সবে ক্লাশ নাইনে উত্তরন,ঠিক হয়নি তখনও কে কোন বিভাগ নিবে,এ নিয়ে চাপা উত্তেজনা সকল মনে...এরই মধ্যে অন্য এক ঢেউ ক্লাশজুড়ে আলোড়ন তুললো! তরঙ্গ নির্মাতা যথারীতি বাদল স্যার। ছোটবড়মাঝারি যেকোন উপলক্ষ পেলেই যিনি সাতঁরাতে ভভালবাসেন! ঘটনা এই, এক ঢাকাইয়া বালিকা ভর্তি হয়েছে আমাদের ক্লাশে,ভারতেশ্বরী হোমস ছিল যার পূর্ববর্তী স্কুল! টেলিভিশনে দেখা বিভিন্ন উৎসব অনুষ্টান উপলক্ষে মাঠজুড়ে ওদের ফুলপাখি হয়ে উঠার সৌজন্যে স্কুলটি তখন গ্রাম মফস্বলের শিক্ষার্থী শিক্ষকদের কাছে যথেষ্ট পরিচিত এবং আগ্রহ উদ্দিপক। তো স্যারের গল্পোচ্ছাস ডানা উড়াতেই থাকে, সেই মৃদু হাওয়ায় আমরা জেনে যাই, তাহার দুই মেয়ে, তাদের হোমসে পাঠানোর স্বপ্ন, আরও যেন কিকি সব।
গ্রাম্য স্কুলটিতে স্যারই ছিলেন কোথায় যেন একটু আলাদা। তার দুই কন্যার নামেই খানিক পরিচয় মেলে, প্রজ্ঞা পারমিতা, প্রজ্ঞা লাবনী...
যাহোক, স্যার বেশ ভালোই সংক্রমন ঘটাতে পেরেছেন উচ্ছাসের, আমাদেরও প্রতিক্ষা রূদ্ধশ্বাস, কিঞ্চিত উত্তেজনা। শুনতে হাস্যকর ঠেকলেও তখনকার পরিস্থিতিতে সেটা খুব স্বাভাবিক ছিল। চাটগাঁ শহরই যাদের কাছে দূরঅস্ত, এ তো খোদ ঢাকাফেরত!
হুম, তাহমিনা তুহিন। আমরা দেখলাম, দেখল সেও। ওর দেখা থামলেও থামেনা আমাদের, দেখতেই থাকি, প্রকাশ্য বা চোরাচোখে! কি সুন্দর কথা বলার ভঙ্গী উচ্চারন, হাটাচলার ধরনও বুঝি অন্য, টিচারদের সাথে কেমন সহজ সপ্রতিভ, রোলকলের জবাবে ভিন্নরকম রেসপন্স...সবকিছুই আমাদেরচে যোজন আলাদা।
মুগ্ধতাজনিত কিছু ভীতি বোধয় থাকে মানুষের। ওর আন্তরিক চেষ্টায় সেই ভীতি বন্ধুতার রূপ নিল। বছর ঘুরতেই দেখলাম, আমরা জুড়ি হয়ে গেছি! অন্যদের থেকে আলাদাও। এসএসসির পর অনিবার্য বিচ্ছিন্নতা। এটুকই শুধু জানা ছিল, সিরাজউদ্দৌল্লা রোড বাসা। বছর দুয়েক পর আমাদেরও শহরবাস। মনের ভেতর গাথাঁ একটাই রোড, ওই রোড দিয়ে যাওয়ার সময় আপনাতেই চোখে জমে বাড়তি সতর্কতা...
