তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের মর্মান্তিক মৃত্যুতে এই দেশ কী হারালো তা প্রতিটি সচেতন মানুষ এক তীব্র আর দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে আজ উপলব্ধি করছেন। কিন্তু প্রচন্ড দুঃখবোধের মধ্যে আমার বার বার মনে পড়ছে মাত্র ৭ দিন আগে একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রথম সংবাদটি যেখানে জানানো হয়েছে দক্ষতার পরীক্ষা ছাড়াই প্রায় সাড়ে ২৪ হাজার লোককে ভারী যানবাহন চালানোর পেশাদার লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এই অত্যন্ত অন্যায় এবং নিয়মবিরোধী আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন দেশের নৌপরিবহনমন্ত্রী, আর দেশের যোগাযোগমন্ত্রী এমন একটি গর্হিত আবেদনের বিরোধিতা করা তো দূরের কথা, এই আবেদনের প্রেক্ষিতে ন্যূনতম পরীক্ষা নিয়ে কীভাবে লাইসেন্স দেয়া যায় তিনি তাই বিবেচনা করছেন। নিয়ম, নীতি কতোটা অবমাননা আর তুচ্ছ করে কাজ আর কথাবার্তা বলা সম্ভব এখানে মন্ত্রীদের পক্ষে; কারণ তারা জানেন এই সমাজে অন্যায় করেও তাদের কোন ভয় নেই, বরং আছে প্রশ্রয়। এই প্রতিবেদনটিতে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে বর্তমান সরকারের সময়ে এই পর্যন্ত এবং অতীতের বিভিন্ন সময়ে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই কতো অসংখ্য পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। আর কিছু ব্যক্তির দুর্নীতি আর ব্যক্তিগত লাভ দেশের বহু মানুষের জন্য তৈরি করছে এক ভীতিকর, প্রাণঘাতী পরিস্থিতি। আমাদের দেশের রাস্তাগুলোতে আজ ভারী যানবাহন চালায় অদক্ষ, অনভিজ্ঞ, বোধহীন চালকরা, রাস্তাগুলি আজ যেন মৃত্যুর পথ। আর এই জঘন্য অব্যবস্থার কারণে এই সমাজকে দিতে হয় চরম মূল্য, যখন বহু মানুষ স্বজনহারা হয় প্রতিনিয়ত, দেশের দীপ্যমান মানুষরা প্রাণ হারায় ভয়ঙ্কর সড়ক দুর্ঘটনায়। তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের এই মর্মবিদারক আর অপূরণীয় মৃত্যুর শোকের মাঝে প্রচন্ড ক্ষোভে মনে পড়ছে ৭ দিন আগে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনটির কথা, যেখানে প্রকাশিত হয়েছে কোন্ অনুভূতিহীন আর নীতিবিবর্জিত সিদ্ধান্ত দায়ী আমাদের দেশের সড়কপথগুলিকে এমন মৃত্যুফাঁদ করে তোলার জন্য।
তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীর অনেকদিক দিয়েই নিষ্প্রভ আর মলিন হয়ে যাওয়া এই সমাজে বেঁচে ছিলেন উজ্জ্বল মানুষ হিসেবে। নিজ যোগ্যতা আর কর্মদক্ষতার প্রকাশের মধ্য দিয়ে এই দু’জন মানুষ হয়ে উঠেছিলেন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব; বহু মানুষ অনুপ্রাণিত হয়েছেন তাঁদের কাজ আর অর্জন দেখে। তারেক মাসুদ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত করে তুলতে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। সম্প্রচার মাধ্যম এবং সিনেমাটোগ্রাফির বিভিন্ন দিকে গভীর ধারণাসম্পন্ন একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে মিশুক মুনীর দেশের গণযোগাযোগ শিক্ষা এবং সম্প্রচার মাধ্যমের মান বৃদ্ধিতে রেখেছেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এই দু’জন মানুষ নিজ নিজ ক্ষেত্রে আরো অনেক মূল্যবান কাজ করার মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজকে সমৃদ্ধ করতে পারতেন। দেশে চিন্তাশীল চলচ্চিত্র নির্মাণের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি তারেক মাসুদ একের পর এক বক্তব্যধর্মী, সমাজসচেতন সৎ চলচ্চিত্র আমাদের উপহার দিয়েছেন। হাতে গোণা যে ক’টি সুনির্মিত ছবি নিয়ে আমরা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বিশ্বে উপস্থাপন করতে পারি, তার মধ্যে তারেক মাসুদের ছবিগুলো অন্যতম। আমাদের চরম দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশের অতীতের দুই সবচেয়ে খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান আর আলমগীর কবিরের মতো তারেক মাসুদও প্রাণ হারালেন দুর্ঘটনায়; নিজের দুই পূর্বসূরীর মতো তারেক মাসুদও পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন অসময়ে যখন দেশের চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করাই তাঁর বাকী ছিল। বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসা মিশুক মুনীর তাঁর বিস্তৃত জ্ঞানকে ব্যবহার করে দেশের সম্প্রচার সাংবাদিকতার মানকে বাড়িয়ে তোলার যে কাজ শুরু করেছিলেন, তাঁর সেই চেষ্টাও থেমে গেল হঠাৎ, চিরদিনের জন্য।
মিশুক মুনীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। ১৯৯৪ সালে বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তাঁকে দেখেছি বিভাগে; ছোট ছোট কতো স্মৃতি তাঁকে ঘিরে। তারেক মাসুদের সাথে চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনার স্মৃতি….. সব আজ শুধুই স্মৃতি। মানুষের এমন অসময়ে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া যে কতোটা কষ্টের।
তারেক মাসুদকে প্রথম দেখি ১৯৯৫ এর এক বিকেলবেলা, পাবলিক লাইব্রেরী মিলনায়তনে। দেশে তখন ‘মুক্তির গান’ কী দারুণ এক সাড়া ফেলেছে! আমরা বার বার দেখছি সেই অসাধারণ ছবি; বন্ধুরা মিলে, পরিবারের সদস্যদের সাথে। এরপর একসময় মুক্তি পেলো ‘মাটির ময়না’; তারেক মাসুদ আমাদের মন স্পর্শ করেই চলেছেন। আমাদের চলচ্চিত্রের মান নিয়ে আমরা আনন্দিত হচ্ছি, আশান্বিত হচ্ছি। সেই আশা আমাদের দেখাচ্ছেন তারেক মাসুদ। তারেক মাসুদের কথা শুনতেও কতো ভাল লাগতো। দীর্ঘদেহী, ভরাট কন্ঠের মানুষটি ধীরস্থির ভাবে কেমন এক অদ্ভুত সারল্য নিয়ে কথা বলতেন। আর যখন হাসতেন তখন সারা মুখ যেন ঝলমল করে উঠতো। চিন্তাসমৃদ্ধ চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে আামাদের দেশে যে শূন্যতা তা পূরণ করার জন্য তারেক মাসুদ তো আছেন; তাঁর কাজ দিয়ে তিনি আরো অনেককে উৎসাহী করে তুলবেন একথা চিন্তা করে আমরা স্বস্তি পেতাম। তারেক মাসুদের সাথে আমার সরাসরি কথা হয় আরো অনেক পরে। ‘মাটির ময়না’ নিয়ে আমি রিভিউ লিখেছি; আমার পরিচিত অনেকের সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়েছে কিন্তু তারেক মাসুদের সাথে আমার দেখা হয়নি। দেশের বাইরে আমাকে থাকতে হয়েছে বিভিন্ন সময়; দেশের বাইরে থেকেই একদিন ফোনে তারেক মাসুদের সাথে প্রথম কথা হয়। এরপর বেশির ভাগ সময় কথা হয়েছে টেলিফোনেই; টেলিফোনেই শুনতাম তাঁর সেই চমৎকার হাসির শব্দ। ধর্মীয় উগ্রতা নিয়ন্ত্রণে