ফটোগ্রাফিতে বেশ মজার কিছু ব্যাপার আছে। এর মধ্যে আমার সব চেয়ে ইন্টারেস্টিং আর আজব লাগে লং এক্সপোজার বা লং শাটার। এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছিলাম আগে।ছবিগুলা কেমন অন্যরকম বানায় দেয়। সন্ধ্যায় বা রাতের বেলায় আলোর অভাবে শাটার স্পীড বাড়িয়ে দেয়া বা স্লো করে দিয়ে আলো ঢুকানো ছবিতে বা ফ্রেমে। এর মাঝে আকাশে যদি মেঘের দৌড়াদৌড়ি থাকে তাহলে মেঘের মজার মোশন একটা ইফেক্ট আসবে বা যদি নদী বা সমুদ্রের ঢেউয়ের অন্যরকম মোশন ইফেক্ট ধরা পরে। সোজা কথায় বললে, লং শাটার তোলার সময়ে ফ্রেমে যা কিছু স্থির সেটা তো স্থির থাকছেই আর যতটুকু সময় ধরে শাটার পড়বে সেই সময়ে ঐ ফ্রেমে যদি গতিশীল কিছু থাকে সেটার একটা মজার ইফেক্ট আসে। আর একেবারেই গতিশীল কিছু না থাকলেও রাতের ছবি তো স্পষ্ট হচ্ছেই আলো বেড়ে গিয়ে ফ্রেমে স্লো শাটারের কারণে।
লং শাটার নিয়ে কিছু কাজ করেছি বা সুযোগ পেলেই করি। এবার ভাবলাম আরও মজার কিছু করি। নেটে ছবি ঘাটার জন্য লাইট পেইন্টিং এর ব্যাপারে ধারনাটা ছিলও কিন্তু তেমন করে না। খালি ছবি দেখতাম। লং শাটারের ভেতর দিয়েও শুধু মাত্র কিছু আলো ছবি আঁকার মত ব্যবহার করে দারুণ আর মজার মজার কাজ করা যায়। কিছু নমুনা দেখাই
এইসব ছবি কিভাবে তোলে সেটা নিয়ে একদিন সুহাস ভাই কে ধরলাম। সুহাস ভাই ফোনে কি কি জানি বলল কিছুই বুঝলাম না। জাস্ট হ হ করে গেলাম। খালি বুঝলাম এই জিনিস একদম সামনা সামনি না দেখলে কিছুতেই বুঝবোনা। এইটা নিয়ে একদম সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। এই শীতে আমার নানাবাড়ি বিক্রমপুরে আমি, সুহাস ভাই, রোয়েনা আর আমার বন্ধু আবির একটা ট্যুর দেই। সেইখানে সুহাস ভাই এর কাছ থেকে ধারনা টা পরিষ্কার হয়। তখনি এক্সপেরিমেন্টের একটা ভুত চাপে মাথায়। দেখি কিছু করা যায় নাকি।
১. এই ছবিটা পুরোপুরি টেস্ট শট। দেখার জন্য কেমন লাগে। ঘন কুয়াশা আর প্রচণ্ড শীতের রাতে আলু ক্ষেতে গিয়ে শুরু করলাম কাজ। আকাশে চাঁদ থাকলেও ঘন কুয়াশার জন্য সেটা তেমন ভালো দেখা যাচ্ছিলোনা। তাই আলোও কম ছিলও। ছবিটা স্পষ্ট করার জন্য অনেক্ষন শাটার ধরে রাখতে হবে। দিলাম ১১ মিনিটের একটা শাটার। মানে ১১ মিনিট ধরে ছবি উঠতে থাকবে। হাতের কাছে কিছু না পেয়ে চেয়ারটা বসিয়ে দিলাম। পাশে দাঁড়ানো আবিরকে বললাম দোস্ত, ঐ চেয়ারটায় একটু ১১ মিনিট একদম না নড়ে বসে থাক। এই প্রচণ্ড শীতে ঠিক মত দাঁড়াতে পারছিনা, সবাই কাঁপতেসি আর আমি কিনা ওকে বলছি না নড়ে ঐখানে চেয়ারে বসে থাকতে ১১ মিনিট। আবির আমাকে পাগলা কিসিমের মনে করতো আগে থেকেই, এইটা বলার পর ও এমন করে তাকালো মনে হলো আমি আসলে পাগলা গারদ থেকে পালায় যাওয়া কেউ। কেমন দূরে সরে গেলো, এমন ভাব যেন আমি ওকে ধরে