এক আলো ঝলমলে গ্রীষ্মে গাড়ী নিয়ে ফিনল্যান্ড থেকে রওনা দিলাম জার্মানির উদ্দেশ্যে। ইচ্ছা ছিল যতখানি সম্ভব ঘুরে দেখব বিশাল জার্মানির যতটা সম্ভব- বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত, গাঢ় সবুজ উপত্যকা, অট্টালিকাময় শহর, দুর-দূরান্তে ছড়িয়ে থাকা কোলাহল মুখর জনপদ, নদী বিধৌত অববাহিকা, গহীন বন, তুষার ঢাকা পর্বত, বন্দর নগরী, পথ চলতে হঠাৎ পেয়ে যাওয়া নির্জন নিরিবিলি গ্রামগুলি- যাই আসুক না আমাদের যাত্রাপথে। সঙ্গী অপু, মুরাদ, সিপু ভাই ও সিপু ভাইয়ের গাড়ী।
এমনভাবে পথিমধ্যে আমাদের গন্তব্য বন। সাবেক পশ্চিম জার্মানির রাজধানী ক্ষুদে শহর বন, ইতিহাস খ্যাত নদী রাইনের পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা। শৈশবে যখন বনে নাম শুনেছিলাম, শিশুমনের কল্পনায় ভেসে উঠত গাছ-গাছালি ছাওয়া কোন জঙ্গুলে জায়গার কথা, তখনতো আর জানা ছিল না এই শহরের নামে বানান হবে BONN, এর সাথে আমাদের বাংলা বন-জঙ্গলের কোন সম্পর্কই যে নেই !
বন সম্পর্কে এত উৎসাহের অন্যতম প্রধান কারণ- সৈয়দ মুজতবা আলী। কিংবদন্তীর এই পর্যটক লেখকের জীবনের এক উল্লেখযোগ্য অংশ কেটেছে এই শহরে, তার অতুলনীয় ক্ষুরধার লেখনীর আদি ও অকৃত্রিম ভক্ত হবার কারণে বনের কোন রাস্তায় সৈয়দ মুজতবা আলী প্রতিদিন চলাচল করতেন, কোন ক্যাফেতে আড্ডা দিতেন, রাইনের তীরে কোন গাছের ছায়ায় বসে সাহিত্য চিন্তায় মগ্ন থাকতেন- সবই তার রসময় লেখা বারংবার পড়ে মোটামুটি জানা হয়ে গিয়েছিল। তার স্বচ্ছ লেখনীর জলবতী ধারা অনায়াসে চোখের সামনে তৈরি করত সেই অদেখা শহরের পথঘাট, রাস্তা, গলি, উপগলি, ভালবেসে ফেলেছিলাম সেখানকার সবকিছুকেই আর প্রতিটি অধিবাসীকে।
তবে বন সম্পর্কে আগ্রহের সত্যিকারের মূল কারণ, সুর সম্রাট বিটোভেন। বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে কেবল মাত্র মোজার্টের সাথে যার তুলনা চলে, সেই ল্যুদভিগ ফন বিটোভেন জন্ম নিয়েছিলেন এই শহরে, এইখানেই অতিবাহিত হয়েছে তার শৈশব, এখানকার জল, বাতাস, সজীব প্রকৃতিতেই অমরত্বের পথে এগিয়েছেন এই মহান শিল্পী। তিনি যে বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যে ঘরে বিশ্বের সমস্ত সুরঝঙ্কার নিয়ে তার প্রথম আগমন, তা এখনও সেই একইভাবে রাখা আছে।
দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে জাদুঘরে পরিণত করা হয়েছে সেই বাড়ীকে, যা আজ সমগ্র পৃথিবীর শত কোটি সুর, সঙ্গীত আর বিটোভেন ভক্তদের কাছে তীর্থ স্থানে পরিণত হয়েছে। সেই তীর্থ যাত্রার কথাই বলব আজ আপনাদের—
বিটোভেন সম্পর্কে দুই লাইন—
