ডাগর ঘরানায় কণ্ঠশীলন ও ধ্রুপদ-শিক্ষাপদ্ধতিঃ পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর -১

নির্ঝর অলয় এর ছবি
লিখেছেন নির্ঝর অলয় [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ২০/১১/২০১৪ - ১০:৩৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বেঙ্গল ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টিভ্যালের আগে শিল্পীদের টেকনিক্যাল ইন্টারভিউ করার সব রকম চেষ্টা করে যখন হাল ছেড়ে দিয়েছি, তখন একদিন হঠাৎ মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! মরিয়া চেষ্টা হিসেবে কয়েকদিন আগে পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরকে মেসেজ পাঠিয়েছিলাম ধ্রুপদের জন্য ভয়েস কালচার বিষয়ে ইন্টারভিউ করার জন্য ১ ঘণ্টা চেয়ে। উত্তরের আশা করি নি। ২৯ নভেম্বর হাসপাতাল থেকে ফিরে দেখি উদয়জি উত্তর দিয়েছেন- “আমি ঢাকায় আছি। এই আমার নাম্বার, কল করুন।“ ফোন করে এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে বন্ধু অমিতকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলাম হোটেলে। ৪৫ মিনিট সময় দিয়েছিলেন, সেটা গিয়ে দাঁড়ালো প্রায় আড়াই ঘণ্টার এক অবিস্মরণীয় আড্ডায়!

পাশ্চাত্যের ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতের তুলনায় আমাদের ক্লাসিক্যাল সঙ্গীতে ভয়েস কালচার কিছুটা অবহেলিত বিষয়। আমাদের সঙ্গীতে প্রায়ই কণ্ঠস্বরের স্বাভাবিকতা, মিষ্টত্ব, জোয়ারি বা রেজোন্যান্স ইত্যাদি গুণাবলির চেয়ে কারুকার্যের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে কণ্ঠসঙ্গীতে গলার আওয়াজের প্রভাবগুণ গলার কাজের চেয়ে অনেক বেশি। আর গলার রেয়াজ বা ভয়েস কালচার সম্পর্কে কথা বলার জন্য এ যুগে পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরের চেয়ে যোগ্য আর কে আছেন! আমার শ্রবণানুভূতির অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কণ্ঠস্বরের টিম্বার, নিয়ন্ত্রণ ও প্রক্ষেপনে এ মুহূর্তে গোটা ভারতবর্ষে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত ও অন্যান্য সকল সঙ্গীত মিলিয়ে পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরের মতো অনিন্দ্য কণ্ঠ আর নেই। কী বলব পণ্ডিতজি সম্পর্কে? এমন গলাও বাস্তবে কখনো শুনি নি (ফৈয়াজ খাঁ আর বড়ে গুলাম আলী খাঁ সাহেবের রেকর্ড বাদ দিলে), এত ভালো মানুষও কখনো দেখিনি। পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকর ডাগর ঘরানার উত্তরসূরী এবং এই মুহূর্তের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধ্রুপদ গায়ক। এই ব্যতিক্রমী সাক্ষাৎকারটি বাংলাদেশের শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শিক্ষার্থীদের উপকারে এলে আমাদের পরিশ্রম সার্থক হবে। কাজটি মূলত একাডেমিক এবং সঙ্গীতের সিরিয়াস শিক্ষার্থী ও শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে। ৩৯ পৃষ্ঠার মূল পাণ্ডুলিপির চুম্বক অংশ সচলের পাঠকদের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হল।

প্রশ্নঃ আপনার সঙ্গীত শিক্ষার সূচনা কীভাবে?
পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ আমার জন্ম মধ্যপ্রদেশে, যদিও আমি মহারাষ্ট্রীয়। মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়ন নামে এক ছোট্ট শহরে আমার জন্ম, ইন্দোরের কাছে। আমার ৮ বছরের বড় বোন একটা গানের স্কুলে শিখত। এই সঙ্গীত বিদ্যালয়টি গোয়ালিয়র ঘরানার শিক্ষাপদ্ধতি অনুসরণ করত। আমার বয়েস যখন ৭-৮ বছর তখন আমি দিদিকে গাইতে শুনতাম। আমি সবসময় দিদির সাথে গাইতাম, ওর গায়কী নকল করতাম। ওকে শেখাতে একজন গুরু বাসায় আসতেন। আমিও একই গান গাইতাম। তাই আমার সঙ্গীতশিক্ষার অনুপ্রেরণা এবং প্রারম্ভিক শিক্ষা আমি পাই আমার বড় বোন এবং আমাদের গোয়ালিয়র ঘরানার সেই গুরুজির কাছে। ৯ বছর বয়সে আমি সঙ্গীতবিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তখন সিক্স, সেভেন না এইটে পড়ি ঠিক মনে নেই। সকালে স্কুলে যেতাম, বিকেলে গানের স্কুল। এই গানের স্কুলে সব রকম গানই শিখতে হত। অবশ্যই খেয়ালের প্রাধান্য ছিল। কারণ খেয়ালই ভারতে সবচেয়ে জনপ্রিয় সঙ্গীত(শাস্ত্রীয়-অনুলেখক)। কাজেই প্রধানত খেয়াল ছাড়াও পাশাপাশি সেখানে ধ্রুপদ, ধামার, টপ্পা, ঠুমরী এবং অন্যান্য ফর্মও সেখানে শেখানো হত। কোনটা শিখতে চাই সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত ছিলাম না, কারণ আমি ছিলাম খুবই ছোট। আমি সব ধরণের গানই সমান আগ্রহ নিয়ে গাইতাম। সঙ্গীতে আমার আগ্রহ বেড়ে যাওয়াটাও একটা আপতিক ঘটনা। মাঝে মাঝে আমার বাবা-মা বলতেন-“যদি আমরা একজন ভালো গুরু পাই, তবে তোমাকে তাঁর কাছে পাঠাব।“- কিন্তু সেটা কী সঙ্গীতের কোন ধারায়, তা নিয়ে ভাবনা ছিল না। সেখানে আমি সব রকমের গানই শিখছিলাম, মূলত খেয়াল।

