অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ। অফুরান প্রাণশক্তিতে উদ্দাম, বিপুল হাস্যকৌতুকে উচ্ছল, কথার পিঠে তাৎক্ষণিক কথা বসানোর ক্ষেত্রে বিস্ময়কর পারংগমতায় উজ্জ্বল, সংগীত প্রতিভায় অনন্য, স্মৃতিশক্তিতে অসাধারণ, মুহুর্মুহু প্রেমে পড়ার ক্ষেত্রে অননুকরণীয় প্রেমিক এবং ভোজন ও আড্ডায় অক্লান্ত পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি বলি কাকা। আমার এই কাকা সম্বোধনটায় কোনো আত্মীয়তার কোনো সূত্র নেই। বাংলাদেশে বেশ কিছু কাকা আছে আমার। পীযূষ তাদের অন্যতম।
কতো স্মৃতি এই কাকার সাথে!
বাংলাদেশ ছেড়ে এলাম ২০০১ এ। কানাডার নিস্তরংগ প্রবাস জীবন। প্রিয় মানুষদের সান্নিধ্য বঞ্চিত একঘেঁয়ে জীবনের ক্লান্তি ক্ষমা করে না প্রভু। কারণে অকারণে বাংলাদেশে ফোন করি। প্রিয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলি। তালিকায় পীযূষও বিদ্যমান। প্রিয় মানুষদের কন্ঠস্বর শোনার পেছনে প্রতিমাসে ব্যয় হয়ে যায় বড় অংকের টাকা। ড্রয়ার ভর্তি ব্যাবহৃত ফোন কার্ডের স্তুপ। প্রতিবেশী এক ভদ্রলোক আমার কাছ থেকে ব্যাবহৃত ফোনকার্ডগুলো চেয়ে নেয়। তার নাকি কার্ড জমানোর শখ। সত্যি মিথ্যা কে জানে! আমি মাঝে মধ্যেই ড্রয়ারে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাই। পাঁচশ ছয়শ কার্ড জমলেই আমি ভদ্রলোককে দিয়ে দেই। লোকটার আকর্ণ বিগলিত হাসি দেখে মনটা ভরে যায়। মানুষের শখ কতো বিচিত্রই না হয়!
২০০৫ এর আগস্টের প্রথম সপ্তাহে পীযূষ জানালো—কানাডা আসছি।
আমি তো প্রায় লাফিয়ে উঠি—আইসা পড়ো কাকা...।
বিত্তান্ত জানলাম। প্রথমে টরন্টো। তারপর আসবে আমার এখানে,অটোয়াতে। কয়েকটা দিন খুবই আনন্দে কাটবে ভেবে পুলকিত হই। কারণ পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতি মানেই পরিবেশটা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠা। আমার স্ত্রী শার্লিও পীযূষকে পছন্দ করে। আমরা দুজনে যৌথ পরিকল্পনা করি। পীযূষকে আপ্যায়নের তালিকাও প্রস্তুত হয়ে যায় দ্রুত। ফাঁকে ফাঁকে কেনা হয় এটা সেটা কতোকিছু!
টরন্টো থেকে পীযূষের ফোন আসে—ও কাহা তু কাঁহা? আইতাছি কাইল্কা। সকালে বাসে উঠুম। দুপুর ১২টায় অটোয়া নামুম। বাসস্টেশনে থাইকো কাকা।
--ব্যান্ডপার্টি লাগবো?
--না। আমার ব্যান্ড বাজাইও না...
