সূর্যদেবের প্রাসাদ। সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। লক্ষ কোটি সোনা রূপা হীরাপান্না গজমোতির দীপ্তি চারিদিকে। অন্দর ও বাহির সবই ঝকমকে। সবসময় সেখানে মধ্যদুপুর, সকাল সন্ধ্যা বা রাত্রি নেই। পৃথিবীর মরণশীল মানুষদের মধ্যে কেউই সেই তাপদীপ্ত চিরমধ্যাহ্নের প্রাসাদে বেশীক্ষণ থাকতে পারবে না, অসহনীয় দীপ্তিতে ঝলসে যাবে। সেই প্রাসাদে সূর্যদেব নিজের অমর পরিচারক-পরিচারিকাদের নিয়ে থাকেন।
একদিন সেখানে এসে হাজির পৃথিবীর এক মানুষ। মানুষটি নওলকিশোর, মুখ একেবারে পরিষ্কার, অজাতশ্বশ্রুগুম্ফ। সেই কিশোর, নাম তার ফিথন। সে একে একে সোপান পার হয়ে প্রাসাদের সিংহদরোজার সামনে এসে উপস্থিত হলো।
বন্ধ দুয়ারে রাশিচক্রের ছবি, কেউ কোথাও নেই। সে একটু ইতঃস্তত করে ঠেলা দিলো দরোজায়। বিশাল দরোজা আস্তে আস্তে খুলে গেল। সে ভিতরে প্রবেশ করলো। ঘরে আলো আর আলো। ঘরের মাঝখানে সিংহাসন, সেই সিংহাসনে বসে আছেন সূর্যদেব। ফিথন এবারে থামলো, সে আর পারছে না, এত দীপ্তি! সে চোখ বুজে ফেললো, মেঝের উপরে নতজানু হয়ে বসে প্রণাম জানালো সূর্যদেবকে।
সূর্যদেব বললেন, "কে তুমি? কেন এসেছ এখানে?"
ফিথন বললো, "আমি ফিথন। আমি এসেছি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে। তুমি কি আমার বাবা? মা বলে তুমি আমার বাবা। কিন্তু আমার সঙ্গে পাঠশালে পড়ে যে ছেলেরা, ওরা শুনে হাসে, বিশ্বাস করে না। মাকে আমি সব বললাম, মা বললো আমি যেন তোমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করি। তাই এসেছি।"
সূর্যদেব হেসে নিজের রত্ন-ঝলকিত মুকুট খুলে রাখলেন, কোমল গলায় বললেন, "কাছে আয় ফিথন।"
ফিথন চোখ খুললো, এবারে সে তাকাতে পারছে সূর্যের মুখের দিকে, এখন আলো আর তাপ অনেক সহনীয়। সে উঠে এক পা এক পা করে এগিয়ে সূর্যদেবের খুব কাছে এলো। সূর্যদেব ডান হাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে বসিয়ে বললেন, " তুই সত্যিই আমার ছেলে। তোর মা ঠিক বলেছে। আমার কথা তো বিশ্বাস করিস? নাকি তাতেও হবে না? ঠিক আছে, আমার কাছে তুই যা চাস দেবো। কী চাস বল।"
ফিথনের তখন এমন চমৎকার লাগছে যে সে কিছুই বলতে পারলো না কয়েক মুহূর্ত। বাপরে, যে সূর্যকে সে প্রতিদিন পৃথিবীর মাটি থেকে দেখেছে ও ও ও ই অনেক উপরে আকাশে, সেই সূর্যের এত কাছে সে বসে আছে? এ যে ভাবা যায় না!
সূর্যদেব আবার বললেন, " কী চাস ফিথন? আমি দেবনদী স্টিক্সকে সাক্ষী রেখে শপথ করছি, তুই আমার কাছে যা চাস তাই তোকে দেবো।"
ফিথন বলে, "আমি তোমার রথ চালাতে চাই একটি দিনের জন্য। একদিনের জন্য সূর্যরথ চালিয়ে আকাশ পার হবো আমি, এই আমার প্রার্থনা।"
সূর্যদেব বুঝলেন গন্ডগোল! ওইভাবে আগে আগেই শপথ করে ফেলা উচিত হয় নি একেবারে স্টিক্সকে সাক্ষী রেখে। ওভাবে শপথ করলে কথা রাখতেই হবে দেবতাকেও। এদিকে এই বাচ্চা ছেলেটা জানে না কী ভয়ানক বিপজ্জনক কাজ সে করতে চাইছে।
সূর্যদেব বললেন, "শোন ফিথন, শোন। তুই অন্য কিছু চেয়ে নে। কত শত রতনমানিক এখানে, যা চাইবি তাই দেবো। সূর্যরথ চালাতে জেদ করিস না খোকা। ঐ রথ বড় সর্বনেশে জিনিস। ও রথ একমাত্র আমি ছাড়া কেউ চালাতে সাহস করে না। কত শক্তিশালী সব দেবতারা আছেন, কেউ ঐ রথ চালাতে পারেন না। ভীষণ কঠিন রাস্তা রে ফিথন, সকালের দিকে সমুদ্র থেকে খাড়া উঠেছে চড়াই, কোনোকরমে ঘোড়াগুলো ওঠে। দুপুরে ঐ অত উপরে, নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘোরে বলে নিচে তাকাই না। তারপরে বিকালে উৎরাইয়ে নামা আরো কঠিন। সমুদ্রদেবতারা যারা আমাকে নিতে আসেন, সকলেই ভাবেন এই বুঝি হুড়মুড়িয়ে পড়লাম সবকিছু সমেত। তুই জিদ করিস না, অন্য কিছু চেয়ে নে খোকা।"
কিন্তু ফিথন আর কিচ্ছুটি চায় না, সে কেবল সূর্যরথ চালাতে চায় একটা দিনের জন্য। এ ছার মনুষ্যজীবন একদিন তো যাবেই, যদি এমন গৌরবময় কাজ করতে গিয়ে যায়, তার চেয়ে ভালো আর কী বা হতে পারে?
