গণ-আন্দোলন পৃথিবীতে কম হয়নি। সাধারণ মানুষের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে গিয়েছে তখনই মানুষ রুখে দাড়িয়েছ। গণ-রোষ হয়েছে মিশরীয় সভ্যতায়, গ্রীক সভ্যতায়, মধ্য যুগে, রেঁনেসার যুগে, আধুনিক সময়ে, উত্তরাধুনিক সময়ে। কে জানে, হয়তো গণ-রোষ হয়েছিল আমাদের আদি মানব সভ্যতাগুলোতেও। কিন্তু প্রতিবারই সেই গণ-জাগরণের সুফল কেড়ে নিয়ে যায় মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। ধর্মের নামে নিয়ে যায় ধর্মাবতারেরা, বিশুদ্ধ রক্তের নামে নিয়ে যায় রাজারা। সাম্যের নামে নিয়ে যায় সাম্যবাদীরা, বুদ্ধির নামে নিয়ে যায় বুদ্ধিজীবিরা। পুঁজির নামে নিয়ে যায় পুঁজিবাদীরা, আর গণতন্ত্রের নামে নিয়ে যায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা।
উপরোক্ত মতবাদগুলোর কোনটাই সাধারণ মানুষকে রিপ্রেজেন্ট করে না। সাধারণ মানুষকে দমিয়ে রাখতে সব সময় একটি কথা সামনে আনা হয় যে সাধারণ মানুষ তার নিজের ভালো মন্দ বিচারের ক্ষমতা রাখে না। তাই উন্নত শ্রেণীর কাউকে না হয় কাউকে সেই কাজটুকু করতে হবে। কথাটুকুর মাঝে সত্যতা কতটুকু রয়েছে? গণতন্ত্র ও এর সমালোচনা (Democracy and Its Critics by Dahl, R. A.) এই বইটিতে এই দিকটি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে যার কিছু আমি আমার গণতন্ত্রের ইতিবৃত্ত এই লেখায় তুলে ধরেছিলাম। বুদ্ধিমত্তার বিচারে, কিংবা শারিরীক গঠনে মানুষে মানুষে পার্থক্য থাকবে প্রাকৃতিক নিয়মে কিন্তু তাতে কারোর নৈতিকতা অন্য একটি মানুষের তুলনায় উন্নত হয়ে যায় না। তাই এমন কোন উন্নত শ্রেণী নেই যারা সাধারণ মানুষের হয়ে তাদেরকে শাসন করার মত যোগ্যতা রাখে।
আমাদের বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রূপটি হলো রিপ্রেজেন্টেটিভ গণতন্ত্র বা প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র। এই ব্যবস্থায় আমরা আমাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করি আমাদের হয়ে শাসন কার্য পরিচালনা করার জন্যে। কিন্তু বর্তমান রিপ্রেজেন্টেটিভ ব্যবস্থাটি সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ হচ্ছে, যার কারণ সেই রিপ্রেজেন্টেটিভ ব্যবস্থার মূলেই রয়েছে। জনপ্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় জনগণের ক্ষমতা সীমিত, শুধুমাত্র প্রতি চার/পাঁচ বছরে দুই চোরের মধ্যে মন্দেরভালো চোরকে বেছে নেওয়ার। এছাড়া আর কোন ক্ষমতা নেই। এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই আইন প্রণয়ন করে, এবং বলাই বাহুল্য তারা সেই আইনই প্রণয়ন করে যেগুলোতে সাধারণ মানুষের কন্ঠকে রোধ করা যায়, আর নিজদের ভাগ্যকে উন্নয়ন যায়।
আজকের বর্তমান রিপ্রেজেন্টেটিভ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বরূপ এমন যে সে সাধারণ মানুষের জেগে উঠাকে মেনে নিতে পারে না। রাষ্ট্র তার সকল শক্তি ব্যবহার করে সেই জেগে উঠাকে রোধ করতে। এমনই চিত্র আমরা দেখতে পাই, আমাদের দেশে, পার্শ্ববর্তী দেশে, এমনকি পাশ্চাত্যেও। ফেইসবুক স্ট্যাটাস রোধে হাইকোর্টের আচরণ, ভারতে আন্না হাজারেকে অনশণে বাধা দেওয়া, কিংবা উইকিলিক্স বন্ধে আমেরিকা ও তার দোস্তদের চেষ্টা সেইসব উদাহরণের খন্ডাংশ।
আমি এটিকে দেখি রিপ্রেজেন্টেটিভ ডেমোক্রেসী বনাম ডিরেক্ট ডেমোক্রেসীর দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই ছিল, কিন্তু ক্ষুদ্র স্কেলে। সাধারণ মানুষের সংগঠিত হবার সূযোগ ছিল কম, নিজেদের মধ্যে মতবিনিময়ের সুযোগ ছিল কম, তথ্যের অবাধ বিচরণ ছিল কম। আজ ব্লগ, ফেইসবুক, ইউটিউব, উইকিলিক্স, সর্বোপরি ইন্টারেন্ট/মোবাইলের যুগে এই দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ মানুষের জন্যে সহজ হয়ে উঠেছে। এরই বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আজ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই দেখি সাধারণ জনগণের জেগে উঠার চিত্র। আধুনিক গণতন্ত্রের রূপদানকারী দেশ বৃটেনেও আজ মানুষ ক্ষোভে দাঙ্গায় নেমে পড়ে। আমেরিকাতেও জনগণ রাজনীতিবিদদের তামাশা দেখতে দেখতে হতাশ। একই হতাশার বহিঃপ্রকাশ দেখি তিউনিসিয়া, মিশরের মতো দেশগুলোতে।
সাম্প্রতিক ঘটনায় আমাদের দেশের মানুষও ক্ষেপে উঠেছে এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে। বুদ্ধিজীবিদের একাংশ প্রায়ই জনগণকে দোষারূপ করার চেষ্টা করে দেশের বর্তমান অবস্থার জন্যে। কিন্তু এই দেশের মানুষই ভাষা আন্দোলনের সময় জেগে উঠেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় জেগে উঠেছে, স্বৈরাচারী আন্দোলনের সময় জেগে উঠেছে। আমার দৃষ্টিতে তারা সব সময়ই সচেতন ছিল, এবং আছে। কিন্তু যে কথাটি বলেছি, প্রতিবারই জনগণ তার দায়িত্ব শেষের পরে অবাক হয়ে দেখে যে তার উপর আমরা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র নামক উপহাস চাপিয়ে দিয়েছি। মিশর আর তিউনিসিয়ার চিত্রটি দেখুন। গণ-আন্দোলন সফল হওয়ার পরেও মানুষ প্রকৃত ক্ষমতা লাভ করতে পারছে না। প্রতিটি আন্দোলনে সাধারণ মানুষই রক্ত দেয়, আর তার সুফল ভোগ করে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। তাই যেটি করতে হবে এই সাধরণ মানুষগুলোকে বিশ্বাস করতে হবে। তাদের উপর আস্থা রাখতে হবে। তাদের উপর আস্থা রেখে একটি সরাসরি গণতন্ত্রমূলক + প্রতিনিধিমূলক সরকার পদ্ধতিতে যেতে হবে। আজকের ইন্টারেন্ট/মোবাইল প্রযুক্তির যুগে এটি কোন অসম্ভব/অবাস্তব বিষয় নয় এবং আমার মতে এটি শুধু সময়ের ব্যাপার।
কেমন হতে পারে এই সরকার? এই সরকার হবে সাংবিধানিক প্রজাতান্ত্রিক সরকার। অর্থাৎ প্রজাতন্ত্রের সকলে সংবিধান অনুসারে চলবে, যা বর্তমান ব্যবস্থার মতই। কিন্তু এই সংবিধান পরিবর্তনের ক্ষমতা কেবল মাত্র জনগণের হাতে থাকবে। সেই সাথে রাষ্ট্রের মৌলিক স্তম্ভগুলো ঃ বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ, সংসদ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ বিভাগ, সামরিক বিভাগ ইত্যাদীর প্রধান সরাসরি জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হবে যারা সংবিধান অনুসারে স্ব-স্ব বিভাগ পরিচালনা করবেন। যে কোন সময়, যে কোন মুহুর্তে, যে কোন বিভাগের প্রধানকে অপসারণের ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকবে, এবং তা অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠ কিংবা ৬৭ বা ৭৫ ভাগ ভোটের মাধ্যমে হবে।