প্রশ্নঃ আপনার বড় বোনের কাছে শেখা প্রথম রাগ কোনটা ছিল?
পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ না, আমার মনে নেই। আমি আসলে তখন কোন রাগ শিখিনি। বিধিমত বসে কোন রাগ দিদির কাছে শেখা হয় নি। দিদি যে রাগ গাইত, আমি সেটাই শুধু গাইতাম। আমি শুধু গানটাই শুনতাম, ওর মধ্যে কী স্বর লাগছে তা নিয়ে ভাবতাম না। ধীরে ধীরে আমি জানলাম- এটা মালকৌঁস, এটা ইমন, এটা ভৈরব ইত্যাদি।

প্রশ্নঃ তাহলে আপনার প্রাতিষ্ঠানিক সঙ্গীতশিক্ষার শুরু ন’বছর বয়সে সঙ্গীতবিদ্যালয়ে?
পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ হ্যাঁ।
প্রশ্নঃ তারপর কীভাবে আপনি ডাগর ঘরানার প্রসিদ্ধ শিল্পীযুগল উস্তাদ জিয়া মহিউদ্দীন ডাগর আর উস্তাদ জিয়া ফরিদুদ্দীন ডাগরের কাছে গেলেন?
পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ এটা আমার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট। আমি ন’বছর থেকে পনের বছর বয়স পর্যন্ত গান শিখছিলাম। আমার তখন পনের বছর বয়স। আমি কাগজ পড়ছিলাম। সেটাও আমাদের নিজেদের নয়। আমাদের প্রতিবেশীর খবরের কাগজ! তখনকার দিনে জীবনযাত্রা খুব সরল ছিল। আমরা প্রায়ই খবরের কাগজ শেয়ার করতাম প্রতিবেশীদের সঙ্গে। ওদের কাগজ আমাদের বাসায় ছিল। আমি তখন পনের বছরের এবং দেশে কী হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে মোটেই চিন্তিত ছিলাম না। আমি কাগজটা দেখছিলাম। আমি প্রতিদিন কাগজ পড়তামও না। হঠাৎ আমি মধ্যপ্রদেশ সরকারের একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম, এটা ১৯৮১ সালে। তারা ধ্রুপদ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। শুধু ধ্রুপদই নয়, সেখানে সারেঙ্গি, পাখাওয়াজ শেখারও কেন্দ্র ছিল। এছাড়া তাঁরা কিছু শিক্ষার্থীকে আমার ‘বড়ে গুরুজী’ উস্তাদ জিয়া মহীউদ্দীন ডাগরের কাছে বীণা শেখার জন্যও পাঠায়। কিছু শিক্ষার্থীকে সন্তুর শেখার জন্যও পাঠানো হত। হারমোনিয়ম, সেতার, তবলা ইত্যাদি খুব জনপ্রিয় হলেও বীণা, সারেঙ্গী, পাখাওয়াজ, টপ্পা গায়কী, ধ্রুপদ গায়কী ইত্যাদিতে বেশি লোক যেত না। তারা এই শিল্পমাধ্যমগুলোকে পুনরিজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন। ভোপালে তাদের একটা কেন্দ্র ছিল। ভোপাল মধ্যপ্রদেশের রাজধানী। আমি বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করলাম। তাঁরা বললেন আবেদন কর, তখন সেটার জন্য আবেদন করলাম। ইন্টারভিউতে ডাক পড়ল। আমার মনে আছে আমার বড়ে গুরুজী জিজ্ঞেস করেছিলেন, “যদি তোমাকে নির্বাচিত করা হয়, তুমি কি আসবে?” আমি বললাম, “অবশ্যই, আমি তো সেজন্যেই এসেছি। যদি সুযোগ পাই তাহলে আমি তো খুবই ভাগ্যবান!” কাজেই আমি ভাবলাম যে, আমি সিলেক্টেড। আমি তখন টেন্থ বা এলেভেন্থ স্ট্যান্ডার্ডে। পড়াশোনা বন্ধ করে কেন্দ্রে যাবার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে আমার মা-বাবা এক ঘণ্টাও ভাবেন নি। আমি ওখানে চলে গেলাম। অন্য আত্মীয়রা ভাবছিল, “না না, কী করছে।“ আমার বাবা ছিলেন এডভোকেট। তাই তারা বলছিলেন, “তুমি গান করো, আমরা গানের বিরুদ্ধে নই, কিন্তু তোমার একাডেমিক শিক্ষাও শেষ করা উচিত।“ কারণ সঙ্গীত কী দেবে তা নিয়ে তাদের কোন ধারনা ছিল না। আমারও কোন ধারনা ছিল না। এখনো আমি কনসার্ট পাবার জন্য বা নাম-যশের জন্য রেয়াজ করি না। এটা সারা জীবনের জন্য। যদি তুমি তোমার বিষয়টাকে ভালোবাসো তবে তো তুমি আশীর্বাদপ্রাপ্ত।

