ক্লান্তি, স্মৃতি, বিচ্ছিন্ন ভাবনা

নির্জন স্বাক্ষর এর ছবি
লিখেছেন নির্জন স্বাক্ষর [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১৫/১১/২০১০ - ২:১৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বাসা থেকে খেলার মাঠটা বেশি দূরে না। শুধু মাঝে কিছু ঘিঞ্জি গলি পেরুতে হয়। সন্ধ্যা হলেই গলির মুখে কুপি জ্বালিয়ে পসরা সাজিয়ে বসে নানা কিসিমের দোকানদার। গাড়ি ঢুকবেনা, তাই রিকশাই ভরসা এই গলিতে। প্রতি সন্ধ্যায় রিকশার নিচে হারিকেন জ্বালিয়ে টুংটাং শব্দ তোলে কোনো এক বাড়ি থেকে ভেসে আসা বাচ্চার কান্নার সাথে পাল্লা দিয়ে।

গলির মোড়ে গত কদিন ধরে নষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জীর্ণ ল্যাম্প পোস্ট আজও ঠিক হল কি না সেটা খেয়াল করার অবস্থায় তখন ছিলাম না। মাগরিবের আজান আমাকে ধাওয়া করছে সাইরেনের মত। যেন আমি ফেরারী আসামী। দ্রুত পা চালাচ্ছি। আজকেও খেলা শেষে ফিরতে দেরী হল। প্রায় অন্ধকার গলিতে দৌড়াতে গিয়ে হয়ত কারোর সাথে ধাক্কা লেগেছিল, ভেঙ্গে যাওয়া রাস্তার কংকাল বের হয়ে যাওয়া উঁচু-নিচু যায়গায় পা পড়ে হয়ত স্যান্ডালটাই ছিঁড়েছিলো, কিংবা কোনো এক রিকশার সাথে কোনায় লেগে টান লেগে জামাটা। বাসাটাকে মনে হচ্ছে কত্ত দূরে। আমি ছুটছি। বাসার সামনে এসেই হাঁফ ধরে গেল। হাঁটু ভেঙ্গে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। আজান শেষ। এর অর্থ আমি আজানের পর বাসায় ঢুকছি। মা আজ নির্ঘাত মারবে। আগেও এমন হয়েছে।

বাসার নিয়ম হলো সন্ধ্যায় মাগরিবের আজানের আগেই বাসায় ফিরতে হবে। এরপর হাত-মুখ ধুয়ে সরাসরি পড়ার টেবিলে বসা। নাস্তা চলে আসবে ঐ টেবিলেই। সপ্তাহে ৪ দিন স্যার আসতো। আমি যে পড়ার টেবিলে সন্ধ্যায় বসে আছি এবং পড়ছি এইরকম একটা ব্যাপার স্যারকে দেখানোর বিষয় ছিল। স্যার নিশ্চিন্ত হতেন। আজ তো মনে হয় স্যার আমার পড়ার টেবিলে বসে আছেন নির্ঘাত রাজ্যের বিরক্তি আর রাগ নিয়ে।

নাহ! আজ কপালে ব্যাপক দুঃখ আছে। একে তো মার বকুনি আর হাল্কা পাতলা চড়-থাপ্পড় তার সাথে স্যারের চোখ রাঙ্গানি। কান মলাও জুটতে পারে। এইসব ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি ভেঙ্গে ৩ তলায় পৌঁছানো। বুক রীতিমত কাঁপছে। সারা গায়ে ঘাম। এই বুঝি দরজা খুললো। সমস্ত বকুনি আর যতো মারধর এক্ষুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে ছোট্ট আমার উপরে। আর কিছুক্ষণ, এই তো এখনি। কর্কশ শব্দে কলিং বেল বাজালাম। ঠিক তখনি এক বিশাল ঝাঁকুনি খেলাম।মনে হলো পড়ে যাচ্ছি।

ব্যাপার আর কিছুইনা। রিকশায় বসে আছি জ্যামে। কাকরাইল মোড়ে। যাচ্ছি শাহবাগ। জ্যাম ঠেলে বেরোতে গিয়ে সামনের রিকশার সাথে ধাক্কা খেয়েছে আমার রিকশা। অন্যমনস্ক থাকায় বড় ধরনের ঝাঁকি খেলাম। মাথার যেখানে আকাইম্যা মগজ থাকে সেখানটাও বাদ গেলোনা। তারপর বুঝলাম এতক্ষণ শৈশবে ছিলাম।

শৈশবের সেই খেয়ে ফেলা দিন গুলো আমাকে কথা নাই বার্তা নাই শুধু টেনে নিয়ে যায় এক ঘোরের ভিতরে, বিনা নোটিসে। সেই সময়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার চাপ, পড়তে বসার চাপ-একটা আতংক ছিলো। আজ এই এত বছর পর সেই সন্ধ্যায় আমি যখন রিকশায় চেপে যাচ্ছি তখন ভাবছি আর নিজেকে প্রশ্ন করছি, তখন চাপ ছিলো, আর সাথে ভয়ও ছিলো অনেক। আজ এতদিন পরেও কি আমি চাপমুক্ত? ভয়শূন্য? আতংক কি ধাওয়া করেনা বর্তমানের আমাকে? মা-বাবা বা স্যারকে খুশি করার জন্য পড়তে বসে দেখাতাম যে প্রতি সন্ধ্যায়, এখনো কি মানুষকে খুশি করার জন্য সেরকম অনেক কিছু করিনা?