প্রতিটি বিভাগ তাদের নিজস্ব নীতিমালা তৈরী করতে পারবেন এবং সেই আলোকে নিজ নিজ বিভাগ পরিচালনা করতে পারবেন, কিন্তু কোন নীতিমালাই সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না। এর ফলে রাষ্ট্রের প্রতিটি কর্মের জন্যে জনগণের কাছে যেতে হচ্ছে না, (যেটি সরাসরি গণতন্ত্রের একটি প্রধান দুর্বলতা)। কেবল মাত্র কোন নুতন আইন করতে হলে যা সংবিধান আপডেট করা ছাড়া সম্ভব নয় সেই সব বিষয়ের ক্ষেত্রে জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে করতে হবে এবং আজকের ইন্টারেন্ট/মোবাইল এর যুগে সল্প সময়ে একটি গণভোটের আয়োজন অসম্ভব কিছু নয়।
ব্যক্তি মানুষের চিন্তা/ধারণা সময়ের সাথে দ্রুত বদল হয়, কিন্তু মাস পিপলের পরিবর্তন সে তুলনায় কিছুটা ধীর গতির হয়। সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা মানুষের চিন্তা অনেক সময় উন্নতর হলেও সেটি গ্রহণে যদি মাস পিপল তৈরী না থাকে সে ক্ষেত্রে মাস পিপলের উপর সেটি চাপিয়ে দিতে গেলে যদি তারা বিদ্রোহ করে বসে তার জন্যে মাস পিপলকে দোষ দেওয়া যায় না। একই কথা প্রযোজ্য একটি শিশু বা কিশোরের ক্ষেত্রে। যদি একজন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তি তার নিজের বুঝ চাপিয়ে দিতে চায় একটি শিশু/কিশোরের উপর সেটি সব সময় কার্যকর নাও হতে পারে। অনেক সময় সেটি সেই শিশু/কিশোরের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। মাস-পিপলকে সেভাবেই দেখতে হবে। অনেক সময় শিশুকে নিজের মতো করে বড় হয়ে উঠতে দিতে হয়, এবং তখনই আমরা পেতে পারি একজন সুস্থ মানসিকতার শিশু। তেমনি ডিরেক্ট ডেমোক্রেসির দ্বারা একটি মানব গোষ্ঠীকে চলতে দিলে তারা সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়ে একটি সুস্থ সিস্টেম গড়ে তুলতে পারবে নিজদের জন্যে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে এই ব্যবস্থায় সকল সংঘর্ষ দূর হয়ে যাবে তা নয়। এই ব্যবস্থাতেও সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিংবা ব্যক্তি বনাম গোত্রের দ্বন্দ্ব রয়েই যাবে। গোত্র চাইবে ব্যক্তিকে রোধ করতে বা সংখ্যাগরিষ্ঠ চাইবে সংখ্যালঘুকে নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব বিবর্তনের নিয়ম অনুসারেই মিমাংসিত হবে। সংখ্যালঘু যদি সংখ্যাগরিষ্ঠকে কিছু চাপিয়ে দিতে চায় সে ক্ষেত্রে যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠ একদিন প্রতিবাদ করে, তেমনি সংখ্যাগরিষ্ঠ যদি প্রতিনিয়ত সংখ্যালঘুকে দমিয়ে রাখতে চায় তবে তারাও একদিন প্রতিবাদ করে উঠবে। বারংবার সংঘর্ষের পরে দু’দলই বুঝে যে দু’পক্ষই সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে যদি তারা একটি সমঝোতায় আসে, যা বর্তমান আধুনিক জনগোষ্ঠী এর মধ্যেই জানে। তাই আমরা সংবিধানে দেখতে পাই ক্ষুদ্র-জনগোষ্ঠিকে রক্ষার্থে আইন।
ডিরেক্ট ডেমোক্রেসী ধারণা বর্তমানে একেবারে অপ্রচলিত তা নয়। সুইজারল্যান্ডে এটি আছে এবং আমেরিকার ২৪ টি প্রদেশে এই পদ্ধতি আছে। তাই আমাদের দেশেও এটি সম্ভব। জনপ্রতিনিধিদের জবাবদীহিতা নিশ্চিত করার জন্যে ডিরেক্ট ডেমোক্রেসীর বিকল্প দেখি না আমি। একটি মৌলিক পরিবর্তন ব্যতীত আমি বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন দেখি না। না হলে হাসিনা, তারপরে খালদা, তার স্থলে এরশাদ বা বামদল কিংবা তৃতীয় শক্তি যাকেই আনা হোক না কেন এই অবস্থা থেকে মুক্তি কোন নেই। যারা পরিবর্তনে দৃঢ়বদ্ধ তারা সংঘবদ্ধ হোন একটি মৌলিক পরিবর্তনের আশায়, শুধু সরকার পরিবর্তনের আশায় নয়।
সবার উম্মুক্ত আলোচনা আশা করছি।
মন্তব্য
খুবই ইন্টারেস্টিং লাগল আইডিয়াটা। আমি আমার দুই পয়সা যোগ করছিঃ
১। রিপ্রেজেন্টেটিভ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র অনেকটা ধর্মব্যবসার আদলে চলে বলেই ধারণা করি।
সাধারণ মানুষদের শুরুতেই বুঝিয়ে দেয়া হয় তারা অযোগ্য (ধর্মের ক্ষেত্রে বলা হয়-- তারা পাপী বান্দা)। তাদের 'সুপথে' চালিত করতে কিছু নির্বাচিত মেষশাবকের প্রয়োজন। মুশকিল হল, মেষশাবকেরা নির্বাচিত হওয়া মাত্র জনগনের লোম বাছতে শুরু করেন। সুপথে পরিচালনার চেয়ে, তাদের উল দিয়ে কোট বানানোটাই প্রিয়তর মনে হয় এদের কাছে।
২। মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক অস্থিরতার পেছনে গণ-মানুষের কোনঠাসা হয়ে পড়ার কারণের পাশাপাশি আরো কিছু ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবক কাজ করেছে বলে মনে হয়। মিশরের অধুনাখ্যাত প্রায়-রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান গণতন্ত্র-পিয়াসী অনেক জাতিগোষ্ঠীর কাছেই একটি আলোকবর্ত্তিকা হয়ে জ্বলছে। প্রশ্ন হল, আমাদের দেশে এমনটি ঘটার সম্ভাবনা কেমন ও কতটুকু?
ক) হাম্বালীগ
খ) বিম্পি
গ) (সবচেয়ে ভীতিকর সম্ভাবনা) এছলামী মৌলবাদী জোট
ঘ) স্বতন্ত্র প্রার্থী
এতদিনের ইতিহাসে আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রাঙ্গনে যে তিনটি মূলধারার রাজনৈতিক দল আছে, তাদের দুইটির জন্ম ক্যান্টনমেন্টে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এই মুহূর্ত্তে দেশে একজন লোকও খুঁজে পাওয়া হয়ত যাবে না, যাঁকে জনগন চোখ বুঁজে তাদের মেষপালক হিসেবে নির্বাচিত করতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো সচেতন ভাবে এইসব ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক বিবর্তন অংকুরে বিনষ্ট করেছে---যাতে করে আমাদের সামনে অনন্তকাল ধরে যেন এই চেনা ক'টি চয়েসই থাকে। ক্ষমতা যেন 'ভাবী আর বোনের' মাঝেই সব সময়ে পূনর্বন্টিত হয় এমন একটা ব্যবস্থা এরা করে ফেলেছেন এর মাঝেই। তৃতীয় যে শক্তিটি আছে, সেইটি নিয়েই আমার বেশি ভয়। কোনঠাসা হতাশ মানুষের সামনে চিন্তা-ভাবনার সুযোগ থাকে না। ডুবন্ত মানুষ খড়কুঁটো পেলেও আঁকড়ে ধরে। আমাদের সেই ডোবার সময়ে খড় হয়ে যদি মৌলবাদীরা এগিয়ে আসে, আমরা কী করব তখন?
