কেয়ার ইত্যাদি সেবা চালু ছিল। যা আমাদের দেশের সমধর্মী খবরগুলোতে কখনোই দেখা যায় না। আমাদের দেশে কিন্তু সর্বাত্মক স্ট্রাইক কখনোই হয় না। সাধারণত শুধু ইন্টার্নরা স্ট্রাইক করে। আমি স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণকালে ইন্টার্নদের একটা স্ট্রাইক দেখেছি। তাতে আমাদের ওয়ার্ডে কোনই সমস্যা হয় নি। উলটো রোগীরা আরো দ্রূত সেবা পেয়েছে- বেশি দক্ষ ও অভিজ্ঞ মেডিকেল অফিসারদের কাছ থেকে। আজকের খবর অনুযায়ী ২৩ এপ্রিল ২০১৪ তারিখ সকালে আয়ারল্যান্ডের ইন্টার্নসহ জুনিয়র চিকিৎসকরা কর্মঘণ্টা সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টায় সীমাবদ্ধ রাখার দাবীতে ধর্মঘট আহ্বান করেছেন। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই ইয়োরোপিয়ান ওয়র্ক ডিরেক্টিভ এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ঘটানো হবে আয়ারল্যান্ডে।
এবার যাওয়া যাক যুক্তরাষ্ট্র-আমেরিকা! যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ডাক্তাররা প্রথম ধর্মঘট আহ্বান করেন ১৯৬৬ সালের ২৮ জুন। এদিন নিউ ইয়র্ক সিটি হেলথ ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক নিয়োজিত প্রায় ১৫০০ ডাক্তার যাদের মধ্যে ডেন্টিস্ট ও অপ্টোমেট্রিস্টরাও ছিলেন, ১১৯ টি শিশু হাসপাতালে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালন করেন। তাঁদের দাবী ছিল বর্ধিত বেতন এবং কর্ম-নিরাপত্তা। এর মধ্যে ৫৫টি হাসপাতাল পুরোপুরি বন্ধ ছিল এবং ৫৮ টি হাসপাতালে সীমাবদ্ধ সেবা বা শুধু ইমার্জেন্সি ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার সেবা চালু ছিল। লক্ষ্যণীয়, এমন স্ট্রাইক বাংলাদেশে হলে হয়ত ডাক্তারদের গণহত্যা করা হত। বাংলাদেশে কখনোই কোন স্ট্রাইকে কোন পাবলিক হাসপাতাল পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়নি।
১৯৬২ সালের ১জুলাই কানাডার সাসকাচুয়ান প্রদেশে ডাক্তাররা নতুন স্বাস্থ্যবীমার প্রতিবাদে সর্বাত্মক ধর্মঘটে যান। এবং রোগীরা ক্লিনিকে গিয়ে দেখতে পানঃ
This sign was on the door of the Prince Albert Clinic to notify patients that the doctors were going on strike on July 1, 1962.
Saskatchewan Archives Board, George and Tillie Taylor
এরপর আবার কানাডার অন্টারিও এবং এলবার্টাতে ১৯৮৬ সালে ডাক্তারদের একটি ঐতিহাসিক ধর্মঘট সংঘটিত হয় নবপ্রযুক্ত স্বাস্থ্যবীমায় ডাক্তারদের অতিরিক্ত বিল নেবার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায়। ডাক্তাররা ৭ মে গণসমাবেশ করে এবং ২৯ ও ৩০ মে তাদের অফিস বন্ধ রাখে এবং ১২ জুন সর্বাত্মক ধর্মঘট আহ্বান করে। চারদিন পর কুইন্স পার্কে আন্দোলনরত চিকিৎসকদের সাথে নিরাপত্তারক্ষীদের সংঘর্ষ বাধে, যেটা জাতীয় সংবাদ-মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮ জুন টরোন্টোতে ১০টি ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড বন্ধ হয়ে যায়। ২৫ জুন, ১৯৮৬ নিউমার্কেটে ইয়র্ক কাউন্টি হসপিটালটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এসময় the College of Physicians and Surgeons of Ontario ডাক্তারদের ইসেনশিয়াল সার্ভিস বা অপরিহার্য