এই অসহ্য সব ব্যথার দংশনে কোনো কোনো সময় জ্বালা ধরে যায়। হয়তো বা সেই অপঘাতের দংশনে এই রাজ্যের স্বনামধন্য লেখক প্রবুদ্ধসুন্দর করকে পর্যন্ত বলতে হয়, আমাদের এলাকায় স্বঘোষিত প্রগতিশীল অনেকের বাড়ির বৈঠকখানায় মুসলমানদের প্রবেশধিকার নেই। বাইরে বসতে দেওয়া হয়। দাদার এই কথা শুনে আমার মনে হয়েছিলো না, আমরা পেরেছি, সত্যিই পেরেছি জাত এন্ড ধর্মের দালাল হতে। এমন অনেক কে আমি বলতে শুনেছি, দেখেছি মাঠে ময়দানে রাস্তায় ধূলা উড়িয়ে তর্কের বহিঃপ্রকাশে – আরে জাতপাত কিছুই না, সবাই মানুষ। কিন্তু নিজের বাড়ির কেউ ভিন্ন জাতের সাথে মেলামেশা করলে সেই হারামির বাচ্চার চেহারার আমূল পরিবর্তন দেখে মনে হতো আলেকজান্ডার তোমার অনুমানকে স্যালুট, এরাইতো গড়েছে বিচিত্র দেশ। আবার সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে যখন প্রফুল্লদা আমাকে বলেন, তাপস পাঠশালায় ধর্মের ক্লাস চলছে, আমি কতদিন কোরান ক্লাসে গিয়ে চুপচাপ অবাক হয়ে শুনেছি মৌলবি স্যারের কথা। দাদার জীবনের ৪০-৫০ বছর পূর্বের এই স্মৃতিচারণা শুনে আমি বাক্যহারা হয়েছি। কিংবা সমীরণদার মুখে শুনি, আমার ছাত্ররা কখনো কখনো জিজ্ঞাসা করে স্যার আপনি বামুন? উত্তরে ষাটোর্ধ এই মানুষটি বলেন – আমি বজ্জাত!
বছর চার পাঁচেক আগের কথা, দুর্গাপূজার সময়, আমি তখন দক্ষিন ত্রিপুরার উদয়পুর শহরে। আমার মনে আছে সেই সময়টায় রমজানের মাসও ছিলো। একদিন সন্ধ্যায় দেখি কাতারে কাতারে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ স্থানীয় বিবেক সঙ্ঘ ক্লাবের পুজোর মণ্ডপের সামনে, মাথায় তাদের ধর্মীয় টুপি। তারপর যা দেখলাম তা আমার হৃদয়ের তারকে ছুঁয়ে গেলো। সবাই সারিবদ্ধ ভাবে মণ্ডপের পাশের ঘরে ঢুকলেন, তারপর নামাজ পড়লেন। নামাজের শেষে মণ্ডপের সামনে সবাই মিলে ইফতেহার সারলেন। সাথে ছিলেন হিন্দু ধর্মের লোকেরাও। এই মানবশৃঙ্খল দেখে আমি ভেবেছিলাম লালনের কথা – জলের উপর পানি না পানির উপর জল!
কিন্তু,
নিজের মধ্যে চলতে থাকা কিছু অস্বাভাবিক অনটন আমার জীবনকে বারবার প্রবল স্রোতে ধাক্কা দেয়। বিশেষ করে আমার ওপারের কথা। ওখানে আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে দুটো মানুষ। একজন আমার আদরের দিদি ভাই, আর অন্যজন আমার.........। জাতের বিচারে ওরা (according to সমাজ) আমার থেকে পৃথক!
আমার দিদিভাই বলেন - আঃলীগের বিরুদ্ধে কথা বললে কেউ আমাদের বলে বিএনপি - জামাত ও পাকিস্থানের দালাল, বিএনপি-জামাতের বিরুদ্ধে কথা বললে কেউ আমাদের বলে আঃলীগ ও ইন্ডিয়ার দালাল, ইসলামের কথা বললে,বানী ছড়ালে কেউ আমাদের বলে কট্ট্ররপন্থী মুসলিম গ্রুপ। একটা কনফেশন তো তাহলে করতেই হয় , আমরা হলাম বাংলাদেশের দালাল, দালালী করি আমার মাটির পতাকার দেশের।
দিদি ভাই এর চেতনায় আমি দেখেছি মৃণ্ময়ীর আরোহণ। বড্ড মায়া হয় ওর জন্য। মনটা ছুটে যায়।
আর অন্যজন......
.........। ওকে আমি একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম - তুমি কোথায়, ঘরে? ও হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলো- হ্যাঁ, বাসায়।
‘ঘর’ আর ‘বাসা’- আচ্ছা কোনো বিশাল তফাত আছে কি? এটাই কি আমদের সীমারেখা? যা টেনে দিয়েছে আমদের মধ্যে ধর্ম-জাত-সোসাইটি।
আজ এই লেখাটা লেখার সময় ভীষণ মন খারাপ লাগছে। ভীষণ। একটা চিনচিন ব্যথা। হারানোর ভয়। দুদিকের
কাটাতারের হাহাকার। শুধু ভাবি আমাদের ‘ঘর’ আর ‘বাসা’ মিলে কি একটা ভালোবাসার ‘সংসার’ হতে পারেনা।
জানি কোথাও উৎ পেতে আছে ভয়ানক ঝলসানো রঙ। কিন্তু সেও কি একবার পিছন ফিরে ভেবে দেখেছে যাকে মারল তারও রক্তের রঙও লাল!
আমি ভেবে পাইনা উত্তর
আমার কানে এখন দোলা খাচ্ছে অঞ্জন দত্ত, এক অদ্ভুত মনমাতানো সুরে......... ওপার থেকে ফিরে এসে বেধেছিলেন :
“ডলারের হার কমলে তাদের দর বদলায়, চোখের জল কিংবা পানি সে তো নুনতাই থেকে যায়।”
=================
আগরতলা
আগস্ট, ২১। ২০১১
মন্তব্য
ভাই এত বিষণ্ণ হয়েন না, আমরা সবাই বদলাবার চেষ্টা করলে সমাজও একদিন বদলাবে।
আমি এখানে আসার সময় এক বয়স্ক আত্মীয়া বলেছিলেন, বাছা, বিদেশে গিয়ে মেমসাহেব বাগিয়ে আনবি তা বেশ কথা, কিন্তু মোছলমান মাইয়া কাউরে ধরিস না যেন! তা বলতে গেলে আমার এখানের বাড়িতে মুসলমান খ্রীষ্টান নাস্তিক সবরকমের লোকেরাই এসে খাইদাই করে গেছে। আর আমি বড়ই দোটানায় থাকি - পশ্চিম এশিয়া (ইরানী-তুর্কী-উজবেক) আবার পূর্ব ইউরোপীয় (জর্জিয়া-রোমানিয়া-ইউক্রেন) দুই অঞ্চলের বালিকাদেরই বড় মনোহরণ লাগে... খ্রীষ্টান না মুসলমান কারা বেশি ম্লেচ্ছ ভাবতে ভাবতে কাউকেই ধরা হল না...
বদলাবার এই তাড়না নিজেদের ভেতরে চেপে না রেখে প্রকাশ করে যেতে হবে। ভিন্ন ধর্ম/জাতের মেল বন্ধনের সুন্দর উদাহরণ গুলো কে চোখের সামনে তুলে ধরতে হবে।
এই বিষয়ে আরো লেখা আসুক।
_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩
নতুন মন্তব্য করুন