১.
একজন অসুস্থ রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম। চট্টগ্রামের মেডিক্যাল সেন্টার। রোগীর জ্বর বেশী, গলায় কফ জমে গেছে, গায়ে লাল র্যাশ উঠে গেছে। ক্লিনিকে নেবার পর তাকে সরাসরি HDU নামক অতি যত্নশীল একটা চেম্বারে ঢুকিয়ে দরোজা বন্ধ করে দিল। ওখানে কারো ঢোকা নিষেধ। একদিন পর রোগ আরো বেড়ে যায়। এরপর একের পর এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আসে, বোর্ড বসে, নতুন ওষুধ দেয়, তিনদিন এই অবস্থা চলার পর রোগীর শেষ নিঃশ্বাসটা যখন বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে তখন রোগীকে একটা আইসিইউ এম্বুলেন্সে করে সোজা ঢাকার একটা বড় হাসপাতালে নেয়া হয় রাতের মধ্যে। প্রায় শেষ অবস্থায় পৌঁছে যাওয়া রোগী জীবন ফিরে পায় আবার।
এবং অতপরঃ কোন উপকারে না এসেও মেডিক্যাল সেন্টার তিন দিনে ষাট হাজার টাকা বিল করেছিল রোগীকে সফলতার সাথে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেবার মূল্যস্বরূপ।
২.
প্রতিবেশী বাড়ির নির্মাণ কাজ করছেন। ভদ্রমহিলার স্বামী মারা গেছে বছর দুয়েক আগে। এখন তার শেষ সঞ্চয়টুকু দিয়ে বাড়ীর কাজে হাত দিয়েছেন। কাজ শুরু করার কদিন পর স্থানীয় কিছু মাস্তান এসে চাঁদা দাবী করলো। এত টাকা দিতে পারবে না বলায় বাড়ীর কাজ বন্ধ করে দিল মাস্তানরা। ভদ্রমহিলা পুলিশে খরব দিলেন। থানা থেকে এস আই এসে এদিক সেদিক ঘুরে মাস্তানদের সাথে কথা বলে বিকেলে এসে জানালো তাকে দশ হাজার টাকা দিলে ব্যাপারটা রফা করে দিতে পারে। ভদ্রমহিলা রাজী হলেন না। এটাও তো চাঁদা। এই চাঁদা বরং মাস্তানদের দিলে ওরা উৎপাত করবে না ভবিষ্যতে। পুলিশকে 'না' বলার ফলস্বরূপ পরদিন পুলিশ আসলো ওনাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যেতে। কারণ তিনি মাস্তান-চক্রকে ধরার জন্য পুলিশকে সহযোগিতা করেননি, উল্টো অসৌজন্যমূলক ব্যবহার করেছেন। বহুকষ্টে তিনি পুলিশ মাস্তান দুপক্ষকে চাঁদা দিয়ে রক্ষা পেলেন হয়রানি থেকে।
এবং অতপরঃ সন্ত্রাসীরা চাঁদা চেয়েছিল ২০ হাজার। পুলিশে খবর দেয়ার বেয়াদবির মাসুলসহ দিতে হলো ৪০ হাজার, আর ব্যাপারটা সুন্দর করে মিটমাটের জন্য পুলিশকে দিতে হলো ১০ হাজার।
৩.
সরকার পরিবর্তনের পরদিন নতুন ক্ষমতাসীন দলের লোকজন সদলবলে অফিসে ঢুকে অভিবাদন জানিয়ে বললো 'সাপ্লাই নিয়ে ভাবনা, আর না আর না'। এখন থেকে সব রকম সাপ্লাই ওরাই দেবে দেবে। আগের সাপ্লায়ার বাদ। অনেকদিন খাইছে ওরা। 'কোটেশন দেন আগামী বছর নতুন টেন্ডার হবে' জানানো হলে, বলা হলো কোটেশন লাগবে না, আমাদের চেহারাই কোটেশন। প্রতিকারের জন্য স্থানীয় সরকার দলীয় সাংসদের বাসায় ধর্না দিতেই, আড়মোড়া ভেঙ্গে তিনি বললেন, 'দলের ছেলেরা গত পাঁচ বছর অনেক নির্যাতন সহ্য করেছে এবার ওদের কিছু করে খেতে দেন। নইলে কখন কি করে বসে, বুভুক্ষু লোকের জন্য আইন নাই। বোঝেনই তো।'
এবং অতপরঃ ঘাড়ে দুটো মাথা নেই বলে আগের দলকে বাদ দিয়ে নতুন দলকে কাজ দেয়া হলো। আগের দলকে বিদায় করার ফলস্বরূপ বিদায়-বাণী আসে, "বাসায় বউ বাচ্চার খবর নিছেন তো?"
