স্কুল-কলেজে পড়ার সময়ে কিছু সার্বজনীন (!) বাংলা সিনেমা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বায়োলজিকাল এনিম্যাল ইনস্টিংক্ট এর কারনে ওইসব সিনেমা থেকেও যে কিছুটা বিনোদন পেয়েছি সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তারপরেও কৌতুহলী মনে কিছু ব্যাপারে প্রশ্ন জাগত। যেমন, “সিনেমাতে দেখায় প্রেমিক-প্রেমিকা হাত ধরে নাচানাচি করছে, আমিতো পার্কে-রাস্তায় অনেক প্রেমিক-প্রেমিকা দেখেছি, তারা নাচানাচি করে না কেন?”, “সিনেমার শেষে নায়কের যখন চমৎকারভাবে ভিলেনকে মেরে ফেলার সুযোগ হয়, তখন প্রতি সিনেমাতে একই উপায়ে একটা পুলিশ বাহিনী এসে বাধা দেয় কেন?” একটু যখন বিজ্ঞান বুঝতে শিখেছি তখন প্রশ্ন তৈরী হল, “আচ্ছা, নায়ক যখন নায়িকাকে বাঁচানোর জন্য রক্ত দেয় তখন রক্তটা লাফিয়ে লাফিয়ে উপরে উঠে একটা ব্যাগে ঢুকে যায়, সেখান থেকেই আবার সরাসরি নায়িকার শরীরে চলে যায়, এটা কিভাবে ঘটা সম্ভব?” এইসব অবাস্তব ঘটনার ব্যাখ্যা চেয়ে বড় কাউকে প্রশ্ন করলে জবাব দিত, “সিনেমা হচ্ছে বাজে জিনিস, বস্তাপচা জিনিস। কিছু অল্পবুদ্ধির মানুষ আছে যারা অন্য কোন চাকরি-বাকরি না পেয়ে সিনেমা বানায়, যুক্তিতর্ক দিয়ে এগুলো মেলানোর চেষ্টা করে লাভ নেই।”
আমি খুব বেশী চেষ্টা করিনি, স্কুল থেকেই মেনে নিয়েছি যে সিনেমা হচ্ছে এমন একটা জিনিস যেটার সাথে বাস্তবের মিল খুঁজে লাভ নেই। আমাদের মেধাহীন পরিচালকদের দক্ষতার কারনে এটা মেনে নেয়া অনেক সহজই হয়েছে। কিন্তু সমস্যা তৈরী হয়েছে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর। এখানে এসে পরিচয় হল Alfred Hichcock, Akira kurosawa, সত্যজিত রায়, তারেক মাসুদদের সাথে। হঠাৎ করে নিজের চিন্তার জগৎতে একটা পরিবর্তন টের পেলাম। অবাক বিস্ময়ে আবিস্কার করলাম যে বাস্তবতা নিয়েও সিনেমা তৈরী করা যায়। শুধু যে সিনেমাটা তৈরী করা যায় তাইনা, সমাজকে প্রভাবিত করে বাস্তবতা বদলেও দেয়া যায়। একে একে সব অসাধারন মেধাবী পরিচালকদের অসংখ্য অসাধারন সিনেমা দেখে নতুন করে সিনেমাকে বুঝতে শিখলাম, সমাজকে দেখতে শিখলাম, জীবনকে অনুভব করতে শিখলাম। নিজের উপর অন্যরকম একটা আত্মবিশ্বাস তৈরী হয় এই ভেবে যে ভাল সিনেমার সত্যিকার জগৎটাকে শেষ পর্যন্ত চিনতে পেরেছি। সত্যিকারের ভাল পরিচালকদের সৃষ্টিগুলো যতই দেখি ততই তাদের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়তে থাকে। দেশের জন্য, সমাজের জন্য কিছু একটা করার ইচ্ছাটাও দৃঢ় হতে থাকে। তারেক মাসুদরা নেতৃত্ব দেবেন, আমরা তাদের পাশে থেকে কাজ করে আরো অনেক এগিয়ে যাব সেই স্বপ্ন দেখতে থাকি।
কিন্তু আজ একটা হত্যাযজ্ঞের (যেটাকে অনেকে সড়ক দুর্ঘটনা বলছেন!) পরে বাস্তবতা নিয়ে আমি আবারো বিভ্রান্ত। আজ মনে হচ্ছে তারেক মাসুদদের কারনে আমরা এতদিন অপ্রয়োজনীয় কিছু কল্পনাকেই বাস্তব ভেবেছি। বরং যে সিনেমাগুলোকে এতদিন বস্তাপচা বলে জেনে এসেছি, সেই সিনেমার সাথেই বাস্তবের মিল বেশী। তারেক মাসুদের মেধার আর কোন বিকল্প নেই কেন সেটা নিয়ে যে ভাবনা ছিল, সেটাও আজ আর নেই। বরং যেই পরিচালকদেরকে এতদিন মেধাহীন ভেবেছি তাদের প্রতিভাতেই আজ আমি মুগ্ধ। অসংখ্য বাংলা সিনেমার যেই ঘটনাগুলোকে উদ্ভট কল্পনা মনে হতো সেগুলোকেই মনে হচ্ছে আমাদের সমাজের আসল চিত্র। আমাদের পরিচালকেরা এই সত্যটা অনেকদিন থেকেই আমাদেরকে দেখিয়ে আসছেন, আমরাই হয়ত এতদিন বুঝতে পারিনি।