অনেক বুঝ দেবার চেষ্টা করলেন সূর্যদেব, লোভ দেখালেন, ভয় দেখালেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না, ফিথন কেবল ঐ একটি জিনিসই চায়। সে অন্য কিছু নেবে না।
এদিকে সময়ও বেশী ছিলো না, ঊষাদেবী পূর্বদুয়ার খুলে দিয়েছিলেন, আকাশের কপালে লেগেছিলো কোমল গোলাপী রঙ। তারাগুলো মিলিয়ে গেছে, শুকতারাও ম্লান। সূর্যোদয়ের সময় হয়ে গেছে।
সূর্যরথে ঘোড়াগুলো জুতে দেওয়া হয়েছে, ফিথন গিয়ে বসলো সেই আশ্চর্য রথে। ঝলমলে সোনালি সেই রথের উপরে উড়ছে আশ্চর্য দীপ্তিময় পতাকা, রথের চাকাদুটি উজ্জ্বল লাল আগুনের। ফিথনের হাতে লাগাম তুলে দিয়ে পরিচারকেরা সরে গেল।
চলতে শুরু করলো রথ, সমুদ্র থেকে খাড়া চড়াই, ঘোড়াগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে মেঘের ভিতর দিয়ে। নীল আকাশের ভিতর দিয়ে উড়ে চলেছে রথ, ফিথন আনন্দের আতিশয্যে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।
এদিকে ঘোড়ারা টের পেয়েছে রথ আজ অনেক হালকা, লাগাম ধরেছে কোনো আনাড়ীর হাত। এরকম অবস্থা দেখে ঘোড়ারা ছুট লাগলো নিজেদের মত। রথ টলতে লাগলো, তারপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একবার যায় ডাইনে একবার যায় বামে, একবার উঠে যায় উপরে, একবার নেমে যায় নিচে। ফিথন ভয়ে একেবারে দিশাহারা হয়ে গেল।
বৃশ্চিক রাশির কাছে এসে ফিথন এতটাই ভয়ার্ত হয়ে পড়লো যে লাগাম ছেড়ে দিলো। রথ হুড়হুড় করে নিচে পড়ছে, চাকার আগুন লেগে গেল পাহাড়ের চূড়ায়, সে আগুন ঘোরবেগে নামতে নামতে উপত্যকার বনে বনে লাগিয়ে দিলো দাবানল। নদীর জল ফুটতে শুরু করেছে, জ্বলছে ঘাস, শস্য, মানুষের ঘরবাড়ি। আগুনলাগা পৃথিবীর আর্তনাদ শূন্য ভেদ করে উঠে যাচ্ছে উপরে, আরো উপরে দেবলোকে। রথের মধ্যে ফিথন তখন নিজেও আধপোড়া, গরম বাষ্পে আচ্ছন্ন সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। এই অবস্থায় মৃত্যুই পরম কাম্য তখন তার।
সেই পরম কাম্য এসে পড়লো। কালো মেঘের থেকে বজ্র এসে অব্যর্থলক্ষ্যে লাগলো ফিথনের গায়ে, ফিথনের মৃতদেহ জ্বলন্ত উল্কার মতন পড়তে লাগলো আকাশ থেকে। সে দেহ পড়লো রহস্যময় নদী এরিডেনাসের বুকে। এরিডেনাস সেই নদী, যা কিনা কোনো মরমানুষের চোখ কোনোদিন দেখতে পায় নি। এরিডেনাসের জলে পড়ে ফিথনের শরীরের আগুন নিভে গেল, সব ঠান্ডা স্নিগ্ধ হল।
এরপরে সূর্যদেবের মেয়েরা, ফিথনের বৈমাত্রেয় ভগিনীরা এসে ফিথনের সমাধি দিলো। সমাধি ঘিরে তারা রয়ে গেল পপলার গাছ হয়ে। ফিথনের জন্য তাদের যে অশ্রু ঝরে পড়ে, তা উজ্জ্বল রত্ন হয়ে ভেসে যায় নদীতে।
*******
মন্তব্য
এইবার! এখন আর পছন্দনীয় কোনো টানেলিং করতে পারবে না...
