[বইয়ের তাক গোছাতে গিয়ে হঠাৎ অনেক পুরনো একটা লেখার খাতা চোখে পড়ল। দেখলাম তাতে প্রায় একুশ বছর আগের অপ্রকাশিত বেশ কিছু লেখা রয়েছে। তারই একটি এখানে তুলে দিলাম। ভাল লাগলে অন্যগুলোও দেব।]
‘তের হয়েছে তো কী হয়েছে?’
রীতিমত চেঁচিয়ে উঠল আকাশ। ‘এক মিনিট দোস্ত’ বলে আমি দ্রুত হাতে টেবিলের গ্লাসটা সরিয়ে ফেলি। আকাশের মতি-গতি ভালোই জানা আছে আমার। রেগে গেলেই ও কাছাকাছি টেবিলের ওপর ঝালটা ঝাড়ে। ও সত্যি সত্যি দশাসই এক কিল মেরে দিল টেবিলে। ভাগ্যিস গ্লাসটা তুলেছিলাম!
‘যাবি কি না বল!’
রাগ কিছুটা কমে এসেছে ওর। সমঝোতায় আসার চেষ্টা করছে।
‘অবশ্যই যাব-না যাওয়ার তো প্রশ্নই নেই’ দ্রুত কন্ঠে বলি আমি। ওকে আর ঘাঁটাতে চাই না। অগত্যা জয়ন্তকে রাজী হতেই হলো। যেখানে সংখ্যা গরিষ্ঠের মতামতই যাওয়ার পক্ষে। আমরা আবার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী কি না!
এইচ এস সি’র পাট চুকিয়ে এখন ঘরে বসে আছি আমরা। পড়াশোনার ভেতর থাকলে সময়টা কিভাবে কাটে তা বোঝা যায় না। কিন্তু তা থেকে বিচ্যুত হলেই বিপদ। এ ওর বই পড়ে, ধার-দেনা করে সপ্তাহ দুই চলেছি। এখন সবারই স্টক শূণ্য এবং সহসাই যে পূর্ণ হবে এমন সম্ভাবণা না দেখে আকাশ প্রস্তাব করেছিল লাইব্রেরীতে যাওয়ার। জয়ন্তর পছন্দ না হওয়ায় ও এলেবেলে অনেক কথাই তুলেছে। সব অগ্রাহ্য হবার পর সংস্কারের ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেছে শেষে।
‘সব না হয় মানলাম কিন্তু আজ যাব কীভাবে বল? আজ যে আনলাকি তের তারিখ’
‘তের হয়েছে তো কী হয়েছে?’
নাম সই করে তিন জনের একটা মিনি লাইন দিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকে গেলাম। সবার সামনে জয়ন্ত – আমি মাঝখানে। হঠাৎ দেখি আমি মাঝখানে নেই মানে আকাশ পেছনে নেই। নাহ্ আছে। ঢোকার মুখেই একটা চেয়ার খালি পেয়ে বসে পড়েছে। যথারীতি জয়ন্ত ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ এর কবলে পড়ে গেল। আমি সবে ‘ময়ূরাক্ষী’ নদী সাঁতরাবার চেষ্টা করছি। আকাশ কী করছে?
সাড়ে তিনটা বই পড়ে ফেরত আসতে হয়েছে বলে মেজাজ সপ্তমে চড়ে আছে জয়ন্তর।
‘সাধে কি আর ওখানে যেতে চাই না?’ বিড়বিড় করল সে। ‘সাড়ে তিনটা বই পড়েছি কি পড়িনি অমনি বলে কি না আপনার এবার আসুন, লাইব্রেরী বন্ধ করবার সময় হয়ে গেছে!’ ঝাঁঝের সাথে বাক্য শেষ করে লাইব্রেরীর ওপর আরেক চোট নিল জয়ন্ত। আমার কথা অবশ্যি আলাদা। আঠারো মাসে বছর আমার। অনেক কষ্টে-সৃষ্টে একটা শেষ করেছি। আকাশে খবরাখবর তো নেয়া হলো না।
‘তুই কয়টা পড়েছিস রে?’