১৭৭০ সালে বনের এই বাড়ীতে বিটোভেনের জন্ম, তার বাবা জোহানও ছিলেন একজন সুরকার। অতি ছোট বেলা থেকেই তার মাঝে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তার তুলনাহীন প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটতে থাকে। তরুণ বয়সে বিটোভেন তখনকার সময়ে সুরকারদের মক্কা খ্যাত ভিয়েনায় বসবাস শুরু করেন, যেখানে তার পেশাদার সঙ্গীত জীবনের শুরু। অত্যন্ত দুঃখজনক ভাবে মাত্র ২৬ বছর বয়সে তার কান ও অন্যান্য শ্রবণ যন্ত্রে জটিল রকমের সমস্যা দেখা দেয় যা তাকে ধীরে ধীরে বধিরতার দিকে নিয়ে যায়। ১৮১৪ সালে নিয়তির অবশ্যম্ভাবী পরিহাসে বিটোভেন শ্রবণ ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে লোপ পায়, কিন্তু প্রকৃতির বিস্ময় এই মহান সুরকারের শুদ্ধ সঙ্গীতের সাধনা থেমে যায় নি তাতে, সেই মান্ধাতার আমলে কানে দেবার কিছু চোঙ জাতীয় যন্ত্রের সাহায্যে তার নিরন্তর শিল্প সৃষ্টির মাধ্যমে অমরত্বের পথে যাত্রা অব্যাহত থাকে।
সত্যিকারের সঙ্গীত প্রতিভা বলতে কি বোঝায় তা বিটোভেন সৃষ্ট সঙ্গীত শুনলে বোঝা যায়, এজন্য আপনার কোন সমঝদার বা তাল-লয় বিশেষজ্ঞ হবার প্রয়োজন নেই, শুধু মনের মাঝে একটু কোমল অনুভূতি, জীবনের প্রতি একটু ভালবাসা, সুন্দরের প্রতি সামান্য আগ্রহ- ব্যস! বিটোভেনের এই অমর সৃষ্টিগুলো আপনার সামনে এক অদেখা ভুবনের পর্দা উম্মোচন করবে, যা একঘেয়ে জীবনের হিংসা, ক্লেদ, ক্লান্তি থেকে শ্রোতাদের একনিমিষে নিয়ে যাবে অন্য এক স্বর্গীয় জীবনে, যেখানে শুধুই সুর, ছন্দ আর সুন্দরের বসবাস।
প্রবল বিস্ময়বোধে আক্রান্ত হতে হয়, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিশ্বের শত কোটি মানুষকে সুরমূর্ছনার ইন্দ্রজালে আচ্ছন্ন করে রাখা এই সুরকার তার নিজের অনেক অমর সৃষ্টিই কোন দিন নিজ কানে শুনতে পারেন নি, তার অন্যতম সেরা সৃষ্টি ৭ম আর ৯ম সিম্ফনি প্রায় বধির অবস্থায় রচিত, যা একই সাথে তার প্রতি শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত করে দেয় আর প্রকৃতির খাম-খেয়ালিতে পর্যুদস্ত এই প্রতিভার জীবন আর সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা আমাদের অপার মুগ্ধতায় ভরিয়ে তোলে। ১৮২৭ সালে ভিয়েনায় এই সুর সম্রাটের জীবনাবসান ঘটে।
বিটোভেনের বাড়ীতে-
অবশেষে রাইন পেরিয়ে বন অল্পক্ষণ ঘুরে সোজা চলে গেলাম বিটোভেনের বাড়ীতে। ভবনের প্রধান দরজায় জার্মান ভাষায় তার নাম লেখা।
অত্যন্ত যত্ন নিয়ে সংরক্ষিত প্রতিটি কক্ষ, জাদুঘরের টিকিটে কেটে সেই অদ্বিতীয় সংগ্রহশালার বিভিন্ন ঘর ঘুরতে ঘুরতে চলে গেলাম উপর তলায়, যেখানে তার জন্মস্থান।
যে ছোট্ট ঘরটিতে বিশ্বনন্দিত সুরকার জন্মে ছিলেন সেখানে অজানা কোন কারণে ছবি তোলা নিষেধ, কেন তা বোধগম্য হল না, কিন্তু ঘরটির দরজা খোলা বিধায় দর্শনার্থীরা মনের আশ মিটিয়ে সুরসম্রাটের জন্মস্থানটি অন্তত অবলোকন করতে পারেন।
