এ্যাম্বাসেডর

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি
লিখেছেন প্রকৃতিপ্রেমিক (তারিখ: মঙ্গল, ১৪/০৮/২০০৭ - ৮:৪৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আর ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া?
নো। আমি কৃত্রিমভাবে হেসে জবাব দেই।
দেন?
ইউ গেস।
প্যাকিস্টান?
নো।
শ্রী লাংকা?
নো।
হয়্যার আর ইউ ফ্রম দেন?

আমার মেজাজের পারদ সপ্তমে ওঠে। কিন্তু সেটা তো প্রকাশ করা যায়না। ঠান্ডা গলায় বলি,

'আরন্ট দেয়ার এনি আদার প্লেসেস ইন সাউথ এই'শা?'

সে ধরতে পেরেছে আমি কোথায় থেকে এসেছি এমন ভাব করে বলে,

'ও, ইউ'র ফ্রম নেপাল, রাইট?'

মেজাজের পারদ এবার বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। আগের চেয়ে ঠান্ডা গলায় ব্যঙ্গের সুরে বলি,

'রঅঙ। বাট ইউ'র ভেরি ক্লোজ; আ'ম ফ্রম বাংলাদেশ।'

ভাগ্য ভাল বাংলাদেশকে চিনতে তার কষ্ট হয়না। সে বলে, হ্যাঁ তোমাদের ওখানে তো এখন ভীষণ বন্যা।

বাংলাদেশ আর বন্যা, বাংলাদেশ আর সাইক্লোন, বাংলাদেশ আর গরীব দেশ; এগুলো এদের কাছে সমার্থক হয়ে গ্যাছে। সপ্তাহ খানেক আগে টরন্টো সান পত্রিকায় পাভেল রহমানের তোলা সিরাজগঞ্জে বন্যার ছবি ছাপা হল। তার কয়েকদিন পর টরন্টো স্টারের উইকএন্ডের পেপারে প্রথম পাতায় বন্যাপীড়িত এক মায়ের ছবি-- সন্তান কোলে নিয়ে কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে, রিলিফের আশায়।

খবর যখন পত্রিকার পাতায় ফলাও হচ্ছে তখন বাংলাদেশের কথা তো জানবেই। তারা জানবে বন্যায় ভেসে যাওয়া বাংলাদেশ, কিন্তু জানবেনা কিভাবে যুগ-যুগ ধরে এই বন্যা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গ্যাছে। তারা জানবে সাইক্লোনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ, কিন্তু জানবেনা কী অসীম সাহসীকতা আর মনোবল দিয়ে এ ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। তারা জানবে আর্সেনিকে আক্রান্ত মানুষে ভরা বাংলাদেশ, কিন্তু জানবেনা বাংলাদেশী বিজ্ঞানীদের তৈরী পানি-আর্সেনিকমুক্ত করার যন্ত্র আবিস্কারের বাংলাদেশ।

বাংলাদেশকে পরিচিত করার দায়িত্ব কাদের? আমরা যারা বিদেশে আছি, তাদের? বিদেশে বাংলাদেশ মিশনের? দেশে যারা আছে তাদের? সার্বিকভাবে সবাই? উত্তরটা সহজে দেওয়া কঠিন।

লক্ষ্য করেছি, ভারতীয় চেহারার কারো সাথে দেখা হলেই হিন্দীতে কথা শুরু করে। আমি চুপ করে থাকি। একসময় বলি 'আই ডোন্ট স্পিক ইওর ল্যাংগুয়েজ'। কিছুটা তাচ্ছিল্লের স্বরে উল্টো জিজ্ঞেস করে, কোন ভাষায় কথা বলি। উত্তর শুনে অবাক হয়, বলে, কেন তোমরা তো হিন্দীও পারো; সাথে একটা রেফারেন্সও দেয়, অমুক বাংলাদেশী তো হিন্দীতেই কথা বলে। আমি আবারো বলি আমি হিন্দী বলতেও পারিনা, বুঝিও না। মনে মনে বলি, হিন্দী কোনদিন বুঝলেও স্বীকার করবনা, আর বলা তো অসম্ভব।

এখানে যত ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে গিয়েছি তার একটা বড় অংশই বাংলাদেশি পরিচালিত। অথচ এগুলোর নাম ইন্ডিয়া গার্ডেন, গেট অফ ইন্ডিয়া, সেহ্‌নাই কিংবা কোহ্-ই-নূর। ভেতরে হয়তো ছোট্ট একটা বাংলাদেশের ম্যাপ বা দেশের একটা শিল্পকর্ম। বেচে বাংলাদেশী খাবার অথচ বলে ইন্ডিয়ান কুইজিন। রিজিওন বোঝাতে ইন্ডিয়ান কুইজিন বলতে আমার আপত্তি নাই কিন্তু তাহলে বাংলাদেশের প্রচার হবে কী ভাবে?