হঠাৎ যুগ্ম কন্ঠের উচ্চারণে প্রশ্নটা আলাদা মাত্রা পেয়ে গেল। তার মানে আমি আর জয়ন্ত এক সময়ে একই প্রশ্ন করেছি। কিন্তু প্রচলিত উত্তরের ধার দিয়ে গেল না আকাশ। মুচকি একটা হাসি হাসল শুধু। তারপর বলল, ‘একটাও পড়িনি – জানিস...’
একটাও পড়িসনি মানে কী? এতক্ষণ বসে বসে করেছিসটা কী?
ঘাস কেটেছে বোধয়! , সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগাল জয়ন্ত – আকাশের ওপর রাগটা এখনো পড়েনি ওর। আশা করেছিলাম জয়ন্তর ঠাট্টাকে গাট্টা রকম একটা উত্তরে জব্দ করে দেবে আকাশ। কিন্তু ওসব কিছু করল না। রাইসোরিয়াস পেশীকে কাজে লাগিয়ে আরো একপ্রস্থ মুচকি হাসল সে। ওর হাসিতে কেমন যেন রহস্যময়তার ছোঁয়া। হঠাৎ ও ‘সাম্প্রতিক ঘটনা ও পারিপাশ্বির্ক অবস্থা’ জাতীয় বিষয় নিয়ে উৎসাহী হয়ে উঠল।
‘আচ্ছা বলতো এখনকার সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা কী?’
‘সে তো অনেক কিছুই’, সংগে সংগে রেসপন্স করলাম আমি, ‘মধ্যপ্রাচ্যের বেহাল অবস্থা, বিশ্বজুড়ে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট এগুলো সবই তো সাম্প্রতিক সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা’
‘মানলাম মানলাম’, শ্রাগ করল আকাশ, ‘ওগুলো তো আন্তজার্তিক ফ্যাক্টর। আমাদের এই এলাকার কথা বল।'
কথাটা বলে পায়ের ওপর পা তুলে বেশ আয়েশ করে বসল আকাশ। তারপর আকাশ দেখার চেষ্টা করতে লাগল যেন। তবে ছাদ গলে আকাশ দৃষ্টিগোচর হয়না বলেই আমার ধারণা! ও দেখছি আমাদের দুজনকে মহাফাঁপড়ে ফেলে দিল। এই এলাকার আবার উল্লেখযোগ্য ঘটনা কী? আমরা দু বন্ধু স্মৃতি হাতড়াতে লাগলাম। আসলেই কিছু ঘটেছে কি না। হঠাৎ মনে হলো আকাশ মজা করছে না তো? আলতু-ফালতু সমস্যা দিয়ে আমাদের মাথা খারাপ করতে পারলে ওর তো দুঃখ পাওয়ার কোনো কারণ নেই! ও বোধয় আমার চিন্তাটা ধরতে পারল। বলল,
‘আচ্ছা ঠিক আছে একটা ক্লু দিচ্ছি। ব্যাপারটা ‘সাময়িক ঠিকানা’র সাথে জড়িত।‘
যাহোক ভাবার একটা সূত্র তো পাওয়া গেল। আমাদের পাশের বাড়ি র নামই সাময়িক ঠিকানা। কিন্তু অই বাড়ির এই আধ্যাত্মিক নামটি ছাড়া আর কোনো বৈশিষ্ট্যের কথা তো মনে পড়ছে না!
‘যা বলবার সরাসরি বল- নইলে উঠলাম’, এই সব রহস্য রহস্য খেলায় অাগ্রহী নয় জয়ন্ত।
‘ঠিক আছে বোস বোস। অই বাড়ির নতুন ভাড়াটের ব্যাপারটা চিন্তা কর। ভদ্রলোক এসেছেন মাস দুয়েক হলো। তার সাথে আমাদের কোনো কথা হয়নি এখনো। ভদ্রলোক কী করেন তাও অজানা আমাদের। তাই অই ভদ্রলোককে কি আমরা রহস্যজগতের মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি না?’
‘একদমই পারি না’, একটু যেন জোরেই বলে ফেললাম আমি, ‘দুমাসে কারো সাথে দেখা না হওয়াটা তেমন কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। তাছাড়া এই ব্যস্ত মহানগরে কে কার হাঁড়ির খোঁজ রাখে? আর ভদ্রলোকের পেশা নিয়ে প্যাঁচাল পেড়েই বা আমাদের কী লাভ?’