চোখ ফেরাই রাতের আকাশে। বছরের এই সময়টায় বেশ তারা দেখা যায়। চলন্ত রিকশায় বসে থেকে একে একে বের করি সন্ধ্যাতারা, কালপুরুষ কিংবা ক্যাসিওপিয়া। প্রশ্নগুলোকে ছড়িয়ে দেই আকাশে, এই নষ্ট শহরের ভারি বাতাসে।

প্রত্যুত্তরহীন আমি সহজ সত্যের মত জেনেছি এর কোনো কাঙ্ক্ষিত উত্তর নেই। রিকশা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই বন্ধুদের সাথে আড্ডা। অন্তত কিছু সময়ে হলেও ক্লান্ত নিজেকে একটু ভারহীন করা যাবে।

দূরে ঝাপ্সা আলোমাখা অদ্ভুত গান। সমস্ত সন্ধ্যা দু হাতে ধরে রাখি অথবা ছেড়ে দেই। ধোঁয়া হয়ে উড়ে যায় সমস্ত সন্ধ্যা…

High Hopes


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

ওহ্! কি অসাধারণ ছবি!! চলুক

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

নির্জন স্বাক্ষর এর ছবি

ঠ্যাঙ্কু ভাইয়া।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

ছবিটা আসল, না ডিজিটাল? গাছের সাপেক্ষে মানুষের কালো অবয়ব দুটো (রেপ্লিকা) একটু অসামঞ্জস্যপূর্ণ লাগছে।

নির্জন স্বাক্ষর এর ছবি

ছবিটা পুরাটাই ম্যানিপুলেশন। গাছ, পাহাড়, মানুষ, বেলুন সব জোড়া-তালি দেয়া। আর যেহেতু এইটা জোড়াতালি তাই এলিমেন্টসের রেশিও ইচ্ছামত করসি।

সবজান্তা এর ছবি

মুহাহাহাহা... কী পোলাডা ইন্দুরে খাইলো দেঁতো হাসি

ছবির চেয়ে লেখা ভালো লাগলো।

ধৈজ্জ্য ধরো সুনা... দিন তুমারো আসবে দেঁতো হাসি


অলমিতি বিস্তারেণ

নির্জন স্বাক্ষর এর ছবি

হ !
দিন আইলেই হয়। ক্যাতক্যাতানি আর ভাল্লাগেনা।

এনকিদু এর ছবি

ক্যাসিওপিয়া


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

নির্জন স্বাক্ষর এর ছবি

হ !
তয় তোর মত নাকের ডগায় পাইনাই রে। দেঁতো হাসি

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

বাসার নিয়ম হলো সন্ধ্যায় মাগরিবের আজানের আগেই বাসায় ফিরতে হবে।
সবারই একই ঘটনা ছিল না? চিন্তিত

ফটোমডিফিকেশন ভালো হয়েছে। প্রতিটা ছবি নিয়েই তো এমন করে লিখতে পারো! আর এই যে, PF-এর High Hopes টা তোমার হয়ে আমি এমবেড করে দিলাম। হাসি


___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

নির্জন স্বাক্ষর এর ছবি

হুম, সবারই তো মনে হয় একি ব্যাপার ছিলো। সন্ধ্যায় ঘরে ঢুকো আর পড়তে বসো।

হাই হোপ্সের জন্য বিরাট ঠেঙ্কু। আমি সেই ঘন্টাখানেক ধরে শুনছি।

ফটো-ম্যানুপুলেশন আমি তেমন পারিনা। মাঝে মাঝে করার ট্রাই করি।

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

আমার ছিলোনা! আমি সব হোমওয়ার্ক শেষ করে তবেই বিকেলে বেরোতে পারতাম! দেঁতো হাসি

-----------------------------------------------------------------------------------
...সময়ের ধাওয়া করা ফেরারীর হাত থিকা যেহেতু রক্ষা পামুনা, তাইলে চলো ধাওয়া কইরা উল্টা তারেই দৌড়ের উপরে রাখি...

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

সন্ধ্যা হলেই পড়তে বসানোর জোরাজুরি ছিল না আমার, কিন্তু মাগরিবের আগেই ঘরে ফেরারটা ছিল... হাসি

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

মিলে গ্যালো দেখি। ক্রিকেট খেলা শেষে মাঠ থেকে বাসায় ফিরতে দেরী হলেই আব্বা কানটা মলে পড়ার টেবিলে বসিয়ে দিতেন। ...

ছবিটা দারুন। কিন্তু তুললেন কীভাবে ?? মানে গাছ আর বেলুনের দূরত্বটা কেমন যেন অবাস্তব ঠেকে...