দেশ ছাড়ার সময় আমার খুবই প্রিয় প্রবীন এক শিক্ষক বলেছিলেন বিদেশে গিয়ে তোমরা প্রত্যেকেই একেকজন এ্যাম্বাসেডর। তাঁর কথা সবসময় মনে রাখি। চাল চলনে, মেজাজ মর্জিতে এই চামড়ার মান যাতে থাকে সেটাই চেস্টা। বাজে ভাবে কখনো গাড়ি চালাইনা, হাঁটার সময় সিগনাল না পড়লে ফাঁকা রাস্তাও পার হইনা; পাছে চামড়ার দূর্নাম হয়! কিন্তু যা কিছুই করছি লাভের গুড়তো যাচ্ছে 'ইন্ডিয়ার' ঘরে। আমারো যে একটা ভাষা আছে, নিজস্ব ভূখন্ড আছে, খাবারের ঐতিহ্য আছে সেটার প্রচারের দায়িত্ব তো আমারি। আমি স্বার্থপরের মত সে চেষ্টাই করে যাই।


মন্তব্য

কেমিকেল আলী এর ছবি

আমার সাথে কয়েকটা ভারতীয়দের দেখা হয়েছিল বেশ কিছুদিন আগে।

পরিচয়ের আগেই আমার সাথে হিন্দিতে কথা শুরু করল। আমি ইংরেজিতে বললাম, "তোমার হিব্রু ভাষা আমি বুঝিনা"।

সে বলে, এইটা হিব্রু না, হিন্দি ভাষা।

আমি উততর দিলাম, আমার কাছে হিব্রু ভাষা মনে হল যে? হিন্দি কি?

তারপর আমারে জিগায়, তুমি কোথা থেকে? আমি বললাম বাংলাদেশ।

এইবার বলে , তুমি কি ইন্ডিয়া চেন? আমি উততর দিলাম মাঝে মাঝে শুনি ইন্ডিয়ার কথা, তবে আমি সিওর না কোথায়।

এরপরে বেটা সরি বলে গেল।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

হা:হা:হা:।

-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

কেমিকেল ভাই, আপনি আসলেই কেমিস্ট্রির মতই জটীল। এই জটীল সেই জটীল না। বুঝতেই পারছেন কী বলতে চাইছি? হা হা ... কঠিন দিছেন আপনি। এই ফর্মুলা অ্যাপ্লাই করতে হবে।

অচেনা এর ছবি

সুন্দর প্রকাশ।
একদম আমার মনের কথা।

হিন্দি কেন পৃথিবীর যে কোন ভাষা শিখতে বলতে
আমার কোন সমস্যা নাই। কিন্তু সমস্যা হলো যখন
কেউ মনে করে তার ভাষা আমার জানা উচিত। এই বাংলাদেশেই অনেক ভারতীয় কাজ করে। এইরকম
এইকজন আমার সাথে একদিন হিন্দি বলা শুরু করলে, এমন ভাবে ওর দিকে তাকাইছিলাম যে এরপর বেটা ভুলেও হিন্দি বলার সাহস দেখায় নাই। কারণ আমি ছিলাম ক্লায়েন্ট চোখ টিপি

-------------------------------------------------
আমি ভালবাসি বিজ্ঞান
আমি ঘৃণা করি জামাত॥

দিগন্ত এর ছবি

আমি কিছু বিখ্যাত কোট দিই তাহলে ...
কোট ১ - আমি ওরাকল হায়দ্রাবাদে জয়েন করলাম। কিছুদিন পরে বিয়ে হল। ম্যানেজার (অন্ধ্রের লোক, আমেরিকান সিটিজেন) জিজ্ঞেস করলেন বৌ এর বাড়ি কোথায়? বললাম ঢাকায়। বলল সেটা কোথায়? কোলকাতার ধারেপাশে কি? ...

কোট ২ - আমার মাইক্রোসফটের এক কলিগ (বাঙালী, কিন্তু আদিবাসী) জিজ্ঞেস করলেন আচ্ছা বাংলাদেশে ঠিক কারা থাকে? বাঙালী না মুসলিম ...

কোট ৩ - শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু কেন বলা হয়? উনি তো বাঙালীদের জন্য কিছু করেননি ...


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

কেমিকেল আলী এর ছবি

কে কোথাকার বা কি সেই কথাটা মুখ্য না, বা কোন সমস্যা না। সমস্যা হল গায়ের রং কাছাকাছি দেখেই যদি আমি মনে করি যে উনি বাংলা, হিন্দি বা উর্দু জানে তাহলেই সমস্যা। আর পরিচয়ের পরে সুবিধা মত বলার ব্যাপারটা অন্য রকম।

অচেনা এর ছবি

আমার মাইক্রোসফটের এক কলিগ (বাঙালী, কিন্তু আদিবাসী)

অনেক্ষণ কপাল চুলকাইলাম, তার্পরেও বুঝলাম্না।
বাঙালী আদিবাসী চিন্তিত

-------------------------------------------------
আমি ভালবাসি বিজ্ঞান
আমি ঘৃণা করি জামাত॥

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

কোট ৩ - শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু কেন বলা হয়? উনি তো বাঙালীদের জন্য কিছু করেননি ...