প্রশ্নঃ সত্যিই মহান। পণ্ডিতজি আপনার কি মনে আছে, কবে এই দুই মায়েস্ট্রোর অধীনে আপনার শিক্ষা শুরু হল?
পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ নভেম্বর, ১৯৮১। আমি ধ্রুপদ জানতাম। কিন্তু সেটা শুধু কম্পোজিশন, দ্বিগুণ, তিনগুণ, চৌগুণ আর কিছু লয়কারী। কিন্তু কোন গভীর অধ্যয়ন ছিল না, রাগ, আলাপ, শ্রুতি সম্পর্কে। কোন রাগে কোন ঋষভ, কোন গান্ধার লাগে, বিভিন্ন পঞ্চম, বিভিন্ন ষড়জ- ইত্যাদি। (এই কথাদুটির ব্যাখ্যা প্রয়োজন। ষড়জ এবং পঞ্চম অচল স্বর। এখানে পণ্ডিতজী বিভিন্ন রাগে বিভিন্নভাবে এই স্বরগুলোর প্রয়োগরীতি বা স্বরোচ্চারকে বুঝিয়েছেন)। খুব গভীর স্টাডি, একেকটা স্বরের গভীর অধ্যয়ন। একটা স্বরের মধ্যে পুরো স্পেসটাকে দেখা। একটা স্বর একটা চরিত্রে পরিণত হয়, একটা স্বরে যত রকম রস উপলব্ধি করা যেতে পারে তার অধ্যয়ন। কেউ কেউ বলে প্রত্যেক রাগের নির্দিষ্ট রস আছে। কিন্তু আসলে সব রাগেই সব আবেগ রয়েছে এবং কোন রাগকে কোন নির্দিষ্ট আবেগ প্রকাশের মাধ্যম করা উচিত নয়। আমাদের উচিত ট্র্যাডিশন অনুযায়ী গাওয়া বা বাজানো। সেটা তুমি যে ঘরানা বা ট্র্যাডিশনেরই হও না কেন, তোমার দায়িত্ব পুরো সততার সাথে, পুরো মনোযোগ দিয়ে, সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে রাগকে প্রকাশ করা। তুমি তোমার সবটুকু দাও, এবং শ্রোতাদের রস সম্পর্কে ভাবতে দাও। এটা একটা অশেষ বিষয়। আমরা বলতে পারি না যে, ঋষভের এই রস, তোড়ির এটা, ইমনের এটা ইত্যাদি। কেউ হয়তো ইমন শুনে চঞ্চল হয়ে উঠতে পারে। এটা খুবই সাবজেক্টিভ। তাই আমি ওতে যাই না। একবার আমি জুরিখে গাইছিলাম। ২-৩জন মহিলা ক্রমাগত কাঁদছিলেন, আবার ২-৩ জন মহিলা ক্রমাগত হাসছিলেন- ৩ বা ৪ সারি পেছনে। কাজেই কী রস সৃষ্টি হচ্ছে সেটা বলা খুব কঠিন কাজ(হাসি)। এভাবেই শুরু হয়েছিল। তারপর উস্তাদদের কাছে আসার পর- তানপুরা টিউনিং এবং তানপুরার সাথে গাওয়া –এ এক নতুন বিশ্বের সন্ধান দিল। কীভাবে প্র্যাকটিস করতে হয়। আমি সাধারণত ভোর চারটায় উঠতাম সাধনার জন্য। এস,আর,এ তেও আমি ৫টায় শুরু করি। যেটা নাকি কখনো হয় নি। আজ মাথুর সাহেব বলছিলেন- সব ছাত্র ৯টার দিকে ঘুম থেকে ওঠে। কিন্তু অনেকে মহান শিল্পী তাঁদের ষড়জ সাধনা করতেন সকালে। পুরনো বুজুর্গদের জিজ্ঞেস করলে আমরা খুব সহজেই জানতে পারি।

প্রশ্নঃ আমরা পরে এটা নিয়ে আরো গভীরভাবে আলোকপাত করব। আপনার ইন্টারভিউ নিয়ে আর কিছু প্রশ্ন করি। আপনাকে কী গাইতে বলা হয়েছিল?
পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ তাঁরা আমাকে কোন নির্দিষ্ট রাগ গাইতে দেন নি। কিন্তু আমি ধ্রুপদ তৈরি করে গিয়েছিলাম, যেহেতু এটা ধ্রুপদের অডিশন। আমি শঙ্করা রাগে ধ্রুপদ গেয়েছিলাম। সব মহান ব্যক্তিরা বসেছিলেন। আমার দুই ওস্তাদ, বীণাবাদক আসাদ আলী খাঁ সাহেব, কুমার গন্ধর্ব, রাজা ছত্রপতি সিং, ঠাকুর জয়দেব সিং। ডঃ প্রেমলতা শর্মা। ঠাকুর জয়দেব সিং এবং ডঃ প্রেমলতা শর্মা ছিলেন তত্ত্বীয় শাস্ত্রের অসাধারণ ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন ব্যক্তি। তাঁরা আমার ওস্তাদদের পিতামহকেও শুনেছেন! এই ইন্টারভিউ এর সময় ঠাকুর জয়দেব সিং এর বয়স পঁচাশির বেশি ছিল। উনি উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেব, আবদুল করীম খাঁ সাহেবদের শুনেছিলেন।
- জাকিরউদ্দীন খাঁ সাহেব?
- হ্যাঁ। এছাড়াও ছিলেন সারেঙ্গীবাদক আবদুল লতিফ খাঁ সাহেব, পাখাওয়াজবাদক স্বামী পাগল দাস। আমি এঁদের সবার সামনে গাইলাম। কেউ একজন জিজ্ঞেস করলেন- তুমি কি খেয়ালও গাও? আমি তো খেয়াল শিখতাম। তাই আমি মালকোষে একটা খেয়াল গাইলাম। তাঁরা কিন্তু আমার শঙ্করা আর মালকৌঁস শুনছিলেন না। এই গুণী লোকগুলোর ছিল দূরদৃষ্টি- “ইয়ে কেয়া কর সাকতা হ্যায়।”

প্রশ্নঃ শঙ্করা এবং মালকৌঁসে কী কম্পোজিশন গেয়েছিলেন মনে আছে?
পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ না। তবে চৌতালের ধ্রুপদ এবং একটা ছোট খেয়াল গেয়েছিলাম।

প্রশ্নঃ এই মহান ব্যক্তিদের সামনে আপনি নার্ভাস বোধ করেন নি?
পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ না। সে সময়ে নার্ভাসনেস কী বস্তু তা আমি জানতাম না। (অট্টহাসি!)