‘কোনোই লাভ নেই। যত্তসব বাগোয়াস---!’ উঠে পড়ল জয়ন্ত। এসব প্রলাপ শুনতে নারাজ ও। আকাশ ওকে জোর করে বসিয়ে দিল। একটু সিরিয়াসনেস এলো ওর আচরণে। ‘কোনো লাভই হয়তো নেই। কিন্তু কিছু ব্যাপার অবশ্যই আলোচনার দাবী রাখে। যেমন ধর ভদ্রলোক সস্ত্রীক আসেননি বা তার কোনো সন্তানকেও দেখা যাচ্ছে না। আবাসিক এলাকায় সাধারণত ব্যাচেলরদের বাড়ি ভাড়া দেয়া হয় না। তাছাড়া একজন ব্যাচেলরের পক্ষে ওরকম ঢাউস একটা বাড়ি ভাড়া নেয়া কোনো কাজের কথা না। এই দুমাসে কয়েকবারই ভদ্রলোকের মুখোমুখি পড়েছি আমি কিন্তু ভদ্রলোক আলাপ করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাননি। এই সবই কী তাকে--’
‘রাখ রাখ অনেক হয়েছে’,বাগড়া দিল জয়ন্ত, ‘পেপারব্যাক পড়ে পড়ে তোর মাথায় অই রহস্য ছাড়া আর কিছু নেই। তোর সাতেও রহস্য পাঁচেও রহস্য!’
হাল ছেড়ে দেবার কোনো রকম লক্ষণই দেখা গেল না আকাশের মধ্যে। ও ধীরে সুস্থে ঘড়ি দেখল। তারপর বলল, ‘ভদ্রলোক রহস্যময় কি না তার সপক্ষে এখনই একটা প্রমাণ দিতে পারি। তোরা যদি অই বাড়িটার দিকে তাকাস তাহলে নির্ঘাত ভদ্রলোককে পায়চারি করতে দেখবি। আর পারলে সাথে বাইনোকুলার নিয়ে যাস। কপালে চিন্তার ভাঁজগুলো স্পষ্ট আসবে তাতে’।
এমন ভাবে বাক্য শেষ করল আকাশ মনে হলো জ্যোতিষ শাস্ত্রে বড় কোনো ডিগ্রী নেয়া আছে ওর! ভেবেছিলাম আমার মতো জয়ন্তও আকাশের এই প্রস্তাবকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে। কিন্তু ও সত্যি সত্যি দেরাজ খুলে বাইনোকুলার নিয়ে ছাদে উঠে গেল। জ্যোতিষ শাস্ত্রে অভাবিত সাফল্য দেখালে গোল্ড জাতীয় মেডেল দেয়ার বিধান যখন আছে তখন চরম ব্যর্থতায় বোল্ড জাতীয় পুরষ্কার দেয়ার নিয়ম চালু করতেই জয়ন্ত উঠে গেল কিনা তা ঠিক আন্দাজ করতে পারলাম না! আকাশের মধ্যে কোনো ভাবান্তর না দেখে কিছুটা বিভ্রান্ত হলাম আমি তবে একটু পরে জয়ন্ত ফিরে এলে ওর যে কী অবস্থা হবে তা ভাবতে গিয়ে কিছুটা মজাই পাচ্ছিলাম। জয়ন্ত চোখ বড় বড় করে কতক্ষণ হয়তো গিলবে আকাশকে। তারপর বলবে, ‘বড় আমার জ্যোতিষ এসেছেন! বারান্দায় হাঁটাহাঁটি তো দূরে থাক ভদ্রলোকের ভ ও দেখলাম না। শুধু দেখলাম অই বাড়ির দরজা ঢাউশ আকৃতির একটা তালা হাউস করে ধরে রেখেছে!’
‘তুই বুঝলি কীভাবে ভদ্রলোক ওভাবে হাঁটবেন?’, একটু যেন ধাক্কা খেলাম। জয়ন্ত আকাশের পূবার্ভাসের পুরো মিল লক্ষ্য করে যে ছুটে এসেছে তাতে কোনো সন্দেহই নেই। তাহলে কি?