সেবা প্রদানের অনুরোধ করে, নইলে তারা প্রোফেশনাল মিসকন্ডাক্টের দায়ে অভিযুক্ত হবেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে। উল্লেখ্য ২৫ দিন ব্যাপী এই আন্দোলনের জনসমর্থন ছিল খুবই কম, সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মী যেমন নার্সরা এর তীব্র বিরোধিতা করে। আন্দোলনরত চিকিৎসকদের চেয়ে ক্ষুদ্র একটি চিকিৎসকগোষ্ঠী সরকারপক্ষের সব নিয়ম মেনে নেয়। এই আন্দোলনের ফলে পেশাটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই পলিসিটি বাস্তবায়িতও হয়। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত চিকিৎসকদের এমন কোন ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয় নি।
চিকিৎসকদের স্ট্রাইক হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বিশ্বের সেরা স্বাস্থ্যব্যবস্থার দেশ ফ্রান্সেও। ২০০২ সালের ২৩ জানুয়ারী ফ্রান্সের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ চিকিৎসক কনসালটেশন ফি বাড়ানোর দাবীতে ধর্মঘট করেন। এরপর ২০০৫ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ফ্রেঞ্চ এসোসিয়েশন অফ হসপিটাল ইমার্জেন্সি ডক্টরস এর নেতৃত্বে ফ্রান্সের পাবলিক এবং ইউনিভার্সিটি হাসপাতালগুলোর ইমার্জেন্সিতে এক ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্বাস্থ্য-প্রশাসক, নার্স এবং এম্বুলেন্স ড্রাইভাররাও যোগ দেন। আন্দোলনরত চিকিৎসকগণের দাবী শুধু উন্নত কর্ম পরিবেশ, অধিক স্টাফ, বেশি বেতন, বেশি শয্যার দাবীই তোলেন নি, বরং সমগ্র ইমার্জেন্সি এবং ‘আউট অফ আওয়ার’ কাজের পুনর্বিন্যাসের দাবী করেছেন। কাজের পরিবেশের উন্নতি ও কর্মঘণ্টা হ্রাস করার দাবীতে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে বড়দিনের ছুটির সময় ফ্রান্সের তরুণ চিকিৎসকদের ইউনিয়ন একটি ধর্মঘট আহ্বান করে।
এছাড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আমরা যাদের প্রায় সব খারাপ দিকগুলো নকল করি, সেই ভারতে আকছার নানা পর্যায়ের চিকিৎসকদের ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। গত মাসেই ইউ,পি তে এক এম,এল,এর সাথে জুনিয়র ডাক্তারদের বিরোধের জের ধরে বিশাল এক ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। কানপুরের GSVM Medical College এর জুনিয়র ডাক্তার ও ছাত্রদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে এ ধর্মঘট ডাকা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ২০১০ সালের জুন মাসে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে জটিল গ্রুপিং এর দরুণ ২ জন চিকিৎসকসহ মোট ৬ জনকে ক্যাম্পাস থেকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে ৩ জন ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং তাদের নামও মামলায় ছিল না। স্রেফ ষড়যন্ত্রের ভিত্তিতে এদের বিরুদ্ধে বিনা অভিযোগে নির্মম নির্যাতন চালানো হয় এবং ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে আহত ছাত্রদের প্রিজন সেলে পাঠানো থেকে বিরত থাকে কারা-কর্তৃপক্ষ। ২০১১ সালে আবারো রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে বিনা দোষে সন্দেহভাজন হিসেবে মেধাবী চিকিৎসক