চমক হাসান। যার নেই কোন তুলনা! বুয়েট থেকে পাশ বের হয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। তার সাথে প্রথম পরিচয় হয় আমার গত ফেবরুয়ারীতে। ভিন্নধর্মী এক গণিত প্রকাশনা উৎসবে "পাইয়ের মান" নিয়ে পুঁথি পড়ছিলো সে। গণিতের মতোন কঠিন একটি বিষয় এতো মজা করে বলা আর তাছাড়া পুঁথির নাম অনেক শুনেছিলাম...জীবনে প্রথম সেদিনই শোনা ভিন্নধর্মী এই পুঁথি পাঠ! অসাধারণ কন্ঠ এই ছেলেটির... বলা যায় অন্ধভক্ত হয়ে গেছি আমি এই তার। তাকে দেখলে আমার শুধু একটা কথাই মনে আসে- "আমাদের দেশে এমন ছেলে আরো চাই যে ছেলেরা কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে..."
বি-স্ক্যান দ্বিতীয়প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমাদের দেশের ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষগুলোকে নিয়ে কি সুন্দর একটা পুঁথি পড়ে গেলো!
দেশের সচেতন নাগরিকেরা যার যার অবস্থান থেকে এভাবেই যদি এগিয়ে আসতো....
আমরা চাই সচেতনতা ছড়িয়ে পড়ুক দিকে দিকে। পাল্টে যাক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি।
আপনাদের সবার সাথে শেয়ার করছি চমকের লেখা পুঁথিটি... ভিডিও রেকর্ডিং শুনতে চাইলে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পুঁথি...
শোনেন শোনেন সুধীজন শোনেন দিয়া মন,
ভিন্নভাবে সক্ষম কিছু মানুষের কথন।
শোনেন বলি মানবজাতি বড়ই চমৎকার,
অনুমানে যায় না করা যোগ্যতার বিচার।
বিখ্যাত লেখিকা ছিলেন হেলেন কেলার,
অন্ধত্ব আর বধিরতা সঙ্গী ছিল তার।
পিছপা হন নি তবু জীবনের সংগ্রামে,
বিশ্বব্যাপী সবাই তারে চেনে আজ এক নামে।
বিশ্বসেরা পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং
পক্ষাঘাতে দুই হাত পা চলৎশক্তিহীন।
কথাও না বলিতে পারেন সিন্থেসাইজার ছাড়া,
তবুও তার মেধার আলোয় ভুবন পাগলপারা।
জগৎসেরা সঙ্গীতস্রষ্টা লুডভিগ বিথোভেন
বধির হবার পরেও কত সঙ্গীত রচেছেন।
জন্ম থেকে হাত-পা-হীন নিক ভুইসিক,
তার কণ্ঠের আশার বাণী ভুলায় দিক-বিদিক।
আমার কত কাছের মানুষ দেখেছি নিজ চোখে-
দেহের বাধার সাধ্য কী গো প্রতিভারে রোখে?
বন্ধু সুজনের কথা শেষ হবে না বলা,
দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ, তবু কী অপূর্ব গলা!
সাবরিনা আপুর কথাই বাদ বা যাবে কেন?
সেরা ব্লগ লিখিয়ে হওয়া নয় তো যেন-তেন!
আরও এমন নিযুত মানুষ একসাথে মিলে,
এই পৃথিবী আরও সুন্দর করছেন তিলে তিলে।
তাদের যদি অক্ষম বল, সক্ষম কোথা পাবে?
আমরা বলি সক্ষম সবাই হয়তো ভিন্নভাবে।
খোলাসা করিয়া বলি শোনেন সুধীজনে,
অনুভূতির কথাগুলি বলি আপনমনে।
ছোট্ট একটি মানবশিশু জন্মাইবার পরে,
কত অসহায় থাকে, কত কষ্ট করে।
তাই বলে কি অস্বাভাবিক বলি আমরা তাকে?