নতুন ঘটনা নতুন বন্ধুতায় আখাঙ্খা ম্লান হয়। তবু মনের একটুকু কোন্ ঠিকই ওর থাকে, সে নিয়েই গড়িয়ে যায় ১১ বছর। একদিন অফিসফেরত হয়ে শুনি, তুহিন এসেছিল! এই অবিশ্বাস্য যোগাযোগে আমার মা বোনরাও রোমাঞ্চিত। কত মোটা হয়েছে, কি পরে এসেছে, কি কি কথা বলেছে, কেমনে খুজেঁ পেল, ইত্যকার গল্পে মুখর... বাসার ঠিকানা দিয়ে গেছে, সেই একই রোড! পড়ে পাওয়া অনুভূতি বুঝি এটাই।
দেখা হল, ১১বছর পর, আশ্চর্য কেউ কাউরে জড়িয়ে ধরলামনা, অথচ ভেতরে উত্তাল যমুনা। ও মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী, একবারই দেখা। কিন্তু ফিরেতো পেলাম।
এইসএসসিতে জুটে গেল নাসরিন...ক্রমশ ঘনিষ্টতায় যখন ষ্পষ্ট হল ওরা বিএনপি সাপোর্টার, সে এক বিস্ময়বোধের চুড়ান্ত। আমাদের গন্ডিবদ্ধ জীবনের ধারনা, দেশের সকল ভাল মানুষেরা লিগ সাপোর্টার! হয় তুমি লীগ সাপোর্ট করো নয় তুমি খারাপ, হিন্দুবিদ্ধেষী!! নাসরিন সান্নিধ্যে বড়সড় এই সংকির্ন মানসিকতা থেকে মুক্তি ঘটল। বুঝলাম আমার জানার বাইরেও রয়েছে বিশাল বাস্তবতা।
নাসরিনও হারিয়ে গেল একসময়, পরে শুধু এইটুক জেনেছিলাম, এবি ব্যাংকের এক কর্মকর্তার সাথে বিয়ে হয়েছে, আপাদমস্তক বোরকা মোড়ানো জীবন। আশা আছে একদিন ওরেও খুজেঁ বের করবো!
তৎপরবর্তি জীবনে যার বন্ধুতায় ভেসেছিলাম তার নাম রমা। বহির্চরিত্রে একেবারেই সাদামাটা অথচ অন্তরে অগ্নিগিরি উত্তাপ। আচারিক হিন্দু হওয়া সত্তেও ওর ভেতরে সংশয়বাদী একটা মন সবসময়ই সক্রিয় ছিল। আমার যাবতীয় ঠিক বেঠিক কর্মকান্ডের মুগ্ধ সমর্থনকারী! ওর বলা একটা কথা মনে পড়লে হাসি পায় এখনও। তদ্দিনে এক পত্র প্রেমে জড়িয়ে পড়েছি, ডাকবিভাগে পোষায়না,বড্ড দেরী করে,কুরিয়ার সার্ভিসই ভরসা!
ও বলেছিল, যদি ওকে লাখটাকা আর আমার চিঠিগুলো, দুইয়ের একটা তুলে নিতে বলা হয় ও চিঠিগুলোই নেবে! মানুষ জীবনে অনেক বোগাস হাস্যকর কথা বলে, তা সত্তেও সব বোগাস কথাকে আমি মূল্যহীন বিবেচনা করিনা, যত অর্থহীনই হোক বলার সময় কথাটার সাথে যে আনন্দ আহ্লাদ মিশে থাকে সেইটুকের জন্যই কথাটা দামী হয়ে উঠে। ভাগ্য ভাল আমার রমাকে পূর্ববর্তিনীদের অনুগামী হতে হয়নি। ওর যখন বিয়ে ঠিক হয়, বলেছিল আমি বন্ধু সার্কেল থেকে হারাচ্ছিনা, ভাবতে পারিস আরও একজন আমাদের সার্কেলে যুক্ত হচ্ছে! আসলেই কি ঘটেছিল সে আর উল্লেখ করতে চাইনে।
এই তিনজন ছিল আমার শিক্ষাজীবনের তিনটি ধাপে পাওয়া তিনখন্ড হীরক।
পত্রিকার পাঠকপাতা গুলো ঘিরে একসময় বেশ আলোড়ন ছিল নব্য ছুটকোছাটকা পড়ুয়া আর লিখিয়েদের মধ্যে। ওই বুদবুদ থেকেই আমার জুটে গেল আর এক চিরকালীন বন্ধু রশীদা আফরোজ। শুধু ওকে চমকে দিতেই একদিন ফেনী ছুটে গিয়েছিলাম একা। এতো কথা ও বলে আর এতোই চমৎকার করে বলে, শোনার নেশা আমার একজীবনে ফুরোবেনা।
স্মৃতিকনা বিশ্বাস, আর এক যোদ্ধা বন্ধু আমার। দেশ আলোড়ন করা এক দুর্ঘটনার শিকার হয়েও লড়াইয়ে জিতে গিয়েছিল ওর অনন্য মনোবলের কারনে। পত্রিকা থেকে নাম ঠিকানা যোগাড় করে শুভাশীষ জানিয়ে পত্র লিখেছিলাম। পত্র বেয়ে আজ আমরা পারিবারিক বন্ধু। ওর বন্ধুতা থেকে শুধু উষ্ণতা নয় অন্য এক শক্তি লাভ করেছি।