৪.
ব্যবসায়ী বন্ধুর ১১ লাখ টাকা মেরে দিয়েছে প্রভাবশালী পার্টনার সাবেক কাস্টমস ডেপুটি কর্তা। বন্ধু আদালতে গেল। ক্ষতিপূরণ মামলা করলো। উকিল নিয়োগ করলো। মামলা শুরু হলো। আদালত পুলিশকে হুকুম করলো তদন্তের। বন্ধু থানায় গিয়ে দেখলো ভাগ্যের বৃহস্পতি তুঙ্গে। থানার পুলিশের কর্তা ক্লাসমেট। বললো, দোস্ত চিন্তা নাই। আমি এই সপ্তাহেই সার্চ করতে যাবো, তুই কদিন পরে খোঁজ নিয়ে যাস। পরের সপ্তাহে থানায় গিয়ে দেখে আসামী ওসির পাশের চেয়ারে বসে খোশগল্প করছে, চা খাচ্ছে। দোস্তকে দেখে বন্ধু পুলিশ এগিয়ে এসে আড়ালে নিয়ে গেল ওকে। কানে কানে ফিসফিস করে বললো, এরা অনেক প্রভাবশালী, এদের সাথে ভেজাল করে কাজ নেই। তাছাড়া তোর মামলার ভিত্তি নাই। তুই কিছু টাকা নিয়ে আপোষ করে ফেল। নইলে কখন তোকে রাস্তাঘাটে কিছু করে ফেলবে, এর এক ছেলে আবার খুনের মামলার আসামী। বন্ধু পুলিশ দোস্তের চোখে চোখ রেখে তাজ্জব বনে যায়। এই চোখ সেদিনের চোখ নয়।
এবং অতপরঃ কদিন পর জানা গেছে, থানাকে এক লাখ টাকা দিয়ে রিপোর্ট উল্টিয়ে দিয়েছে সাবেক সরকারী কর্তা।
৫.
আমার বন্ধুটা নাছোড়। প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে সে আরো উপরের দিকে গেল সূত্র ধরে ধরে, র্যাব, আর্মি যেখানে যা পরিচয় আছে সব কাজে লাগিয়ে রিপোর্টের একটা গতি করলো। কিন্তু মামলার নির্ধারিত তারিখে আদালতে হাজির হলে উকিল তাকে এক পাশে নিয়ে ফিসফিস করে বললো, ঝামেলা না করে আপোষ করে ফেলেন। এই মামলা টিকবে না। ওরা অনেক শক্তিশালী। শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে একটা বুদ্ধি দিলাম। উকিলের চোখে সেদিনকার পুলিশ দোস্তের ছায়া দেখতে পেয়ে চমকে গেল বন্ধু। পুলিশ আর উকিল একই সুরে কথা বলছে কেন?
এবং অতপরঃ বিশ হাজার টাকা দিয়ে উকিলকে কিনে নিয়েছিল বিপক্ষ দল। পরের তারিখ থেকে বাদীর উকিল আসামী পক্ষে কোর্টে দাঁড়ানো শুরু করলো।
............................................................................................................
[সিরিজ নয়, তবু আরো স্থানীয় অভিজ্ঞতা আসতে পারে ভবিষ্যতে।]
শিরোনাম কৃতজ্ঞতাঃ সত্যজিৎ রায়
মন্তব্য
যাদের ঘটনা বল্লেন তাদের নাম/ধাম প্রকাশ করা যায়না?
ঘটনাগুলো সাম্প্রতিক থেকে কয়েক বছর আগের। তাই সবার নাম মনে নেই।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
এইসব অনিয়মই নিয়ম হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। জানিনা কবে এর থেকে পরিত্রাণ মেলে।
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
এই না হলে আমাদের দেশ? ... বেশ বেশ!