১) প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের ধারণাটা এখন পর্যন্ত জনগনের কাছে সম্পূর্ণ অলীক না হলেও ঝাপসা তো বটেই।
২) মানুষকে গণতন্ত্রের দুই ধরণের সুবিধা অসুবিধা সম্পর্কে জানানোর দ্রুততম উপায় হল, মিডিয়ার
সচেতন অংশগ্রহন। মিডিয়াগুলো এখন পর্যন্ত নিজ নিজ খোঁয়াড়ের গু পরিবেশনে সচেষ্ট। অন্য পাড়ার
ফুল তাদের কাছে গোছানো কষ্টকর।
৩) ২০০৮ এ হাম্বালীগের প্রত্যাবর্তন আমার জন্যে একটা বিরাট স্বস্তির খবর ছিল। কারণ, আমি খুব খুবই
ভীত ছিলাম যে হতাশ জনগন মৌলবাদী গোষ্ঠীকে না ফিরিয়ে আনে। আমার মনে হয়েছিল, আমাদের
পিঠ থেকে গেছে এবং 'ডুবন্ত-মানুষ' থিওরীতে খড়কুটো হিসেবে মৌলবাদীদের না ধরে ফেলি আমরা!
আমি পরম প্রীত হয়ে লক্ষ্য করেছি---আমার দেশের লোকজন তাদের জাত চিনিয়েছে। আমাকে শক্ত
একটা নাড়া দিয়ে দেশ দেখিয়ে দিয়েছে কেন এখনো এই দেশটা নিয়ে আমি গর্ব করতে পারি।
আমার দেশ হল এমন দেশ যা সারা বিশ্বের মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ধর্ম শেষ কথা
নয়। ধর্ম দিয়ে আমাদের ভুলিয়ে রাখা যাবে না। হ্যাঁ, আমরা সেই দেশের লোক, যাঁরা দেখিয়ে দিয়েছি
শুধু ধর্মের উপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা হাস্যকর দ্বিজাতিতত্ত্ব কতটা ব্যর্থ ধারণা! আমরা দেখিয়েছি
সংস্কৃতির জোরটা আমাদের হৃদয়ের কতটা গভীরে প্রোথিত!
৪) প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের যে জাতিগত ম্যাচ্যুরিটি দরকার সেইটা আমাদের নেই-
এমনটা আমি বলব না। আমি বলব, যে ধারণার আমাদের যথেষ্ট পরিমান পরিচিতি নেই। এবং আমরা
জাতি হিসেবে খুব দ্রুত অ্যাডাপ্ট করে নিতে পারি যেকোন কিছুর সাথে। প্রশ্ন হল কেবল ধারণা নয়----
আমাদের কিছু কাঠামোগত সংস্কার সাধনও প্রয়োজন।
৫) প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের অন্যতম ভীতিকর দিক হিসেবে যেটা বলা হয়, যা আপনি উল্লেখ করেছেন লেখায়,
সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত সংখ্যালঘুর উপরে চাপিয়ে দেয়া---সেটা যেকোন সিস্টেমেই উপস্থিত। এই
পরিস্থিতি সফল ভাবে মোকাবেলা যারা করেছে উদাহরণ স্বরূপ সুইজারল্যান্ড, আম্রিকা---এদের ধরন
আমরা পর্যালোচনা করে দেখতে পারি।
আপনার বিশাল ও সুচিন্তিত মতামতের জন্যে অনেক ধন্যবাদ অনিকেত'দা। আপনার মন্তব্য লেখাটিকে সমৃদ্ধ করেছে। মন্তব্যের সাথে খুব বেশি দ্বিমত নেই।
মন্তব্যে
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
পাঁচ নম্বরটাই সবথেকে বড় ভয়। হিটলার কিন্তু গণভোট আয়োজন করেই ক্ষমতায় এসেছেন ও পরে জার্মানীকে যুদ্ধে নামিয়েছিলেন। গণতন্ত্র যাতে ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর দিয়ে না চলে সেই বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ - অর্থাৎ কতটা রাষ্ট্রের হাতে থাকবে আর কতটা থাকবে না। ধরা যাক টেলিফোনে আড়ি পাতার ব্যাপারটা - জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আড়ি পাতা মেনে নেওয়া হবে না হবে না? এর ওপরে আছে জনগণকে মিথ্যা বোঝানো, প্রোপাগাণ্ডা ওয়ার ও মিডিয়াবাজী। এসবের জন্যই আপনার সিস্টেমে একটা সংবিধান থাকা দরকার।
পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।
সেটার কিন্তু সহজ সমধান সিস্টেমের মধ্যেই আছে। সেটা হচ্ছে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। যদি গণভোটে জিতে আসা এক ব্যক্তির হাতে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে সে সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করবেই। কিন্তু আমি যে মৌলিক সাতটি কাঠামোর কথা বলেছি সেগুলোতে যদি ভিন্ন ভিন্ন নির্বাচিত ব্যক্তি থাকে, এবং যে কাউকে যে কোন সময় অপসারণ করা যায় সেক্ষেত্রে কারো একক ক্ষমতা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এখন কি হচ্ছে এক প্রধানমন্ত্রীর হাতে সব ক্ষমতা, যে কারণে রাজনীতি থেকে শুরু করে প্রশাসন পর্যন্ত সর্বস্তরের কার্যক্রম প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে। রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতিকমিশন, সামরিক বিভাগ, পুলিশ বিভাগে সব কয়টি বিভাগের প্রধান নিয়োগ দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রী দ্বারা। যার ফলে রাষ্ট্রে সেই এক নায়কতন্ত্রই দেখা যায়। আবার এখন কি হচ্ছে এই সকল ব্যক্তিকে অপসারণ করতে হলে আরেক নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। পুরো প্রশাসন, সিস্টেমকে প্রতিস্থাপিত করতে হচ্ছে, তার আগে কিছু করা যাচ্ছে না। ডিরেক্ট ডেমোক্রেসির ফলে এবং প্রযুক্তির সাহায্যে যে কোন মুহুর্তে যে কেউকে অপসারণ করে নুতন একজনকে প্রতিস্থাপিত করা যাবে, সবাইকে একত্রে প্রতিস্থাপনের দরকার নেই। এতে যেটা হবে একটি ধারাবাহিকতা থাকবে প্রশাসনে। আজকে কি হচ্ছে, একবার লীগের প্রশাসন আসছে পরের বার বিনপির প্রশাসন আসছে। একদল এসে আগের সব কিছু ছুড়ে ফেলে দিয়ে নুতন থেকে শুরু করে। কোন ধারাবাহিকতা থাকছে না। এর ফলে আমাদের যতটুকু প্রবৃদ্ধি অর্জন করার কথা তার কিছুই হচ্ছে না।
আমি রাজনীতিসচেতন নই, খুব একটা প্যাঁচঘোঁচ বুঝিও না। কিন্তু যেভাবে ক্রমাগত একদল এসে পূর্বসূরির সমস্ত রেকর্ড ভাঙছে তাতে এই আশঙ্কাটা থেকে কিছুতেই মুক্ত হতে পারি না। এই প্রথা যদি চলতে থাকে আজ হোক কাল হোক লোকজন এই তিন নম্বর বিকল্প বেছে নেবেই। দুইবার, হয়তো তিনবার তারা দেখিয়েছে তারা এদেরকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে- কিন্তু আর কতবার? সবারই তো ধৈর্যের সীমা আছে।
লেখাটা ভাল লেগেছে। এই বিষয়ে জ্ঞান কম, তাই খুব গভীরে কোন মন্তব্য করতে পারছি না। কিন্তু আপনার ব্যক্তি মানুষের সাথে গণ মানুষের কাঠামোগত তুলনাটা চমৎকার।
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
জিও দাদা। ব্যাপক আইডিয়া।
ফাহিমের কথার পুনরাবৃত্তি করলাম।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ... চমৎকার পোস্ট ... কিন্তু এই বিষয়ে গিয়ান কম বইলা আলোচনায় ঢুকলাম না। আলোচনা চলুক।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
আইডিয়া চমৎকার। তবে বেশ কিছু মডিফিকেশনের প্রয়োজন আছে মনে হয়। আর ইন্টারনেটের এমন প্রসারের যুগে ডিরেক্ট ডেমোক্রেসি অনেক সমস্যার সমাধান হতে পারে।
গণ-আন্দোলনের ফলস্বরুপ যে ভয় এর কথা বলেছেন, তার সাথে পুরোপুরি একমত। কিন্তু direct democracy এর বাস্তবায়ণ কিভাবে বা আদৌ সম্ভব কিনা সেটা বুঝতে পারছি না।
এছাড়া......আইন/নীতিমালা প্রণয়নের যে প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন এতে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ থাকছে সেটা ঠিক, কিন্তু আমাদের বড় সমস্যা তো আইন এর প্রয়োগে/বাস্তবায়নে, আইন প্রণয়নে নয়।বিভাগের প্রধানগুলো ও যদি আগের মানুষগুলোর মতই দুর্নীতি শুরু করে তাহলে এদের অপসারণ কিভাবে হবে "চেইন অব কমান্ড" ছাড়া?