আর যে দুজন এখন পর্যন্ত আমার জীবনটাকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে রয়েছে তাদের বোধকরি ছাত্ররাজনীতির মাঠ থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম, ঠিক মনে নেই! একজন বীথি,আসমা বীথি। অসাধারন গদ্য লিখতো। বেলাশেষে ও যে কবি পরিচিতি পাবে বা কবিতামগ্ন জীবন কাটাবে আদ্দিকালে সেটা আমার বোঝার বাইরে ছিল। আজ ভাবলেও আতঙ্ক হয় ও না থাকলে সেই দু:সময়টা আদৌ পেরুতে পারতাম? প্রতিটা দিন ওর মানসিক শুশ্রুষা যত্ন আর পরিচর্যাই আমাকে সুস্থ রাখতে পেরেছিল। জীবনে এমন কিছু দুর্যোগ থাকে পরিবারের লোকের পক্ষে যা মোকাবেলা করা সাধ্যের বাইরেতো বটেই, অনেকসময় তাদের জ্ঞ্যাত হবার সুযোগও থাকেনা। সেইযে গাটছড়া বাধাঁ হল আজ অবধি অটুট। আলাদা আলাদা আমরা কোথাও আনন্দ পাইনা, ঘর হোক কি বাইরে, একসাথে থাকাটাই আনন্দের সমার্থক॥ ও একা কোথাও গেল বা আমি, সেরকম ক্ষেত্রে ইন্দ্রপূরীকেও ইটভাটাই মনে হয়!
দীর্ঘ চৌদ্দবছরের সংসার ওর সাথে।
ওর মাধ্যমেই বোধহয় পরিচয় ঘটেছিল মেঘবালিকার সাথে, কান্তা তাজরিন। এক চলন্ত বিস্ময়। যত দূর থেকেই দেখুক, দৃস্টিসীমায় পৌছুলে আর হুশ থাকেনা, দৌড়ে আসা চাই। রাস্তা মার্কেট জনারন্য দেখাটা যেখানেই হোক জড়িয়ে ধরে টপাটপ চুমু! এখন মনেও পড়েনা এক না দুই বছরের যৌথ জীবন ছিল। খুব দ্রুতই বিয়েবাবদ ইউরোপবাসী...কি আজব ওর মাধ্যমেই জানলাম কেউ কেউ চোখের আড়ালটাকে ঝেটিয়ে মন পর্যন্ত পৌছুতে দেয়না। আমার ফোনে ওর নাম্বারটি সেভ করা কান্তেশ্বরী নামে! ও ঠিক তাই।
বী আমার ঘটিতে তোলা জল, নিত্যব্যবহার্য, প্রয়োজন, মজুদ থাকা চায়, নয়তো প্রান উষ্ঠাগত। আর কান্তা সমুদ্রজল....
এর বাইরে আরও অনেকেই ছোট বোনটি ভাইটি বা দাদা দিদি হয়ে জড়িয়ে ছিল আছে। ওদের থাকা আমার তুচ্ছ জীবনটাকে ঋদ্ধ করেছে।
অরুন্ধতী ঝিলি
মন্তব্য
আরেকটু গুছিয়ে লিখতে পারতেন। অনেকগুলো গল্প, একেবারে সব না বলে অল্প অল্প করে বলতেন, আরেকটু ডিটেইলস সহ। লিখতে থাকুন।
_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই
আমিই প্রথম। ভালো লেগেছে। সাথে মনটা ও খারাপ হয়ে গেছে। ওই যে একটা কথা বলেনা, as a child we always wants to grow up. But when we are grown up, we realize that, broken toys and lost pencil are better than broken hearts and lost friends.
ভালো থাকুন।
এ হাসনাত।
তবু আপনি অনেক lucky যে শেষ পর্যন্ত কেউ রয়ে গেল, অনেকের কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা।
লাবন্যপ্রভা
ভাষা অলংকরণ বেশি হয়ে গেছে বোধ হয়, আর একটু সহজ ভাষা ব্যবহার করা যেত।
চলুক
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
ঝিলি ঝিলি ঝিলিমিলি.
কত কত কতকাল পর তোমার একটা লেখা পড়লাম!
কী ভালো যে আমার লাগছে।
নতুন মন্তব্য করুন