চারপাশে এইই ঘটে!!! নির্মম বাস্তবতা!!!
_____________________
Give Her Freedom!
জনাব সাফি, আপনি নাম/ধাম জানতে চেয়েছেন। এ ধরনের ঘটনাতো অহরহই ঘটছে। কত নাম চা? আমি অনেক বলতে পারি, কিন্তু বলা যাবেনা আক্কেল সেলামীর ভয়ে।
মন্তব্য লিখেছি : প্রৌঢ়ভাবনা
ও ভাইরে, কত রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়--
facebook
সত্যিই, কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়!
(প্রথম পাতার প্রিভিউয়ে ১ ছাড়া আর কিছুই আসছে না। এডিট করে বদলে দিলে ভাল হয়।)
এমন আরো কতো ঘটনা যে চোখের আড়ালে থেকে যায়... যারা ভুক্তভোগী শুধু তারাই জানে...
মনটা খুব খারাপ, তারেক মাসুদ নেই! এর মাঝে একটু ভালো লাগার জন্য হীরক রাজার দেশে নাম দেখে পড়তে এলাম। কোথায় গেলে বুকভরে শ্বাস নেয়া যাবে বলতে পারেন কি ভাই নীড়সন্ধানী!
চলুক।
এসব ঘটনা এত পরিচিত যে অস্বাভাবিকও লাগে না আর
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
বেশ ক'বছর আগে একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়তে এক ছাত্র দুর্ঘটনায় পড়ে ইয়ারলী ভাইভা দিতে পারে না। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম হলো রেজাল্ট প্রকাশ হবার আগে ভাইভা দিতে না পারলে ওই ইয়ারকে সম্পূর্ণ ফেল হিসেবে দেখানো হবে অথবা, সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্ট ছাত্র হতে ২,৫০০/- জমা দিয়ে ভাইভা পরীক্ষা পুনরায় নিবে। তো, আমার সেই বন্ধু যথারীতি দুর্ঘটনার কয়েকদিন পর যেয়ে নিজ খরচে ভাইভা পরীক্ষা দিতে চায় এই মর্মে ডিপার্টমেন্ট বরাবর দরখাস্ত করে। এরপর থেকে শুরু হয় সেই বন্ধুর দৌড়......দরখাস্তটিতে কোন মতেই ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান-পরীক্ষা কমিটির সভাপতি অনুমতি দিতে রাজী হয় না; নানান অজুহাত দেখাতে থাকে। পরবর্তীতে, ডিপার্টমেন্টের প্রধান অফিস সহকারী মারফত ৪০,০০০/- ঘুষ দিতে হয়। আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল সেই বন্ধুটি অনেক কষ্ট করে টাকা জোগাড় করেছিল। সেই ৪০,০০০/- ভাগ হয় তিনজনের মাঝে-ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান, পরীক্ষা কমিটির সভাপতি ও প্রধান অফিস সহকারীর মাঝে।
এই হলো আমাদের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থা!!!
আমাদের দেশের অবস্থা একটি প্রবাদ বাক্য দিয়েই বুঝানো যায়-
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
হ
------------------------------------
সময় এসেছে চল ধরি মোরা হাল,
শক্ত কৃপাণে তুলি বরাহের ছাল।
ক্রমাগত হতাশ হয়ে যাচ্ছি। আর ভাল্লাগেনা...
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
চারদিকে এই ই চলে...।
এটা হচ্ছে এমন বিচিত্র দেশ যেখানে অনিয়মই নিয়ম। আমরা এমন একদেশে বাস করি যেখানে পুলিশ জনসাধারণের বন্ধু নয় হত্যাকারী, আইন-শৃঙ্খলা যেখানে কাগুজে বুলি, সড়ক যেখানে আতঙ্ক, জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত সাংসদরা হলো জোকার.........
হতাশ, ক্ষুব্ধ।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
সোজা পথ পড়ে পায়ে সোজা পথে কেউ চলেনা, বাঁকা পথ জ্যাম হরদম জমজমাট ভীড় কমেনা....
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
রঙ ভরা বঙ্গ দেশ
ইসরাত
নতুন মন্তব্য করুন