আশিস কুমারকে প্রায় আড়াই মাস কারাবন্দী রাখা হয় এবং সে ৩১ তম বি,সি,এস এর লিখিত পরীক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়। এই গুরুতর ঘটনাদ্বয়ের ফলেও কিন্তু কোন ধর্মঘট হয়নি। প্রায় একই ধরণের ঘটনায় কিন্তু গোটা উত্তরপ্রদেশের মেডিকেল ছাত্ররা ও জুনিয়র চিকিৎসকরা উত্তাল হয়ে উঠেছিল গত মাসেই। কাজেই আমাদের ডাক্তার ও শিক্ষার্থীরা কিন্তু অনেক বেশি সহিষ্ণু, এমন গুরুতর অন্যায়ও কিন্তু তারা মেনে নিয়েছে।
চিকিৎসকদের ধর্মঘট কখনোই কাম্য নয়। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে এ ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না তাদের হাতে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে উপরের আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, উন্নত দেশের চিকিৎসক-ধর্মঘটের সাথে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের ধর্মঘটের বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। উন্নত দেশের চিকিৎসকগণ যেখানে ধর্মঘট করেছেন বেশি বেতন, প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ, উন্নত কাজের পরিবেশ, কম কর্মঘণ্টা ইত্যাদি দাবীতে সেখানে আমাদের চিকিৎসকদের একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ বিক্ষিপ্তভাবে ধর্মঘট করেছেন শুধুমাত্র “নিরাপদ কর্মস্থলের” দাবীতে বা আহত বা নিহত চিকিৎসকের প্রতি সংঘটিত অপরাধের বিচার চেয়ে। কাজেই আমাদের চিকিৎসকদের আন্দোলন অনেক বেশি নিঃস্বার্থ। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য দেশের চিকিৎসকবৃন্দের ধর্মঘট যেমন ব্যাপক ও সর্বাত্মক আমাদের তেমন নয়। ১৯৬২ তে আমেরিকাতে এবং ১৯৮৬ তে কানাডায় বেশ কিছু হাসপাতাল পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। পক্ষান্তরে, এদেশের কোন পাবলিক হাসপাতালেই ইমার্জেন্সি ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার সেবা কখনোই বন্ধ করা হয় নি কোন ধর্মঘটেই। কখনোই সবস্তরের চিকিৎসক একত্রে সর্বাত্মক ধর্মঘট করেননি এবং অধিকাংশ সময়েই ধর্মঘট শুধু ইন্টার্নদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অন্য সকল পর্যায়ের চিকিৎসক কর্তব্যরত থাকেন। তৃতীয়ত, উন্নত দেশের সংবাদ মাধ্যমে স্ট্রাইকের রিপোর্ট পড়লে দেখা যায় একটা নিরপেক্ষ অবস্থান। বারবার বলা হয় যে ক্রিটিক্যাল কেয়ার, ইমার্জেন্সি, ক্যান্সার কেয়ার ইত্যাদি চালু আছে। পক্ষান্তরে আমাদের দেশের কোন সংবাদ-মাধ্যমেই সচরাচর ইমার্জেন্সি, আই,সি,ইউ, করোনারি কেয়ার ইউনিট খোলা রাখার কথাটি প্রচার করা হয় না। তবে বারডেমে সাম্প্রতিক চিকিৎসক আন্দোলনের সময় চ্যানেল আই এই কথাটি প্রচার করেছিল। চতুর্থত, প্রায়ই নন-আর্জেন্ট পেশেন্টদের ছবি ছাপিয়ে রোগীদের “জিম্মি করা” প্রভৃতি অযৌক্তিক শব্দ এবং ভোগান্তির অতিরিঞ্জিত চিত্র পেশ করা হয়। আমার নিজের স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণের সময় ইন্টার্নরা নারী ইন্টার্নকে উত্যক্ত করার প্রতিবাদে ধর্মঘট করেছিল। আমরা মধ্যপর্যায়ের চিকিৎসকরা খুব সহজেই এই ঘাটতি পূরণ করে নিয়েছিলাম এবং ইন্টার্নদের কাজ আমরা করাতে আরো দ্রূত কাজ শেষ হয়েছিল। আর