কিন্তু গল্পটা কেমন জানি...
টানেল সীল করে দিয়েছ নাকি ? তবে তো ছন্দকে ভালো টাইট দিয়েছ।
গল্পটার পরবর্তীকালের কথা ভাবো, ফিথন পরে রাইট ব্রাদার্সদের মধ্যে একজন হয়ে জন্মালেন, সার্থক আকাশযান বানালেন, এসব ভাবো।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
টানেল মডুরাই সীল করে দিয়েছে, পোলাটার কমেন্ট এখন সরাসরিই চলে আসে কিনা...
অনেকদিনপর গ্রীক পুরানের কাহিনী শুনলাম।।ভাল লাগল।
থ্যাঙ্কস রুমঝুম।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আহা ফিথনটা শেষ পর্যন্ত মরেই গেলো! এই গল্প পড়ে কী শিখলাম? শিখলাম যে তুলিদি পোষ্ট দেয়া মাত্রই মন্তব্যের জন্য হুড়োহুড়ি করতে নেই। কারণ হুড়োহুড়িতে পড়ে গিয়ে হাড়গোড় ভাঙ্গার খুব সম্ভবনা আছে(লোকে ভয় পেয়ে তাও যদি প্রথম মন্তব্য করাটা ছাড়ে )
একদম। হুড়াহুড়ি একেবারেই ভালো না।
তা নতুন কী রান্না করলে?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ব্যাটা রামছাগল!
সেটার জন্য এতো কাঁদার কী হলো? আরে সূর্যদেবের দুই একটা মেয়ে তো এই আমাদের কৌস্তুভের জন্যও কাঁদতে পারতো? এত গুণী ছেলেটা কোথায় একটু বালিকাদের মনোরঞ্জন করে হৃদয়ে ঢেউ তুলবে, তা না পরিসংখ্যান আর আপনার পোস্টে প্রথম মন্তব্যের জন্য দৌড়ানো ছাড়া অন্য কোন দিকে তাকায়ই না!
"এই যে এনার পাতে রসগোল্লা দিন তো, একেবারে খালি পড়ে আছে।" নেমন্তন্ন বাড়িতে এইভাবে পাশের লোকের পাতে রসগোল্লা দিতে পরিবেশককে প্ররোচিত করার মানে জানো তো?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
হুঁ, "ঐ পাতে দৈ দাও" - আর কি।
কিন্তু আমার তো আর ওইরকম ভান করে লাভ নেই - এমনিতেই বুড়ো হয়ে গেছি, সমবয়েসী বালিকারা আর চুপচাপ বসে নেই এতদিনে, তাইতে হৃদয়খানাও ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো। এখন তো দিন এই কৌস্তুভের মত নওজোয়ানদেরই।
আহারে। এরকম বুড়িয়ে গেলে কী করে?
রোজ ভালো করে একেবারে ক্লীন শেভ করলেই তো আর বুড়ো হবে না, পড়লে না তাসনীম এর লেখায়?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ক্লিন শেভ তো সেই দাড়ি কাটা শুরু করা থেকে আজ অব্দি প্রতিদিনই করছি - খোঁচা খোঁচা দাড়ি থাকলে নিজেরই অস্বস্তি লাগে... তাই বলে বয়স তো আর থেমে নেই (দীর্ঘশ্বাস)
এইবেলা মুখটা কেবল দেখিয়ে যাই ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
সবগুলোই সুন্দর হয়।
_____________________
Give Her Freedom!
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ভাল লাগল, সূর্যের সন্তান শুনে মহাভারতের আসল নায়ক কর্ণের কথা মনে পড়ে গেল।
facebook
ঠিক। তবে কর্ণ চিরকাল স্বনির্ভর, কর্মতৎপর। সূর্য বাবা একটু খোজখবরও নিলো না!
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
এই গল্পটা আগে শুনেছি, এখন পড়তে চমৎকার লেগেছে। গল্পের আবার একটা ছোট্ট মোরালও আছে!
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
গ্রীক-রোমান উপকথাগুলো বেশ পরিচিত অনেকেরই, কাহিনিগুলো ও জমজমাট। কতসব সূক্ষ্ম টানপোড়েনের গল্প!
পড়েছেন বলে ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
এটা আগে পড়িনি মনে হচ্ছে। বেশ ভালো লাগলো।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
পড়া গল্প, তবু তুলিরেখার ছোঁয়া আছে বলেই কিনা জানিনা ভারী ভালো লাগলো। আচ্ছা লোকেরা কাঁদলেই মণি মানিক হয়, আমরা কাঁদলে হয়না কেন বলতে পার ? তাহলে এতদিনে বেশ একটা রত্ন ভাণ্ডার দিয়ে বসা যেত !
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
ধুর! সব দেখি খালি দুক্ষু দুক্ষু পূরাণ হয়...
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
নতুন মন্তব্য করুন