স্মাগলার ভিলেন অত্যন্ত সুখে শান্তিতে স্মাগলিং করে যাচ্ছে। যে কেউ ছোটখাট কোন সমস্যা সৃষ্টি করলেই তাকে দিনে দুপুরে খুন করে ফেলা হয়, তখন এলাকার সবাই নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে ভেতরে বসে থাকেন। এমন পরিস্থিতিতে এলাকার এক সংগ্রামী কলেজ ছাত্রকে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা যায়। তার বড় ভাই পুলিশ অফিসার। কলেজ ছাত্রটি একদিন স্মাগলারদের একটা অপরাধ দেখে ফেলে, ভিলেনের চোখে চোখ রেখে, মুখোশ খুলে দেয়ার হুমকি দিয়ে আসে (ওই কলেজ ছাত্র নিজে মনে হয় কোনদিন বাংলা সিনেমা দেখেনি, দেখে থাকলে এটা অন্তত জানত যে এই হুমকির ফলাফল কি হবে)। ভিলেন তার পথের কাঁটা সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু কোন এক কারনে এবার আর দিনে দুপুরে তার হত্যা করতে ইচ্ছে করে না (যদিও সবার সামনে তলোয়ার দিয়ে কুপিয়ে মারলেও সাক্ষী দেয়ার যে কোন মানুষ পাওয়া যাবে না সেটা সিনেমার ভিলেন এবং সিনেমার দর্শক দুই পক্ষই জানেন)। এবার রাতের অন্ধকারে এমনভাবে মারতে হবে যাতে কোন প্রমান না থাকে। কলেজ ছাত্রটি রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে। যেহেতু আজকে ভিলেন তাকে খুন করবে, এতএব সে একা এবং দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোন ধরনের কোন প্রাণী নেই। হঠাৎ একটা ট্রাক এসে তাকে চাপা দিয়ে চলে যায়। বড় ভাই আইনের লোক, তাই আইনের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি দিতে চায়। যদিও দেখা যাচ্ছে যে কলেজ ছাত্রটিকে ফুটপাতের উপর এসে মেরে ফেলা হয়েছে, তারপরেও ভিলেনের দল আদালতে প্রমান করে দেয় যে “ওটা হত্যা নয় দুর্ঘটনা”।
(এরপর কবরে এসে শপথ নিয়ে বড়ভাই কিভাবে এই ঘটনার প্রতিশোধ নেবে সেটা আমরা সবাই জানি)
দেশটা একটা আদর্শ মগের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে। যেখানে সেখানে যখন তখন মানুষ খুন হচ্ছে। অপরাধীদের মুখোমুখী হওয়ার সাহস কারো নেই, সবাই নিজের মত করে গা বাঁচিয়ে চলছেন। এই সময় তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনির নামে দুইজনকে দেখা যার নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। আস্তে আস্তে তাঁরাও অসুস্থ একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থার পথের কাঁটায় পরিনত হয়। একদিন তারা মাইক্রোবাসে করে যেতে থাকে। হঠাৎ একটা বাস তাদেরকে চাপা দিয়ে চলে যায়। তাঁদের অসংখ্য ভক্তরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে বলতে থাকে এটা দুর্ঘটনা নয়, এটা হত্যা, হত্যাকারী রাষ্ট্রকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। কিন্তু একসময় সুস্পষ্টভাবে প্রমান হয়ে যায় যে এটা একটা দুর্ঘটনা। শুধু তাই না, যারা মারা গিয়েছেন দোষটাও আসলে তাদেরই। যদি কেউ প্রশ্ন করতে চান, “প্রতিদিনই যে দূর্ঘটনাগুলো ঘটছে, সেগুলো কার দোষে?”, উত্তর দেয়ার জন্য কাউকে পাওয়া যাবে না।
(এই হত্যা, ভক্তদের ক্ষোভ, এই সবকিছুর পর শেষ পর্যন্ত কি হবে তাও আমরা সবাই জানি)
আমাদের সার্বজনীন (!) বাংলা সিনেমার সেই ভিলেন আর আমাদের তৈরী করা সার্বিক রাষ্ট্র ব্যাবস্থার মধ্যে কোন সাদৃশ্য কি খুঁজে পাচ্ছেন না?
