তারেক মাসুদ। চলচিত্র নির্মাতা। অথচ তাঁর কোন কমার্শিয়াল ফিল্ম নেই। চাইলেই তিনি বানাতে পারতেন। সুখ্যাতি ছিল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। তাঁর অধিকাংশ ছবির প্রযোজক ছিলেন তাঁরই স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ। সুযোগ, যশ এবং খ্যাতিকে ব্যবহার করে কড়ি কড়ি টাকা আয় করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। এক অন্য রকম মানুষ ছিলেন এই তারেক মাসুদ। আজীবন তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল বিকল্প ধারার স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচিত্র বানানো। পূর্ব বাংলায় যদি আজ পর্যন্ত কারো মাঝে সত্যজিৎ-এর ছায়া দেখা গিয়ে থাকে, সেটা অবশ্যই তারেক মাসুদ। অত্যন্ত বেদনার্ত হৃদয়ে সেই মানুষটাকে নিয়ে লিখতে বসে সবগুলো “কাল” অতীতে ব্যবহার করতে হচ্ছে। কারণ আজ মানুষটাই অতীত।
মাটির ময়না বানানোর আগেই তাঁর নাম শুনেছিলাম। কিন্তু তিনি পরিচিতির চূড়ায় পৌঁছেন এই চলচিত্রের মাধ্যমে। কান চলচিত্র উৎসবে যখন মাটির ময়না প্রদর্শনীর জন্যে মনোনীত হয় সেটাই ছিল আমাদের চলচিত্র জগতের জন্যে অনেক বড় একটা সংবাদ। যারা চলচিত্র সম্পর্কে সাধারণ খোঁজ খবর রাখেন, তারা জানেন যে “কান ফিল্ম ফেসটিভেল” হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ফেসটিভেল। কান-এর এ্যাওয়ার্ড অস্কার, গোল্ডেন গ্লোব বা বাফটার থেকে অনেক বেশী মর্যাদাপূর্ণ। সেই চলচিত্র উৎসবে বিশ্বের সেরা চলচিত্রের সাথে প্রতিযোগিতায় নামার আগেও দিয়ে আসতে হয় কঠিন পরীক্ষা। সেই পরীক্ষা অতিক্রম করে এবং প্রতিযোগিতা করে যখন তারেক মাসুদ ছিনিয়ে আনলেন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্রিটিক্স এ্যাওয়ার্ড, সেটা আমাদের জন্যে হয়ে দাঁড়াল এক বিরল অর্জন, এক অভাবনীয় সম্মান। পরবর্তীতে মাটির ময়না বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ভিনদেশী ভাষার ছবি হিসেবে অস্কারের জন্যে পাঠানো হয়।
আমার জীবনের অন্যমত বৃহৎ বিস্ময়গুলোর একটির মুখোমুখি হলাম আমি এরপরই। দেশের জন্যে এত সুনাম এবং সম্মান বয়ে আনা চলচিত্রটি বাংলাদেশে “নিষিদ্ধ” হয়ে রইলো। কারণ এর গল্পে রয়েছে তথাকথিত “স্পর্শকাতর” বিষয়বস্তু! কেটে যেতে থাকে সময়। মাটির ময়না আমার আর দেখ হয় না। বেশ কয়েক বছর পর একদিন টিভির পর্দায় একটা চলচিত্র দেখে আমি থমকে দাঁড়াই। একদম শুরু থেকে না দেখায় নামটা জানতাম না। যত দেখছিলাম, ততই আমি গোগ্রাসে গিলছিলাম। ক্যামেরার যাদু কাকে বলে এবং কত প্রকার – তারই প্রদর্শনী চলছিল। মুগ্ধ এবং বাকরুদ্ধ হয়ে আমি দেখছিলাম আর বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম এটা কোন চলচিত্র? খানিক পর বিজ্ঞাপন বিরতীতে যাওয়ার সময় নাম দেখলাম – মাটির ময়না। সেই শুরু। আমি তারেক মাসুদের ভক্ত হয়ে গেলাম সারা জীবনের জন্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় কার্নেগী মেলন-এর কম্পিউটার বিজ্ঞানের অকালে ঝরে যাওয়া অধ্যাপক র্যান্ডি পাউশ তাঁর “দ্যা লাস্ট লেকচার”-এ বলেছিলেন, মৃত্যুর আগে তুমি তোমার শৈশবের স্বপ্নগুলোকে পূর্ণ করো। কথাটা অভাবনীয় ভাবে আমার মনের গভীরে রাখা চিন্তার সাথে মিলে যায়। আমার