নির্ধারিত দিনে আমি রওনা হই বাসস্টেশনের দিকে। ওখানে পৌঁছে যাই আগেভাগে। ঘড়ির কাটা স্লো হয়ে যায়। অপেক্ষার সময় চিরকাল দীর্ঘতরই হয়। সময় কাটেনা। এমন সময় গান এলো মোর মনে। আমি গুনগুন করি—বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল পূর্ণ হোক পূর্ণ হোক পূর্ণ হোক হে ভগবান...।
২
পীযূষের সঙ্গে ম্যারাথন আড্ডায় আমার ক্যালেন্ডার আর ঘড়ি এলোমেলো হয়ে যায়। দিন আর রাত্রির কোনো পার্থক্য থাকেনা। আমাদের আড্ডার বিষয় পরিবর্তীত হয় দ্রুত। আমাদের আড্ডায় অনুপস্থিত থেকেও বারবার উপস্থিত হয় আফজাল হোসেন, ফরিদুর রেজা সাগর, আবদুর রহমান, কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খান, তোয়াব খান, আবেদ খান, রাহাত খান, নাঈমুল, আমীরুল, মাযহার, সানী, সায়ীদ স্যার, বিটিভি, চ্যানেল আই, এটিএন বাংলা, ইভা রহমান,মাহফুজুর রহমান, আবদুল গাফফার চৌধুরী, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, রামেন্দু মজুমদার, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আসাদ চৌধুরী, মমতাজ স্যার, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, প্রথম আলো, ইনকিলাব, বুশ, আম্রিকা, আমাদের সময়, শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, ফালু, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, বাংলা একাডেমী, পুরান ঢাকা, বাংলাবাজার, ধ্রুব এষ, মাশুক হেলাল, নঈম নিজাম, আফরোজা বানু, মহসীন রেজা, পলাশি থেকে ধানমন্ডি, বংগবন্ধু,অমিতাভ বচ্চন, সৈয়দ হাসান ইমাম, ডালপুরী, হাজির বিরিয়ানী, চকবাজারের ইফতার, কবি শামসুল ইসলাম পিকু বাই, ফেরদৌসী মজুমদার, আবদুল্লাহ আল মামুনরা।
বিস্তর কথাবার্তা আর বেসুমার খানাখাদ্য আমাদের সময়কে প্লাবিত করে ফেলে।
খিদে পাবার আগেই আমরা খাই। ঘুম চলে যাবার পর আমরা নিদ্রা যাই।
অটোয়ার পার্কসমূহ, নদী আর ক্যানেলের তীরবর্তী অঞ্চলসমূহ, ডাউন টাউনের অন্ধিসন্ধি এবং শহরের অখ্যাত অথচ সুন্দর কোনাকাঞ্চি আমরা চষে ফেলি।
অটোয়ার পতেংগায় যাইবা কাকা?
আমার কথায় মজা পায় পীযূষ। --এইখানেও পতেংগা আছে!
নিয়ে গেলাম তাকে ব্রিটানিয়া পার্কে। যেখানে ছোটবড় নানান আকৃতির পাথর ফেলে রাখা হয়েছে অটোয়া নদীর কোল আর তীর ঘেঁষে। নদীর জলে পা ডুবিয়ে সেই পাথরের উপরে বসে থাকি আমরা। শার্লি আমাদের ছবি তোলে নানান এঙ্গেলে। আশপাশে নানান দেশের নানান সাইজ আর চেহারার মানুষ। কেউ কেউ বড়শি ফেলে মাছ ধরার চেষ্টা করছে। এমন সময় আবারও, গান এলো মোর মনে। উদাত্ত কন্ঠে আমি গেয়ে উঠলাম—বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল পূর্ণ হোক পূর্ণ হোক পূর্ণ হোক হে ভগবান...।
মুহূর্তেই আমার সঙ্গে কোরাসে শামিল হলো কাকা। শামিল হলো শার্লি। আশপাশের লোকজনের উপস্থিতিকে উপেক্ষা করে আমাদের তিনজনের কন্ঠে গীত হলো গানটি, পুরোটাই।
পীযূষ কাকা বললো—এই অসাধারণ গানটিকেও মুসলমানাইজেশন করা হয়েছিলো, ভাবতে পারো? নজরুলের কবিতার নবজীবনের গাহিয়া গান সজীব করিব মহাশ্মশানকে করা হয়েছিলো সজীব করিব গোরস্থান। আর এই গানটার হে ভগবানের জায়গায় করা হয়েছিলো হে রহমান...।
আমি আর পীযূষ দৈত কন্ঠে হে ভগবানের জায়গাটা এডিট করে বারকয় হে রহমান হে রহমান গাইলাম। শার্লি তো হেসেই মরে ধর্মান্তরিত গানের কলিটি শুনে। আর ঠিক তক্ষুণি আমার করোটির ভেতরে একটা স্পার্কিং অনুভূত হলো। সেই স্পার্কিং-এর ঝিলিকে আমি একটা ছড়াকে দেখতে পেলাম স্পষ্ট! সেকেন্ডের মধ্যেই মস্তিষ্কের ভেতরে রচিত হয়ে গেলো কয়েকটা পঙ্ক্তি। খুব দ্রুততায় আমি পকেট হাতড়ে টুকরো কাগজের বাসের টিকিট আর কলমটা বের করে প্রায় হিব্রু ভাষায় টুকে ফেললাম পঙ্ক্তিসমূহকে—বাংলার মাটি বাংলার জল/ মুজিবের নাম জপে অবিরল/বাঙালির আশা বাঙালির ভাষা/মুজিবের প্রতি রচে ভালোবাসা...।