(গতকাল থেকেই বিভিন্ন প্রলাপ বকছি, “তারেক মাসুদঃ শ্রদ্ধা এবং ক্ষোভ”। )
সুমন_সাস্ট
মন্তব্য
আমরা এক আজব দেশের বাসিন্দা। যেখানে বাস্তবতাও চরম অবাস্তবতা এবং অবিশ্বাসে ভরপুর।
বাংলাদেশে একটা রেভুলেশন দরকার।
বাংলার শিক্ষিত জনগন জেগে উটা শুরু করছে। তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করা শিখছে। এখনই সময়। স্বাধীনতার পর থেকে চলে আসা প্রথাগত সরকার ব্যবস্থা বদলে ফেলতে হবে। সরকার হবে, বর্তমানের শিক্ষিত জনগন থেকে। সরকার হবে মানুষের জন্য। তারা নির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক ফায়দা হাছিল করতে আসবে না। যারা দেশকে ভালবাসে, দেশের এই অবস্থায় ক্ষুদ্ধ, যারা দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, তারা দেশের দায়িত্ব নিক। বর্তমানে যে রাজনৈতিক দলগুলু আছে তাদের দারা এই দেশের কোন উন্নতি হবে, দেশের মেধাগুলো মাথা উচু করে দাঁড়ানোর সুজুগ পাবে, সেটা আর বিশ্বাস বা আশা কোনটাই করা যায় না।
আমারা প্রায়ই শুনি আশেপাশের মানুষ গুলা বলছে, এ দেশ থেকে চলে যেতে পারলে আর ফিরে আসবে না।
সবার জন্য এমন একটা ফিল্ড তৈরি করে দিতে হবে, যেন তারা নিজ দেশকে ভালবাসতে পারে, কাউকে যেন মনের দুঃখে দেশ থেকে চলে যেতে হয়। আর এই মেধাবীদের কাজে লাগিয়েই আমরা দেশ বদলে দিতে পারি।
আমরা যেমন জানি, বিসশএর মানুষ জন ও জানে বাংলাদেশ থেকে অনেক মেধার জন্ম হয়। কিন্তু এখানে এই মেধার কোন মূল্য দেয়া হয় না, বিকাশের পর্যাপ্ত সুজুগ ও রাষ্ট্র দিতে পারে না।
এখন পর্যন্ত এক মুহুর্তের জন্যও অন্য কিছু মাথায় আনতে পারিনি, গন্তব্যটা এখনো ঠিক করতে পারিনি। হয়তো সম্পূর্ণ ভুলে যাব, কোনদিন আর মনে করব না। অথবা প্রতিটা দিন শুরু করব শুধু তাদের কথা মনে করে, তাদের আদর্শটা মাথায় নিয়ে।
সুমন_সাস্ট
আরো একজন তারেক মাসুদ নিশ্চয় আসবেন। তার জন্য অপেক্ষায় আছি।
এ হাসনাত
স্বাধীনতার এত বছরে একটা তারেক মাসুদ যে পেয়েছিলাম সেটাই আমাদের সৌভাগ্য ছিল। এই মগের মুল্লুক দেশে সৌভাগ্য বারবার আমাদের কাছে আসবে, এমন আশায় বুক বাধা বড়ই কঠিন।
সুমন_সাস্ট
নতুন মন্তব্য করুন