তার ভালো- মন্দের চিন্তা মাথায় সদা থাকে।
একটু করে হাঁটতে শেখাই, বলতে শেখাই কথা,
মমতাতে নজর রাখি, যেন না পায় ব্যথা।
অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ঠিক তাদেরই মতো,
ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষ আছেন সমাজে যত।
বোকা মানুষ তাদের ফেলে অস্বাভাবিক দলে,
কত তুচ্ছ করেই তাদের প্রতিবন্ধী বলে।
সর্বযুগে যারা ছিলেন সমাজের ভিতরে,
অস্বাভাবিক ভাবি আমি তাদের কী করে?
এখন সময় এসেছে...
তাদের কথাও ভাবতে হবে অন্য সবার সাথে
তাদের চিন্তা থাকবে সকল পরিকল্পনাতে।
ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষ চান সবসময়,
চারটি অধিকার যেন সদা নিশ্চিত রয়।
প্রথম হলো শিক্ষা, যেটা ছাড়া গতি নাই,
যোগ্যতার ভিত্তিতে তারপর কর্মসংস্থান চাই।
বাস-ট্রেন যাতায়াত হোক সহায়ক,
সর্বক্ষেত্রে প্রবেশের সুবিধা নিশ্চিত হোক।
অল্প কথায় চারটি কথা আবার ভেঙ্গে বলি,
শোনেন শোনেন সুধীজন, শোনেন সকলি।
অল্পমাত্রায় প্রতিবন্ধী মানুষ আছেন যারা,
অন্য সবার সাথেই শিক্ষা নিতে পারেন তারা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হলে সচেতন,
কতই না সহজ হতো শিক্ষা গ্রহণ।
হুইলচেয়ারে যেই শিশুটিই পড়তে যাক না কেন,
উপযোগী টয়লেটের ব্যবস্থা থাকে যেন।
দোতলা বা উঁচু স্কুলে লিফট যদি না থাকে,
কর্তৃপক্ষ যেন দুজন সাহায্যকারী রাখে।
সম্ভব না হলে তাকিয়ে সবার মঙ্গলপানে,
নীচতলাতেই শ্রেণীকক্ষ নামিয়ে যেন আনে।
দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী ছাত্র পড়বে নির্ভাবনায়,
তার জন্য শ্রুতি- লেখক যদি রাখা যায়।
বাসায় এসে ক্লাস যেন শোনে বারবার
তার জন্য থাকতে পারে টেপ রেকর্ডার।
বাক ও শ্রবন প্রতিবন্ধী ছাত্র আছে যারা,
ইশারাতে বুঝে বুঝে শিখতে পারে তারা।
তার জন্য চাই ইশারা ভাষার অনুবাদক
এই ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানগুলোয় নজর দেয়া হোক।
শিক্ষা পাবার পরেও নেই অবহেলার শেষ,
বেকারত্ব আর ঘোচে না, হায় অভাগা দেশ।
ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষ যোগ্যতার বিচারে
অনেক সাধারণ মানুষকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।
অফিসিয়াল কত কাজই করা যায় বসে,
যোগ্য কেন রবে বেকার শারীরিক বাধার দোষে?
যোগ্যতার অনুযায়ী কর্মসংস্থানে
ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষ পৌঁছাক সঠিক স্থানে।
সহায়ক যাতায়াতের কথা এবার বলি,
শোনেন শোনেন সুধীজন শোনেন সকলি।
আছেন যারা মানুষ- ভিন্নভাবে সক্ষম,
সহায়ক যাতায়াতের ব্যবস্থা খুব কম।
বাস- ট্রেন- গাড়ি- প্লেন সব জায়গাতে
তাদের চলাচলের কথা ভাববে গুরুত্বের সাথে।
ওঠা-নামা যেন হয় সহজে নিরাপদে,
বসতে যেন পারেন তারা;না পড়েন বিপদে।
আরেকটা বিষয় বলি নিত্য যে দুর্ভোগে
ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষ দুর্ভাবনায় ভোগে।
সর্বক্ষেত্রে প্রবেশ করার সুবিধাটা চাই,
নইলে শিশু, বৃদ্ধসহ ভুগবে যে সবাই।
স্কুল-কলেজ হাসপাতালে কিংবা জাদুঘরে,
সবাই যেন অনায়াসে প্রবেশ করতে পারে।
সিঁড়ির পাশে র্যাম্প থাক ঢুকতে গেলে ঘরে,
উপর তলায় উঠুক লিফটে আর এস্কেলেটরে।
সমাজ যদি এই অধিকার নিশ্চিত করতে জানে,
ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষ বাঁচবে সসম্মানে।
অনেককিছুই বলা হলেও হয় নি তো বলা
যেই ব্যথার বুকের ভেতর সদা বয়ে চলা।
হয়তো দরকার অধিকারের হয়তো বা সঙ্গীর,
সবার আগে বদল দরকার দৃষ্টিভঙ্গীর।
অন্যেরে যে তুচ্ছ করে, নিজে হয় না বড়,
শ্রদ্ধা চাইলে আগে অপরেরে শ্রদ্ধা কর।
বড় সেই হয় যে বা বড় ভাবতে জানে,
নিজেরে তুচ্ছ করিয়া অন্যে বড় মানে।
ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষ- শ্রদ্ধা তাদের তরে,
জীবন সংগ্রাম যান চালিয়ে কত বাধার পরে।
করুণা না চান তারা, চান অধিকার,
মানুষ দেবে বাড়িয়ে হাত সহযোগিতার।
সহযোগিতার কথা সবার বেলায়ই খাটে,
বলো তো, এই সমাজে কার একলা জীবন কাটে?