‘ভদ্রলোক যে সুবিধার লোক নন তা না জেনেই কি এতো কথা বলেছি আমি?’ সাফাই গাইল আকাশ।
‘তুই কি আরো কিছু---’, আমার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে ভীষণরকম।
‘ধীরে বন্ধু ধীরে- কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো সব জানতে পারবি’, আকাশ আমাদেরকে আশ্বস্ত করে। কিন্তু ওর এই আশ্বস্ত করা বাণী আমাদেরকে সন্ত্রস্তই করে তোলে বেশি।
‘আচ্ছা সাজ্জাদ তোর না এক মামা আছে পুলিশের লাইনে- ইন্সপেক্টর না কি যেন-’
‘কেন ভুলে গেলি নাকি? মিলন মামাকে তো তোর ভুলে যাওয়ার কথা নয়। গতমাসে আপুর জন্মদিনে এসেছিলেন না—লম্বামত দেখতে--’
‘বুঝতে পেরেছি- তুই এক কাজ কর রিসিভারটা তোল। মিলন মামাকে বল তিনি যেন ঠিক চারটে দশে এখানে থাকেন- অবশ্যই অফিসার হিসেবে।’
আমার মুখমন্ডলে প্রশ্নবাচকতা দেখে আকাশ ওর মুখমন্ডলের ভাব পাল্টে দিল। যাতে বুঝলাম ব্যাপারটা হালকা কিছু না আর এই নিয়ে এই মুহূর্তে প্রশ্ন করাটাও কাঙ্খিত নয় ওর কাছে। আকাশ আমাদের দীর্ঘ দিনের বন্ধু। ওর ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস। আমি নিশ্চিত মনে ডায়াল করতে লেগে গেলাম। এই ফাঁকে দেখলাম আকাশ জয়ন্তকে কিছু বলছে। আমি অনেক চাপা টাপা খরচ করে রাজী করাতে পারলাম মামাকে। পেশাগত দায়িত্ব ফেলে ভাগ্নেদের তামাশার পাত্র হতে কার আর সাধ হয়! রিসিভার রেখে দেখি জয়ন্ত হাতে একটা হকি স্টিক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খেলার জন্য যে আনা হয়নি তা বিলক্ষণ বুঝতে পারছি। কিন্তু আকাশ কী করতে চাইছে?
আকাশ বার কয়েক ঘড়ি দেখল। কী একটা ইঙ্গিত করাতে জয়ন্ত সোফার পেছনে লুকিয়ে পড়ল। ওর হাতে তখনো হকি স্টিকটা। আমার হাতে একটা পত্রিকা গুঁজে দিল আকাশ । বলল, ‘নিরীহ গোবেচারার মতো পড়তে থাক। একজন অতিথি আসতে পারেন। তাকে অভ্যর্থনা জানাতে আমি আছি। খবরদার কোনো চঞ্চলতা যেন প্রকাশ না পায় আচরণে।’ তাজ্জব বনে গেলাম। আকাশ এমন দারুণ নেতৃত্ব দিতে পারে তা জানা ছিল না আমার। ও স্কুল জীবনে স্কাউটিং করেছিল জানতাম। ওসব করলে যে বুদ্ধিসুদ্ধিও বেড়ে যায় তাতো জানতাম না! ওর কথা মতো বসে পড়লাম সোফায়। চোখ যদিও গিয়ে থাকল পত্রিকার পাতায় কিন্তু দেখছিলাম না কিছুই। ব্যাপারটা কী? পাঁচ না সাত মিনিট কেটেছে বলতে পারব না, টেনশনে থাকলে এমন হয়, দরজায় নক হলো। আকাশ এতক্ষণ আমার পাশে বসে ছিল, প্রায় স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে দরজা খুলতে গেল। একজন হ্যাংলা পাতলা গোছের লোক ঢুকল ঘরে। আকাশের সাথে কি যেন বলল ফিসফিসিয়ে। আমি নিরীহ ভঙ্গিতে লোকটাকে দেখেই আবার পড়াশোনায় মন দিলাম। লোকটার মুখে দাড়ি গোফের জঙ্গল, উসকো খুসকো চুল, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ- কেমন