প্রশ্নঃ পণ্ডিতজি, ভারতীয় ক্লাসিক্যাল মিউজিকে ভয়েস কালচার বিষয়টি পাশ্চাত্যের ক্লাসিক্যাল মিউজিকের তুলনায় কিছুটা অবহেলিত। পাশ্চাত্যে যেখানে আওয়াজের গুণের ওপর খুব বেশি জোর দেয়া হয়, আমাদের এখানে আওয়াজের গুণের চেয়ে গলার কারুকাজের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। আমার মতে বর্তমান ভারতীয় ক্লাসিক্যাল মিউজিকে আপনার গলাই গুণধর্মে সেরা, আপনার কণ্ঠ গভীর, মন্দ্রিত এবং সব ধরণের গুণই আছে। তিন সপ্তকে সমান স্বাচ্ছন্দে বিস্তৃত আপনার গলা- কাজেই আমরা চাই আপনি ভয়েস কালচার নিয়ে আমাদের কিছু বলুন। প্রথমে আমরা শুরু করব পিচ নির্ণয়ের সঠিক পদ্ধতি দিয়ে।
পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ পিচের প্রসঙ্গে আসার আগে আমি একটু বলতে চাই। কারণ আমি গত ২৫ বছর যাবৎ বিদেশে গাইছি। আমি পাশ্চাত্যের বহু গায়কের সংস্পর্শে এসেছি। আমি তাদের সাথে কথা বলেছি। এখন আমি সিদ্ধান্তে এসেছি যে দুই সংগীতধারার মধ্যে তুলনার কোন দরকার নেই। কিন্তু আমি তুলনার চেষ্টা করেছি। কারণ তাদের থ্রো খুবই ভালো, তাছাড়া বিভিন্ন ভয়েসের ব্যবহার করে থাকে(ভয়েস রেজিস্টার)। দু মাসে আগে আমি গ্রীসে ছিলাম। এক তরুণী আমার ওয়র্কশপে এসেছিলেন। তিনি অসামান্য গায়িকা ছিলেন, কী গলা আর কী রেঞ্জ! তিনি আমাকে বললেন কী করে ভোকাল কর্ডকে নিরাপদ রাখতে হয় আর কণ্ঠের বিভিন্ন স্থান বুঝতে হয়। তিনি আমাকে এগুলো শেখাচ্ছিলেন। আমি শুধু একটু অভিজ্ঞতা অর্জন করতে চাচ্ছিলাম। আমি এটা আমেরিকাতেও করেছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার মনে হয়েছে যে, যদি আমরা কণ্ঠস্বর কোথা থেকে উৎপন্ন হচ্ছে তাতেই আমাদের মনোযোগ আর উদ্যম নিবিষ্ট করি, তাহলে আমরা রাগ, রস, ভাব এবং আমাদের সামগ্রিক সংস্কৃতির পরিচয় আমাদের গানে তুলে ধরার উদ্যম ও মনোযোগ হারিয়ে ফেলব। এতে করে আমাদের কালজয়ী সঙ্গীতের ক্ষতি হবে। যখন আমি কোন জায়গায় গাই, তখন আমার উচিত রাগ বা স্বরের মাধ্যমে ২০০ বা ৪০০ বছর আগে চলে যাওয়া। আমার নিজেকে ওখানে খুঁজে পাওয়া উচিত, সুন্দর হলে বসে সুন্দর সাউন্ড সিস্টেমে গাইছি- এভাবে নিজেকে কল্পনা করা উচিত নয়। নিজেকে সংযুক্ত করা উচিত উচ্চতর সাঙ্গীতিক আধ্যাত্মিকতা আর উচ্চতর মননশীলতার জগতে। যদি আমি ভাবতে থাকি, আমার কণ্ঠস্বর কোত্থেকে আসছে আর আমি কি সঠিক প্রত্যঙ্গগুলো স্পর্শ করে স্বর উৎপন্ন করছি কিনা - তাহলে আমি সেটা করতে সমর্থ হবো না। আমার ভুল হতে পারে। কিন্তু আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, সঠিক পদ্ধতিতে রেয়াজ বা সাধনাই একমাত্র পথ। আরেকটা ব্যাপার পাশ্চাত্যে দলগতসংগীতের প্রচলন খুব বেশি। তারা বৃন্দগান করে এবং সিদ্ধান্ত নেয় কার গলা কোন অক্টেভে বেশি ভালো লাগে। আমি ঠিক জানি না- ওরা এর জন্য আলাদা নামও দিয়েছে।
-বেস, ব্যারিটোন, টেনর ইত্যাদি।
পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ হ্যাঁ। আর আমাদের সংগীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। কারণ আমরা বিশ্বাস করি শিল্প বা সঙ্গীতে অন্য কাউকে নকল করা খারাপ, কিন্তু নিজেকে নকল করা সবচেয়ে খারাপ। কাজেই কারো গলা বা গান নকল করার চেষ্টা সম্পূর্ণ ভুল। কাজেই আমি মনে করি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য খুব বড় ব্যাপার। এখন আপনার পয়েন্টে আসছি। সবার আগে, অসাধারণ ধৈর্য থাকতে হবে, আর নো শর্টকাট। এবং শেষপর্যন্ত ওই ‘লংকাট’টাই শর্টকাট হয়ে যাবে। আমি দেখেছি, কিছু শিক্ষার্থী নানা শিক্ষকের কাছে শেখার জন্য ঘুরতে থাকে। কিছুদিন এখানে তো কিছুদিন ওখানে। ২৫-৩০ বছর পরও দেখা যায় তারা কোন পর্যায়ে পৌঁছুতে পারে না। সঙ্গীতকে তারা বন্ধু হিসেবে পায় না। কারণ তাদের পথটাই ভুল। কাজেই ধৈর্য এবং তারপর নিজের গলার সামর্থ্যকে চেনা। এবং গলার সঠিক থ্রো। ভয়েস কালচার কী? ভয়েস কালচার মানে এই নয় যে, আমার আপনার মত সুন্দর কণ্ঠস্বর হোক, ধরে নিন। না, সেটা ভুল। আমার নিজের কণ্ঠস্বর এবং তাকে প্রস্তুত করার পদ্ধতিই ভয়েস কালচার। কাজেই ধৈর্য এবং সঠিক নির্দেশনা। আমি ধ্রুপদেরও কোন অথোরিটি নই। আমি ধ্রুপদের একটা ধারা। আরো দশটা ধারার ধ্রুপদের মানুষ আছে। আমি শুধু একটা লাইন বা ঘরানার যেটা আমার গুরু। যেটা তাঁরা আমাকে শিখিয়েছেন বা আমি উপলব্ধি করেছি- আমি সেই অনুযায়ীই কথা বলছি। আমি যেটা শিখেছি, একটা স্বর যেমন সা গাওয়াই কণ্ঠকে মার্জিত করবে। কখন কালচার করবে? যখন সঠিক প্রক্ষেপন, সঠিক উচ্চারণে গাওয়া হবে। জোর করে লাভ হবে না, লুকোলেও লাভ হবে না। কী সাহায্য করবে? ভল্যুম। ভল্যুম কালচার। ভল্যুম কালচারস ইয়োর ভয়েস। আগের দিনে রেডিওতে ভল্যুমের গোল বাটন থাকত। সেটাকে একটু খুলে দিতে হত। সেরকম এই গলাটাকে একটু খুলে দিলেই ভালো ফল হবে। যদি সঠিকভাবে খোলা না হয় বা জোর কড়া হয় সেটা ভালো হবে না। আর সঠিক উচ্চারণে। এটা খুবই সহজ মনে হয়। কিন্তু এটাই একমাত্র পথ। এটা হচ্ছে সা বা আ-কার ঠিক করার একদম বুনিয়াদী পন্থা। এ হচ্ছে গলাকে খুব সরলাভাবে তৈরি কড়া। তারপর বাকি সব আসবে। কণ্ঠের পরই আসবে দম। দমের জন্য আমি এস,আর,এ তে ভোর পাঁচটায় যেটা শেখাই- ভোর বেলায় সারারাত বিশ্রামের পর- লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে সোজা হয়ে বসে সা গাইতে হবে। একদমে যতক্ষণ সম্ভব। এটা আস্তে আস্তে বাড়াতে হবে। কিন্তু মাঝে মাঝে কমতেও পারে। এমনকি দুবছর পরও কমতে পারে।