উপরে একটি মন্তব্যে কিছুটা বলেছি। বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, ও দুর্নীতি কমিশন যদি স্বায়াত্বশাসিত থাকে সে ক্ষেত্রে যে কোন প্রধানকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই অপসারণ সম্ভব, এবং যদি দুর্নীতি্র প্রমান থাকে সেক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী বিচারও সম্ভব। এখন কেন হচ্ছে না? কারণ এই বিভাগগুলো স্বায়াত্বশাসিত নয়। এই বিভাগগুলোতে যাদেরকে প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাদেরকে দলীয় অনুগত্যের ভিক্তিতেই দেওয়া হয়। এ কারণে আইন থাকলেও তার প্রয়োগ হচ্ছে না। সুতরাং সমস্যাটার মূলে ধরতে হবে। এবং আমার মতে সমস্যার মূলে হলো সব ক্ষমতা এক প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকাটা। এর ফলেই আজকে আমাদের দুই মহিলার হাতে জিম্মি হয়ে থাকা। এর কারণেই পরিবারতন্ত্র হতে বের হতে পারছি না। এই কথা শুধু আমাদের দেশের জন্যে প্রযোজ্য তা নয়। ভারত/পাকিস্তান/থাইল্যান্ড সব খানেই দেখুন, বাপ মরলে ছেলে/মেয়ে, না হলে বৌ, না হলে ভাই/বোন, কেউ না কেউ এসে বসবেই।
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ শুধু এই মৌলিক কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। বিকেন্দ্রীকরণ হতে হবে আঞ্চলিক পর্যায়েও। যেমনঃ প্রতিটি জেলাকে একেকটি স্বায়াত্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে যেগুলোতে রাষ্ট্রের বেসিক কাঠামোগুলো থাকবে এবং তারা একই ভাবে সেই অঞ্চলের মানুষদের ভোটের মাধ্যমে সরাসরি নির্বাচিত হবে এবং তারা তাদের অঞ্চলের জন্যে নিজেদের নীতিমালা নির্ধারণ করবে। এভাবে বিকেন্দ্রীকরণের ফলে ক্ষুদ্র-জনগোষ্ঠীর অধিকারও নিশ্চিত করা সম্ভব।
রাষ্ট্রের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং আঞ্চলিক বিকেন্দ্রীকরণ এই দু'য়ের সংমিশ্রণে প্রত্যক্ষ্য গণতন্ত্র কার্যকর সম্ভব।
মন্তব্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ আপানার ব্যাখ্যার জন্যে
পুরোপুরি সহমত।
মন্তব্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ অপছন্দনীয়, ত্রিমাত্রিক কবি, তাপস শর্মা, ফাহিম হাসান, নিটোল।
প্রিয় সিদ্দিক-ই রব্বানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,
আমরা আপনার মন্তব্যটি পোস্ট আকারে পেয়েছি। সচলায়তনে একটি পোস্টের মন্তব্য পোস্ট আকারে আসা (মেটাব্লগিং) নিরুৎসাহিত করা হয়। আপনি অতিথি লেখক অ্যকাউন্ট থেকে লগ আউট করে মন্তব্য করুন। নামের ঘরে আপনার নাম ব্যবহার করুন। যদি কোনো এরর দেখায় তাহলে আপনার নামের সাথে (পাঠক) শব্দটি যোগ করে নিন।
আপনার সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত।
আপনার মন্তব্য/লেখা:
--------------------------------------------------------
সচলায়তনের লেখক স্বাধীন এর 'ডিরেক্ট ডেমোক্রেসী কি সমাধান হতে পারে?' লিখাটির প্রেক্ষিতে এ লিখাটি লিখেছিলাম, কিন্ত মন্তব্যের ঘরে আমার প্রবেশাধিকার নেই বিধায় এখানে সে মন্তব্যটি তুলে ধরছি।
স্বাধীন,
আপনার চিন্তার সঙ্গে আমার চিন্তার বেশ মিল পাচ্ছি। আমিও বলি যে গণতন্ত্র কথাটার মধ্যে সাধারণ মানুষ যে স্বপ্নটি দেখে আত্মোৎসর্গ করে, তাকে বার বারই হাইজ্যাক করে নিয়ে যায় ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী, বিভিন্ন নামে, বিভিন্নভাবে - যারা তখন এলিট বনে যায়। আর 'গভর্ণমেন্ট' কথাটির মধ্যেই এলিট শ্রেণী তৈরীর প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে যায়, মানুষকে শোষনের প্রক্রিয়া চলে আসে। যার জন্য আমি ডেইলী ষ্টার পত্রিকায় লিখেছিলাম যে আমরা Government চাই না, Facilitator চাই। এজন্য আমি বলে থাকি যে প্রচলিত ডেমোক্রেসী হচ্ছে Government of the Elites, for the Elites, by the Elites, - আব্রাহাম লিঙ্কন ভুল বলেছিলেন। আর একটি কথা হচ্ছে যে গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তিতে কিছু অবাস্তবতা আছে যার জন্য আমরা একটি অস্পষ্টতায় ভুগি আর এই সুযোগটির সদ্ব্যবহার করে নেয় সুযোগ সন্ধানীরা। যেমন, গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে সবাই সমান, সবাই 'রাজা', তাই সবাই দেশের শাসন করতে পারবে। তারপরই বলা হয়, সবাই তো শাসন করা যায় না, তাই ভোট দিয়ে 'প্রতিনিধি' নির্বাচন কর। এখানে খুব সূক্ষ্ম একটি মারপ্যাঁচ আছে খেয়াল করবেন। তাই জনগণের 'রাজা' হবার অধিকার রূপ নিল কেবলমাত্র 'ভোটাধিকারে' - এখানেই হাইজ্যাকের কাজটি সমাধা হয়ে গেল।
এখানে কয়েকটি জিনিস খেয়াল করা দরকার। গণতন্ত্রের মূল দার্শনিক ভিত্তি - 'সমাজের সবাই সমান' একথাটি অবাস্তব। সবাই সমান হতে গেলে প্রয়োজন হবে সবার সমান জ্ঞান, সমান অর্থনৈতিক অবস্থা, সমান বয়স, সমান লিঙ্গ - যা কখনোই সম্ভব নয়। এজন্যই পুরুষের আধিপত্যের কারণে নারীরা হাজারো বছর ধরে বঞ্চিত হয়ে আর প্রতিবাদ করে না, মুখ বুজে সয়ে যায়, নতুবা আত্মহত্যা করে। যেমনটি করছে বর্তমানের বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের কৃষকেরা।
আবার 'প্রতিনিধি' নির্বাচন করার পরই আমরা তাদেরকে বলছি 'নেতা'। নেতা আর প্রতিনিধি এক জিনিস নয়। যিনি 'প্রতিনিধি' নির্বাচিত হলেন তার কিন্তু নেতা হবার যোগ্যতা নাও থাকতে পারে। কিন্তু তিনি তখন নিজেকে নেতার মতই ভাবেন, আর জনগণও তার কাছে নেতার আচরণ আশা করে। আর যোগ্যতা বিহীন নেতার হাতে পড়ে দেশের ও মানুষের বেহাল অবস্থা হওয়াটাই স্বাভাবিক, যা আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। আসলে মানুষের সমাজের বিবর্তন দেখলে বোঝা যাবে আমরা কিন্তু অবচেতন মনে নেতৃত্বই খুঁজি। মানুষের সামাজিক উত্তরণে নেতৃত্বের প্রয়োজন আছে। তাই এটিকে পরিষ্কার করেই রাষ্ট্রদর্শন তৈরী হওয়া উচিৎ - যে জ্ঞানী ও যোগ্য নেতা খুঁজে তাকে নেতৃত্বের আসনে বসাতে হবে। তিনি নিজে যেচে এসে নেতা হতে চাইবেন না।
আধুনিক যুগের ইন্টারনেট ব্যবহার করে আমরা কিভাবে একজন রাষ্ট্রনেতা খুঁজতে পারি এর একটি সম্ভাব্য পদ্ধতি চিন্তা করে একটি পুস্তিকা লিখেছিলাম কয়েক বছর আগে, কিন্তু কাগজে ছাপানো হয় নি। তবে 'বৃত্তেরবাইরে' নামে আমার ব্যক্তিগত একটি ব্লগে আছে। ইংরেজীতে britterbaire লিখে Google search দিলেই পেয়ে যাবেন এটি। প্রথম প্রবন্ধটিই হচ্ছে এ বিষয়ে, বাংলায়। A new system of state নামের link এর মাধ্যমে। এ প্রবন্ধের উপর মতামত পেলে খুশী হব। এর আগেও সচলায়তনের মাধ্যমে এটির লিঙ্ক একবার দিয়েছিলাম। আরও প্রায় ৪৫ টির মত প্রবন্ধ আছে এতে, বিভিন্ন বিষয়ে।
