অনেকদিনের ভ্যাপসা গরম জীবনের রস-রূপ-স্বাদ-গন্ধ শুষে নিচ্ছিলো একেবারেই। তারপর সেদিন যখন দুপুর থেকেই আকাশ কালো হওয়া শুরু করলো তখন একটু স্বস্তি পেলাম। ঝড়ো বৃষ্টি না হোক, গরমটাকে তাড়াতে অন্তত একটু মাঝারি বৃষ্টিই হোকনা কেন? শেষমেশ সেই বৃষ্টি পড়ল অফিস থেকে বের হবার সময়ে। বৃষ্টিতে ভিজতে সবসময়েই ভালো লাগলেও সারাদিন অফিস করে রাস্তায় জমে থাকা কাদা পানি মাড়াতে হবে ভাবতে ভালো লাগে? তাই ঠাণ্ডা বাতাসে শ্বাস নিতে পারার আনন্দের সাথে যে বিরক্তিও কাজ করেনি কিছুটা তা কিন্তু না।
তারপর রোজকার রুটিনে বাস ধরার জন্য অফিস শেষের ভিড়ে জায়গা করে কোনোমতে উঠে পরলাম একটাতে। প্রচণ্ড ভিড়ে চিড়েচ্যাপটা হয়ে ঘেমো গন্ধ আর ঠেসাঠেসিতে ভরা একটা জায়গায় রড ধরে নিজেকে ঝুলিয়ে রাখতে খবর হয়ে যাচ্ছিলো! স্বভাবমতোই একটু পরেই কন্ট্রাক্টর এসে কানের সামনে চিৎকার দেয়, “বাই, ভাড়াডা, হাতে হাতে দিয়া দেন”। তাতে কিছু মানুষ প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে নিজেদের যাবতীয় ক্ষোভ-হতাশা-বিতৃষ্ণা ঝাড়লো কনট্রাক্টরের উপর, “ঐ ব্যাটা, দেহস না? খাড়াইতে পারিনা ঠিকমত।প্যাসেঞ্জার লস এক্কেরে পেট ভইরা, পকেটে হাত ঢুকানের জায়গা আছে নি? যা যা, পরে লইস।"
কন্ট্রাক্টর খুব বেশি প্রতিবাদ করতে পারেনা। দৌড়ানি খেয়ে এরপরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ ঠেলে অন্য জায়গায় ভাড়া নিতে গিয়ে খায় আবার ঝাড়ি, “ঠেলস ক্যা? চক্ষে দেখস না?” এইবার কন্ট্রাক্টর আর ছাড়ে না। প্রতিবাদ করে কিছু বলে উঠে বা মুখ শক্ত করে কিছু বলার চেষ্টা করে। এতেও বাড়ে মানুষের রাগ। আর ভাড়া নাকি বেড়ে গেছে এই নিয়ে শুরু হয় নতুন তর্ক। কন্ট্রাক্টরও যে একটা বেদ্দপ, ভাড়া বেশি চাওয়ার সাথে তার গলা উঁচু করে কথা বলার ব্যাপারটাও মানুষের রাগের আগুনে তেল ছিটানোর মতোই হয়, অন্তত তখন। কিছু মানুষ এইটাই বলতে থাকে গলার রগ ফুলিয়ে। প্রতিদিনের দৃশ্য এটা, নতুন কিছুই না। বিরক্ত হয়ে চোখ ফেরাই অন্যদিকে। বাসের জানলার কাচে বৃষ্টির ছাঁট। এর ভিতর দিয়ে দেখি প্রতি মূহুর্তের আরও ঘোলা হতে থাকা রাতের ঢাকা।
বাস স্টপেজ আসে। বাস থামে। হুড়োহুড়ি পরে যায় মানুষের। কেউ নামে, কেউ উঠে। ভেতরে যারা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো, তারা সুযোগ খোঁজে খালি সিট দখলের। কামড়াকামড়ি সেখানেও। সেই দলে আমিও আছি। দেখলাম একটা সিট খালি হলো একদম সামনেই। ধুম করে বসে পড়লাম সেটাতে। আশেপাশের কিছু মানুষের বিরক্তিমাখা দৃষ্টির তোয়াক্কা না করেই।
