আমার বালকবেলায় পুঁজোর ছুটিতে আব্বা আমাদেরকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতেন। তখন রেলগাড়িতে করে আমাদের গ্রামের বাড়ি যেতে হত। সে সময় বাংলাদেশে (তদানিন্তন পূর্ব-পাকিস্তান) আন্তজেলা সড়ক যোগাযোগ ছিলনা বললেই চলে। তখনকার দিনে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল রেলপথ ও নৌপথ।
আমাদের ট্রেন পদ্মা নদী পার হত সাড়ারপুলের উপর দিয়ে। ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা যেত পদ্মা নদীতে হরেক রকম নৌকার রংবেরং এর পাল তুলে যাতায়াতের দৃশ্য। যাত্রাপথে ক্ষুধা লাগলে ট্রেনের বুফেকারে খাবারের অর্ডার দেওয়া হত। সে খাবার ছিল আমাদের কাছে অমৃতসম।
রেলগাড়িতে ভ্রমণের আরেক মজা ছিলো, কোন বড় স্টেশনে ( যাকে বলা হয় জংসন ) গাড়ি থামলেই আমরা, ছেলেপেলেরা স্টেশনের প্লাটফর্মৈ নেমে পড়তাম। এটা ওটা দেখতাম আর গাড়ির ভোঁ বাজার সাথে সাথে তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে উঠে পড়তাম। ছেলেবেলায় অনেক লম্বা ভ্রমনেও কখনও আমরা ক্লান্তি বোধ করতাম না।
আমাদের গ্রামের সেই ষ্টেশনটির নাম ছিল সুন্দরপুর। কি সুন্দর ছিমছাম নিরিবিলি ছিল ষ্টেশনটি। এখন ষ্টেশনটি পরিত্যক্ত। সেখানে এখন আর ট্রেন থামেনা। পরিচর্যার অভাবে ষ্টেশনটি এখন ভাঙাচোরা অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় পড়ে আছে।
যাহোক, ট্রেন নির্দিষ্ট ষ্টেশনে পৌঁছালে কুলি ডেকে মালামাল নামানো হত। ষ্টেশনের বাইরে আমাদের জন্য গরুর গাড়ি অপেক্ষা করত আমাদেরকে বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য। মালামাল উঠিয়ে আমরাও গাড়িতে চেপে বসতাম। বড়দের কেউ কেউ গাড়ির সাথে হেঁটেই চলতেন।
বাড়িতে পৌঁছালে একটা উৎসব উৎসব ভাব হত আমাদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য। হাতমুখ ধোবার জন্য বালতিতে পানি দেওয়া হত। কেউবা মগে করে পানি ঢেলে দিতেন আমাদের সুবিধার জন্য। তারপর আমাদের খাবার জন্য দেওয়া হত বিভিন্ন ধরনের পিঁঠা, মুড়কী, খই, মুড়ি ও পাটালি ইত্যাদি। চা ও দেয়া হত বটে তবে সেটাতে একধরনের সোঁদা গন্ধ থাকত।
সকালে আলুভর্তা, ডিমভাজি ও ডালের সাথে গাওয়া ঘি দিয়ে ভাত খাওয়া। পুকুরপাড়ে তখন চলছে জাল টেনে মাছ ধরার কাজ। এভাবে বেশ কয়েকটা মাছ ধরা হত। দুপুরে অনেকজনের জন্য রান্না হত। কারন, আমাদের সাথে দেখা করার জন্য বেশকিছু আত্মীয়স্বজন ঐ বাড়িতে আসতেন।
আমি আমার সমবয়সীদের সাথে বিকালে এবং জোছনা রাতে বাড়ির উঠানে 'বুড়ি চু' 'দাড়িয়াবান্ধা' এই ধরনের খেলা খেলতাম।
আমাদের পাশের গ্রামে একটি বর্ধিষ্ণু হিন্দু পরিবার থাকতেন (এখন তাঁরা ভারতে)। তাঁদের বাড়িতে দূর্গাপুজোর উৎসব হত। আমরা পুঁজোর আনন্দ উপভোগ করার জন্য তাদের বাড়িতে যেতাম। আমাদের সঙ্গে একজন মুরুব্বি দিয়ে আমাদেরকে পাঠান হত। তাঁদের বাড়ি পৌঁছালে আমাদেরকে অন্দরে নিয়ে যাওয়া হত এবং নানা ধরনের মিষ্টান্ন ও ফলমূল ইত্যাদি খেতে দেওয়া হত। আমরা একধরনের লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে সেগুলো খেতাম।
সারারাত ধরে সেখানে যাত্রাপালা হত। আমরা কিছুক্ষন অনুষ্ঠান দেখে বাড়ি ফিরে আসতাম। কিশোরবয়সে দেখা একটি যাত্রাপালার গানের কয়েকটি লাইন এখনও স্মরন করতে পারি, যেমন, "শিশুকালে দুঃখ পাবি, সাগরজলে ভেসে যাবি। এ রাজাকে নিধন করে, রাজা হবি বিশ বছরে।" কিশোর বয়সের স্মৃতি সম্ভবত সহজে ভোলার নয়।
গ্রাম থেকে ফেরার দিন আমাদের সাথে অনেক আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশী বিদায় দেবার জন্য ষ্টেশন অবধি আসতেন। আমরা ফিরে আসতাম আমাদের সেই ছোট্ট মফস্বল শহরে। স্কুলের বন্ধুদের সাথে গ্রামের অভিজ্ঞতার গল্প হত। আমার মত অনেকেই ছুটিতে গ্রামে যেত। তারাও তাদের আনন্দ শেয়ার করত।
তখনকার দিনে আমরা নিজেরাই পায়ে হেটে স্কুলে যাতায়াত করতাম। আজকের দিনের মত কোন অভিভাবক আমাদেরকে আনানেওয়া করতেননা। তখন সড়কও অনেক নিরাপদ ছিল। মফস্বল শহরে আমরা ব্যাক্তিগত ব্যবহারের মটরগাড়ি দু-একটি ব্যতীত দেখি নাই। শহরের মধ্যে বাস চলাচলও তেমন ছিলনা। বেবিটেক্সীও ছিলনা। বাহন বলতে শুধুমাত্র রিকসা।