শৈশবের স্বপ্ন তিনটি, এক. পিহেইচডি করবো, দুই. এমন কিছু উপন্যাস লিখবো যা মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেবে অনেক দিনের জন্যে এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি চলচিত্র বানাবো। শেষের স্বপ্নটা এই তিন স্বপ্নের মধ্যে সবচেয়ে বড়। যারা আমাকে ছোটবেলা থেকে চেনে, তারা জানে আমি সব সময় বলি আমি বড় হলে চলচিত্র নির্মাতা হবো। আমার বন্ধুদের “জীবনের আদর্শ” কে এই প্রশ্ন করা হলে কেউ বলতো মহানবী (সঃ), কেউ বলতো বঙ্গবন্ধু অথবা কেউ বলতো বাবা/মা। কিন্তু আমি সব সময় বলতাম এবং এখনও বলি “সত্যজিৎ রায়”। আমাদের ঢাকা বাসায় আমার ঘরে ঠিক খাটের সামনে সত্যজিৎ রায়ের একটা ছবি টাঙ্গানো রয়েছে। আমি প্রতিদিন সেখানে তাকাতাম এবং অফসোস করতাম। গুরুকে ভালো করে বোঝার আগেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। যে আমার আদর্শ তার সাথে দেখা হবার কোন সুযোগ তিনি রাখেন নি। কিন্তু যখন মাটির ময়না দেখলাম এবং এর পর একে একে তারেক মাসুদকে বিভিন্ন সৃষ্টির মাধ্যমে জানতে শুরু করলাম, তখন মনেমনে বলতাম গুরুকে কোন দিন দেখার সুযোগ হয় নি, কিন্তু হয়তো গুরুই এবার এপার বাংলায় এসেছেন। একদিন তাঁর (তারেক মাসুদ) সাথে দেখা করতেই হবে।
এই তো কয়েকদিন আগের ঘটনা। আমার ভালোবাসার মানুষকে স্কাইপে গল্প করতে করতে মজা করে বলছিলাম আমি চলচিত্র বানাবো এবং সে হবে আমার প্রযোজক। অনেকটা ক্যাথরিন মাসুদ এবং তারেক মাসুদের মত। স্পষ্ট মনে আছে, গত পরশুদিন ট্রাম লাইনের পাশে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তাদের কথা ভাবতে শুরু করলাম। ভাবছিলাম, তাদের পরিচয় হয়েছিল কী করে? সেখান থেকে কী করে প্রণয় এবং পরিণয়? সত্য বলতে কী, আমার অজান্তেই এই যুগল আমার কাছে একটা স্বপ্নের যুগল হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুদের সাথে কথা বলতে গেলে আমার কথায় মাঝে মাঝেই তাঁরা চলে আসেন। তারেক মাসুদকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি না। শুধু তাঁর সৃষ্টি দেখেছি। আর মনেমনে বলেছি একদিন না একদিন আমি তাঁর সাথে দেখা করবো। সময় চলে যায় নি। এখনোতো তরুণই তিনি।
তারেক মাসুদ তার স্বপ্নের চলচিত্র বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এত বড় ব্যাপ্তিতে বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত কোন চলচিত্র নির্মিত হয় নি। ৪৭-এর দেশভাগ, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গনঅভ্যুত্থান এবং ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি “কাগজের ফুল”। সেজন্যে ভোরে ভোরে লোকেশন দেখতে গিয়েছিলেন ঢাকার অদূরে। ঘণ্টাখানেক সেখানে থেকে ফেরার পথে মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় সব শেষ। তারেক মাসুদ, কাগজের ফুল – সব, সব শেষ।
তারেক মাসুদ, আপনি এটা কী করলেন? আপনার সাথে দেখা করার জন্যে অনেক অনেক স্বপ্ন নিয়ে অপেক্ষা করছিল এক তরুণ। একটাবার, শুধু একটাবার আপনার সাথে দেখা করার সুযোগ খুঁজছিল সে। এপার বাংলার সত্যজিৎ বলে সে আপনাকেই মনে করতো। অথচ আপনি তাকে এবং অন্য সবাইকে ফাঁকি দিয়ে অকালে চলে গেলেন? খুব কষ্ট হচ্ছে, খুব। বারবার মন বলছে, কেন এমন হয়? কেন, কেন, কেন?