ধন্যবাদ একটি ভাল চিন্তার জন্য। আমাদেরকে ভাবতে হবে, প্রচলিত ডেমোক্রেসীর বাইরে একটি বিকল্প ব্যবস্থা চিন্তা করতেই হবে. নাহলে গোটা পৃথিবীই আজ ডেমোক্রেসীর প্রবক্তা/এলিটদের হাতে পড়ে অনাবাসযোগ্য হয়ে পড়তে চলেছে।
সিদ্দিক-ই রব্বানী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আপনাকেও ধন্যবাদ সিদ্দিক-ই-রাব্বানী মন্তব্যের জন্যে। আপনার লেখাগুলো পড়ে মন্তব্য করবো অবশ্যই।
প্রিয় সিদ্দিক-ই-রব্বানী
আপনার "বাংলাদেশের জন্যে নুতন সরকার ব্যবস্থার সন্ধানে" লেখাটি পড়লাম। লেখাটির অনেক ক্ষেত্রেই আমার চিন্তার সাথে মিল রয়েছে, বিশেষ করে নীচ থেকে উপরমুখী ক্ষমতার বিষয়টি এবং প্রচলিত গণন্ত্রের সমস্যাগুলো। কিন্তু সমাধানে এসে আমি কিছুটা কনফিউজড। কনফিউজ এ কারণে যে আপনি নীচ থেকে উপরমুখী (অন্য কথায় ডিরেক্ট ডেমোক্রেসী), ব্যবস্থার কথা বলছেন কিন্তু একই সাথে আবার একজন যোগ্য নেতার প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরছেন। যোগ্য নেতার মাপকাঠি হিসেবে বেশ কয়েকবার শিক্ষার বিষয়টি আনছেন। আমার কাছে এটি স্ব-বিরোধী বলে মনে হচ্ছে (আমি নিশ্চিত নই এটা আমার বুঝার ভুল কিনা)।
আপনি সমুদ্রগামী জাহাজের উদাহরণ দিলেন, তারপর দু'টো শিক্ষিত বনাম অশিক্ষিতের কমিটির তুলনা করে, দু'ক্ষেত্রেই দেখালেন যে একজন যোগ্য নেতা সবচেয়ে উত্তম। আপনি রাষ্ট্রনেতা, ন্যায়পাল এদের ক্ষেত্রেও একই যুক্তি টেনেছেন। আমার কাছে মনে হয়েছে আপনি একপ্রকার বুদ্ধিজীবি, কিংবা মেরিট্রোক্রেসীর কথা বলছেন যেটা কিন্তু সরাসরি গণতন্ত্র নয়। এখানে আপনার সাথে আমার বিশাল পার্থক্য রয়ে যাচ্ছে।
আপনার উপরের দু'টি উদাহরণের ক্ষেত্রে আমি যেটা বলবো আপনার উদাহরণ দু'টি যে জিনিসটি ওভারলুক করেছে তা হচ্ছে সময়ের সাথে সাথে মানুষের অভিজ্ঞতা অর্জনের বিষয়টি। হ্যাঁ, একটি জাহাজ যদি শুধু একবারই সাগরে বিপদে পড়ে এবং সে ক্ষেত্রে একজন কাপ্তান একজন খালাসীর চেয়ে ভালো ভাবে জাহাজটিকে তীরে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু এই ঘটনা যদি অসীম সংখ্যকবার ঘটে তবে একজন খালাসী তার অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিখে একজন কাপ্তানের সমপর্যায়ে যেতে পারবে, এবং সেই অভিজ্ঞতা চিরস্থায়ী হবে। আমাদের দেশেই অনেক অভিজ্ঞ নার্স একজন নবীন ডাক্তারের চেয়ে অনেক সময় ভালো জানে। তাই আমার টার্গেট খালাসী শ্রেণীর উপর আস্থা রেখে তাকেই প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করা যেন সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়ে একটি স্থায়ী সিস্টেমে পরিণত হয়। নেতা খোঁজার সমস্যা হচ্ছে নেতা বারবার জন্মায় না। নেতা কয়েক যুগ পরে, বিশেষ করে ক্রান্তিকালে জন্মায়। আর ভোটের মাধ্যমে কি নেতা নির্ধারণ করা সম্ভব? বড়জোর প্রতিনিধি নির্বাচন সম্ভব।
আবারো ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমার লেখাটি পড়ার জন্যে এবং মন্তব্যের জন্যে। আপনার লেখাটির ব্যাপারে যে কনফিউশান সেটা দূর করবেন সে প্রত্যাশা করছি।
পোস্টের সাথে মোটামুটি সহমত। একটা স্পেসিফিক বিষয়ে ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণটা জানাতে চাইব।
ব্রিটিশ আমলাতান্ত্রিক সিস্টেমে থাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা ধারণা করি এর অতিধীরগতি কর্মপদ্ধতি। আর এই ব্যবস্থাটায় উপরের স্তরে একজন না থাকলে তার যারা অধীনস্থ থাকার কথা তাদের সবার কাজকর্ম মোটামুটি বন্ধ হয়ে পড়ে। ডিরেক্ট ডেমোক্রেসির ক্ষেত্রে, আমরা যদি মাস তিন-চার পরপর প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ের কাউকে বদল করি, তাহলে সিস্টেম হয়তো বারবার ধাক্কা খাবে। এরকম অবস্থার কথা চিন্তা করলে, সমর্থনযোগ্য সমাধান কি হতে পারে? কোনও স্ট্যান্ডবাই কমিটি, যারা পরবর্তীজন দায়িত্ব বুঝে নেবার আগে কাজ চালিয়ে নিতে থাকবে? না কি একজন কোনও মানুষের সব বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতার বদলে একটা দেশ পরিচালনাকারী প্যানেলের হাতে সিদ্ধান্তগ্রহণ ক্ষমতা থাকতে পারে? এই দ্বিতীয় অবস্থার সময়, প্রত্যেক সদস্য আলাদাভাবে জনগণের সিদ্ধান্তের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। কাজেই, কাউকে যদি অপসারণ করতে হয়, সার্বিক সিস্টেম একইভাবে চলতে পারবে কোনও বাধা বা বিরতি বাদ দিয়ে। এই দিক থেকে মনে হচ্ছে, দ্বিতীয় অবস্থাটা হয়তো ডিরেক্ট ডেমোক্রেসির ক্ষেত্রে আমাদের জন্য একটা কাঙ্ক্ষিত অপশন হয়ে আসতে পারে।
পোস্ট আর প্রথম কমেন্ট, দুইটাই দারুন।
-অন্যকেউ
প্রাসঙ্গিক বিধায় মিশরের গণ-আন্দোলনের একটি ভিডিও শেয়ার করছি সবার সাথে
আমাদের দেশের বর্তমান সিস্টেমে দুটি গ্রুপের হাতেই দেশের শাসনক্ষমতার পালাবদল হয়। গত চল্লিশ বছরের ইতিহাসে এর কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি। সারা দেশই মূলত দুটি ভাগে বিভক্ত। সেটা সচিবালয় হোক কিংবা পাড়াগাঁয়ের হাডুডু খেলার দল হোক। এই দুটি গ্রুপ পরস্পরের জন্য চরম বিদ্বেষী হলেও এরা তৃতীয় কারো উপস্থিতি সহ্য করতে পারে না। এই দুই দলের হাতে ক্ষমতার পালাবদল হলেও সব একই রয়ে যায়। খাড়া বড়ি থোড়- খাড়া বড়ি থোড়। এবং যদিও পাচ বছর পর পর নির্বাচন নামক একটা শান্ত্বনা অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়, তাতে দেশের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। এটা জেনেও আমরা ভোট দিতে যাই। বর্তমান সিস্টেমে যদি চলতে থাকে দেশ আগামী একশো বছরেও কতটুকু আগাবে সেটা একটা বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন। আমাদের পেছনের অনেক দেশ আমাদের নাকের ডগা দিয়ে সামনে চলে গেছে। দক্ষিন এশিয়ায় নেপাল ভূটান বাদে আর কেউ বাকী নেই। দশ বছর পর দেখা যাবে ভূটানের মতো দেশও আমাদের চেয়ে এগিয়ে গেছে (বর্তমানেই সামাজিক আর্থিক পরিস্থিতিতে ভূটান আমাদের চেয়ে এগিয়ে)।