উদাসীন এক সময়ে যে সাহস নিয়ে তিনি ‘মাটির ময়না’ নির্মাণ করেছেন তা একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে সবসময়। এই ছবিটির বিশ্লেষণে আমি তাই সবসময়ই আগ্রহ বোধ করেছি। আমার পিএইচডি থিসিসেও একটি অন্যতম কেস স্টাডি চ্যাপ্টার থাকছে ছবিটির ওপর। কখনো দেশে গিয়ে দেখেছি যে তারেক মাসুদ দেশে নেই; কিন্তু গত ডিসেম্বরে দেশে যেয়ে তারেক মাসুদের সাথে দেখা হয়ে গেল। তিনি তখন তাঁর সদ্যনির্মিত ‘রানওয়ে’ ছবিটি নিয়ে দেশের বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ঢাকায় থাকেন খুব কম। ঠিক করেছেন আগে দেশের বিভিন্ন শহরের মানুষ ‘রানওয়ে’ দেখবে, তারপর ছবিটি মুক্তি পাবে ঢাকায়।
আমাকে বার বার বলেছেন মানুষ কতো আগ্রহ নিয়ে 'রানওয়ে' দেখছে। দেশে বাণিজ্যিক ছবির উপাদান ছাড়া নির্মিত বক্তব্যধর্মী ছবিরও যে কতো দর্শক আছে গভীর উৎসাহ নিয়ে তিনি তা বলতেন। তাঁর এই উৎসাহ দেখে ভাল লাগতো খুব; এমন উৎসাহই তো একজন চলচ্চিত্রকারকে তাঁর পছন্দমতো কাজ করতে আরো আগ্রহী করে তোলে। আমাকে বেশ ক’বারই বলেছেন সম্ভব হলে তাঁর সঙ্গে ‘রানওয়ে’র কোন একটা স্ক্রীনিং-এ যাওয়ার জন্য; বলতেন যে আমার গবেষণার অনেক মূল্যবান তথ্য আমি এর মাধ্যমে পেয়ে যাবো। নিজের ব্যস্ততার কারণে সেই সময় ঢাকার বাইরে যেতে পারিনি। তারেক মাসুদ কিন্তু এক সন্ধ্যাবেলা মণিপুরী পাড়ায় তাঁর বাড়িতেই আমার জন্য ‘রানওয়ে’ দেখার ব্যবস্থা করলেন। দিনটি ছিল এ বছরের ০৩ জানুয়ারি। একা একা তাঁর ড্রইংরুমে বসে ছবিটি দেখলাম। তিনি পাশে বসে থাকলেন চুপচাপ। দেখা শেষ হলে সেই শীতের সন্ধ্যায় নিজের চলচ্চিত্র, দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে তিনি কথা বলে গেলেন দীর্ঘক্ষণ। মুখোমুখি ড্রইংরুমে বসে, খাবার টেবিলে রাতের খাওয়া খেতে খেতে। ১৯৯৫-এর সেই বিকেলবেলা থেকে ২০১১-এর সেই সন্ধ্যা। ১৬ বছরে তারেক মাসুদের চেহারায় কিছুটা পরিবর্তন এলেও প্রাণশক্তিতে কোন ঘাটতি এসেছে বলে মনে হচ্ছিলো না। বরং এক গভীর উৎসাহ যেন তাঁকে ঘিরে আছে তাই মনে হচ্ছিলো। বলছিলেন ‘কাগজের ফুল’-এর কথা, যা হবে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছবি। বলছিলেন ছবি নির্মাণ করতে যেয়ে নানা বিপত্তি অতিক্রম করে আসার কথা। সেদিনের পর দেশে যতোদিন ছিলাম তারেক মাসুদের সাথে আর দেখা হয়নি আমার। তিনি ঢাকার বাইরে চলে যান আবার; ‘রানওয়ে’ ছবিটির ওপর একটি রিভিউ লিখেছিলাম ‘নিউ এজ’-এ; সেখানে শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম নিজের ছবি নিয়ে তাঁর এক শহর থেকে আর এক শহরে ঘুরে বেড়ানোর কথা। নিজের বক্তব্যধর্মী চলচ্চিত্র দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য তাঁর আন্তরিক ইচ্ছা আর কঠিন পরিশ্রম আমাকে মুগ্ধ করেছিল। সমাজের সমস্যা নিয়ে নির্মিত ছবির সাথে বহু দর্শককে সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে দেশের সামাজিকভাবে-দায়িত্বশীল চলচ্চিত্রের ধারাটিকে আরো পূর্ণতা দেয়ার জন্য তারেক মাসুদের কাজের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সেদিনের পর আবারও বিভিন্ন সময় তাঁর সাথে টেলিফোনে কথা হয়েছে, কানে ভেসে এসেছে তাঁর সেই ভরাট কন্ঠের পরিপাটি উচ্চারণ, তাঁর সেই সুন্দর হাসির শব্দ। সেই সন্ধ্যার প্রায় ৩-৪ ঘন্টার আলোচনার অডিও ক্লিপ আমার কাছে আছে; জানি যে রেকর্ড করা এই কথাগুলি আগামী দিনগুলিতে আমি শুনবো অনেকবার। কিন্তু তারেক মাসুদের সাথে আর কথা হবে না। বহু মানুষের মন ভেঙ্গে দিয়ে, তাঁর নিজের স্বপ্নের কাজ শুরু করার আগেই এই মানুষটিকে চলে যেতে হলো পৃথিবী ছেড়ে।