তারেক মাসুদের সাথে দেখা হবার যে স্বপ্ন, তা আর কোন দিন পূরণ হবে না।
মন্তব্য
-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...
বিনম্র শ্রদ্ধা।
__________♣♣♣_________
না-দেখা দৃশ্যের ভেতর সবই সুন্দর!
কিছু বলতে পারছিনা, মনটা অসম্ভব খারাপ হয়ে আছে।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
।ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।
love the life you live. live the life you love.
আর কতো?
ইদানীং পৃথিবী অনুভব করে, একটা সূর্যে চলছেনা আর
এতো পাপ, অন্ধকার
ডজনখানেক সূর্য দরকার।
_____________________
Give Her Freedom!
বাংলাদেশের যে কি অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল ... আমরা হয়ত সুদূর ভবিষ্যতে ও আরেকজন তারেক মাসুদ পাব না । তার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ।
বিনম্র শ্রদ্ধা
বিনম্র শ্রদ্ধা।
ভাষাহীন।
বিনম্র শ্রদ্ধা।
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
তারেক মাসুদ,মিশুক মুনীর...তাঁরা হয়তো চলে গেছেন না ফেরার দেশে।আমরা তাঁদের হাসিমাখা মুখ,স্বপ্ন ভরা চোখ আর কোনদিন হয়তো দেখতে পারবোনা...কিন্তু এই দেশ কে নিয়ে তাঁরা যে স্বপ্ন দেখতেন,যে পথে তাঁরা চলা শুরু করেছিলেন,এখন আমাদের উচিত,সেই পথটাকে অনুসরণ করা,তাঁদের স্বপ্ন গুলো কে বাস্তবায়িত করা...তাহলে,তাঁরা যেখানেই থাকুক না কেন,নিশ্চয়ই শান্তি পাবেন,খুশি হবেন।তাঁরা সমসময় আমাদের মনে আছেন এবং থাকবেন।মন থেকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি...
খবরটা শোনার পর প্রথম অনুভূতি ছিল 'অসম্ভব' ...এবং 'অসম্ভব'। এই দুঃখ ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। এই ক্ষতি পূরণ হওয়ার মতো না। তাঁদের শূন্যস্থান পূরণ করবেন এমন কেউ কি আছেন এদেশে?!
আমাদের চামড়া হলো গন্ডারের চামড়া। আমাদের মেমোরী হলো গোল্ডফিশ মেমোরী। রাস্তাঘাটে বাসায় দোকানপাটে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সম্ভাবনা নিয়ে বসবাস।
লেখাটা বারবার পড়ছিলাম । আর আমার শরীরের পশম গুলোতে শিহরণ হচ্ছিল। আমি বিহ্বল, ভাষা আমার সিক্ত
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
নতুন মন্তব্য করুন