ইন্টার্নদের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হলে বুঝতে হবে যে, সিস্টেম আবার দাবী করছে যে, সরকারী মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা ইন্টার্নদের আবার অতীতের মত ইন সার্ভিস ট্রেইনী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হোক এবং তাদের ট্রেনিং পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশনে গণ্য করা হোক। বর্তমান ব্যবস্থায় ইন্টার্ন যেহেতু সরকারী কর্মচারী নয়- জনগণ তাদের সাথে প্রায়ই সাধারণ সৌজন্যটুকুও রক্ষা করে না। অত্যধিক রোগীর চাপে ডাক্তাররাও মাঝে মাঝে খারাপ ব্যবহার করেন সেটা তাঁরা স্বীকারও করেন। বেশ কিছু চিকিৎসক পেশার মর্যাদাহানি করছেন- এটাও সত্যি। কিন্তু তার জন্য সব চিকিৎসক দায়ী নন। বিশেষত, তরুণ চিকিৎসকদের সততা, ত্যাগ আর উদ্যমের ওপরই এই অন্যতম দরিদ্র স্বাস্থ্যব্যবস্থাটি টিকে আছে।
কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, চিকিৎসকদের ধর্মঘট শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং সমগ্র বিশ্বেই কোন বিরল ঘটনা নয়। বাংলাদেশের ধর্মঘটের সংখ্যা বেশি হলেও তা উন্নত দেশগুলোর মত সর্বাত্মক ও ব্যাপক নয়। সাংবাদিকদের ওপর চিকিৎসকদের আক্রোশের কারণ ঢালাওভাবে প্রমাণবিহীন “ভুল চিকিৎসা”-অভিযোগ নিয়ে একপেশে ও জাজমেন্টাল সংবাদ-পরিবেশন। তাছাড়া তরুণ চিকিৎসকদের নিম্নতম বেতন, বেসরকারী খাতে তাদের ওপর নির্যাতন, বিনা বেতনে ট্রেনিং, বেকারত্ব, হাস্যকর বেতনে অন্য পেশার চেয়ে পুরো একদিন বেশি কাজ করা (বেসরকারী খাতে ৪৮ ঘণ্টা যা ৬ টি পূর্ণদিবসের সমতূল), নিরাপত্তা ও ছুটির অভাব ইত্যাদি বিষয়ে কখনোই কোন সংবাদ বাংলাদেশের মিডিয়া দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রকাশ করেনি। অথচ বহির্বিশ্বে প্রায়ই চিকিৎসকদের অভাব-অভিযোগ, দাবী-দাওয়া নিয়ে সুন্দর নিউজ, ডকুমেন্টারি ফিল্ম এমনকি ডকুফিকশন ভিত্তিক টি,ভি-সিরিজও তৈরি হয়েছে। কিছু অপচিকিৎসক যেমন রোগীদের প্রতারণা করেন, তেমনি কিছু অপসাংবাদিকও চিকিৎসকদের ব্ল্যাকমেইলিং করে। সব মিলিয়ে চিকিৎসক ও সাংবাদিকদের মধ্যে এক অহি-নকুল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। মারামারি কোন সমাধান নয়। চিকিৎসকদের উচিত নিরাপত্তা, বেতন-বৃদ্ধি, কর্মঘণ্টা হ্রাস, অবকাশ বৃদ্ধি ইত্যাদি ইস্যুতে উপযুক্ত মাধ্যমে সরকারের কাছে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দাবি-দাওয়া পেশ করা। তেমনি সৎ সাংবাদিকদেরও উচিত খারাপ দিকগুলোর পাশাপাশি তরুণ চিকিৎসকদের অভাব-অভিযোগগুলো তুলে ধরা। ডাক্তার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরাও যে মানুষ- তাদেরও খেতে-পড়তে-ঘুমুতে হয়, জীবন চালাতে টাকা লাগে –সেই বাস্তবটা সাধারণ মানুষকে বোঝানো। তরুণ চিকিৎসকদের ওপর অত্যধিক কাজের চাপ ও মানুষের প্রত্যাশার জন্য শুধু প্রচার-মাধ্যম আর জনগণই নয়, আমাদের কিছু সাবেকী ধ্যানধারণার অধ্যাপক ও শিক্ষকও দায়ী। তাঁরাই জনমনে ২৪ ঘণ্টার বিরামহীন ডিউটি, কোন বিশ্রাম লাগবে না – এসমস্ত অবান্তর সেকেলে ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছেন। উল্লেখ্য, অতীতে যুক্তরাষ্ট্রে যে ৩০ ঘণ্টার টানা ডিউটি