নবম-দশম শ্রেণীর বাংলা বইয়ের শেষের দিকের একটি পাতায় যেহেতু তাঁর কবিতা ছিল তাতেই ধারণা করতাম এই কবি হয়তো বেঁচে আছেন। ঠিক তাই। বেঁচেই ছিলেন, কিন্তু কোন এক অজানা কারণে তাঁকে আমার পছন্দ হতনা। হয়তো তাঁর লেখা কখনো পড়িনি বলে, কিংবা শুধু মুখের কথা শুনেই তাঁকে আমার ঘোর অপছন্দ।
এরপর ১৯৯২ থেকে ১৯৯৪। সময়টা আমার জীবনে নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। নটর ডেমের ডিসিপ্লিন্ড লাইফ উপভোগ করা শুরু করেছি। পুরনো বন্ধু মাসুম আর আমার রোল পাশাপাশি। আমি তখন হুমায়ূন বলতে পাগল। আর মাসুম আছে শওকত আলী, সেলিনা হোসেন আর শওকত ওসমান নিয়ে। স্পষ্টতই দুটা ভিন্ন ধারা। ক্লাসে পড়ার আলোচনার চেয়ে এঁদের সাহিত্যমান (!) নিয়ে ঝগড়াই বেশী হত।
ঠিক সেই সময় শা.রা. বিতর্কের শুরু। আজান নিয়ে তাঁর একটা লেখা বা মন্তব্য (যদিও নিজে কখনোই দেখিনি) এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। আমি নজরুল ভালবাসি। আবার প্রচন্ড ধার্মিক। কিন্তু কবিদের প্রতি আমার আলাদা সহানুভূতি। বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে.. পদচিহ্ন এঁকে দেয়াতে আমার ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগেনা। আর তাই শামসুর রাহমানের আজান বিতর্কই হয়ত তাঁর প্রতি আমাকে আগ্রহী করে তোলে। তখনই মাসুমের কাছে থেকে উপহার পাই "শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা"।
রেখে রেখে কবিতাগুলো পড়তে থাকি। মনে হয় কবিতো আমার মনের কথাগুলোই বলছে--
কবিকে দু:খ দিওনা
দু:খ দিলে সেও জলে স্থলে হাওয়ায় হাওয়ায়
নীলিমায় গেঁথে দেবে দু:খের অক্ষর।
কবি তার নি:সঙ্গতা কফিনের মত মুড়ে রাখে,
হাঁটে ফুটপাতে একা...
আমি যেন স্পর্শ পাই অন্য কিছুর, নতুন করে ভাবতে থাকি কবিকে। একদিন টিভিতে কবিতা নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান চলছে। একজন বললেন, শামসুর রাহমানের কবিতা আগের মত নাই। আমি কবিতার বোদ্ধা পাঠক নই। তাই অতশত বুঝিনা। কিন্তু তাঁর সাদাসিদে কথার সাজানো পংক্তিমালাই আমাকে আরো কাছে টেনে নিয়ে আসে।
তাঁর কোন একটা কবিতার একটা লাইন
মেঘের নেকাব ছিঁড়ে হাসফাস করে জলবন্দি চাঁদ
--অতি সাধারণ এ কথাগুলোই কখন এক যাদুমন্ত্রবলে মস্তিষ্কের নিউরনে স্থান করে নিয়েছে, টেরই পাইনি।
কিংবা হঠাৎ করে শুরু হওয়া কবিতা
এখন কয়টা বাজে?
ঘড়ি দেখবার সামর্থ উধাও...
হঠাৎই ভাল লেগে যায়। কবির স্বার্থকতা বোধহয় এখানেই। অপ্রিয় একজন কবি তাঁর লেখনি দিয়েই স্থান করে নিয়েছেন প্রিয় কবির আসন।
কবিকে নিয়ে কল্পবাসী হয়েছি অনেকবারই। যেন আমি তাঁর শ্যামলীর বাসায় যাচ্ছি তাঁকে দেখব বলে। কিন্তু কী একটা সংকোচ অনুভব করতাম বারবারই। কবি কি আমাকে দেখা দেবেন! কবির জন্য কী উপহার নেব আমি?
একটা কবিতা? না, তা হবে হাস্যকর।
বই? গদ্য না পদ্যের?
আচ্ছা কবি কী খেতে পছন্দ করেন? বগুড়ার লাল আলুর ভর্তা?
হয়তো কবিকে 'আপনি' না 'তুমি' বলে ডাকব, সে সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারিনি বলেই কখনো তাঁকে আর দেখা হয়নি, কথা হয়নি।
কবির বিদায়দিনে প্রথম আলো কয়েকটা লাইন তুলে দেয় প্রথম পাতায়:
যেদিন মরবো আমি,সেদিন কী বার হবে,
বলা মুশকিল।
শুক্রবার? বুধবার? শনিবার? নাকি রবিবার?
যে বারই হোক,
সেদিন বর্ষায় যেন না ভেজে শহর,
যেন ঘিনঘিনে কাদা
না জমে গলির মোড়ে।
সেদিন ভাসলে পথ-ঘাট,
পুণ্যবান শবানুগামীরা বড়ো বিরক্ত হবেন।
(বিবেচনা/ নিজ বাসভূমে)
কবিকে কল্পনায় হলেও, বাস্তবে দেখিনি কোনদিনই। কিন্তু একদা এক অপ্রিয় কবির বিদায়ের খবরে লোনা জলে ভেসেছি মহাবাস্তবের এই পরবাসে। কোনদিন দেখা হলে কবিকে হয়তো তুমি করেই বলতাম। কিন্তু অন্তর্মূখি এই 'আমি'র কল্পনা কোনদিনই আর বাস্তব রূপ পাবেনা। কবির বিদায় দিনে আজ তাই সাদাসিদে এ শ্রদ্ধার্ঘ।
মন্তব্য
কবিতার লাইনগুলো স্মরণ থেকে লেখা। তাই ভুলের সম্ভাবনা বেশী। অনুগ্রহ করে কেউ ঠিক করে দিলে আনন্দিত হব।
.........
যত বড় হোক সে ইন্দ্রধনু দূর আকাশে আঁকা
আমি ভালবাসি মোর ধরনীর প্রজাপতির পাখা
যেদিন মরবো আমি,সেদিন কী বার হবে, বলা মুশকিল।
শুক্রবার? বুধবার? শনিবার? নাকি রবিবার?
যে বারই হোক,
সেদিন বর্ষায় যেন না ভেজে শহর, যেন ঘিনঘিনে কাদা
না জমে গলির মোড়ে। সেদিন ভাসলে পথ-ঘাট,
পুণ্যবাদ শবানুগামীরা বড়ো বিরক্ত হবেন।
(বিবেচনা/ নিজ বাসভূমে)
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ব্যাক্তিগত ব্লগ | আমার ছবিঘর
বিপ্র,
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
তাঁর স্মৃতিতে শ্রদ্ধা ।
-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।
কবিরা এইভাবেই মানুষের অন্তরে জায়গা করে নেন।
-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!
এই কবিতাটি পড়া হয়নি। ধন্যবাদ কিছু চুম্বক অংশ পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য।
রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।
বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।
প্রকৃতিপ্রেমিক ভাই,
বানানটি পুন্যবান হবে...।টাইপ করার সময় ভুলক্রমে পুন্যবাদ লিখছি...একটু ঠিক করে দিন।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ব্যাক্তিগত ব্লগ | আমার ছবিঘর
আমি আগেই ঠিক করে ফেলেছি। ধন্যবাদ আবারো।
নতুন মন্তব্য করুন