“যদিও আকাশ ধোঁয়াশায় ম্রিয়মান/ তোমার জন্য লিখছি প্রেমের গান”
......কবীর সুমনকে কোট করলাম। যতদূর এগিয়ে চলে সময়ের ব্যপ্তি, ভেসে যায় আমার জীবন। যতবার সুন্দরকে দেখতে চাই, অসুন্দর তার তির্যক পাছা দেখিয়ে দেয়। আমি আমার লেখার প্রথম পর্যায়ে আমার ঠাকুমার কথা বলছিলাম।উনার কিংবা উনার মতো আরও অনেক ঠাম্মারা আছেন যারা জাত নিয়ে নিয়মিত জুয়া খেলেন। এই শ্রেণীর মানুষরাও ধর্মভেদাভেদিদের তালিকার একটা বিরাট পার্ট। অন্যদের মানসিকতার কথা ভালো ভাবে বলতে না পারলেও ঠাম্মার ব্যাপারটা আমি হয়তো এখন খানিকটা রিয়েলাইজ করতে পারি। ৪৭, ৭১, এবং সর্বশেষ ৯১ এর বিড়ম্বনা তিনি দেখেছিলেন। আমি এই তিনটাকে তিন যুগ বলে ধরি। আমার পৈতৃক ভিটা নাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। আমি যাইনি কখনও। আগরতলা থেকে তো শুনেছি ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগে। আমার ঠাকুমার ভেতরের বোধের পরিবর্তন মনে হয় ভিটেমাটির ছিন্নতার ফল।
কতবার দেখেছি ছেলেবেলায়, সকাল সকাল বাড়ির সবাই চা আর মুড়ি দিয়ে ব্রেকফাস্ট করছে – তখন ছোট্ট একটা আড্ডা জমতো। নানা কথার ফাঁকে চলে আসতো বাংলাদেশের কথা। কিংবা কত সন্ধ্যা বেলায় লোডশেডিং হয়ে গেলে ঠাম্মা দাওয়ায় বসে গল্প করতেন। এর বেশীর ভাগটাই জুড়ে থাকত বাংলাদেশের কথা। হালকা হ্যারিকেনের আলোতে আমার ঠাকুমার কাতর এবং অশ্রুশীতল ছবিটা আমি কোনদিনও ভুলতে পারবোনা। যখন গল্প বলতেন তখন আশ্চর্যজনক ভাবে মুসলমান বিদ্বেষ উধাও হয়ে যেতো। পদ্মার ইলিশ, বাংলার পূর্ণ প্রকৃতির ছোঁয়া, সবুজের দর্পণ, পুকুরের সোঁদা মাটির গন্ধ, বাংলার মাটির ধান, নদীর কলতানকে ঠাম্মা ভয়ানক ভাবে মিস করতেন।এই ভাবনার অবতরণিকায় তখন তার ভাষায় কিংবা মানসিকতায় কোনো জাত বিদ্বেষ আমার চোখে পড়েনি। দাদুর অনেক মুসলমান বন্ধুদের তিনি নিজ হাতে রেঁধে খাইয়েছেন- এই কথাটাও আমি অনেক পরে জেনেছি। চিটাগাং,বরিশাল, নোয়াখালি ইত্যাদি নানা জায়গা থেকে দাদুর পেশেন্টরা আসতেন। এদের অনেকেই মুসলিম সম্প্রদায়ের, রাতে বাড়ি ফিরতে পারতেন না অনেক সময়। কিন্ত তাদের স্থান বাড়ির বাইরে হতোনা, ভেতরেই হতো। মিয়া ভাইয়েরা ডাক্তার বাবুর কাছে আসার সময় কত রকমের গিফট নিয়ে আসতেন সে কথাও আমি ঠাকুমার মুখেই শুনেছি। ইলিশ, নলিনি গুড়ের নাড়ু, বিন্নি ধানের চাল আরও কত কি......... কিন্তু ৭১ এর পরের কথা বলতেই ঠাম্মার মুখ বিষে ভরে উঠত। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত উনি শান্তিতে ছিলেন না। ভিটেমাটি হারানোর বেদনা তিনি মেনে নিতে পারেন নি। পারেন নি ভুলতে তার সোনার বাঙলার পবিত্র মুখ। ঠিক এমনটাই হয়েছিলো আমার মার মায়ের সাথেও, আমার দিদিমা। ছেলেকে(আমার মেজো মামা ) পাঠিয়ে ছিলেন জমি দেখে আসতে ওপারে...... এখন দিদিমার বয়স ৮৫, এখনো ছেলের সজীব মুখটার সন্ধান করেন...।