ছিল (অধুনাবিলুপ্ত) রেসিডেন্টদের, সেখানে কিন্তু রাত ১২টার পর অন কল আওয়ারটাও গণ্য হত। ডাক্তারের বিশ্রামের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল। আমরা অনেকেই কিন্তু ২৪ ঘণ্টাই জেগে বসে কাজ করেছি। বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রাইভেট হাসপাতালে ডাক্তারদের জন্য এমনকি বসার কক্ষও নেই। টিকেট কাউন্টারের মত জায়গায় তাদের বসতে দেয়া হয়। প্রোফেসরের রুমে এসি অথচ লেকচার-মেডিকেল অফিসারদের কমন রুমে গরমে জীবন অতীষ্ঠ, এমনকি ক্রস ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই- যা চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর। বাংলাদেশের কোন ভদ্রস্থ পেশায় এই হাস্যকর বৈষম্যগুলো নেই। এই অসুস্থ দ্বন্দ্বের অবসান হোক, চিকিৎসকেরা বিশেষত নির্যাতিত তরুণ চিকিৎসকেরা তাঁদের অধিকার ও সম্মান ফিরে পান। ধর্মঘট কোন পেশাতেই কাম্য নয় আবার কোন পেশাতেই একে আইন করে বন্ধ করা যায় না। উল্লেখ্য ১৯৭১ সালে আমাদের চিকিৎসক ও নার্সরা খুব কার্যকর কিছু ধর্মঘট পরিচালনা করে মুক্তির সংগ্রামে একটি বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। চিকিৎসকেরা কখনোই রোগীদের জিম্মি করার উদ্দেশ্যে ধর্মঘট করেন না। তা করতে হলে তাঁরা সব সেবাই বন্ধ করে দিতেন আমেরিকা বা কানাডার অতীতের ঘটনার মত। সব সংঘাত ও গোষ্ঠীবিদ্বেষের অবসান হোক।
[বিঃ দ্রঃ এই পোস্টের মন্তব্যে সর্বস্তরের চিকিৎসকগণ তাঁদের অভাব-অভিযোগের বর্ণনা দিতে পারেন]
নির্ঘণ্টঃ
http://www.bbc.com/news/health-18270523
http://www.theguardian.com/commentisfree/2012/jun/04/doctors-striking-nhs-industrial-action
http://careers.bmj.com/careers/advice/view-article.html?id=20004322
http://www.thejournal.ie/junior-doctors-strike-action-2-1119030-Oct2013/
http://news.google.com/newspapers?nid=1955&dat=19660628&id=oLwhAAAAIBAJ&sjid=fJwFAAAAIBAJ&pg=3735
,7338391
http://www.historymuseum.ca/cmc/exhibitions/hist/medicare/medic-5h07e.shtml
http://www.historymuseum.ca/cmc/exhibitions/hist/medicare/medic-7h11e.shtml
http://www.bmj.com/content/330/7496/864.3
http://www.english.rfi.fr/france/20121224-young-doctors-france-go-holiday-strike
মন্তব্য
অসাধারণ লেখা। চিকিৎসকদের (ইন্টার্ন চিকিৎসক মূলত) ধর্মঘট মানে যে পুরো চিকিৎসা সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়া না, এটা পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট পড়লে বোঝা যায় না। এই ধরনের ক্ষেত্রে পত্রিকার রিপোর্টিং এর আরেকটি ইন্টারেস্টিং বিষয় লক্ষ করা যায়। এরা শুরুই করবে (সাংবাদিকতার ভাষায় 'ইন্ট্রো' বলে মনে হয়) দুই একজন রোগীর মন্তব্য দিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেটা নন-ইমার্জেন্সী কেস এবং তারপর হয়ত হাল-হকিকত কিছু বয়ান করে। আমার এই 'মাইক্রো' পর্যায়ের দুই একটা উদাহরণ দিয়ে পুরো 'ম্যাক্রো' বিষয়াকে বিচার করার পদ্ধতিতে ঘোরতর আপত্তি আছে।
গোঁসাইবাবু
ধন্যবাদ।