বিশ্বাস হয় না যে আমাদের দারুণ প্রাণবন্ত, অত্যন্ত চৌকস এবং সুপুরুষ মিশুক স্যারও হঠাৎই চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য। আমি এই কথা ভাবতে পারি না। এখনো যেন চোখের সামনে স্পষ্ট ভাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যানের কক্ষে ১৭ বছর আগের একটি সকাল। আমি তখন সদ্য ভর্তি হয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথমে ভর্তি হয়েছিলাম আইন বিভাগে। কিন্তু প্রথম দিন আইন বিভাগে ক্লাস করতে যেয়েই মনে হয়েছিল এই বিভাগে আমার ভাল লাগবে না, এই বিষয় আমার নয়। অ্যানেক্স বিল্ডিং-এর পরিবেশ দেখে মনটা কেমন দমে গিয়েছিল। বিভাগ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিতেও দেরী করিনি একেবারেই। ইংরেজি সাহিত্য না সাংবাদিকতা কোন্ বিষয় নিয়ে পড়বো এই নিয়ে সামান্য দোটানায় থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যে সাংবাদিকতাই পড়বো। কলাভবনের কলরবমূখর পরিবেশে এসে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সাংবাদিকতা বিভাগের বিভিন্ন শিক্ষকের কথা জেনেও এই ডিপার্টমেন্টে পড়ার আগ্রহ আরো বেড়ে গিয়েছিল। প্রফেসর নূরউদ্দিন, আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী, সিতারা পারভীন, আলী রিয়াজ, শাহেদ কামাল ও আরো অনেকের কথা শুনেছিলাম। জানলাম শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলেও এই বিভাগের শিক্ষক, যিনি দেশের অন্যতম সেরা একজন সিনেমাটোগ্রাফারও। আইন বিভাগ পরিবর্তন করে এই বিভাগে ভর্তির জন্য বিভাগের চেয়ারম্যানের কক্ষে এলাম সেই সকালে; চেয়ারম্যান তখন অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য। তিনি সব কাগজপত্র দেখে বললেন আর একটি চিঠিরও দরকার হবে। এর মধ্যেই কক্ষে ঢুকলেন ছয় ফুট লম্বা, একহারা গড়নের অত্যন্ত সুপুরুষ একজন মানুষ। সত্যজিৎ রায়-এর ফেলুদা’র “ছিন্নমস্তার অভিশাপ” উপন্যাসে কারান্ডিকার নামে একজন রিং মাস্টারের প্রধান চরিত্র আছে; সত্যজিৎ রায় তাঁর একটি ছবিও এঁকেছেন সেখানে। দীর্ঘদেহ, চাড়া-দেয়া-গোঁফ আর মাথার ঘন চুলে রূপালি ছোঁয়া নিয়ে এই ভদ্রলোক যেন ছোটবেলা থেকে বহুবার দেখা সত্যজিতের আঁকা ঠিক সেই চরিত্রটি। যেই বিস্ময় নিয়ে সেদিন তাকিয়েছিলাম ভদ্রলোকের দিকে, সেই বিস্ময় আর ভালো-লাগা আমার কোনদিন যায়নি। আরেফিন স্যার সেই ভদ্রলোককেই বললেন আমাকে একটি চিঠি দেয়ার জন্য, আর ভদ্রলোক মুহুর্তেই অত্যন্ত সুন্দর ইংরেজিতে একটি চিঠি তৈরি করে আমাকে দিলেন। তাকিয়ে দেখি তাঁর নাম লেখা আছে, আশফাক মুনীর। বুঝলাম ইনিই মুনীর চৌধুরীর ছেলে, বিভাগের শিক্ষক। এক দারুণ খুশির অনুভূতি নিয়ে বেরিয়ে আসলাম চেয়ারম্যানের ঘর ছেড়ে।