প্রশ্নঃ মিডল অক্টেভ সা নাকি খড়জ?
পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ না, না, না। খরজ না। খড়জ ছোঁওয়াই তো খুব কঠিন কাজ শুরুতে। মধ্য সপ্তকের সা। আগে মধ্যসপ্তকের সা ঠিক করতে হবে। সা থেকে মন্দ্রসপ্তকের পঞ্চম পর্যন্ত প্রথমে পরিস্কার হতে হবে একদম। সা তে ২০-২৫ মিনিট, নি তে ৫-৭ মিনিট, ধা তে ৫-১০ মিনিট এবং আবার পঞ্চমে ২০ মিনিট। আ-কারে এবং সঠিক ভল্যুম এবং আ-কারের সঠিক উচ্চারণে। এটা খুবই সাহায্য করে। এরপর রেঞ্জ। রেঞ্জ কী করে তৈরি করতে হবে? আমি ১৫ বছরে এক অক্টেভ তৈরি করেছিলাম।

প্রশ্নঃ আপনি যখন জিয়া ফরিদুদ্দীন ডাগরের কাছে গেলেন তখন আপনার পিচ কী ছিল?

পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ আমার বয়স তখন ১৬ হলেও আমার গলা তখনো ভাঙে নি। সাধারণত ১৪-১৫-১৬ বছর বয়সে গলা পালটায়। আমার মনে আছে, প্রথম ২-৩ মাস আমি মেয়েদের পিচে গান করেছিলাম। এ বা এ শার্প, কালি পাঁচ।
- যেটা আপনার আগের পিচ ছিল, আপনার বোনের মতই?
-হ্যাঁ। তারপর আমার গলা পালটে গেল। একটা সময় আসে যখন গলাটা অনেক খাদে চলে যায়। তারপর আমি সি শার্প, ডি শার্প বা ডি তে গাইতাম।

প্রশ্নঃ কোন নির্দিষ্ট পিচ ছিল না?
পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ না। কোন নির্দিষ্ট পিচ ছিল না। আমি আপনাকে বলছি, আমার ওস্তাদ বা আমি কখনো হারমোনিয়াম ব্যবহার করি নি। আমার ওস্তাদ এমনকি পিচ পাইপও ব্যবহার করতেন না। তিনি গেয়ে তানপুরা মেলাতেন। (গান- সা-পা, দে-রে না-সা)। তিনি কোন সাহায্য নিতেন না। কারণ সেটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক উপায়। বিভিন্ন সময়ে আমাদের গলা বিভিন্ন রকম শোনাতে পারে। খুব ভোরে একরকম, সকালের শেষভাগে কিংবা সন্ধ্যায় অন্যরকম ইত্যাদি। যদি আপনি খুব ক্লান্ত হন, যদি আপনার গলায় কোন সমস্যা হয় তাতেও গলার স্বর চড়ে যেতে পারে। যেমন খুব আর্দ্র পরিবেশে যেমন বম্বে বা ক্যালকাটাতে আমার পিচ খুব সহজেই চড়ে যেতে পারে।