বাংলাদেশে ডাক্তারদের পেশাগত সমস্যা অনেক। বিশেষত, তরুণ ডাক্তাররা এদেশেই সবচেয়ে বেশি শোষিত ও নির্যাতিত। বাংলাদেশই বোধহয় পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে তরুণ ডাক্তারদের বেসরকারী চাকরীতেও সরকারীর সমান বা আরো কম বেতন দেয়া হয় হাতে গোণা ৪-৫টা হাসপাতাল বাদে। অধ্যাপকদের সাথে তরুণ চিকিৎসকদের দূরত্ব কয়েক আলোকবর্ষের। পোস্টগ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষায় অকৃতকার্যতার হার পৃথিবীতে সর্বাধিক। অথচ দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও ঘাটতি বিশাল। ঠিক কী কারণে ৫ বছরের কোর্স গড়ে ৮-১০ বছর লাগে তার কারণ অনুসন্ধান করে এখন পর্যন্ত কোন গবেষণা হয় নি। অনেকেই মনে করেন, যে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পরীক্ষকদের অনেকেই ছাত্রদের নিজেদের ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। আমি নিউরোলজির এম,ডির এক পরীক্ষককে একবার বলতে শুনেছিলাম, "তিনজন পরীক্ষা দিসে, তিনটাই ভালো। কিন্তু তিনটারে তো আর পাশ করানো যাইবো না। একটারে করাইলাম।"- এই জ্বলন্ত সত্যি নিয়ে লেখাও খুব অনিরাপদ। প্রফেসরের কোন কথায় বৈজ্ঞানিক ভাবে কন্ট্রাডিক্ট করলে মোটামুটি সারাজীবনের জন্য পোস্টগ্র্যাজুয়েশনে ফেইল নিশ্চিত হয়ে যায় এমনটাই বড় ভাইদের মুখে শুনেছি। জনৈক মিডলেভেল এক সেমিনারে এই কাজ করে ৬ বার এফ,সি,পি,এস পার্ট-২ তে ফেল করেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার উনিই এম,আর,সি,এস পরীক্ষায় রেকর্ড মার্ক্স পেয়েছেন। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, প্রতিনিয়ত মেরুদণ্ড ঝুঁকিয়ে থাকা, নিম্নতম বেতন, পাবলিকের মার- এই দুর্বিষহ পরিবেশের মধ্যেও আমাদের তরুণ ডাক্তারদের জন্যই বাংলাদেশ স্বাস্থ্যখাতে পৃথিবীর বিস্ময়। এগুলো নিয়ে আজ পর্যন্ত একটা লেখাও হয় নি!
দুর্দান্ত লিখেছো ভাই!
প্রতিবাদ জারি থাকুক।
প্রতিরোধ জারি থাকুক।
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
ওডিনদা, আমি দুর্দান্ত লিখতে চাই না। আমি চাই সব তরুণ পেশাজীবির জন্য একটা দুর্দান্ত ভবিষ্যৎ, শুধু চিকিৎসকদের জন্য নয়।
ক্লান্ত হয়ে গেছি ব্যক্তিগত আলাপে, ফেসবুকে মানুষকে আমাদের মতো তরুণ ডাক্তারদের দুর্দশা বোঝাতে বোঝাতে
------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
ক্লান্ত হলে চলবে না। ক্লান্ত কেন হয়ে গেছেন তাও বলছি। আসলে দেখা যায়, তরুণ চিকিৎসকরা খুব আবেগতাড়িত হয়ে তাদের দুর্দশার কথা হড়বড় করে বলে যায়। এতে মানুষ শোনেও না বোঝেও না। আমাদের মূল পয়েন্টগুলো খুঁজে বের করে সেগুলো থেকে উত্তরণের চেষ্টা করতে হবে। আমার মতে মূল পয়েন্টগুলো হচ্ছেঃ
১। চাকরিতে পর্যাপ্ত বেতনের অভাব এবং সিনিয়রদের সাথে আয়ের অনুপাতের অবিশ্বাস্য বৈষম্য।
২। চিকিৎসকদের কর্মস্থলে বস্তুত কোন নিরাপত্তা নেই।
৩। পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশনের জন্য তরুণ চিকিৎসকরা প্রফেসরদের কাছে অস্বাস্থ্যকর রকম ভাবে দায়বদ্ধ।
৪। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পরীক্ষক ও পরীক্ষার্থীর মধ্যে বিদ্যমান অসুস্থ বাজার সম্পর্ক এবং তারই মিথস্ক্রিয়ায় পোস্টগ্র্যাজুয়েশনে পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিম্ন পাশের হার,