কামড়ে-টামড়ে দিব। কি আর করা, ঐ চেয়ারটাই তখন ভরসা। শুরু হল ১১ মিনিট ধরে ছবি তোলা। এর মাঝে আমি একটা টর্চ লাইট নিয়ে খুব ধীরে ধীরে পুরো চেয়ারটায় ব্রাশের মত করে পেইন্ট করলাম প্রায় ৩ মিনিট মানে চেয়ারটার উপর আলো টর্চের আলো ফেললাম। মূল লাইট পেইন্টিং এর থিমে যা করে সেটা হচ্ছে কোনও স্থির জিনিসের আশেপাশে লাইট দিয়ে কিছু আঁকে লং শাটার তোলার সময়টায়। আমি করলাম একটু ভিন্ন করে। দেখিনা কি হয়। আমি শুধু সাবজেক্টের উপর লাইট ফেললাম। অন্ধকারে শুধু সেইটা ফুটে উঠবে। ছবি উঠার পর দেখে খুব একটা খারাপ লাগলো না। আবির কে দেখালাম। তখন দেখি ব্যাটা কেমন মিনমিনে গলায় বলল, দোস্ত আমি মডেল হইতে রাজি।
২. পরের রাতে আবির কে চেয়ারে বসিয়ে দিলাম মডেল বানিয়ে। ঐদিন কুয়াশা একটু কম থাকায় আকাশে চাঁদটা দেখা যাচ্ছিলো ভালো করেই। এইবার লাইট পেইন্টিং করে বেশ মজা পেলাম। এই ছবিটা তোলার সময়ে মাঝে আবিরের পুরো শরীরে আর আশেপাশের কিছু জায়গায় টর্চ লাইট দিয়ে সেই ধীরে ধীরে ব্রাশের মত পেইন্ট করে লাইট ফেললাম। অন্ধকারে ও স্পষ্ট হলো।
৩. এই ছবিটা আমার খুব মজা লাগসে। ৮ মিনিটের ছবি। আবির কে বললাম প্রথম ৪ মিনিট তুই বসে থাকবি আর পরের ৪ মিনিট দাঁড়ায় থাকবি। তাতে একটা ছায়ার মত ব্যাপার আসবে। আর আমার টর্চ দিয়ে লাইট পেইন্টিং তো আছেই।
৪. একটু পর আরও থিম মাথায় এলো। ভাবলাম লং শাটারের ফর্মুলা তো সেই স্থির জিনিস স্থির থাকবে আর গতিশীল জিনিসের মোশন এর ইফেক্ট আসবে। আমি তো এতক্ষণ লাইট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফেলসি সাবজেক্টের উপর পেইন্টিং বা আঁকার মত করে। এবার যদি লাইট টাই স্থির রেখে দেই কোথাও, তাহলে কেমন আসবে? যেই ভাবা সেই কাজ। কম্পোজিশন ঠিক করে ফেললাম। তারপর ক্যামেরার ঠিক উপর থেকে টর্চটা ধরে রাখলাম আবিরের দিকে টর্চ একদম না নড়িয়ে। মজার একটা ইফেক্ট আসলো।
ছবিগুলো বলতে গেলে প্রায় একদম ক্যামেরা থেকে তেমন কোনও এডিটিং ছাড়া। এডিট কি করবো, যা করার ক্যামেরা আর আলো নিয়ে খেলাতেই করে দিসে। মানে ছবি তোলার সময়তেই কাজ হয়ে গেছে। একটু অন্যরকম কিছু করার চিন্তা থেকেই এই এক্সপেরিমেন্টগুলো করা। সুহাস ভাই না থাকলে এসব সম্ভব হতনা। আর অবশ্যই ব্যাটা আবিরের কথা বলতেই হয়। ভয়ানক শীতের রাতে অনেক কষ্ট করসে একেক টা ছবির জন্য। ছবিগুলো তুলসি রাত ১২টার পর থেকে শুরু করে প্রায় রাত ৩টা পর্যন্ত। গ্রামের মানুষ যদি না জানতো যে আমরা ঢাকা থেকে গিয়েছি এবং এই রাত বিরাতে আলু ক্ষেতে ছবি তুলি তাহলে নির্ঘাত ভয় পেত কারণ একেক টা ছবি তোলা শেষে শীতে আমরা সবাই আক্ষরিক অর্থেই নাচানাচি করসি কাঁপুনিতে। কেউ দূর থেকে রাত ৩টায় দেখত মানুষের মত কিছু অবয়ব হাত পা ছুঁড়ে নাচতেসে। ব্যপারটা একটু ইয়ে আর কি !