বিদ্যমান তথাকথিত গণতন্ত্রের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ভিন্ন কোন সিস্টেমে দেশকে চালাতে হবে। এই ভিন্ন সিস্টেমের জন্য যে একটা তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উপস্থিতি প্রয়োজন সেটা আমাদের নেই। ফলে আমাদের কেউ কেউ আশা করে একটা অলৌকিক বিপ্লবের যেখানে একজন মাহাথির এসে দেশের হাল ধরবে। যেটা আদৌ কখনো ঘটবে না।
তাই আপনার প্রস্তাবটা পছন্দ হলেও দুঃখের সাথে বলছি, দুই দলের বাইরে নতুন কোন সিস্টেম প্রয়োগের কোন কাণ্ডারির জন্ম বাংলাদেশে এখনো হয়নি। বরং ভয় আছে মৌলবাদি উত্থানে বিএনপি জোটের যে অন্তর্গত উৎসাহ আছে, সেরকম কোন উৎসাহ মিলিটারীর কাছ থেকে পেলে, বাংলাদেশকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তান বানিয়ে ছেড়ে দেবে। যেটার সম্ভাবনা ১/১১ পূর্ব সময়ে দেখা গিয়েছিল।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
এই বিষয়টাই আমাকে অবাক করে সবচেয়ে বেশি। এতো ভয়ের কারণ থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে যুব সমাজের মাঝে কিছু করার কোন প্রত্যয় চোখে পড়ে না। মাস-পিপল যদি পরিবর্তনে বিশ্বাসী না হয় সেক্ষেত্রে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। মিশরের এপ্রিল ৬ষ্ঠ মুভমেন্ট সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের একটি ইন্টারিভিউ শুনছিলাম গতকাল। কিভাবে তারা মানুষদেরকে সংগঠিত করেছে, মানুষের কাছে পরিবর্তনের বাণী নিয়ে গিয়েছে সেগুলো তারা বিস্তারিত বর্ণনা করেছে এই ইন্টারভিডিওতে। ইন্টারভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে এমাইটি তে। প্রায় দেড় ঘন্টার ভিডিও। ভিডিওটা সবারই দেখা উচিত।
প্রিয় স্বাধীন,
ধন্যবাদ, আমার লিখাটি ধৈর্যের সাথে পড়ে মতামত দেয়াতে। হ্যাঁ, বিষয়টি আপনি ধরেছেন ঠিকই, এখানে কিছুটা আপাতঃ স্ব-বিরোধীতা আছে বলে মনে হয়, আমি নিজেও এটিকে কিভাবে পরিষ্কার করা যায় তা নিয়ে ভাবছি। তবে অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে, আমাদের ভাবা দরকার, একটি গণমানুষের প্রয়োজন কি, এবং নেতৃত্ব সেখানে কেমন স্থানে থাকবে? আমার মনে হয় একটি যোগ্য নেতৃত্ব জনগণকে প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষিত করে তুলবে এবং তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করবে যেন তারা তাদের সমস্যার সমাধান নিজেরাই করতে পারে। এ কাজটি করতে পারে জ্ঞানী ও যোগ্য নেতৃত্ব। নেতৃত্ব সবার কাজকে কো-অর্ডিনেট করবে। 'শাসন' করার কাজটি নেতৃত্ব করবে না, এটি সে ছেড়ে দেবে জনগণের উপর। এখানেই বর্তমান সরকার ব্যবস্থা থেকে ভিন্নভাবে চিন্তা করার সুযোগ এসে যাচ্ছে।
আমরা যে ধরণের সরকার ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি সেখানে সরকার 'শাসন' করে। তার কাজ যেন হয়ে গেছে আইন প্রণয়ন করা আর শাস্তি দেয়া (যা আমরাও এখন কথায় কথায় উল্লেখ করে থাকি)। আর সরকারই যেন সব সমস্যার সমাধান করবে। এটি তার নির্বাচনী ম্যানিফেষ্টোতেও থাকে, আর সেটি সে করতেও চায়। জনগণের মেধা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা, দক্ষতা, সবই চলতে বাধ্য করা হয় সরকারের তৈরী রোড ম্যাপের ভিত্তিতে। অথচ, কোটি কোটি জনগণের মেধাকে সমস্যা সমাধানে নিয়োজিত করতে পারলে অনেক কম সময়ে তা সম্ভব হত। এটি করতে পারে যোগ্য নেতৃত্ব। নদীর তীরে একটি বাঁধের জন্য সরকারের দিকে বছরের পর বছর তাকিয়ে বসে থাকে যে জনগণ, শেষ পর্ষন্ত উদ্যোগ নিয়ে তারা নিজেরাই অল্প সময়েই সেটি করতে পেরেছে - এ ধরণের অনেক উদাহরণ আমরা দেখেছি। একটি যোগ্য নেতৃত্ব জনগণের নিজের ক্ষমতাকে ব্যবহারের সুযোগ তৈরী করে দেবে, যা 'শাসক' সরকার পারবে না।
নাটোরের 'লাঠি বাঁশী সমিতির' কথা আমি প্রায়ই বলে থাকি। তারা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে খুব অল্প সময়ে নাটোরকে সম্পূর্ণ অপরাধমুক্ত করে ফেলতে পেরেছিল। জনগণের মেধা ও উদ্যম কাজে লাগাবার এটি একটি সফল মডেল, যা অন্য জায়গায় পরীক্ষা করে দেখা উচিৎ ছিল। দেশে একজন যোগ্য 'নেতৃত্ব' থাকলে তিনি তাই করতেন। কিন্তু 'ডেমোক্রেসীর' নির্বাচিত সরকার নিজে 'শাসক', জনগণের ক্ষমতায়ন সে সহ্য করে না। তাই সরকার এতে সংবিধানের অপলাপ দেখলেন, সংবিধানে দেয়া ম্যজিষ্ট্রেট-পুলিশের 'ক্ষমতার' উপর হস্তক্ষেপ মনে করা হল এটিকে, তাই 'অসাংবিধানিক' আখ্যা দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হল সফল একটি মডেলকে। তাহলে দেখা যাচ্ছে সংবিধান যেভাবে সমস্যার সমাধান চেয়েছে, তার বাইরে কোন উদ্ভাবনী পদক্ষেপ সে সহ্য করে না, জনগণের স্বার্থের জন্য ভাল মনে হলেও। সংবিধান সরকারকে 'আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাকারক' বলে - এখনেই সমস্যা। এ বৃত্ত থেকে বের হতে পারলে আমরা হয়ত বিষয়টিকে আরও পরিষ্কার ভাবে ভাবতে পারতাম। আমি নিজেও কিন্তু এ বৃত্ত থেকে পুরোপুরি বের হতে পারি নি, তাই কিছু স্ব-বিরোধীতা আমার মধ্যেও থেকে যাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু একবার যদি একটি সুস্থ ধারার দিকে আমরা এগুতে পারি তবে অনেক বিষয় আপনা থেকেই পরিষ্কার হতে থাকবে।
এবার আপনার উদাহরণে দেয়া অভিজ্ঞ নার্স ও নতুন ডাক্তার এর কথায় আসা যাক। একজন ডাক্তার শরীরের ভিতরের যাবতীয় কার্যকরণ ও সম্ভাব্য অসুখ সম্পর্কে যত জ্ঞান অর্জন করেন একজন নার্সের কিন্তু তা থাকে না। তাই একজন ডাক্তার প্রথমে ভুল করলেও তাড়াতাড়ি তার ভুলগুলো নিজেই শুধরিয়ে খুব অল্প সময়ে ভাল চিকিৎসা দিতে পারবেন, নতুন জটিল বিষয়েও সঠিক সমাধানের দিক নির্দেশনা দিতে পারবেন। আর একজন নার্স কিন্তু অনেক বছরের অভিজ্ঞতার পরও জটিল বিষয়ে সঠিক সমাধান দিতে পারবেন না। তার প্রচেষ্টা 'ট্রায়াল এন্ড এরর' এর ভিত্তিতেই চলতে থাকবে, কখনও সফল হবে, কখনও বিরাট ভুল করবে। তাই চিকিৎসার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ডাক্তারের হাতেই থাকা ভাল, নার্সের হাতে নয়।
তেমনি প্রচলিত গণতন্ত্রে নির্বাচিত স্বল্প শিক্ষিত, কম যোগ্যতা বিশিষ্ট প্রতিনিধি 'ট্রায়াল এন্ড এরর' এর মাধ্যমেই চলতে থাকবেন, কয়েক শ বছর পরও একই রকম চলতে থাকবে।
আশা করি এ বিষয়ে আমরা আরও আলোচনা করতে পারব।
ধন্যবাদ
সিদ্দিক-ই-রব্বানী
প্রিয় সিদ্দিক-ই-রব্বানী