কাঠের সেই কামরাটিতে উঁকি দেবার সাথে সাথেই সারা শরীর রোমাঞ্চে কাটা দিয়ে উঠল, শুধুমাত্র স্থাণুর মত দাড়িয়ে রইলাম মাত্র, একবার মনে হল সংজ্ঞা লোপ পেতে যাচ্ছে হয়ত আমার, পাশেই দাঁড়ানো বন্ধুদের কোন কথাই কানে প্রবেশ করছে না, মাথায় শুধুই লক্ষ হাজারবার শোনা বিটোভেনের ৫ম, ৭ম আর ৯ম সিম্ফনি ঘুরে ঘুরে আসছে। অবাক হয়ে ভাবছি, এই ঘরেই সেই শিশুটির জন্ম- প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্রই কান্নাভরা চিৎকারে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়েছিল যে, বার্তা পৌঁছেছিল আমি এসেছি! বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মত কালের করাল গর্ভে হারিয়ে যেতে নয়, মাথা উঁচু করে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে থাকতে। অনেকেই বিশ্বাস করে থাকেন, শব্দ হারিয়ে যায় না, কোন না কোন ভাবে প্রকৃতির মাঝে টিকে থাকে, ভবিষ্যতে যদি সে রকম যন্ত্র আবিষ্কার করা যায় তাহলে অতীতের সমস্ত কথাই হয়ত শোনা যাবে! বিশ্বাস হয় না, তারপরও মনে হচ্ছিল, ইস্ যদি এই মহান শিল্পীর জন্মক্ষণটিতে যাওয়া জেত, শোনা যেত তার প্রথম উচ্চারিত কণ্ঠ! অবশেষে সঙ্গীদের ডাকে সম্বিত ফিরল।
বিটোভেনের লেখা প্রায় ৫০০ চিঠির অমুল্য সংগ্রহ আছে এইখানে, আজীবন অকৃতদার এই অতি বিখ্যাতের চিঠি নিয়ে আজও দস্তুরমত গবেষণা চলে, নিষ্ঠাবান গবেষকদের আসা যদি কোন অজানা তথ্য বেরিয়ে পরে, হয়ত গোপন কোন রোমান্স(বিটোভেনের অজানা অথচ কল্পিত প্রেম নিয়ে একাধিক কাহিনী সেলুলয়েডের ফিতেয় স্থান নিয়েছে)।
সুরকারের সংগ্রহিত সমস্ত স্বরলিপি সুন্দর ভাবে সংরক্ষিত, সৃষ্টিশীল মনের অন্যতম পরিচায়ক অসংখ্য স্কেচও আছে সেই খানে, আর আছে বিটোভেন রচিত সমস্ত সঙ্গীত। দর্শকরা যে কেউ চাইলেই অডিও সেকশনে যেয়ে হারিয়ে যেতে পারবেন সেই অপার্থিব সুর মূর্ছনায়।
তার ব্যবহৃত শ্রবণে সহায়ক সেই যন্ত্রগুলো রাখা আছে পরম মমতায়, বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা তার পোট্রেট। আছে চেল্লো, বেহালা, পিয়ানসহ নানা বাদ্যযন্ত্র। অবশেষে মন্ত্রমুগ্ধ মানুষের মত মাথার উপরে নীল আকাশ জোড়া রোদ নিয়ে বিটোভেনের বাড়ীর আঙ্গিনায় আমরা সবাই, সেখানে একচিলতে বাগান, গোলাপের সমারোহ, এক কোণে শিল্পীর আবক্ষ ভাস্কর্য।
বন ছাড়ার আগে গেলাম বিটোভেন হাউসের অদূরেই এক সবুজ মাঠে, যার মাঝে তার মুখমণ্ডলের এক বিশালাকার অসাধারণ ভাস্কর্য, সম্পূর্ণটাই ধাতব পদার্থে তৈরি। একরাশ এলোমেলো চুল, চিরচেনা মুখভঙ্গী আর চোখের কোণে এক অজানা বিষণ্ণ ক্ষ্যাপা দৃষ্টি, যার মানে আজ পর্যন্ত আমরা কেউ-ই জানতে পারি নি।।
মন্তব্য
Nice writing
ধন্যবাদ !