৫। দেশে পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক থাকার পরও তাদের সপ্তাহে কমপক্ষে ৬টি কর্মদিবস , মাঝে মাঝে ৭ দিনই। সরকারী ও সকল প্রকার মানবিক নিয়মের ঊর্ধ্বে থাকা বেসরকারী হাসপাতালগুলো তাদের মুনাফার জন্য সরকারী বা তার চেয়েও কম বেতনে ডাক্তারদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে ৪৮ ঘণ্টা বা ৬টি ৮ ঘণ্টার পূর্ণ কর্মদিবস (হ্যাঁ চারদিনে করলেও!) যা বাংলাদেশে বা বিশ্বেই কোন সিভিল পেশায় নেই। এই অন্যায় বাস্তবায়ন করার জন্য তারা ডাক্তারদের বোঝায় যে, ডাক্তাররা শ্রম-আইনের ঊর্ধ্বে এবং সারা পৃথিবীতেই তাদের ৪৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়- যেটা একটা নোংরা মিথ্যাচার। আসলে ৪০ ঘণ্টার জায়গায় ৪৮ ঘণ্টা করালে কম ডাক্তার নিয়োগ দিলেই চলে- আসল ব্যাপার হল এটা! জীবিকার তাগিদে বর্তমানে তরুণ ডাক্তাদেরদের সপ্তাহে ৭২-৮৪ ঘণ্টা কাজ করতে হয় যার থেকে সাকুল্যে আয় ৩০-৩২ হাজার টাকা!
৬। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্যব্যবস্থাগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় যে, সেরা ব্যবস্থাগুলো সরকার নিয়ন্ত্রিত এবং 'আউট অফ পকেট এক্সপেনডিচার' খুবই কম। অর্থাৎ সেবাপ্রদানের মুহূর্তে রোগীর থেকে কোন টাকা নেয়া হবে না- সেটা আগেই বীমা বা ট্যাক্সের আকারে নেয়া হবে। বছর শেষে উদ্বৃত্ত টাকা ফেরত দেয়া হবে। অথচ আমরা এই দরিদ্র দেশে ক্রমাগত ভারতকে আর আমেরিকাকে নকল করে উচ্চব্যয় ও নিম্নমানের বেসরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলছি যার পরিণাম ভয়ঙ্কর। আমি বেসরকারীকরণের বিরোধী নই। কিন্তু মানহীন বেসরকারীকরণের বিরোধী। দেশের ৫১ টি বেসরকারী মেডিকেল কলেজের মধ্যে ৩০টিই মানহীন! প্রথম ১০-১২টার উপযুক্ত অবকাঠামো আছে এবং তার পরের বড়জোর ৮-১০টির মেডিকেল কলেজ চালানোর প্রাথমিক যোগ্যতা অর্থাৎ ২৫০ বেডের হাসপাতাল আছে।
এই তো সমস্যা। এবার চলুন সমাধানগুলো একসাথে ভেবে বের করি!
ধন্যবাদ।
বাঙালিদের মনে একটা ভুল ধারণা আছে, বিদেশ মানেই স্বর্গরাজ্য, সেটা অ্যামেরিকা ইউ এস এ কানাডা হলে তো কথাই নেই। একবার সবাইকে এই স্বর্গরাজ্যে এনে ফেলতে পারলে দেখা যেত কি পরিমাণ ভালো লাগে তাদের।
আমি অ্যামেরিকাতে থেকেও ডাক্তার দরকার হলে এখনো দেশে আমার বোনকে ফোন দেই। কারণ এদেশের ফ্রি ডাক্তার দেখে যা বলে, তার চেয়ে আমার বোন ফোনে শুনে ভালো ডায়াগনোসিস করতে পারে।
দেশে কিছু হলেই সিজারিয়ান বেবি করিয়ে দেয় বলে ডাক্তারদের নিয়ে অনেক ক্ষোভ আছে, আমার বোন নিজে ডাক্তার হয়েও দুইটা বেবি নিয়েছে সিজারিয়ান, নিজের ডিসিশনে। যদিও সিজারিয়ানে লং টার্ম ভুগতে হয়। কারণ একটাই, নিজে ডাক্তার বলেই সে জানে আমাদের দেশের ইনফ্রাস্ট্রাকচারে নরমাল ডেলিভারিতে হুট করে কোন জটিলতা দেখা গেলে হয় তো সেটা ঠিকমত মোকাবেলা করা যাবে না।
এখন সেই ইনফ্রাস্ট্রাকচার ঠিক না করে ডাক্তারকে কসাই বলার মানে কী থাকতে পারে, সেটা কেউ চিন্তা করবে না। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা ভালো না ঠিক, কিন্তু ভালো ডাক্তার নেই সেটা কোনভাবেই ঠিক না। হ্যাঁ, টাকালোভী কসাই ডাক্তার নেই তা নয়, সেটা কোন পেশায় নেই?