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্যে। আমার মনে হয় না আমাদের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য রয়েছে। আমি নিজেও যেমন বলেছি যে রিপ্রেজেন্টেটিভরাই দেশ চালাবে, কিন্তু ক্ষমতার মূল কেন্দ্র যেন জনগনই থাকে। অর্থাৎ দেশ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা চালালেও আইন করার অধিকার যেন জনগণেরি হাতেই থাকে। আর নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে অপসারণের জন্যে চার বছর অপেক্ষার প্রয়োজন নেই। কেউ ভালো চালালে জনগণ যতদিন চাইবে ততদিন থাকবে, কিন্তু খারাপ চালালে জনগণ যেন যেকোন মুহুর্তেই তাকে বাদ দিতে পারে সে রকম ব্যবস্থা রাখার কথা আমি বলছি। ই-ডেমোক্রেসী চালু হলেই এরকম গণ-ভোট আয়োজন করা সম্ভব অল্প সময়ের ব্যবধানে। এই মুহুর্তে যেমন যোযাযোগ মন্ত্রী কিংবা নৌ-পরিবহন মন্ত্রীর পদত্যাগ জনগণ চাইছে। কিন্তু সরকার না চাইলে জনগণের এই দাবী বাস্তাবায়ন হবে না। অর্থাৎ সরকার জনগণের কাছে বাধ্য না হয়ে বরং জনগণ সরকারে কাছে জিম্মি। এই সিস্টেমের পরিবর্তন প্রয়োজন। বিদেশে যে কোন চাকুরীই করতে চান, প্রতি বছর শেষে মূল্যায়ণ শেষে চাকুরী নবায়ন করে। চাকুরী নবায়নের আশায় একজন কর্মী পুরো বছর মন দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করে। অথচ আমাদের দেশে সরকারী চাকুরীতে একবার ঢুকলে সেই চাকুরী সারাজীবনের জন্যে নিশ্চিত। এর পরে আপনার মাঝে জবাবদিহীতা কিভাবে আসবে? একই কথা প্রযোজ্য সরকারের ক্ষেত্রে। কেউ যখন জানে যে তারা পাঁচ বছরের জন্যে ক্ষমতায় এসেছে, এবং পাঁচ বছরে যদি এক হাজার কোটি টাকা বানানো যায়, তবে কি দরকার আছে জবাবদিহীতার? সেটাই কি ভালো নয়, কোটি টাকা বানিয়ে, তারপর বিদেশে নগদ টাকায় বাড়ি কিনে ব্যবসা করে জীবন পার করে দেওয়া। সেরকমই কি করছে না, আমাদের রাজনীতিবিদেরা, সরকারী আমলারা? আমি এই সিস্টেম পরিবর্তনের পক্ষে। যে কাউকে যে কোন মুহুর্তে বাতিলের পক্ষে। জনগন এখানে চাকুরীদাতা, আর রাজনিতিবিদ বা সরকারী আমলা বা সরকারী কর্মকর্তারা হচ্ছে জনগণের পক্ষে চাকুরীজীবি। যেই মাসে তাদের কাজে গাফিলতি পাওয়া যাবে সেই মাসেই পত্রপাঠ বিদায়ের পক্ষে আমি, সেই সাথে দুর্নীতির প্রমান থাকলে বিচারের পক্ষপাতি আমি। এ সবই সম্ভব যখন ডিরেক্ট ডেমোক্রেসী, অথবা ই-ডেমোক্রেসী দেশে প্রতিষ্টিত হবে।
তবে নেতৃত্ব নিয়ে আমি বেশি চিন্তিত নই। একটি ভালো সিস্টেম থাকলে সেই সিস্টেমই উন্নতর নেতৃত্ব গড়ে তুলবে। আবার ভিন্ন ভাবে বললে একটি বাজে সিস্টেমে থাকলে ভালো নেতাও ভুল পথে চলে যাবেন, যেটার উদাহরণ আমাদের দেশে দেখা যায়। সরকারী চাকুরী/পুলিশ সব খানে এমন ব্যবস্থা যে আপনি ঘুষ না খেয়ে চলতে পারবেন না। অর্থাৎ সেখানে কোন ভালো মানুষও কিছু দিন থাকার পর বদলে যাবেন। তেমনি যদি ধরেও নেই যে হাসিনা/খালেদা ভালো নেত্রী, কিন্তু বর্তমান দলীয় রাজনৈতিক সিস্টেমে হাসিনা/খালেদা কে আবুল/শাহজাহান/সাকা/মওদুদ এদের উপর ভরসা করে চলতে হয়। এই দুই নেতৃত্বকে যদি এদের উপর ভরসা না করে সরাসরি জনগণের মতামতে চলতে হতো, সে ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে কিছু ভিন্ন হলেও পেতাম। অর্থাৎ এই বর্তমান সংসদীয় গণতন্ত্রে শাসন ব্যবস্থা বা সরকার ব্যবস্থা জনগণের মতামতে চলে না, চলে নির্বাচিত সংসদদের মতামতে। আমাদের দরকার এই মধ্যভোগী দালালদের হাত হতে ক্ষমতা নিয়ে সেটা সরাসরি জনগণের কাছে পৌছে দেওয়া।
আলোচনা চলতে থাকুক।
প্রিয় স্বাধীন,
আমি মাঝে মাঝে বলে থাকি যে একজন টিএনও এর মূল্যায়ণ করবে এলাকা জনগণ, তার উপরের কর্মচারী নয়। তাহলেই বলা যাবে যে জনগণের শাসন। এ বিষয়ে আপনার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের মূল্যায়ণ করবে কে ? - যাদেরকে সে সেবা দিচ্ছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বার এ প্রস্তাব তুলে আমরা বারবারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছি - কারণ আমরা শিক্ষকেরাও রাজনীতিতে ডুবে এতটাই সীমিত হয়ে গেছি যে যুক্তির কথার কোন মূল্য আমাদের কাছে নেই। সেদিন আমাদের বিভাগের একজন ছাত্র ভর্তির বিষয়ে একটি অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয় কয়েক শত অধ্যাপকদের উপস্থিতিতে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল। আমি এর অযৌক্তিকতা তুলে ধরলাম বিভিন্ন যুক্তির আলোকে। কোন কাজ হল না, কারণ গণতন্ত্রের মেজরিটি। পরে ব্যক্তিগত আলোচনায় একজন শিক্ষক (যিনি রাজনীতির সাথে যুক্ত) তিনি আমাকে সরাসরিই বলে ফেললেন - 'আপনার যুক্তিগুলোই সঠিক ছিল, কিন্তু আপনি যে ভোটকেন্দ্রে যান না এটি তার পরিণতি' (আমি ভোট দিই না - এটা মোটামুটি রাজনীতিতে সক্রিয় ঢাকা বিশ্বববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকেরাই জানেন)। বিশ্ববিদ্যালয়ে মেজরিটির কন্ঠ ক্ষমতায় (সত্যিকার ভোট কখনো নেয়া হয় না) ২+২=৫ সিদ্ধান্ত এলেও সবাইকে তাই মেনে নিতে হয়।
নেতৃত্বের বিষয়ে যে কনফিউশনের কথা আমি বলেছিলাম, সেটি কিন্তু আপনার লিখাতেও ফুটে উঠেছে। হাসিনা, খালেদা কিন্তু নেতা নন - তারা প্রতিনিধি। তাই নেতৃত্বের যোগ্যতা তাদের থাকার প্রয়োজন নেই। তাই তাদের কাছ থেকে ভাল সিষ্টেম আশা করতে পারি না। তাছাড়া যে ইলেকশনের মাধ্যমে তারা এসেছেন, তার কিছু প্রক্রিয়ার ফলে অনেক কিছু বুঝলেও তারা কিছু করতে পারেন না। তাদের হাত-পা অনেক মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, ক্যাডারদের কাছে বাঁধা। আমার প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে যে যোগ্য নেতা আসবেন, জ্ঞানের পরিধির কারণে তিনি অনেক সমস্যার সমাধানে সঠিক পথটি খুঁজে নিতে দ্বিধা করবেন না, কারণ তিনি নিজেকে অন্যের থেকে ভাল দাবী করে এ পদে আসেন নি। ভাল সিষ্টেম বা পদ্ধতিও তিনি তৈরী করতে পারবেন। ভুল হলেও তিনি সহজে স্বীকার করতে পারবেন, সহজে অন্যের মতামত গ্রহণ করতে পারবেন। কিন্তু বর্তমান ইলেকশন পদ্ধতিতে যিনি ক্ষমতায় আসেন, তার পক্ষে ভুল স্বীকার করা বিশাল লজ্জার ব্যাপার, তাই পারতপক্ষে স্বীকার করবেন না। শুধু লজ্জার ব্যাপার নয়, ভুল স্বীকার করলে বিরোধী দল সাথে সাথেই তাকে নেমে যেতে বলবে। চারদিকের ঘটনায় তাই দেখতে পাচ্ছি না?