বিবাগী বিবাগী ভাব। একে ঠ্যাঙ্গানোর জন্যই কি জয়ন্তকে তৈরী রেখেছে আকাশ! কিন্তু এর দোষ কী? কিম্বা এই সময়ে এর এখানে আসারই বা দরকার কী ছিল? আকাশ লোকটাকে নিয়ে পাশের গেস্টরুমে ঢুকে গেল। আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। একটু পর দেখি আকাশ গেস্টরুম থেকে বেরিয়ে সন্তর্পনে দরজা লাগিয়ে হুড়কো তুলে দিল। তারপর পা টিপে টিপে আমার কাছে এসে বলল মিলন মামাকে আসতে বলেছিলি তো ঠিকমতো? ফিসফিসিয়ে বলার কারণে কেমন একটা আধি-ভৌতিক ব্যাপার বলে ঠেকল আমার কাছে। আমি মাথা নাড়লাম শুধু। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আকাশ বেশ অস্থির হয়ে পড়ল। চারটা এগারো বেজে গেছে। ও জয়ন্তকে দরজার পাশে নিঃশব্দে অবস্থান নিতে বলে আমার কাছে এলো। ‘দেখ ঠিক ঠাক যদি তোর মামা না আসেন তাহলে কিন্তু বারোটা বাজবে আমাদের। চারটা পনের! কিছু একটা কর!’
এখন ব্যাপারটা অনেকটা আমার কাছে স্পষ্ট। আগুন্তুককে পুলিশে সোপর্দ করার জন্যই আকাশের এই ব্যাপক প্রস্তুতি। কিন্তু--- নাহ এখন কোনো প্রশ্ন নয়। আমি ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। টাইম মেইনটেইন করার বিষয়টি আমি মামাকে বুঝিয়েছিলাম। হঠাৎ নজর পড়ল রাস্তারে ওধারে একটা পার্ক করা মোটরসাইকেলের ওপর। পুলিশের হোন্ডা কোনো সন্দেহ নেই। চোখ দ্রুত ঘোরালাম দৃষ্টি সীমানার ভেতর। অই তো! পান দোকানে দাঁড়িয়ে আয়েশ করে পান চিবুচ্ছেন মামা। এক দৌড়ে মামার সামনে। আমাকে দেখেই ‘কিরে হঠাৎ এমন জরুরী তলব’ জাতীয় তরল কথা বলতে চাচ্ছিলেন হয়তো কিন্তু আমি মামার হাত পাকড়ে ‘চলো’ বলে সজোরে টানতে শুরু করেছি। লোকটা যদি টের পেয়ে যায় যে তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে তবে সে অবশ্যই পালাবার চেষ্টা করবে। ডেঞ্জারাস ধরনের লোক হলে তার পক্ষে দরজা ভেঙ্গে ফেলাটা কোনো কঠিন কাজ হবার কথা নয়। তখন জয়ন্ত আর আকাশের ওপরই বরং আকাশ ভেঙ্গে পড়তে পারে! মামাকে নিয়ে রুমে ঢুকতে ঢুকতেই মামা ‘ক্ কী ব্যাপার’ বলে কথা শুরু করে দিচ্ছিলেন। আকাশ ঠোঁটে আঙ্গুল তুলে থামাল তাকে। তারপর এক কোণে নিয়ে পুরো ঘটনা সংক্ষেপে জানাল তাঁকে। ব্যাপার শুনে আমার চোখ তো কপালে উঠে যাওয়ার যোগাড়। ব্যাপারটাতে যদি সাকসেসফুল হই তাহলে হেভ্ভি একটা ব্যাপার হবে। সব শুনে টুনে হেসে ফেললেন মিলন মামা। হোলস্টার থেকে সাবেকি আমলের রিভলবারটা বের করে হাতে নিলেন। তারপর হঠাৎ দরজা খুলে ঢুকে পড়লেন ভেতরের গেস্টরুমে। যেখানে আগুন্তুককে বসিয়ে রেখেছিল আকাশ। আকাশের কথাই ফলে গেল। শান্তিনিকেতনী ব্যাগে অশান্তির নিয়ামক হেরোইনের প্যাকেট মিলল দুটো। একজন অপ্রস্তুত লোককে অস্ত্রের মুখে কাবু করা কোনো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসাররের জন্য