প্রশ্নঃ পণ্ডিতিজি, আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিতে পিচ নির্ণয় নিয়ে অনেক মতবাদ এবং প্রথা আছে। সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে যে, স্বর থেকে সহজে মন্দ্র মধ্যম এবং ওপরে তার সপ্তকের মধ্যম পর্যন্ত কণ্ঠস্বর সহজে যায়- সেই স্বরকে সা ধরা। আমাদের গুরুরা আরেকটা বিষয় প্র্যাকটিস করেন- সেটা হচ্ছে কনসার্ট পিচের আধপর্দা নীচে রেয়াজ করা। যেমন কেউ যদি কনসার্টে সি শার্পে পারফর্ম করে তবে সে সি তে রেয়াজ করবে- এমন একটা অলিখিত নিয়ম কেউ কেউ খুব শক্তভাবে মেনে চলেন। কিন্তু মাত্র আপনি যেটা বললেন, আমি যদি বাজারে গিয়ে খুব চেঁচাই তবে স্বাভাবিকভাবেই আমার গলাটা চড়ে যাবে। যদি এমনিতে স্কেল সি শার্প হয় হয়তো বাজার থেকে ফিরে সেটা ডি বা ডি শার্পে মিলবে। তাহলে ঠিক সেই মুহূর্তে আমি কেন ডি বা ডি শার্পে গাইব না?
পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ কারেক্ট! কারেক্ট! এবং আমার ওস্তাদ এই একই কথাই বলতেন। রেয়াজের সময় একটু নিচে করতে বলতেন। যেমন যদি কনসার্টের পিচ সি শার্প হয় তবে রেয়াজ সি তে করতে বলতেন।
- এটা কি সাহায্য করে? কীভাবে?
- পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ আমি নিশ্চিত নই। তবে একটা কারণ হতে পারে- কনসার্টে এনার্জি লেভেলটা একটু বেশি থাকে। উত্তেজনাও বেশি থাকে। মাঝে মাঝে কিছু রাগের ক্ষেত্রে যেমন তোড়ি, দরবারী এসব গাওয়ার আগে কন্সার্টেও আমাদের গুরু বলতেন পিচ নীচু কর। কাজেই তখন আবার উত্তেজনার নিয়মটাও খাটছে না। কাজেই এটা বেশ ট্রিকি প্রশ্ন। কাজেই আমি বলব, সি বা সি শার্প ইত্যাদি সব ভুলে যান। রেয়াজ করা উচিত খুব আরামদায়ক উপায়ে। ওপরের মধ্যম এবং নীচের মধ্যমের মধ্যে, বা ওপরের গান্ধার ও নীচের গান্ধার বা মধ্যম- যেটাই হোক। মধ্যম ভালো, কারণ অধিকাংশ রাগেই মধ্যম লাগে। কাজেই মন্দ্র মা থেকে তারসপ্তকের মা। তারপর পারফরমেন্সের সময় একটু চড়িয়ে দেয়া যায়- সেটা ভালো। আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে। খুব সহজেই নীচু পিচের মতই স্বাচ্ছন্দে ওপরের পিচেও গাওয়া যায়। আর যদি তানপুরা থাকে তাহলে তো ন ও সা এর মধ্যেও একটু চড়া নিখাদে তানপুরা মেলানো যাবে। আমার অভিজ্ঞতায় বলে আমার গুরুও অনুষ্ঠানের সময় একটু চড়িয়ে নিতেন।

প্রশ্নঃ পণ্ডিতজি আমার পরবর্তী প্রশ্ন হচ্ছে, পিচ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ -কণ্ঠস্বরের টিম্বার নাকি রেঞ্জ?

পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ আমার কাছে দুটো আলাদা ব্যাপার। রেঞ্জ গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু টিম্বার আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে জরুরী বস্তু হচ্ছে সাউন্ড। কাজেই যখন অধিকাংশ লোকের কানে সাউন্ড প্রশান্তিদায়ক এবং সুন্দর, তখন সেটা আসলেই একটা কিছু। এটা দুই অক্টেভ হোক, বা আড়াই অক্টেভ হোক বা দেড় অক্টেভ। কিন্তু টিম্বারটা খুব জরুরী। কাজেই আমার কাছে দুটো আলাদা এবং আমার মতে টিম্বার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একটা রাগ গাইতে গেলে রেঞ্জ তো তৈরি করতেই হবে। দুটোর ক্ষেত্রেই চর্চার মাধ্যমে উন্নতি করা সম্ভব, একটা পর্যায় পর্যন্ত। কিছু লোকের স্বাভাবিকভাবেই খুব উঁচু রেঞ্জের ভয়েস, আবার কিছু লোকের খুব স্বাভাবিক নীচু রেঞ্জের ভয়েস। কাজেই এটা অনুভব করতে হবে। অনেক সময় বহু বছরের বহু ঘণ্টার রেয়াজের পরও এটা হয় না, কারণ এটা সহজাত নয় বলে। কাজেই সহজাত শক্তিকে অস্বীকারও করা যায় না। কিন্তু আমার সুস্পষ্ট বিশ্বাস যে, একজন সহজেই ৪-৫টা স্বর গড়ে তুলতে পারে।

প্রশ্নঃ এখানে আমার একটা প্রশ্ন আছে। যদি টিম্বারই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয় তবে উস্তাদ আমীর খাঁ সাহেব ও পণ্ডিত ভীমসেনজি খুবই গভীর ও গম্ভীর গলা নিয়ে যৌবনে অত্যন্ত উঁচু পিচে গাইতেন কী করে? যৌবনে ওনারা ই বা এফ স্কেলে গান করতেন।
-পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ হ্যাঁ, ঠিক ঠিক।

প্রশ্নঃ কাজেই আমার মতে রেঞ্জও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে আপনি কিভাবে ছাত্রদের পিচ নির্ণয় করেন?
পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ একই পদ্ধতি, মন্দ্র মধ্যম থেকে তার মধ্যম। তবে শুরুতে আমি মন্দ্র পঞ্চম থেকে তারসপ্তকের গান্ধার পর্যন্তই সন্তুষ্ট, মধ্যম পর্যন্ত না হলেও চলবে।

প্রশ্নঃ আপনি কি একটু ডিমন্সট্রেট করবেন?

পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ অবশ্যই। আমি একটু তানপুরাটা ছাড়ি। (এন্ড্রয়েড ফোনে তানপুরা ছেড়ে ডিমন্সট্রেশন) প্রথমে সা গাইতে বলি। গানঃ সা ন, ধ প। যদি শিক্ষার্থীর পঞ্চমে সমস্যা হয়, তখন আমি তাকে ওপরে গাইতে বলি। যেমনঃ (গান- তারসপ্তকের সা গ ম।) যদি তার মধ্যম বা গান্ধার খুব ভালো হয়, তখন আমি তার পিচ চড়িয়ে দেব। কাজেই প্রথমে ভাল তারার সা এবং ভালো উদারার পা। আমি প্রথমে এটাই দেখি। ভালো মানে মোটামুটি ঠিক হলেই হল। যদি তারসপ্তকের সা যথেষ্ট ভালো হয়, তাহলে ঋষভ আসবে। এমনকি গান্ধারও আসবে। আর যদি মন্দ্র পঞ্চম ভালো হয় আমি সেটাকে রেফারেন্স করে পিচ নির্ণয় করি। (গান- প সা সা)- এটা ঠিক থাকলেই আমি সে অনুযায়ী শুরুর পিচ নির্ধারণ করি। তারপর রেয়াজের পর ফলাফলের ভিত্তিতে এটা ওপরে বা নীচুতে পরিবর্তন করা যেতে পারে। আমার ৮-৯ জন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে দু’জন বাদে সবারই আলাদা আলাদা পিচ।

প্রশ্নঃ তারা কি আপনার সাথে গান?

- পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ হ্যাঁ।

প্রশ্নঃ আপনার সাথে আপনার পিচেই গান?

- পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ না। আমি যখন ছাত্রদের শেখাই, একজন শেখালে ছাত্রের পিচেই শেখাই সেটা যেটাই হোক। আমি ছাত্রের পিচেই গাই। আর যখন গ্রুপে শেখাই তখন যদি বেশি ছেলে থাকে, কম মেয়ে থাকে তখন আমি সি তে শেখাই। যদি বেশি মেয়ে থাকে, কম ছেলে থাকে তখন এ বা এ শার্প।
(ফোনঃ “অজয়দার কনসার্টের আগে।”)
(সি স্কেলে ডিমন্সট্রেশনঃ সা লাগানো।)
মাঝারি ভল্যুমে সা গাইতে হবে। খুব জোরে না, আবার গলা চেপেও না। গানের ভেতর এটা করা যেতে পারে, কিন্তু সাধনার সময় না।

প্রশ্নঃ আমার পরবর্তী প্রশ্ন- আমাদের প্রাজ্ঞজনেরা সব সময়ই খোলা আওয়াজে গান করার পরামর্শ দিয়েছেন। এই খোলা আওয়াজ বলতে কী বোঝায়?
- পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ এর উত্তর আমার ডিমনস্ট্রেশনে আছে। খোলা আওয়াজ মানে মুখ স্বাভাবিকভাবে খুলে আকারে গাওয়া, এতে জোরও করা চলবে না আবার লুকোনোও চলবে না।
- আ-কারে, ওঙ্কার নয়?
- না, ওম নয়। ওঙ্কার গাওয়ার(অভ্যাসের) জন্য নয়। তার গুরুত্ব আলাদা। আমরা রি, নুম জাতীয় সিলেবল ব্যবহার করি। নুম আসে ওম থেকে। কিন্তু সেটা গানের ক্ষেত্রে। কিন্তু সাধনা বা ভয়েস কালচারের জন্য ওম কখনোই সাহায্য করবে না।
- সরগম?
- সরগম ঠিক আছে।
- তাহলে আপনারা কি সরগম প্র্যাকটিস করার পর সেটা আবার আ-কারে প্র্যাকটিস করেন?
- হ্যাঁ। খেয়াল গায়কের ক্ষেত্রে আকারে প্র্যাকটিস করতেই হবে। তবে আমরা সরগমে বেশি অভ্যেস করি। কারণ আমাদের এই সিলেবলগুলো উচ্চারণ করতে হয়। (আলাপঃ আ-রনন, তারন, রিরেরেনেনুম অনন তারন তারণ নুম রনন—ইত্যাদি) এতে জিহ্বার ব্যবহার করতে হয়। একই জিনিস আ-কারে করলে এমন দাঁড়ায়। (তান) এটা আলাদা। আমাদের সিলেবল উচ্চারণ করতে হয়। তাই আমাদের ক্ষেত্রে সরগমে সাধনা করা অপেক্ষাকৃত ভালো।
এরপর আসি রেঞ্জের কথায়। খরজের পর রেঞ্জের জন্য আছে মূর্ছনা। মূর্ছনা হচ্ছে ওই বিশেষ দিনে এবং ওই সময়ে গায়কের সবচেয়ে কম্ফোর্টেবল নীচের পিচ থেকে শুরু করে মূর্ছনার অভ্যাস। এটা সকালে ৭টার দিকে বা খরজ অভ্যেস করার পর অভ্যেস করা ভালো। অর্থাৎ ২০ মিনিট সা, ২০ মিনিট মন্দ্র পা এবং ৫-১০ মিনিট নি, ধ আ-কারে সাধার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে সবচেয়ে নীচের স্বর থেকে শুরু করতে হবে। যেমনঃ
গ্‌ ম্‌ প্‌ ধ্‌ ন্‌ স র গ/ গ র স ন্‌ ধ্‌ প্‌ ম্‌ গ্‌- এটা কমপক্ষে বার ১৫ গাওয়ার পর মা
ম্‌ প্‌ ধ্‌ ন্‌ স র গ ম/ ম গ র স ন্‌ ধ্‌ প্‌ ম্‌
প্‌ ধ্‌ ন্‌ স র গ ম প/ প ম গ র স ন্‌ ধ্‌ প্‌
এভাবে একটা করে স্বর বাড়াতে বাড়াতে ওপরের স্বরগুলোতে যেতে হবে। চেষ্টা করতে হবে তারার গান্ধার ছুঁতে। মন্দ্র গা থেকে তারার গা সহজে যেতে পারলে তারার মধ্যম ছুঁতে চেষ্টা করতে হবে। কাজেই কিছুক্ষণ গা থেকে গা গাইলে বা পা থেকে গা পর্যন্ত গাইতে গাইতে তারার মধ্যম পরিস্কার হয়ে যাবে। তারপর এটাকে আরো বিস্তৃত করা সম্ভব। সকালে প্র্যাকটিসের সময় আমি প্রায় ৩ সপ্তকই স্পর্শ করি। এতে ওয়ার্মড আপ হতে একটু সময় লাগে।