৭১ এর পর দলে দলে উদ্বাস্তুর স্রোত এখানে এসে বাতাসকে ভারি করে তুলে। আর ৯১ এর কিছুটা স্রোত আমি নিজেও দেখেছি। ............... আমার দেশের ১২০ কোটিও কতটা উদার হতে পেরেছে। জাতপাতের নামে উত্তর ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে, বিহার, ঝাড়খণ্ড, প্রভৃতি অঞ্চলে যা এখনও চলছে তা আমার পক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সব শালারা একবিংশ শতকের নরকের মড়ক। ......... এদিকে গুজরাটে শুয়োরের বাচ্চা হারামি হিন্দু মৌলবাদীর দল মুসলিম মারে, কিংবা ধর্মের ধ্বজা মাথায় তুলে নিয়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে; আর ওপারে লুঙ্গিওয়ালারা কোমর বাইন্ধ্যা নাইম্যা পড়েন এই বলে,- আমাগো ভাইয়েরারে কাটছে, এবার আমরা কাটুম... স্লোগান উঠে : হিন্দু বাঙালি ধর ,ধইরা ধইরা কোতল কর। চোখের জল লবণের স্বাদ হয়ে নেমে আসে।
এই দুই বাংলার বাইরে এদের আশেপাশেই আরেকটি বাঙলার অবস্থান। এইটা হল তৃতীয় ভুবন। যে ভুবনর কথা – বাকি দুই ভুবনের মানুষজন ঠিকভাবে জানেনও না।আমি এখানেই জন্মেছি। এটাই আমার ভুবন। ভারতবর্ষের উত্তর পূর্বাঞ্চল। আমি পাহাড়ি মানুষ। তাই জাতপাত মাথায় ঢুকেনা। আমি তো একটা বদ-জাত কিংবা বজ্জাত, তাই ধর্ম কথা মাথায় যায়না। আমার ধর্ম নাকি হিন্দু, ভালোবাসি একটা মুসলিম মেয়েকে( জানিনা আমার পরিণতি কোথায়), আমার জাত নাকি বাঙালি, কিন্তু আমি মাছে ঝোলে অভ্যস্ত নই, আমার প্রচুর পরিমানে খ্রিষ্টান বন্ধু, কতবার গির্জায় গিয়েছি খৃস্টমাসের রাতে, কিংবা এমনও হয়েছে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে নিভৃত ম্রিয়মান হয়ে গেছে আমি আমার এক বোদ্ধিস্ট বন্ধুর সাথে বসে রয়েছি তাদের মঠে। কই আমার জাতকে কোথাও খুঁজে পাইনি......
রেপ কথাটা শুনলেই ক্যামন যেন একটা গা রিনরিন ভাব এসে যায় ভদ্র মানুষের মনে, তাই না। তবে আমি রেপ করেছি। নিজের ভেতরের নষ্ট ভণ্ড ধর্মাচারকে, জাতের ব্যাভিচারকে । বহু বার করেছি, ভবিষ্যতে আরও করব। আর আমার মতো একজন কুলাঙ্গার পারলে, আপনারা কেউ পারবেন না। আসুন না হাত বাড়াই আর সবাই মিলে জাতের গণ ধর্ষণে সামিল হই.........
শেষে আবার সুমনের কাছে যাই......
আমার
“সব অভিমান আকাশের চেনা চেনা
সবার জন্য সুদিন কি আসবেনা
উত্তর চেয়ে আকাশ পেতেছে কান
আমিও বেধেছি আমার প্রেমের গান।” তারপর...............