এই কথাগুলো ঢোকাতে সমাজের মাথায়
বি-স্ক্যানের জন্ম হলো ফেইসবুকের পাতায়।
সাবরিনা সুলতানা আর সালমা মাহবুব মিলে
গড়ে তুললেন এই প্রতিষ্ঠান ধীরে, তিলে তিলে।
বি-স্ক্যানের কার্যক্রম চলল জোরদার এগিয়ে,
চারখানা কর্মনীতি সঙ্গে করে নিয়ে।
প্রথম দরকার সবার মধ্যে সচেতনতা থাকা,
অধিকার সম্বন্ধে মনে পরিষ্কার ছবি আঁকা।
প্রতিবন্ধী মানুষের স্বার্থ হোক সুরক্ষিত,
স্বনির্ভরতার মন্ত্রে হোক তারা দীক্ষিত।
বি-স্ক্যানের এই পথচলা দেখায় আশার আলো।
এবার হবে অন্ধকার দূর, ভাবতে লাগে ভালো।
আস্তে আস্তে তৈরী হবে গণজাগরণ,
বদলে যাবে এই সমাজের চিন্তার ধরণ।
ভিন্নভাবে সক্ষম নাকি স্বাভাবিকভাবে,
এই ভেদাভেদও একদিন লুপ্ত হয়ে যাবে।
এই শুভ কামনাতে বিদায় জানাই,
(নিশ্চয়ই) সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই।
মন্তব্য
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ
আপা, আপনার সাথে আছি। আমি একজন উন্নয়নকর্মী, সাথে থাকতে পারার কথা বলতে পেরে ভালো লাগছে, আপনার সময়ও খুব করে ভালো কাটুক। শুভেচ্ছা,
চমৎকার। চমক হাসানের কাজ আসলে চমকপ্রদ।
শুভেচ্ছা রইল।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
facebook
আপনার প্রচেষ্টা অসাধারণ। আপনাদের মতো মানুষের খুব দরকার সমাজটার।
অটঃ 'ভিন্নভাবে সক্ষম' শব্দটা যথার্থ, মানবিক আর দারুণ লাগলো। কিন্তু ক্লিপটাতে দেখছি 'ডিজেইবল্ড' ই লেখা আছে।
_____________________
Give Her Freedom!
বেশ বেশ। এরকম বিষয়ের উপর লঘু ধাঁচের সৃষ্টির মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি করা উচিত।
চমক হাসানকে ধন্যবাদ বলে দেবেন দয়া করে। ভালো থাকবেন সবসময়। ইন্সটিটিউশন্সগুলো কথা বলে অনেক কিন্তু কাজ করে সামান্যই। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষকে সাধারণ মানুষের পাশেই থাকতে হবে।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
চমক হাসানের কবিতা চমকে দেবার মতোই
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
চমক ভাই আসলে সবসময়ই চমকে দেন!
খুব সুন্দর। চমক তো দেখি inclusive education এর কথাই বলে গেল!
মুহাহহা। চমক ভাই আমার তিনরুম পাশেই থাকতেন।
নতুন মন্তব্য করুন