আমার মনে হয় তরুণদেরকে নতুন পদ্ধতি নিয়ে ভাবতে হবে, অনেক আলোচনা চলতে থাকা উচিৎ। তাহলে কমপক্ষে ভাল একটি পদ্ধতির দিকে আমরা দশ/বিশ বছর পরে হলেও আসতে পারব।
ধন্যবাদ
সিদ্দিক-ই-রব্বানী
প্রিয় সিদ্দিক-ই-রব্বানী
দুঃখিত মন্তব্যের জবাব অনেক দেরীতে প্রদানের জন্যে। ঈদ এবং ব্যক্তিগত ঝামেলায় এই দেরী।
যা হোক, আপনার ছাত্র/শিক্ষকের উদাহরণটি একটি চমৎকার উদাহরণ। এই উদাহরণটি আমাদের বর্তমান রিপ্রেজেন্টেটিভ ব্যবস্থার সত্যিকার রূপক হিসেবে দেখতে পারেন। ছাত্রের স্থলে চিন্তা করুন আমাদের জনগণকে আর শিক্ষকদেরকে চিন্তা করুন জনপ্রতিনিধি রূপে। শুধু পার্থক্য একটি যে শিক্ষকেরা নির্বাচিত নয়। এখন শিক্ষকেরা যেহেতু ছাত্রদের চেয়ে আলাদা একটি শ্রেণী, যাদের কাজ হচ্ছে ছাত্রদের হয়ে ছাত্রদের ভালো মন্দ দেখাশুনা করা (এজ ইফ, ছাত্ররা নিজেদের ভালো মন্দ বিচারে যথেষ্ট বুদ্ধিমান নয়), তাই তারা যখন যে কোন সিদ্ধান্ত নিবে সেই সিদ্ধান্ত শিক্ষকদের সুবিধে মোতাবেক নেওয়া হবে সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? এই সিদ্ধান্ত যদি শিক্ষকেরা না নিয়ে শুধু ছাত্ররা মিলে নিতো, অথবা দুইপক্ষ মিলে নিতো তাহলে কি ছাত্রদের পক্ষে সিদ্ধান্ত যেতো না?
তাই এই উদাহরণটি প্রমান করে যে শাসক শ্রেণী যদি উচ্চ-শিক্ষিতও হয়, কিংবা যোগ্যও হয় (যদিও কে যোগ্য তার নির্ণয় করার মাপকাঠি এক বড় প্রশ্ন) তাদের দ্বারা গৃহীত সিদ্ধান্ত কখনই জনগণের পক্ষে যাবে না, যদি না সেই সিদ্ধান্তে জনগণের অংশগ্রহন থাকে। তাই জন-প্রতিনিধিরা যোগ্য না উচ্চ-শিক্ষিত সেইটা মূল সমস্যা নয়, মূল সমস্যা জনপ্রতিনিধিরা যে আইন প্রণয়ন করে সেটাতে জনগণের অংশগ্রহণ না থাকায় তাতে জনগণের চিন্তা প্রতিফলিত হয় না, হয় জনপ্রতিনিধিদের চিন্তা। তাই আমি আগেও বলেছি, নেতৃত্ব নিয়ে আমি চিন্তিত নই। যদি জনগণের অংশগ্রহণ থাকে সেক্ষেত্রে অল্প-শিক্ষিত কিংবা দুর্বল নেতৃত্বেও একটি রাষ্ট্র, সমাজ চলতে পারবে, এবং সেটি একটি স্থায়ী ব্যবস্থা হবে। কারণ ব্যক্তি মানুষের পরিবর্তন দ্রুত হলেও গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের চিন্তার পরিবর্তন ধীর গতির এবং সেটা একমুখী। তাই গণমানুষের অংশগ্রহণে যে শাসন চলবে তা একমুখী হবে এবং স্থায়ী হবে বলে আমার মনে হয়।
প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় একটি লেখার লিঙ্ক দিচ্ছি আগ্রহী পাঠকদের জন্য। এটি বদরুদ্দীন উমরের একটি লেখাঃ সমাজ পরিবর্তনের লড়াই এখন সামনে
লেখাটি অনেক বড়, নানান তত্ত্বীয় বিশ্লেষণ রয়েছে। তবে সব শেষের কথাগুলো আমার কাছে বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে এই লেখার সাথে।
এই উদ্ধৃতির প্রথম অংশ অনেকটা আমার লেখার মতোই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে শেষের সিদ্ধান্ত নিয়ে। লেখক সকল সমস্যার সমাধান হিসেবে দেখছেন সেই একই দলীয় শাসনে, শুধু পার্থক্য এই যে এই দলকে তিনি মনে করেন যে এটাই প্রকৃত জনগণের দল। কিন্তু প্রতিটি রাজনৈতিক দলই জনগণকে একই কথা বলে যে তারাই জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই নুতন দল এমন কি ভিন্ন শাসন দিবে যাতে জনগণের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। অন্য ভাবে বললে, এই দল যে ক্ষমতায় যেয়ে জনগণের বিপক্ষে কাজ করবে না সেই নিশ্চয়তা কোথায়? অথবা যদি তারা করে সে ক্ষেত্রে সেই দলকে অপসারণের জন্যে কি মানুষকে আবারো আরেকটি বিপ্লবের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে? আমি বুঝিনা আমাদের বাম দলের নেতারা অনেক কথাই বলেন কিন্তু সরাসরি ডিরেক্ট ডেমোক্রেসীর কথা কেন বলেন না। জনগণের সমর্থনে ক্ষমতায় গেলেও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে চায় সেই ক্ষুদ্র গোষ্ঠিই। এটা আমার কাছে বাম-দলগুলোর স্ববিরোধী চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। তাদের লক্ষ্যও আসলে ক্ষমতায় যাওয়া, শুধু পার্থক্য যে তারা ভোটের রাজনীতি বা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। এইটা হাসিনা/খালেদা গং এর চেয়ে আরো ভয়ঙ্কর। হাসিনা/খালেদাকে অন্তত প্রতি পাঁচ বছরে অপসারণ সম্ভব, কিন্তু এই বাম-গোষ্ঠী একবার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলে তারা জনগণের বিরুদ্ধে যতই অপরাধ করুক তাদের সরানোর কোন উপায় নেই, আরেক রক্তক্ষয়ী বিপ্লব ছাড়া। আমার ধারণা সাধারণ মানুষও এই সত্যটি বুঝে থাকে। তাই বাম-দলগুলোর উচিত এই বিপ্লবের চিন্তা ছেড়ে গণতন্ত্রের পথে , ভোটের রাজনীতির পথে আসা যে পথের বিকল্প নেই।
নতুন মন্তব্য করুন