এত ভিড়ে কাউকে অত খেয়াল করে দেখা হয়না। কিন্তু কেন যেন এক জায়গায় হঠাৎ চোখ আটকে গেলো। দেখলাম ক্র্যাচ হাতে এক বুড়ো ভদ্রলোক এই প্রচণ্ড ভিড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক হাতে রড ধরে। এতগুলো মানুষের ভিড়ে ক্র্যাচ নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে তাতে চোখ একটু পরলেও খেয়াল করার মত তেমন কোনও বিশেষত্ব নাই। সাধারণ একটা সাদা শার্ট, ছাই কালারের প্যান্ট। শুকনো গড়ন, মুখে হাজারো চিন্তার ছাপ। কাঁচা-পাকা চুল। বেশ কিছুদিনের না কামানো দাড়ি। এবং বেশিরভাগ বুড়োদের মত ভ্রু কুঁচকানো। মনে হচ্ছে সারা দুনিয়ার বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এরকম বৈশিষ্টহীন বুড়োলোকের দিকে তাকানোর কোনও মানে নাই। কিন্তু তাও তাকাচ্ছি কিংবা কখনো কখনো তাকাচ্ছি তার রডে ধরা এক হাত, আরেক হাতের বগলে ক্র্যাচের দিকে। কেমন অস্বস্তি লাগছিলো। কী মনে করে বলেই ফেললাম, “চাচা, আপনি এখানে বসেন। আমি সামনেই নেমে যাব।" উনি ফিরে তাকালেন আমার দিকে। কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে কিন্তু স্পষ্ট উচ্চারণে এবং শান্ত গলায় উনি আমাকে বললেন, “না বাবা তুমি বস। আমি বসব না।"
বাসের মানুষের উচ্চস্বরে কথা-বার্তার আওয়াজ, গাড়ির আওয়াজ এসব কিছু ছাপিয়ে শুনলাম তার কথা। কণ্ঠের সেই দৃঢ়তাতে খোঁজ পাই তার শক্ত আত্মসম্মানবোধের। দেখতে এমন সাদাসিধে, আটপৌরে মানুষের সাথে এমন গলার স্বর ঠিক মেলাতে পারছিলাম না। স্বাভাবিক ভাবেই আগ্রহী হই তার প্রতি। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর এক ধরনের কৌতূহল থেকেই আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে উনার পা কাটা কেন এবং কিভাবে হল। অসুস্থ কৌতূহল জানি তাই প্রশ্নটা করা ঠিক হবে কি হবেনা, করলেই বা কী মনে করেন সেসব ভাবতেই ভাবতেই দুম করে হঠাৎ একসময়ে জিগ্যেস করে বসি, “কিছু মনে করবেন না, আপনার পায়ে কি হয়েছিলো জানতে পারি?”
উনি ফিরে তাকান। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করি তার চোখগুলো কী অদ্ভুত রকম অনূভুতিহীন। একটু পর অন্যদিকে তাকিয়ে শ্বাস ফেলেন বড় করে। এদিকে সিগনালে আটকে থাকা বাসটা একটু ঝাঁকুনি দিয়ে হঠাৎ চলতে শুরু করতেই তার মধ্যে এক অস্থিরতা দেখতে পাই। যেন এতক্ষণ কোনও গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। আমার দিকে তাকালেন আবারো। একটু যেন কিসের সংকোচের আভাস তার দৃষ্টিতে। বাসের পাশ দিয়ে হুশ করে অন্য বাস ছুটে যায় অনেক শব্দ তুলে। সিগন্যাল ছাড়ার পর সবাই হুড়মুড়িয়ে চলতে থাকে, সবসময়কার মতোই। এতসব কোলাহল, গোলমাল তাতেও তার উপর থেকে চোখ সরাই না। সময় এগিয়ে যেতে থাকে। আর আমি অপেক্ষায় থাকি উনার কিছু বলার আশায়।
এরপর হঠাৎ তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। খুব ধীরে ধীরে থেমে থেমে উনি বলতে থাকেন, যেন কী বলবেন বা কীভাবে বলবেন সেটা ঠিক ভেবে উঠতে পারছেন না। কাকে বলছেন সেটাও মনে হচ্ছে তার মাথায় নেই কিংবা হয়ত নিজেকেই শুনিয়ে বিড়বিড় করছেন। তারপর কী করে যেন তার সব জড়তা, সংকোচ কেটে যেতে থাকে আর গলার স্বরে আগের চেয়েও দৃঢ়তা এনে চোয়াল শক্ত করে অথচ সেই শান্ত স্বরেই কথাটা লাগামহীন ভাবে যেন কোনো কারনে ইচ্ছে-অনিচ্ছে রোধ করার ক্ষমতা হারিয়ে ছোট্ট শব্দ উচ্চারণ করেন, "একাত্তর!"