প্রশ্নঃ ওপরের অক্টেভের স্বরগুলোর উন্নতির জন্য নীচের অক্টেভের স্বরের অভ্যাসের গুরুত্ব কী? এটার সবসময়ই খুব গুরুত্ব দেয়া হয়েছে- খরজ সাধনা।
- পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ শুধুমাত্র খরজ গাইলে আপার অক্টেভ গড়ে তুলতে সম্ভবত কোন সাহায্যই হবে না, যদি মূর্ছনা এবং কিছু অন্যান্য অভ্যাস না করা হয়। তারসপ্তকও রেয়াজ করেই তৈরি করতে হবে। খরজ হচ্ছে জলের মত। জল খেলে আমরা হাইড্রেটেড হই। না খেলে ডিহাইড্রেটেড। খরজ নিখুঁতভাবে গাইতে হবে। খরজ গাওয়ার মুখ্য উদ্দেশ্য এই যে, এটা একটা স্বরকে গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করে, ফুসুফুসের ক্ষমতা বাড়ায়। খরজ শেখায় যে একটা স্বর কত কথা বলতে পারে। যখন তুমি ২০ মিনিট খরজ গাইতে বসবে, প্রথনে অনেক চিন্তা মাথায় আসবে। ঠিক হচ্ছে কিনা, তানপুরা ঠিক সুরে বাঁধা হয়েছে কিনা, গতকাল কী হয়েছিল, আজ-কাল কী হবে ইত্যাদি। কিন্তু কিছু সময় পর তুমি এই একটি স্বরের সাথে একাত্ম হয়ে যাবে। আমরা একে বলি একাকার- একরূপ। তাই এটা শেখায় একটা স্বরের সাথে একাত্ম হয়ে যেতে এবং এই অভ্যাস গানে প্রতিফলিত হয়।
-অর্থাৎ এটা একরকমের ধ্যান?
-হ্যাঁ।
-আর এছাড়া খরজ অভ্যাস ফুসফুসের শক্তি বৃদ্ধি করে, ফলে প্রত্যেকটা স্বরের জোর, ওজস ও শক্তি বৃদ্ধি পায়?
- একদম ঠিক। স্বরের ভেতর একটা প্রাণ সঞ্চার হয়, একটা অর্থবহ কিছু তৈরি হয়।
- আমরা পিচ নির্ণয় সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। গোটা উপমহাদেশেই এ নিয়ে সঠিক চর্চা নেই এবং প্রচুর দ্বিধা আছে। সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি হল মেয়েরা বি ফ্ল্যাট বা এ শার্প এবং ছেলেরা সি স্কেলে প্র্যাকটিস করে। এই আলোচনা থেকে আমরা জানলাম এমন প্র্যাকটিস সঠিক নয়, আবার এক আধ পর্দা গলার অবস্থা অনুযায়ী পালটে গাইলেও কোন ক্ষতি নেই। যেমন- এই মুহূর্তে যদি আমার মন্দ্র স্বর ভালো না হয় তবে আমার স্কেল সি হলেও এখন উচিত সি শার্পে গাওয়া?
- কারেক্ট, কারেক্ট, কারেক্ট! এটুকু স্বাধীনতা অবশ্যই থাকতে হবে। আমাদের সঙ্গীত ফিক্সড নয় এবং এটা ২৪ ঘণ্টার।

প্রশ্নঃ কেউ কেউ বলেন যে, শুরুতে স্কেল পালটে গাইলে গলার রেজোন্যান্স বা অনুনাদ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে রেঞ্জের মধ্যে থাকলে পিচের কারণে রেজোন্যান্সের কোন ক্ষতি হবার কথা নয়। কাজেই গলার রেঞ্জের বাইরে না গেলে কী নোট বা স্কেল এক-আধ নোট ওপর নীচে হলে কোন ক্ষতি নেই।
-পণ্ডিত উদয় ভাওয়ালকরঃ অবশ্যই।

(ক্রমশ)


মন্তব্য

শেহাব এর ছবি

যদিও পড়তে ভাল লেগেছে কিন্তু কিছু বুঝি নাই। শুধু এটুকু বুঝেছি আপনি যত্ন নিয়ে কাজটি করেছেন।

নির্ঝর অলয় এর ছবি

ঠিক কোন অংশটা বুঝতে সমস্যা হচ্ছে? আপনি চাইলে সাহায্য করতে পারি। সঙ্গীত চর্চাকারী এবং পদার্থবিদ্যার ছাত্রদের জন্য এটা মোটেও কঠিন কিছু না। হাসি

শেহাব এর ছবি

আগে তাহলে আমি নিজে একটু পড়াশোনা করে নেই।

তারেক অণু এর ছবি

উত্তম জাঝা! চলুক আজ থেকে যাচ্ছি

নির্ঝর অলয় এর ছবি

চলুক

সুমিমা ইয়াসমিন এর ছবি

চলুক
অনেক আগ্রহ নিয়ে পড়লাম লেখাটা। আরও আগ্রহ তৈরি হলো...।

নির্ঝর অলয় এর ছবি

এ জাতীয় কাজের আগ্রহী পাঠক খুঁজে পাওয়া লুপ্ত প্রজাতির পুনরুদ্ধারের মতই!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।