_________________________________________

সেরিওজা

নির্জন স্বাক্ষর এর ছবি

হেহেহে...কান মলা তো রেগুলার খাইতাম।

ছবিটা ভুয়া। বানানো। এম্নেই মঞ্চাইলো, বানাইলাইলাম।

আর যেহেতু এমনি এমনি বানানো, তাই এলিমেন্টসের দিকে অত নজর দেইনাই। অবশ্য আরেকটা বড় কারন ঐ পিঙ্ক ফ্লয়েড আর হাই হোপ্স। আমার ইমাজিনেশনে এইরকম কম্পোজিশনই আসচে।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

মুহাহাহাহা... কী পোলারে কুত্তায় খাইলো দেঁতো হাসি

লেখা ছুডু হইছে, আরেকটু পড়ার তেষ্টা জাগছিলো মন খারাপ

এবং, এট্টু দৈজ্জ দরো সুনা... দিন তুমারো আসপে দেঁতো হাসি
____________________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ !

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

নির্জন স্বাক্ষর এর ছবি

লেখা ছুডু হইসে কারন রিকশা শাহবাগ চলে গেসিলো।

আর হ...দৈজ্জ দৈরা আছিরে সুনা।

আর ইয়ে..তুই কিন্তু দুষ্টামি কম করিস।

অতিথি লেখক এর ছবি

এখনো কি মানুষকে খুশি করার জন্য সেরকম অনেক কিছু করিনা?

সেটাই, আমরা প্রতিনিয়ত অন্যকে খুশি করার জন্য কত কিছুই না করি।
ছবিটা ভালো লেগেছে যদিও কিছুটা অবাস্তব আবাস্তব লাগছে আর লেখার কথা না-ই বা বললাম।

পাগল মন

নির্জন স্বাক্ষর এর ছবি

ছবিটা ভাই অবাস্তবই ! এমনি বানাইলাম।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ছবিটা ব্যাপক।

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

নির্জন স্বাক্ষর এর ছবি

হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাটা সুন্দর, কিন্তূ আমার মনে হয় পোস্ট করার আগে একবার যদি পড়ে নিতেন তাহলে মনে হয় ছোটখাটো যে ভুল্গুলো আছে তা আর থাকতো না।

প্রতি সন্ধ্যায় রিকশার নিচে হারিকেন জ্বালিয়ে টুংটাং শব্দ তোলে কোনো এক বাড়ি থেকে ভেসে আসা বাচ্চার কান্নার সাথে পাল্লা দিয়ে।

যেমন উপরের লাইনটা পড়ে মনে হচ্ছে বাক্যটা অসুম্পুর্ণ।
যাই হোক শুভ কামনা চালিয়ে যান।
মাহফুজ খান

নির্জন স্বাক্ষর এর ছবি

যা লিখেছি, একদম যেইটা মনে হচ্ছিলো তাই। হয়তো সেই ছোটবেলায় কোনো এক সন্ধ্যায় এমন করে বাচ্চা কাঁদছিলো আর পাশ দিয়ে হয়ত রিকশার টুংটাং শব্দ কানে এসেছিলো একি সাথে। স্মৃতি জিনিশটাই এমন। আকাইম্যা মগজ কি যে সব জমা করে রাখে আর হুট হাট খোঁচা দেয়...

আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ !

নির্জন স্বাক্ষর এর ছবি

রিকশায় ধাক্কা খাইলো যে ! মন খারাপ

নাজনীন খলিল এর ছবি

ভাল লাগল চমৎকার লেখাটি।

নির্জন স্বাক্ষর এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে !

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এই ছেলে গিটার বা মেশিনগানের মতো ক্যামেরা চালায় তাতে আমরা আনন্দিত, কিন্তু এই ছেলে নিয়মিত লেখে না কেন? অন্ততঃ এই লেখাটা পড়ে মনে হলো এমন টাইপ লেখা নিয়মিত পাই না কেন?



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নির্জন স্বাক্ষর এর ছবি

পাণ্ডব দা, লেখালেখি আমার আসে না। তবে লিখতে ইচ্ছে হয় খুব। হাবিজাবি অনেক কিছুই লিখি প্রায়ই প্রতিদিন। শেয়ার করা হয়না।

এটা কেন লিখসি জানিনা। সেদিন মন একটু ক্যাতক্যাতা ছিলো, তাই লিখে ফেলছিলাম এক টানে। তার পর কিভাবে কিভাবে জানি সচলে দিয়েও দিলাম।

আপনার মন্তব্যের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। সাহস বেড়ে গেলো মনে হচ্ছে। হয়ত আরো লেখা দেয়ার চেষ্টা করব। হাসি

ওডিন এর ছবি

পাণ্ডবদার এই প্রশ্ন আমারও? হাসি

আরেকটু বেশি বেশি লেখলে কি হয় মিয়া?
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না

নির্জন স্বাক্ষর এর ছবি

লিখতে পারিনা তো। আমার লেখা বেশি পড়লে তুমি আমারে মাইর দিবা। মনে আছে, ভুভুজেলা বিষয়ক আইডিয়া? চোখ টিপি

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

আলোর ছবিটি সুন্দর, আরো বেশী সুন্দর কথার ছবিটি!
-----------------------------------
যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ — কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।