সবাই আশফাক মুনীর স্যার এর ডাক নাম ‘মিশুক’-ই বেশি ব্যবহার করতো। মিশুক স্যারকে ক্লাসরুমে পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে এমএ ক্লাস পর্যন্ত। তখন তিনি আমাদের দুটো কোর্স পড়াতে শুরু করলেন। আমরা সবসময়ই অনেক কৌতুহল আর আকর্ষণ নিয়ে দেখতাম তাঁকে। করিডোর দিয়ে দ্রুত গতিতে হেঁটে যেতেন; কথা বলতেন এক অদ্ভুত আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে। কখনো বাংলায় বেশ ঘরোয়া ভাবে কথা বলে উঠতেন, আর খুব সাবলীলভাবে চমৎকার ইংরেজিতেও কথা বলতেন প্রায়ই। যখন আমাদের ভিডিও কমিউনিকেশন কোর্সটি পড়াতে শুরু করলেন তখন দেখলাম এই বিষয়ে তাঁর দখল। প্রতিটি ক্লাসই আমাদের জন্য ছিল অত্যন্ত আগ্রহের, কারণ দেশের সেরা একজন এক্সপার্টের ক্লাস করছিলাম আমরা। জানতাম যে ক্যামেরার প্রতিটি অংশ, প্রতিটি কলাকৌশল এই মানুষটির দারুণভাবে রপ্ত; তাঁর ক্যামেরা ধরা দেখা মাত্রই তা বোঝা যেতো। একদিন মনে আছে মিশুক স্যার আমাদের শট ডিভিশনের ওপর কাজ দিয়েছিলেন। প্রত্যেকের আলাদা কাজ, কে কতো সৃষ্টিশীল হতে পারে। আমি গভীর মনোযোগ ঢেলে কাজ শেষ করে তাঁর কাছে নিয়ে গেলাম দেখাবার জন্য; তিনি বললেন আমি কয়েক মিনিট দেরী করে ফেলেছি, তিনি এখন আর তা দেখবেন না। আমি বললাম পুরোটা দেখার দরকার নেই শুধু কাঠামোটা ঠিক আছে কী না এক নজড়ে তাই দেখতে। তিনি তাতেও রাজী না হলে আমি যে মনোক্ষুণ্ণ হয়েছিলাম, তা বোধ হয় আমার চেহারাতে প্রকাশ পেয়েছিল। মনে আছে পরের ক্লাসে ঢুকেই তিনি সোজা এগিয়ে এসে আমার সামনে থেকে আমার খাতাটি তুলে নিয়েছিলেন, তারপর আমি যা চেয়েছিলাম তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি সময় আর মনোযোগ দিয়ে আমার সেই শট ডিভিশনের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করেছিলেন বলতে গেলে ক্লাসের পুরো সময় ধরেই। আগের দিন আমি যে মন খারাপ করেছিলাম তা নিশ্চয়ই তাঁর মনে ছিল। সেই স্মৃতি ভুলবো না কখনোই। মনে আছে ‘অ্যাডভারটাইজিং’ ক্লাসে হাস্যরসে ভরা তাঁর চমৎকার লেকচার। মিশুক স্যারের দারুণ কথা বলার ধরনেই তাঁর ক্লাসগুলো উপভোগ্য হয়ে উঠতো অনেকখানি। তারেক মাসুদের মতো মিশুক স্যারের হাসিটিও ছিল অত্যন্ত সুন্দর। সেই হাসি দেখলেই ভাল লাগতো।
অবশ্য মিশুক স্যার আমরা মাস্টার্স শেষ করতে না করতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছেড়ে দেন। এর কিছুদিন পর চলে যান দেশের বাইরে। আমি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ার পর কিছুদিন ভিডিও কমিউনিকেশন কোর্সটি পড়াই; কিন্তু মিশুক স্যার আর আসতেন না বিভাগে। সেই আকর্ষণীয় মানুষটির সাথে আর দেখা হতো না। এরপর আমিও দেশের বাইরে চলে যাই। প্রায় ১০ বছর ওনার সাথে দেখা হয়নি। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা ছেড়ে আবার বাইরে চলে আসার ঠিক দু’দিন আগে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল মিশুক স্যারের সাথে। হোটেল সোনারগাঁ-র উল্টোদিকে একটা কফিশপে এক পড়ন্ত বিকেলে ঢুকে চেয়ারে বসতে না বসতেই দেখি পাশের টেবিল থেকে পরিচিত চেহারার একজন হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে; সেই পরিচিত হাসি দেখে দারুণ খুশিতে এগিয়ে যাই মিশুক স্যারের কাছে। দেখি আগের মতোই ঝকঝকে, ধারালো চেহারা আছে তাঁর। শুধু এই ১০ বছরে মাথার চুল আর সেই জাঁদরেল গোঁফ অনেকটাই সাদা হয়ে গেছে। আমাদের দু’জনের সাথেই অন্য মানুষ ছিল বলে আর বেশি আলাপ করা হয়নি সেদিন; কিন্তু স্যারের সাথে এতোদিন পর দেখা হলো বলে ভাল লেগেছিল অনেক। আমরা বসে থাকতে থাকতেই তিনি আগের মতোই দ্রুত পায়ে হেঁটে বেরিয়ে যান; দরজার কাছে পৌঁছে একবার ঘুরে তাকান আমাদের দিকে। আমিও দেখি তাঁকে; একবারও কী ভেবেছিলাম এই সতেজ, প্রাণবন্ত চেহারার মানুষটি পৃথিবী ছেড়েই চলে যাবেন আর কয়েক মাস পর।