ডাল-ভাত ব্যাপার। আমরা অই রুমে ঢুকতে ঢোকার আগেই দেখি মিলন মামা লোকটার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছেন। ফোন করে দেয়াতে মিনিট দশেকের মধ্যে পুলিশ লেখা একটা পেট্রোলকার এসে দাঁড়িয়ে গেল সাময়িক ঠিকানার সামনে। রহস্যময় ভদ্রলোককেও গ্রেফতার করতে কোনো কষ্ট হলো না পুলিশের। মিলন মামার ওপর এখন ভীষণ দায়িত্ব। যাওয়ার সময় আমাদের পিঠ চাপড়ে আদর করে গেলেন। আর বলে গেলেন সামনের শুক্রবারে চাইনিজে আপ্যায়ন করবেন আমাদেরকে। আর কীভাবে সম্ভব হলো এই হেরোইন পাচারকারী চক্রকে ধরা তা সবিস্তারে শুনবেন। চাইনিজ খেতে আমাদের কারুরই তেমন আপত্তি থাকার কথা নয় বিশেষত যখন নিজের গাঁটের পয়সা যাচ্ছে না একটিও!
মালিবাগের একটা রেস্তোঁরায় মুখোমুখি বসে আছি আমরা। আজ মিলন মামার গায়ে পুলিশি পোশাক নয়, দৃষ্টিনন্দন সাফারি। খাবারের ব্যাপারটা আমাদের ওপর ছেড়ে দেয়ায় জয়ন্ত মেন্যুটাকে লুফে নিয়েছে। ওর নিদের্শমত কিছু দামী আইটেমের অপেক্ষায় এখন আমরা।
‘তা ভাগ্নে ব্যাপারটা কী?’ মামা আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন। আমি মামার দৃষ্টিকে প্রতিফলিত করে আকাশের গায়ে ফেলে দিলাম। আকাশ শুরু করল,
‘সেদিন বই টই না পেয়ে লাইব্রেরীতে গিয়েছিলাম বই পড়তে। ভাবছি কী বই পড়া যায় হঠাৎ দেখি পাশের বাসার নতুন ভাড়াটে ভদ্রলোক আবিদ সাহেব ঢুকলেন। তিনি ঢুকেই ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব তাকের একটি বই বের করে নিলেন। ভদ্রলোককে আমার কখনোই গবেষক মনে হয়নি। কিন্তু তিনি যখন একটু পর বইটা রেখে বেরিয়ে গেলেন তখন আমার একটু সন্দেহ হলো। আমিও গিয়ে অই বইটা হাতে নিলাম। পাতা উল্টাতে গিয়ে দেখি মাল শব্দটার নিচে আন্ডারলাইন করা। হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মতো একটা সম্ভাবনা মাথায় উঁকি দিয়ে গেল। ভদ্রলোক কি প্রায় অপ্রচলিত একটা বইয়ের মাধ্যমে কোনো গোপন সংবাদ আদান-প্রদান করছেন? বইটা ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে শেষ পযর্ন্ত পুরো মেসেজটাই উদ্ধার করে ফেললাম। আজ বিকেল চার টায় ১০ নয়াপল্টনে মাল পৌঁছে দেবে – আঃ হোঃ বিভিন্ন পাতায় নানা শব্দের নিচে দাগ টেনে টেনে মেসেজটা লেখা ছিল। সন্দেহ না করে পড়লে কারো পক্ষে বিষয়টা বোঝা মুশকিলই। আমি এক ফাঁকে বুদ্ধি করে রেজিস্ট্রার খাতা দেখে এসেছে। ওমা! আবিদ হোসেন নামে কেউ এখন পযর্ন্ত ইন-ই করেনি! নয়া পল্টনেরও কেউ নেই আমরা ছাড়া। হঠাৎ মাথায় একটা দুষ্টুমি খেলে গেল। ১০/১ নং বাসাটাই আমাদের। চালাকি করে ১০ এর পর অবলিক ১ শব্দ দুটোর নিচেও দাগ টেনে দিলাম। তারপর বইটাকে যথাস্থানে রেখে ওখান থেকে একটু দূরের একটা টেবিলে বসে পড়লাম। ভাব করছিলাম যেন বই পড়ছি কিন্তু সারাক্ষণই