আগরতলা
আগস্ট, ১৮।২০১১
মন্তব্য
পাড়াত ভাই দেখি! আমারও আদি বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া!
সিরিজটার দিকে লক্ষ্য রাখছি, চলুক।
এ পর্বে ঠাকুমা-দিদিমার বেদনা কিংবা হারানোর ঘটনা প্রবাহ আরেকটু বিশদে হলে ভাল হতো।
পড়ছি। আগ্রহের সাথে
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
এবার ভাল হয়েছে। তবে দিগন্ত বাহার যেমন বললেন, কাহিনীগুলো আরো বিশদে বলুন, আপনার হাত যখন ভাল, ওগুলো পড়তে আকর্ষণীয় লাগবে।
এই বাক্যটায় কিছু একটা পরিবর্তন হবে, যতিচিহ্ন বা অন্য কিছু...
আমি, আমরা, বিদেশী বন্ধুদের কাছে কথা উঠলে বলি, culturally I'm Hindu to some extent, but overall an atheist. আপনি চাইলে তেমন কিছু বলতে পারেন।
আমি অবশ্য কেউ ধর্ম কি জিজ্ঞেস করলে বলি "I am a human and nothing else matters"... তবে তার ঝামেলাও আছে, হুয়াওয়ের এক চৈনিক এটাকে নতুন ধর্ম ভেবে একটু অতি উৎসাহী হয়ে উঠেছিলো
আর আমার মতো একজন কুলাঙ্গার পারলে, আপনারা কেন পারবেন না?
আর আমার মতো একজন কুলাঙ্গার পারলে, আপনারা কেউ পারবেন না!
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে কৌস্তভ। আর আমার মতো একজন কুলাঙ্গার পারলে আপনারা কেউ পারবেন না - এই বাক্যটা এই রকম হবে। এন্ড আমিও আজ থেকে বলব, culturally I'm Hindu to some extent, but overall an atheist.
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ অপছন্দনীয়
১। এই পররবে অভিবাসীর মনকষ্ট ঠিক ঠিক উঠে এসেছে। কারন যাই হোক, যারা দেশ পেছবে ফেলে আসে, তাদের পেট পোড়আবেই।
২। জন্মসুত্রে আপনার প্রপিতামহী ও তাঁর সন্তানেরা বাংলাদেশী। তাঁরা তাদের নাগরিকত্ব ও দেশে ফেলে যাওয়া সম্পদাদীর পুনরাধিকার দাবী করতে পারেন। রিয়েল এস্টেট বুম ও থানাপর্যায়ে ভূমিতথ্য সুলভ হত শুরু করায়, এখন আর শুধু গায়ের জোরে জমি দখলে রাখা যাচ্ছে। যদি জমির অবস্থান বহুতল বাড়ঈ করার উপযোগী হয়, তাহলে অনেকক্ষেত্রেই রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার নিজের তাগিদেই সেই ধলাই, কঐলাশহর, কামালপুর থেকেও প্রকৃত মালিক ধরে এনে এনেছে।
৩। আখাউরা-আগরতলা সড়ক বাংলাদেশ-ভারত সীমানার একটি ব্য়াস্ততম বানিজইয়িক সড়ক। আগরতলায় অভিবাসী অনেকেই সীমানার কাছাকাছি এপাড়এর আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের সাথে নিবীড় যোগাযোগ রাখে। দিনপাশ নিয়ে জয়নগর চারনম্বর রাস্তার একটি বাড়ঈতে সদ্য় রান্নাকরা পোনামাছ-শাজনার তরকারি গরম থাকতেই এপারে আখাউরা রোড সংলগ্ন বাসায় এনে পরিবেশন করার গল্প বলতে পারি।
২। আগরতলা-মেলাঘর থেকে শুরু করে দক্ষিনের মানুবাজার, মানে জনঅধ্য়ুষিত পুরো পশ্চিম ত্রিপুরাই তো সমতলে। আগরতলায় থেকে আপনি নিজেকে পাহাড়ঈ বলছেন কেন?
যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকটা সহজ হলেও , এখন তো আর আগের মতো অবস্থা নেই দাদা। ইন্টারন্যাশনাল নানা সমস্যা আছে এখন। আর আমি নিজেকে পাহাড়ি বলেছি এই কারনে, যে আমার গোটা উত্তর পূর্বাঞ্চলই পাহাড়ে ঢাকা। আমি এখন আগরতলায় থাকি ঠিকই কিন্তু আমার জীবনের অনেকটা অংশ কেটেছে গ্রাম ত্রিপুরার পাহাড়ের কোলে।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ - দুর্দান্ত
যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে আপনার জন্ম কোন জেলার কোন শহরে?
না মনে করার কি আছে ভাই দুর্দান্ত । আমার জন্ম দক্ষিন ত্রিপুরার অমরপুর শহরের অঞ্চলবর্তী এক পাহাড়িয়া গ্রামে ।
আহ, দেওতামুরা রেঞ্জ এর ঝর্নাগুলো। ছবি থাকলে আপলোডাবেন, প্লিজ?
আচ্ছা দেওয়ার চেষ্টা করবো। আপনি কি করে এতো কিছু জানেন ?
, আমার গ্রামের বাড়িও আখাউড়া। আপনার দিদিমার মতো আমার দাদু আর বাবার অবস্থা একই। তারা ছিল ওইপাড়ে, ৬৭ বা এর কাছাকাছি সময়ে চলে এসেছে অদল-বদল করে। আমার দাদার কবর ওই পাড়েই। বাবা সেইদিন ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট করে আগরতলা দিয়ে আব্বার নানা বাড়ি গেলেন। ওখানে বাবাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় কিছু এখনো আছেন। এই পর্বটা পড়ে তাই বাবার কষ্টটা একটু বুঝতে পারলাম।
এমনটাই হয় স্বাধীন ভাই । বিভাজন শুধু আমাদের নয়, আমাদের জীবন বোধটাকেও কেড়ে নিয়েছে। এপারে আসা হয়েছে আপনার। আসবেন প্লিজ। ভালো লাগবে। আমার শুভেচ্ছা নেবেন।
এই বিষয়গুলোর প্লাটফর্ম ধর্ম; কিন্তু আমার কখনওই মনে হয় না ধর্ম ইসুটাই এর মূল কারণ
আমার হিসেবে এর গোড়াটা রাজনীতি আর রাজনৈতিক উচ্ছেদ
বিরোধীদের দূরে সরিয়ে এদলের ভোট ব্যাংক পরিশুদ্ধ করা
এর প্রয়োজনে ধর্ম হলে দোহাই উঠে ধর্মের; জাতি হলে দোহাই উঠে জাতির
০২
পড়ছি লেখাটা
হয়ত রাজনীতি পর্যন্তই আসবে আপনার আলোচনা
[url]মাহবুব লীলেন[/url] ভাই আমি আপনার একজন ভক্ত। আপনার লেখা খুব বেশী পরিমাণে আমি পড়িনি। এটা আমার দুর্ভাগ্য।আমাদের এখানে ঠিকঠাক পাওয়াও যায়না। আমার এক দাদার দৌলতে আপনার সাথে আমার পরিচয়। অনেক শুনেছি আপনার কথা। তারপর যখন নিম নাখারা এর গল্প গুলি সচলায়তনে সামনে পেলাম, সব গুলি একনাগাড়ে পরে ফেললাম। আমি অভিভূত , আপ্লুত , আপনার ভাষার জাদুতে, সাহিত্যের অভিলাসায়।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
* তবে রাজনীতির প্রসঙ্গে এখনই আসতে চাইছিনা। তবে ফিউচারে লিখব আশা করি।
আমার ঠাকুরমা বলতেন 'হিন্দুস্থানে আইয়া নতুন জনম নেউয়া লাগলো' মানে সব কিছুই নতুন করে শুরু করতে হলে ......
নতুন মন্তব্য করুন