আর অন্য যে কোন পেশার মত ডাক্তাররাও দিনশেষে মানুষ। তাদের ধর্মঘটে যাওয়ার অধিকার অবশ্যই আছে। স্পেশালি ইন্টার্ন ডাক্তার, যারা মোটামুটি কর্মীবাহিনী, তাদের ধর্মঘটে যাওয়াতে যে চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে পড়ে না, সেটা বোঝার মত বুদ্ধি থাকা উচিত। দুর্ভোগ হয় সেটা সত্যি, কিন্তু হসপিটালে ঢুকে ডাক্তার পিটিয়ে হাতের সুখ করে নেবেন, আবার তারপর সেই ডাক্তারকেই মারতে গিয়ে হাতে হওয়া স্প্রেইনের চিকিৎসা করতে বলবেন, এরকম ডাবল স্ট্যান্ডার্ড চলে না।
___________________
রাতের বাসা হয় নি বাঁধা দিনের কাজে ত্রুটি
বিনা কাজের সেবার মাঝে পাই নে আমি ছুটি
পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপু।
এটা আমাদের অধ্যাপকদের কে বোঝাবে? তাঁরা নিজেরা প্রতিদিন ৮টা-আড়াইটা অফিস (সবাই ঠিকমত করেন না অবশ্য!) করে ৩টা থেকে চেম্বারে বসেন। বাসায় ফেরেন রাত ১২ টায়, কেউ বা ২টায়। শুক্রবারেও অন্য কোন উপজেলায় গিয়ে সেবার নাম করে ব্যবসা। এমন কিন্তু সবাই না। কিন্তু পলিসিমেকারদের অনেকেই এমন। কাজেই এরা তরুণ ডাক্তারদের ওপর সীমাহীন কর্মঘণ্টা চাপিয়ে দিয়েছে।
পোস্টগ্র্যাজুয়েশনের অবিশ্বাস্য দীর্ঘসূত্রীতার কারণ, আমাদের স্বভাব- আমরা সব একা খেতে চাই। প্রফেসর ভাবেন সব রোগী আমার চাই। পাশ করলেই এরা আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। ৩ বছর দিনরাত গাধার খাটুনি খেটে ট্রেনিং করে, ১ বছর কোর্স এবং অবিশ্রান্ত পড়াশোনার পরও প্রায় সবাই ফেল কেন করে? আমাকে এক কর্পোরেট দালাল অধ্যাপক বলেছিলেন, "তোমরা ঘণ্টা গুণে কাজ কর, তাই ফেল কর। নইলে সারা পৃথিবীতে ৭০-৮০% পাশ করে। " আমি কিছু বলিনি। কারণ ওই মহাশক্তিধর অধ্যাপকের সামনে আমি অসহায়। উনি আমাকে কার্ডিয়াক সার্জারীর একটা পোস্টে নেবেন বলেছিলেন যদি তাঁকে ৬ দিন ২৪ ঘণ্টার কমিটমেন্ট দিই। আমি মানে মানে কেটে পড়ে বেঁচেছিলাম!
তরুণ চিকিৎসকদের সাধারণ মানুষ বড় ডাক্তারদের সাথে গুলিয়ে ফেলে। তাঁদের অনেকেই হিপোক্রেটক ওথের সম্মান রাখেন না। কিন্তু তাঁরা থাকেন গজদন্ত মীনারে, সাধারণ মানুষ পায় আমাদের, আমাদের ওপরই রাগ ঝাড়ে! অবশ্য সবাই এমন না। এ,বি,এম আবদুল্লাহ স্যারের মত মহান মানুষও আছেন!
ঠিকই বলেছেন। এই পচে যাওয়া ইনফ্রাস্ট্রাকচার পুরোটা বদলাতে হবে। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
নতুন মন্তব্য করুন