নজর রেখেছি কেউ এসে অই বইটা নেয় কি না। আসবেই যে এমন আশা অবশ্য ছিল না। কিন্তু প্রায় ঘন্টা দেড়েক পর ঢ্যাঙা এক লোককে এগিয়ে যেতে দেখলাম ওখানে। তখন বুকের ভেতরটা কেমন যে করছিল! লোকটা সত্যি সত্যি অই বইটা নিয়েই একটা টেবিলে বসে পড়ল। আমি নিশ্চিত ছিলাম লোকটা সেই মেসেজটা পড়ে নিচ্ছে। একটু পর অই লোকও নিরুদ্দেশ হলো। এরপর কী ঘটেছে তাতো সবাই জানি।’
এতক্ষণ চুপচাপ ফ্রিজ হয়ে শুনে যাচ্ছিলাম আমরা। আকাশের চোখ আনন্দ আর গরবে চিকচিক করছে।
‘কংগ্রাচুলেশনস ভাগ্নে কংগ্রাচুলেশনস!’ গমগমে গলায় আকাশকে অভিনন্দিত করলেন মিলন মামা। ওর পিঠ চাপড়ে দিলেন একবার। ভালো ছেলেরা সাধারণত বিনয়ী হয়। আকাশ সাথে সাথে বলল,
‘আমার আর কৃতিত্ব কী? আসল কৃতিত্ব তো সেই লাইব্রেরী বা সেই বইটার--’
ওর মুখের কথাকে কেড়ে নিয়ে পঞ্চমুখে মামার উক্তি, ‘তা বৈকি তা বৈকি!’
কবিতা লেখার চেষ্টায় আমি কখনো ক্ষ্যান্ত দিইনি। এখন এই মুহূর্তে কাব্য করবার এমন মোক্ষম সুযোগ পেয়ে তা ছেড়ে দেব অমন ছেলে আমি নই। সঙ্গে সঙ্গে বললাম,
‘মামা, তা বৈকি না বলে বরং বলো বই বৈকি!’
৯/১১/১৯৯০ খ্রীঃ
মন্তব্য
'শ্রাগ করা' মানে কী?
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
'কী জানি!' ভাব করে কাঁধ ঝাঁকানো।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
ভালোই লাগলো। কিশোরদের উপযোগী মনে হলো, এরকম লেখা তো কম পড়া হয় সচলায়তনে। তবে গল্পটা আরেকটু ঘষে-মেজে ছোট করে নেয়া গেলে ভালো হত মনে হলো, অথবা ব্লগের পাতায় দীর্ঘ জিনিস পড়ে অনভ্যস্থতায় আমার এমন মনে হতে পারে। একটু যদি প্যারার আর কথোপকথনের মাঝের স্পেসটা বাড়িয়ে দেয়া যায়, তাহলে পড়তে চোখের আরাম হয় বোধ করি।
বাকিগুলোও আসুক।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
হ্যাঁ কিশোরদের উপযোগী করেই এক কিশোরের লেখা ছিল গল্পটা। কাহিনীর প্রয়োজনে কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। লেখক রাশ টানার চেষ্টা করেননি। ঘষা-মাজা করা যেতই। তবে অই সময়ের স্বাদটা ধরার সুবিধার্থে আর কলম চালাইনি।
ধন্যবাদ আপনাকে অজস্র।
ভালো লেগেছে। আরো ভালো-ও হতে পারতো। মনে হলো।
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ
খোমাখাতা
অবশ্যই। আপনার সাথে সহমত। প্রায় একুশ বছর আগে কাঁচা হাতের লেখা গল্প। ইচ্ছে করেই আর সম্পাদনা করিনি।
ধন্যবাদ মন্তব্য করার জন্য।
কবিতা কই?
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আপাতত কবিতার মাঠ ধু ধু বালুচর! এক পশলা বৃষ্টি হলেই হয়তো কবিতা আসবে!
ভালো লাগলো...
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
কষ্ট করে পড়ার জন্য অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা।
নতুন মন্তব্য করুন