বাস থামে পরের স্টপেজে, আমার দিকে একবার তাকিয়ে একটু হেসে খুব আস্তে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে পা গেছে। শরীরের অনেক জায়গার জখমের দাগ এখনো আছে। যুদ্ধ আমি এখনো করি, আমার যুদ্ধ এখনো শেষ হয় নাই।"
এরপরে যোদ্ধা নেমে যান তার জয় করা স্বাধীন দেশের রাজধানীর রাজপথে। আমি চুপ করে থাকলাম। জানালা দিয়ে দেখলাম, উনি হেঁটে ফুটপাথে উঠলেন।আস্তে আস্তে বাস চলতে শুরু করলে আমি তাঁকে হারিয়ে ফেললাম মানুষের ভিড়ে।
বাস থেকে নেমে দেখি বৃষ্টি থেমে গেছে। বাসার সামনের রাস্তায় এক হাঁটু কাদা-পানি দিয়ে হাঁটছিলাম। ঠিক বাসার সামনে এসে থামলাম একটা সিগারেট ধরিয়ে। মাথার ভেতর ভাবনাগুলো কেমন ধোঁয়ার সাথে রাতের ছড়ানো আকাশে মিলিয়ে যায় হাওয়ায় হাওয়ায়…
কেবল একটা কন্ঠ আমার মাথার ভেতর বলতেই থাকে বলতেই থাকে, "আমার যুদ্ধ এখনো শেষ হয় নাই"
কিছু কিছু যুদ্ধ বোধহয় কখনো শেষ হয় না, হবার নয় !
মন্তব্য
ভালো লাগলো। ডিটেইলসটা খুব সুন্দর।
এঁদের যুদ্ধ আসলেই শেষ হবার নয়, চারিদিকে পাকিপ্রেমীদের থাবার বিরুদ্ধে আমরা যেখানে গা বাঁচিয়ে চলি, সেখানে তাঁদেরই তো নামতে হয়। আমরা নিজেদের বোধকে আর কতদিন ঘুম পাড়িয়ে রাখবো??
স্মোক ফটোগ্রাফিটা জোশ ...
==========================================================
ফ্লিকার । ফেসবুক । 500 PX ।
...........................আমরা যাঁদের কাঁধের উপর দাঁড়িয়ে আছি ; আমরা তাঁদের মূল্যায়ণ করতে পারি নাই ।
----------------------------------
আমার চারপাশ ডট কম
(গুড়)
লেখা আর ছবি আলাদা আলাদা ভাবে ভালো লাগলো। বিশেষ করে ছবিটা, দারুণ!
ভালো লাগলো। সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। স্মোক ফটোগ্রাফিটা জোশ ...
-------------------
sad poems
লেখা, ছবি দুটোই দারুণ। ছবিটা অদ্ভুত সুন্দর।
_____________________
আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।
ল ব্যাটা, হলুদ পাঁচতারা খা!
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
আপনার ছবি আমার ভালো লাগে। খুব।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
ছবিটা অনেক সুন্দর
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস
লেখাটা অনেক মন ছোঁয়া। ছবিটাও অনেক সুন্দর। আর একজন যুদ্ধহত মুক্তিযোদ্ধার জীবনযুদ্ধ ............. কিছুই বলার নেই! এযুগের সকল সুখের মালিক দেহ-সাইদী আর গুয়েবাড়ারা।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
ছবিটা অনেক ভালো লেগেছিল, কিন্তু লেখাটা আরো বেশি ভালো লাগলো।
অনেকদিন পরে একটা (গুড়) দেই।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
এই ছবি কেম্নে তুলসেন?
নতুন মন্তব্য করুন