facebook
কিছুদিন পর লোকে বিখ্যাত পর্যটক তারেক অণু'র বাড়ীই প্রদর্শনে আসবে।
আরে না ধৈবত দা, আইন্নের হিসাবে বিশাল গলদ, গোটা বিশ্বই আমার বাড়ী---
facebook
বাড়ীর ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ নাকি?
তাই তো মনে হল! ফাজলামোর একশেষ, কি হয় ছবি তুললে !!! হাঙ্গেরিতে দেখেছিলাম ছবি তুলতে চাইলে অল্প কিছু টাকা বেশি দিতে হয়, সেটা অনেক ভাল ব্যবস্থা। আর বিশ্বের প্রায় সব সেরা জাদুঘরগুলোতেই ছবি তুলতে দেয়, বাংলাদেশ অবশ্য বিশাল ব্যতিক্রম, তেলাপোকার মল পড়ে থাকলেও বলবে ছবি তোলা যাবে না, বলে ছবি দেখে যদি বিদেশীরা পাচার করে নিয়ে যায়!
facebook
ছবি না তুলতে দেয়াটা একটা অনাচারই বটে। আর আপনি তা তুলতে না পারায় এবার আমরাও তার ভুক্তভোগী হলাম।
আপনাকে হিংসে করে যদি একটু তৃপ্তি পাই...
------------------------------------
সময় এসেছে চল ধরি মোরা হাল,
শক্ত কৃপাণে তুলি বরাহের ছাল।
আরে বিপ্লবীদের হিংসা থাকতে নেই !!
facebook
facebook
চমৎকার
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
facebook
facebook
_____________________
Give Her Freedom!
facebook
ভাস্কর্যে বিটোভেনের ক্ষ্যাপাটে দৃষ্টিটা জটিল লাগলো।
লেখা মারাত্মক হয়েছে, অণু ভাই। আপনার লেখার প্রশংসা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। একটা খারাপ লেখা দিন না রে ভাই!
থ্যাঙ্কু, থ্যাঙ্কু, আমাদের বঙ্গ সমাজে খাঁটি প্রশংসা বড়ই দুর্লভ জিনিস ভাই, পাচ্ছি যখন একটু আকটু - চলুক না ! হে হে, মস্কো থেকে শুভেচ্ছা
facebook
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
facebook
facebook
দে নাদা, দাদা
facebook
লেখাটি পড়ে বেশ ভাল লাগলো।
অনেক ধন্যবাদ। জেনে ভাল লাগল
facebook
হেহে, আপনার লেখার ব্যাকলগ ক্লিয়ার করছি। আমি বন গেছি, বাড়িখানা দেখেছি, ভাস্কর্যও দেখেছি, কিন্তু মিউজিয়াম বন্ধ ছিল ঐদিন তাই ঢুকতে পারিনি
যেই সুর শুনে অজানা কারণে চোখে পানি চলে আসে গলায় কিছু আটকে আছে মনে হয় সেই সুর সম্রাটের বাড়ি ঘুরে দেখে আমাদের জানানোর জন্য কৃতজ্ঞতা। ভাস্কর্যটা আগে দেখা হয় নি। সুন্দর ছিল তো!
--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি
খুব ভালো লাগলো! এর পর য়োহান সেবাসটিয়ান বাখ - নিয়ে লেখা পাবো আশা করি!
নতুন মন্তব্য করুন