এ্যাঁ! আমি হাসব, না কাঁদব বুঝতে পারছিনা।

দিগন্ত এর ছবি

"বাঙালী আদিবাসী" - কথাটা একটু ভুল হয়েছে বলা। বলা উচিত ছিল পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী ...


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

দিগন্ত এর ছবি

আমি হাসব, না কাঁদব বুঝতে পারছিনা।

- আমার ধারণা সবগুলো লিস্ট করে আমি একটা বড় পোস্টও দিতে পারি ... কিন্তু সেটা বড্ড বেশী বড় হয়ে যেতে পারে।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

কেমিকেল আলী এর ছবি

আর একটা ঘটনা বলি।
একবার দেশে যাবার সময় টরোন্টো থেকে লাগেজগুলো একবারে ঢাকা দিতে পারিনি। কাতারের দোহা পর্যন্ত দিয়েছে। কাতার এয়ার। উনারা বলল আপনাকে দোহাতে গিয়ে কিছুই করতে হবে না।শুধু লাগেজগুলো নিয়ে এয়ারপোর্টের ম্যানেজমেন্টকে দিলেই হবে।

আমি দোহাতে নামার পরে লাগেজ নিয়ে কাউন্টার দিতেই হিন্দিতে কথা বলা শুরু করল। আমি বললাম আমি হিন্দি জানি না। উনারা ভাংগা ভাংগা ইংরেজিতে বলল, লাগেজ আপনাকে সাথে করে হোটেলে নিয়ে যেতে হবে। আমার মেজাজ গেল তেরা হয়ে। গেলাম উনাদের উপরের এক বসের কাছে।

সেই উপরের লোক আর আমি ফিরে আসলাম আগের সেই কাউন্টারে।
বস আর কাউন্টারের লোকগুলো হিন্দিতে কথা বলা শুরু করল।

শুরু করল এই বলে যে আমি হিন্দি বুঝি না তাই আমার সামনেই সব ওরা আলাপ করে নিচ্ছে।

ওরা যা আলাপ করল তার সারমর্ম হল এই যে, আসলে আমার লাগেজ ওদেরই রাখার কথা, কিন্তু জায়গার একটু সমস্যা আছে। তবে বেশি জোর করলে ওরা আমার লাগেজ রাখবে।

ওদের কথা শেষ, আমার পিট ঢলে ঐ বস টাইপের লোকটা যেই জ্ঞান দিতে আসছে, আমি শুধু হিন্দিতে বলছি - আমি অল্প কিছু হিন্দি জানি। তবে আপনার যা আলাপ করছেন এইখানে তার বেশি কিছু বুঝি নাই।

উনি এত লজ্জা পেল তা আর বলার মত না। কাউন্টারের লোকগুলোর শুধু বলল, এই ব্যাগ তোদের কাউন্টারে রাখলেও রাখতে হবে।

আর আমাকে বলল, সরি ইয়ার।

অতিথি এর ছবি

nice writing

নজমুল আলবাব এর ছবি

লেখাটাতো দারুন। কেমিকেল আর দিগন্ত'র কমেন্টগুলো যোশ

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

জিফরান খালেদ এর ছবি

লন্ডনে এহেন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া ডালভাত। আমি চোস্ত আংরেজী মারাই তখন (পুরাপুরি হয়না যদিও)।

আইচ্ছা, তারেক পোলাডা কই? আমারে গুতাইতে গুতাইতে এহানে আনি নিজে ভ্যানিশ!!

হুররর!!!

ঝরাপাতা এর ছবি

আমি আবার ফেইস করেছি ভিন্ন রকম পরিস্থিতি। এখানে যে ইন্ডিয়ান ছেলেগুলো আছে তারা প্রথম থেকেই ইংরেজীতে কথা বলে আমার সাথে। কিন্তু পাকিস্থানি যেগুলো আছে পরিচয়ের শুরুতেই উর্দুতে কথা বলে। তখন তাকে বলি আমি উর্দু জানি না। এই কথা শুনে বেশিরভাগই খুব মর্মাহত হয়। যেন আমাদের জন্য উর্দু জানাটা ফরজ।

আমাদের ভাষাকে, দেশকে রিপ্রেসেন্ট করার দায়িত্ব আমাদেরই। কারণ অনেক বাংলাদেশীকে দেখেছি ইন্ডিয়ান বা পাকিস্থানীদের সাথে হিন্দীতে কথা বলতে।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

নজমুল আলবাব লিখেছেন:
লেখাটাতো দারুন। কেমিকেল আর দিগন্ত'র কমেন্টগুলো যোশ

তা আর বলতে...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।