যাইহোক, এই এক্সপেরিমেন্ট শেষে একটা কথা খুব মনে হইসে। নিজের মনের অন্ধকারের জায়গা গুলোতে যদি লাইট পেইন্টিং করে ভালো কিছু স্পষ্ট করা যেত আর সেইগুলা দেখে ভালো কিছু করা যেত।
জীবনে কিছুই পারলাম না। লাইফ ইজ দীর্ঘশ্বাস-ফুল !
মন্তব্য
ফটোগ্রাফীর এপর সবসময়ই আগ্রহ ছিল আপনার লেখা পড়ে তো এখন হাত পুরো নিশপিশ করছে। কিন্তু একটাই সমস্যা SLR ক্যামেরার অনেক দাম.................
@ রাহিদ হাসান রবিন:
ফটোগ্রাফি মানেই SLR না। জেদ আর চোখ এই দুই হল আসল। যদি সত্যি প্যাশেনেট হন তাহলে আজকে এই এখন থেকেই ছবি তোলা শুরু করেন। মোবাইলে ক্যামেরা নাই? ঐটা দিয়ে তুলেন। ছোট পয়েন্ট অ্যান্ড শুট দিয়ে তুলেন। হাত পাকাতে বন্ধুর ক্যামেরা ধার করেন। স্টুডিওতে মাগনা কামলা খাটেন। পল্টন থেকে পুরানো ক্যামেরা ভাড়া নেন। টাকা না থাকলে দুইটার জায়গায় তিনটা টিউশানি করেন, তাও না হলে ঘরের পুরানো জিনিস বিক্রি করে ফেলেন -- শুধু হাত নিশপিশ করলে হবে না, মনের নিশপিশ করা চাই।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
পল্টন থেকে পুরানো ক্যামেরা কিভাবে ভাড়া পাওয়া যায় জানাবেন ??
আপনার ছবিগুলো দেখে আমার নিজেরই মডেল হতে ইচ্ছে করছে।দিবেন নাকি আমার এরকম অশরীরী কিছু ছবি তুলে।
দারুণ লাগলো লং শাটারের পরীক্ষামূলক কাজ।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
ঘ্যাচাং
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
খাসা। আপনার লাইট পেইন্টিংগুলোও ভাল লাগল, আর টর্চ দিয়ে স্লো পেইন্টিং-টাও বেশ।
আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি
আলোর ঢেউয়ে উঠল মেতে মল্লিকা মালতী ।
বাহ, চমৎকার! পাঁচ তারা নয় হাজার তারা!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
দারুণ লাগলো!
"মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম-
তোমারি কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক-
সত্যেরে লও সহজে।"
ছবি তোলার নেশাটা অনেকদিন চাপা দিয়ে রাখছিলাম। আপনার ছবিগুলো তো মাথা খারাপ করে দিল। দুর্দান্ত হয়েছে সব কটা ছবি।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
দারুন লাগলো ছবিগুলো।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
৩ নাম্বার ছবিটা ব্যাপক মজার!
ভালো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
হু। এখন বুঝছি। ট্যাকা দে।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
ভালো লেগেছে। ৩ নম্বর ছবিটা দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম চেয়ারে বসা মডেল আলু ক্ষেতে পটল তুলেছে আর আত্মাটাও (দাঁড়ানো) লং শাটারে ধরা পড়েছে। মাবুদে এলাহী!
ঘুমাতে যাবার আগে এভাবে ডিস্টাব দেয়া ঠিক না। এটা একটা টেস্ট কমেন্ট, কাল বাসায় ফিরে মন মতো কমেন্ট করবো।
তবে আপাততঃ গ্যালারীতে ... কেনো? জানতে হলে কাল কল দিস ... মু হা হা হা হা ... ... ...
==========================================================
ফ্লিকার । ফেসবুক । 500 PX ।
পোষ্ট পড়ে এবং ছবিগুলো দেখে আনন্দ পেলাম
বাহ! চমৎকার হয়েছে।
এই যে 'লাইট পেইন্টিং' জাতীয় জিনিসগুলো, এগুলো তোমার সাথে আলাপ না হলে জানা হতো না গল্পে গল্পে... এই রকম আলোচনা পোস্ট নিয়মিত চললে ভালো হয়।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
ছবিগুলো দারুণ। কিভাবে তোলা হয়েছে লেখার জন্য
(৩নং ছবিটা) ফিল্মের ক্যামেরায় রিল না ঘুরিয়ে এই ছবি তোলা যেত।একই ফ্রেমে এত লং শাটার ছাড়া আর কোন উপায় নাই? এভাবে অসীম ধৈর্যের ব্যাপার।
নতুন মন্তব্য করুন