তাঁর সাথে আমার কবে প্রথম দেখা, মনে নেই। তখন গ্রীষ্ম চলছে। ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নেই, কাজও নেই। বাড়তি কিছু আয়ের জন্য নঈম আংকেলের দোকানে মাঝে মধ্যে কাজ করি। ডলার স্টোরের মত, তবে দামী জিনিসও আছে। নানা রঙের মানুষ আসে। কেউ কেনে গিফট কার্ড, চকোলেটবার; কেউ ছবির ফ্রেম, বাচ্চাদের খেলনা, পোষা প্রাণীর খাবার। টুকটাক ব...তাঁর সাথে আমার কবে প্রথম দেখা, মনে নেই। তখন গ্রীষ্ম চলছে। ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নেই, কাজও নেই। বাড়তি কিছু আয়ের জন্য নঈম আংকেলের দোকানে মাঝে মধ্যে কাজ করি। ডলার স্টোরের মত, তবে দামী জিনিসও আছে। নানা রঙের মানুষ আসে। কেউ কেনে গিফট কার্ড, চকোলেটবার; কেউ ছবির ফ্রেম, বাচ্চাদের খেলনা, পোষা প্রাণীর খাবার। টুকটাক বেচাকেনা, সময় চলে যায়।
তিনি মাঝেমধ্যেই আসতেন, বিকালের দিকে। চোখে পুরু কালো রোদ চশমা, দুপাশে ঘেরা দেয়া যাতে আলো না লাগে। টুকটাক কথা হয়। বেশীরভাগই আবহাওয়া নিয়ে-- আজকের দিনটা খুবই চমৎকার, মেঘলা দিন হালকা রোদ, এসব। একটা দুটা জিনিস কেনেন, "থ্যাংস ডিয়ার" বলে চলে যান। একদিন গিফট কার্ড কিনে কলম চাইলেন কিছু লিখবেন বলে। আমি এগিয়ে দেই। লিখে কলমটা নেড়েচেড়ে বললেন খুবই সুন্দর কলম আর তেমনি দারুণ লেখে। আমি বলি, পছন্দ হলে আপনি নিতে পারেন, আমার আরেকটা আছে। নীল কালির সামান্য বলপেন। এরকম কত কলম দোকানের কোনাকাঞ্চিতে পড়ে থাকে। প্রথমে ইতস্তত করলেন। বললেন, "এভাবে কি ব্যবসা চলবে?" আমি বলি, "এটা তোমার জন্য আমার সামান্য উপহার হিসেবে রেখে দাও"।
এর কয়েকদিন পরে তিনি আবার এলেন। যথারীতি কুশল বিনিময় হল। তিনি ব্যাগ থেকে বের করলেনএকটা প্লাস্টিকের বাটি। ভেতরে বাসায় বানানো কুকিজ। আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, "এটা তোমার জন্য"। আমি কিছুটা অবাক, কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এর আগে কোন সাদা মানুষ এভাবে কোন খাবারের জিনিস এগিয়ে দেয়নি। সন্দেহবাতিক ছোট মন আমার। কী না কী দিয়েছে, আমি সংকোচ করছিলাম আর নেব কি নেবনা তাই ভাবছিলাম। কিন্তু সামনা সামনি তো আর না করা যায়না। তাই ধন্যবাদ দিয়ে দুহাত পেতে বাটি নিলাম। তাঁকে বোঝালাম কুকিজ পেয়ে আমি অতিশয় আনন্দিত।
তার অনেকদিন পর আবার তিনি এলেন। অনেক্ষণ কী একটা খুঁজলেন; বোধহয় পেলেন না। অবশেষে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন দোকানে ছোট্ট ছবির ফ্রেম আছে কী না। আমি এগিয়ে এসে তাঁকে নিয়ে সবগুলো ফ্রেম দেখালাম। তিনি বললেন, "তোমার দোকানের সবগুলো ফ্রেমই সুন্দর, কিন্তু আমি ছোট্ট একটা ফ্রেম খুঁজছি ছোট্ট একটা ছবি রাখার জন্য, ..for my husband's photo; an old photo. He passed away six years ago" এই বলে তিনি থামলেন।
আমি তাঁর কথা শুনে বিরাট একটা ধাক্কা খেলাম। তাঁর দিকে এই প্রথম ঠিকমত চাইলাম। হালকা সবুজ রঙের ফুলপ্যান্ট আর সাদার মধ্যে কাজ করা ফতুয়ার মত শার্ট; ইন করা। কালো জুতা পায়ে, পরিপাটি করে আঁচড়ানো ধবধবে সাদা চুল। হাতে ওয়াকিং স্টিক। অন্তত আশির কাছাকাছি বয়স, মুখে তার ছাপ স্পষ্ট। একসময় অত্যন্ত আকর্যণীয় ছিলেন তা অনুমান করি।
মুহূর্তেই আমি যেন হারিয়ে যাই তাঁর অতীতে। ষাট সত্তর বছর আগে এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা কেমন ছিল তার কোন ধারনা আমার নেই। তাই কল্পনা বেশীদূর এগোয়না। যৌবনের সোনালী দিনগুলো পেরিয়ে জীবন সায়াহ্নে এসে প্রয়াত স্বামীর পুরনো একটা ছবি সোনালী একটা ফ্রেমে বাঁধতে চাইছেন, যেন পুরনো মানুষটাকে সময়ের ফ্রেমে বেঁধে ফেলা। আমার বুকের ভেতরটা কষ্টে ভরে গেল। সেদিন কথাবার্তা আর বিশেষ হলনা। তিনি স্বভাবমত "থ্যাংস ডিয়ার" বলে হাসিমুখে বিদায় নিলেন। আমি কাঁচের দেয়ালের এপাশ থেকে তাঁর হেঁটে যাওয়া দেখতে থাকি অপলক।
তার বেশ কয়েকদিন পরের কথা। মাঝখানে কী একটা কারণে কয়েকদিনের বিরতি নিয়েছি। ফিরে এসে দেখি কাউন্টারের পাশে ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের বাটিতে হাতে বানানো পিঠা। সেলোফেন দিয়ে সুন্দর করে মোড়ানো। আংকেল নঈম বললেন বয়স্ক একজন মহিলা এটা আমার জন্য রেখে গেছেন। বুঝতে বাকি রইলনা কে আমাকে এই স্নেহের বাঁধনে জড়িয়েছেন। আজ তিন বছর পরেও তাঁর মুখখানি স্মৃতিতে অম্লান।
মন্তব্য
ভালবাসাটুকু ছুঁয়ে গেল .. .. ..
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে
নতুন মন্তব্য করুন