দুপুরে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে হাঁটতে নাজেল হলো আরো কিছু পঙ্ক্তি। দ্বিপ্রাহরিক আহার সমাপনের পরপরই ঝাঁকেঝাঁকে ছুটে আসা শব্দ আর মিলের সমন্বয়ে তৈরি হয়ে গেলো মুজিব বন্দনা নামের ছড়াটি। পীযূষ কাকা ছড়াটিকে উচ্চ পর্যায়ে এপ্রিশিয়েট করলো। দুচারটে শব্দ ধারও দিতে চাইলো মুক্তহস্তে।
ছড়াটা পাঠিয়ে দিলাম জনকন্ঠে, তোয়াব ভাইকে। ছাপা হলো সেটা জনকন্ঠের চতুরংগ পাতায়, যেখানে ছাপা হতো ঢাউস ঢাউস কলাম।
জাতিরজনক বংগবন্ধু শেখ মুজিবের মৃত্যুদিবসে ছড়াটা তুলে দিলাম এখানে, আমার বন্ধুদের উদ্দেশে—
মুজিব বন্দনা
বাংলার মাটি বাংলার জল
মুজিবের নাম জপে অবিরল।
বাঙালির আশা বাঙালির ভাষা
মুজিবের প্রতি রচে ভালোবাসা।
বাংলার কলি বাংলার ফুল
মুজিবের নামে ফুটিতে ব্যাকুল।
বাংলার তরু বাংলার পাখি
মুজিবের নামে করে ডাকাডাকি।
বাংলার মেঘ বাংলার নদী
মুজিবের নামে বহে নিরবধি।
বাংলার জ্ঞানী বাংলার কবি
মমতায় আঁকে মুজিবের ছবি।
বাংলার প্রতি বাঙালির ঘরে
জ্বলিছে পিদিম মুজিবের তরে।
বাঙালির এই প্রিয় স্বাধীনতা
বলে পলে পলে মুজিবের কথা।
বাংলার গীতি বাঙালির প্রীতি
করেছে ধারণ মুজিবের স্মৃতি।
মুজিবের নাম মুছে দেবে কিসে?
মুজিব রয়েছে পতাকায় মিশে।
মুজিব রয়েছে দেখো চারপাশে
ছয়টি ঋতুতে আর বারোমাসে।
মুজিব রয়েছে দেখো সবখানে
বাংলার গানে বাঙালির প্রাণে।
বাংলার রাত বাংলার দিন
শুধিবে কেমনে মুজিবের ঋণ?
মুজিবের নাম চির অবিনাশী
মুজিবেরে আমি বড় ভালোবাসি।
এক নিঃশ্বাসে আমি অনায়াসে
বাংলাদেশের নামটার পাশে
লিখে রাখলাম লিখে রাখলাম
মুজিবের নাম মুজিবের নাম...!
রচনাকালঃ কানাডা ১৩ আগস্ট ২০০৫
প্রকাশকালঃ ১৫ আগস্ট ২০০৫, দৈনিক জনকন্ঠ
মন্তব্য
উইন্ড এর আনলিমিটেড সার্ভিস ব্যাবহার করেন, কলিং খরচা কমে যাবে।
ছড়ার জন্মকথা অসাধারণ লাগল।
দারুণ লাগলো রিটন ভাই,
আপনার ছড়া তৈরীর এরকম অনেক গল্প আছে আমি নিশ্চিত... সেগুলোও জানতে চাই।
এবারের আগস্ট মাসটা শোকের বাতাসে অনেক ভারী হয়ে গেলো।
লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ
দুপুরে সচলে ঢুকে ১৫ আগষ্টরে শোকের মধ্যেও খুশি হলাম সচলের ব্যনারটা দেখে। যাক মহান নেতাকে নিয়ে মুস্তাফিজ ভাই সুন্দর একটা ব্যানার করেছেন। রিটন ভাই তার সহজাত প্রতিভায় লেখা ২০০৫ সালের একটা ছড়া আর এর সানে নজুল দিলেন। ছড়াটা পড়ে রক্তে নাচন ধরল। তারপর তামান্ন কাজীর একটা কবিতা হৃদয় ছুয়ে গেল। তারপর দেখি আর কিছুই নেই শোকবহ ১৫ আগষ্ট নিয়ে। কেন জানি বিষাদের দিনে মনটা আরো বিষাদে ভরে গেল।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
দারুণ লাগলো ছড়ার জন্মকথা ভাইয়া।
বাংলার নদী-মাটি-প্রাণ বঙ্গবন্ধুর নাম এমনিতেই মনে রাখবে, তবে নামকরণের খেলায় জরাজীর্ণ করে ফেলা দেখে সন্দেহ জাগে রাজনীতিবিদদেরা নিজেরাই সম্ভবত প্রিয় নেতার নাম ভুলে যাবার আতঙ্কে ভুগেন।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
_____________________
Give Her Freedom!
আগে পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম এবার পড়ে তা জানিয়ে গেলাম।
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না
অসাধারন অনুভূতি ।
ছড়াতিহাস পড়ে মজা পেলাম।
ছড়াতিহাস পড়ে মজা পেলাম।
অলস সময়
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
অসাধারণ স্মৃতিচারণ সেই সাথে অসাধারণ এক ছড়ার জন্মকথা
কুর্ণিশ জানিয়ে গেলাম রিটন ভাই
নতুন মন্তব্য করুন