আমাদের চলচ্চিত্র এবং গণমাধ্যম জগতের এই দুই অত্যন্ত মেধাবী মানুষের এমন দুর্ভাগ্যজনক অকালমৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। এই দুই উজ্জ্বল মানুষের হারিয়ে যাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত করলো পুরো দেশকে, যে দেশে আশার বদলে হতাশাই আমাদের পীড়িত করে বেশির ভাগ সময়। আর এই সমাজে যারা নিজেদের কাজ দিয়ে আমাদের আশান্বিত করে তোলেন, সেরকম মানুষরা যখন সমাজে টিকে থাকা সর্বনেশে অব্যবস্থার কারণে প্রাণ হারান তখন আমাদের দুঃখ তীব্রতর হয়। অনিয়ম, অবহেলা আর অনুভূতিহীনতার যে অসুস্থ চর্চা প্রতিনিয়ত চলছে আমাদের দেশে তা দিনের পর দিন টিকে থাকলে আর আমরা একটি নিরাপদ, সুন্দর সমাজে বাস করার প্রত্যাশা করি কী করে? আর আমরা নিজ স্বার্থের জন্য, বা ভয়ে, অন্যায় আর অনিয়মের বিরুদ্ধে খোলাখুলি প্রতিবাদ না করে এই সমাজে নিয়ম-নীতিকে উপেক্ষা করার ক্ষতিকর প্রবণতাগুলিকে আরো বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করছি। সমাজের সাধারণ মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হবার জন্য পথ দেখাবেন যে বুদ্ধিজীবীরা তাদের অনেকেও তো অনেক সময়ই নিশ্চুপ, সংবাদপত্রও কখনো বিভিন্ন অন্যায়ের সরাসরি সমালোচনা করা হলে তা প্রকাশে সাহসী বা আগ্রহী হয় না। এই সমাজে তাই এক মন্ত্রী আরেক মন্ত্রীর কাছে সম্পূর্ণ নিয়মবিরোধী আবেদন করতে দ্বিধা করেন না, যথাযথ পরীক্ষা গ্রহণ ছাড়াই এই দেশে লক্ষ লক্ষ ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার অনিয়ম করা হয়, যে জঘন্য সিদ্ধান্তের প্রাণঘাতী ফল আমরা দেখি অহরহ ঘটতে থাকা সড়ক দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে, দুর্ঘটনায় দেশের মেধাবী মানুষরা প্রাণ হারানোর পরও সড়কপথে ক্রমাগত দুর্ঘটনা ঘটতে থাকার অব্যবস্থার দায় নেয়া তো দূরের কথা, মন্ত্রীরা চালকদের বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানোর কথাও মানতে চান না, দেশে একের পর এক খুন, পিটিয়ে হত্যাকান্ড ঘটার পরেও দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেন আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে। অনেকে প্রশ্ন করেন কী করে মন্ত্রীরা এমনটি করতে পারেন? উত্তরটি আমাদের না বুঝতে পারার তো কোন কারণ সেই। যে দেশে ক্ষমতায় থাকা এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অন্যায় কাজ এবং অযৌক্তিক, অসংবেদনশীল কথার বিরুদ্ধে কঠিন, উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়ার চর্চা নেই সেখানে অন্যায় আর অনুভূতিহীনতা প্রশ্রয় পাবে এ তো খুবই স্বাভাবিক। আমরা আশ্বস্ত হতাম যদি দেখতাম সংবাদপত্রে খবর প্রকাশের পরপরই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে কেন তিনি যোগ্যতার পরীক্ষা ছাড়াই সাড়ে ২৪ হাজার লাইসেন্স দেয়ার সুপারিশ করেছেন এজন্য সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে হতো। কিন্তু এমন একটি অভিযোগ প্রকাশের পরও তো সেই মন্ত্রীকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। অনিয়ম, যথেচ্ছাচার চলতেই থাকবে, আর এই সমাজও সুন্দর, সুশৃঙ্খলভাবে এগোবে তা তো আমরা আশা করতে পারি না। আর সমাজের সচেতন এবং অগ্রসর ব্যক্তিদের বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক হয়ে জোরালোভাবে প্রতিবাদ না করা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশীলদের অনুচিত কাজ করার সাহসই কেবল বাড়িয়ে তুলছে।
তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর এবং আরো অনেকের করুণ মৃত্যু যদি আমাদের অপরাধী করে তোলে তাহলে এই অপরাধবোধ যেন আমাদের অসৎ নিশ্চুপতাকে মুছে দেয়, এই প্রত্যাশা করি।
মন্তব্য
আমরা কি আর তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনিরের মত কাউকে পাব ?? কোনভাবেই এই ক্ষতি পোষানো সম্ভব নয় ।
উনারা ছিলেন আলোকিত শুভ্র মানুষ!!! যে শুভ্রালো বাংলার বড় বেশি দরকার!!!!
_____________________
Give Her Freedom!
একেকটা খবর পড়তেছি, মন আরও বেশি খারাপ হচ্ছে। কষ্ট বাড়তেছে। গত দুই দিনে যা বুঝি নাই, কালকে রাত থেকে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতেছি। এই ক্ষতি যে কতো বড় ক্ষতি সেটা বুঝতে বুঝতে গোটা কয়েক দশক চলে যাবে আমাদের দেশের ভুদাই পাবলিকের! আর এই সুযোগে আবুল-শাজাহান'রা বুঝে না বুঝে ছাগলের মতো ম্যাৎকার করে যাবে।
"আমাদের অসৎ নিশ্চুপতা" - অসাধারন।
সারাটা দিনই পুরানো অনেক কিছু পড়লাম। এই ক্ষতি যে কতো বড় ক্ষতি ...।
(আর লাইসেন্সের ব্যাপারটা! আজকের পত্রিকায় দেখলাম ২০০৯ সালে ১০,০০০ লাইসেন্স দক্ষতার পরীক্ষা ছাড়াই দিয়ে দেয়া হয়েছে... আর সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের মিটিং ডাকা হয়েছিল পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স দেয়ার জন্য... হোয়াট অ্যা জোক!)
অডিও রেকর্ডটা সচলায়তনের প্রকাশ করে দিন প্লিজ। কারিগরী সহায়তা লাগলে আমাকে ইমেইল করবেন অনুগ্রহ করে, udvranto এট জিমেইলে।
:(
ব্যানারটার জন্য কর্ত্রিপক্ষকে ধন্যবাদ।
অনেক কষ্ট নিয়ে লেখাটা পড়লাম...আপনার যেকোনো লেখাই ভালো লাগে স্যার...আরো লিখবেন সচলে...
nawarid nur saba
আমার সৌভাগ্য যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে এমন বেশ কয়েকজন শিক্ষক পেয়েছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার করেও যাদের শিক্ষা প্রতিনিয়ত কাজে লাগছে। দূরে থেকেও যারা এখনও শিক্ষা দিচ্ছেন। কিন্তু একইসঙ্গে, আপনার এই লেখা পড়ে মনে হচ্ছে, আরো কিছু শিক্ষককেও মিস করেছি। আশফাক মুনীর স্যারের জন্য এখন কেবল হাহাকারই করা সাজে আমার। আর আপনার জন্য সান্তনা। স্যার, আমি বুঝতে পারি, আপনার নিজের বেদনা আরো বেশি।
অভিনন্দন!
অনেক অনেক ধন্যবাদ। আনন্দিত বোধ করছি।
সচলাভিনন্দন!
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
আপনি এতোদিন সচল ছিলেন না?
না; গতকাল পূর্ণ সচল হয়েছি।
নতুন মন্তব্য করুন