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে কোনমতে দুটো নাকেমুখে গুঁজেই দৌড় মাঠের দিকে। আমরা দুদলে ভাগ হয়ে ফুটবল খেলতাম। ক্রিকেট খেলার চল তখন ছিলনা। তবে সন্ধ্যার আগেই আমাদেরকে বাড়ি ফিরতে হত, নইলে আব্বার হাতে উত্তম মধ্যমের মাফ ছিলনা।
জোছনা রাতে দল বেধে নৌকায় চড়ে নদীতে ঘুরে বেড়াতাম। কখনও সখনও নৌকা থেকে পানিতে লাফ দিয়ে পড়তাম। প্রায় সবাই সাঁতার জানতো। আমরা সাইকেল চালাতেও জানতাম। ছোট থাকার কারনে আমরা সিটে বসে চালাতে পারতামনা। আমরা যেভাবে চালাতাম তাকে বলত হাফ সাইকেল চালানো।
আমার বড় ভাইয়েরা সাইকেল চালিয়ে কলেজে যেতেন। তখন ভাবতাম কবে বড় হব। বড়দের কি মজা। বড় একসময় হলাম বটে তখন উপলব্ধি করলাম কৈশোরই হচ্ছে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। কোন দায়িত্ব থাকেনা। দায়িত্ববোধই জন্মেনা।
তারপর একদিন বড় হলাম। শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ। তারপর সংসারজীবন। আর দেশটাকে অপরিকল্পিত উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যেতে দেখলাম সত্যিকার অর্থেই। সমাজে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি প্রবেশ করল দৃশ্যমানভাবে। মাদকের থাবা গ্রাস করল যুবসমাজকে। এমনকি সমাজের প্রায় সর্বশ্রেনীকেই।
খাদ্যে ভেজাল, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতি, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, যানজট, ভূমিদখল, নদীদখল,পরিবেশদূষণ, মন্ত্রী-আমলাদের দূর্নীতি, প্রভাবশালী ও সূধীজনদের নির্লজ্জ সুবিধাভোগ। রাজনীতির চরম দেওলিয়াত্ব, সমাজজীবনে অস্থিরতা, ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা, মূল্যবোধের চরম অবনতি।
বিবেকবান ভাল মানুষগুলোকে তখন পরিবারের কাছে বোকা বলে চিহ্নিত করা শুরু হল। এ পরিবর্তন এত দ্রুত ঘটল যে, সংস্কৃতিমনা বিবেকবান মধ্যবিত্তেরা এর সাথে তাল মিলিয়ে মানিয়ে নিতে পারলেননা। তাঁরা প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন। কিন্তু তাদের প্রতিবাদের প্রতি বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করলেননা সংশ্লৃষ্টজনেরা। আপামর জনগন হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ল। ভাল কিছুর আশা আর অবশিষ্ট রইলনা। টানেলের শেষপ্রান্তে আর আলোর আভাষ পাওয়া যাচ্ছিলনা।
আমি এখন ঢাকা শহরের বনানীতে একটি ছয়তলা এ্যাপার্টমেন্ট ভবনের চারতলার একটি ফ্লাটে থাকি যেখানে সর্বক্ষণ বাতি জালিয়ে রাখতে হয় অন্ধকার নিবারনের জন্যে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া হয়না বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তাহীনতার অজুহাতে। বাসায় কথা বলার তেমন কেউ নাই। আছে একটা ল্যাপটপ। ই-মেইল, ফেসবুক, ইউটিউব, সচলায়তন ইত্যাদি নিয়ে মেতে থাকার ব্যার্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস।
এখন আর ভোরের স্নিগ্ধ বাতাশ গায়ে লাগানো হয়না, জোছনা রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার সুযোগও হয়না। এমনকি নিজ চোখে রমযান অথবা ঈদের চাঁদও দেখা হয়না।
আমার ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আকাশ দেখা যায়না, দেখা যায় পাশের ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রনকারী যন্ত্র। এভাবে কি সত্যিই বেঁচে থাকা যায়? জীবনধারন করা যায় অবশ্য। তোমাদের কাছে এই প্রৌঢ়ের আকুল আবেদন, আমাকে বাঁচতে দাও। ফিরিয়ে দাও আমাকে আমার পৃথিবী।
লিখেছি : প্রৌঢ়ভাবনা
মন্তব্য
অসাধারণ
আপনার লেখায় খুব সহজ একটা ভাব আছে যা ভালো লাগলো। কিছু শব্দ একসাথে হয়েছে এদিকে নজর দেবার বিনীত অনুরোধ থাকলো(উত্তমমধ্যম/আমরাযেভাবে......) আরো লেখা আসুক শুভকামনা।
সেই পৃথিবী ফিরিয়ে দেয়া যাবে না। তবে সুযোগ থাকলে ঘুরে বেড়াতে পারেন যে কোন বয়সের একজন সঙ্গী নিয়ে। মাটির কাছাকাছি কোন জায়গায় গিয়ে জুতো খুলে হেটে আসতে পারেন। সদ্য নিড়ানি দেয়া অচেনা সবজী খেতের মাঝ দিয়ে পায়ে ধুলোবালি লাগিয়ে ছেলেমানুষিতে মেতে উঠতে পারেন। বয়স হলে এসব মানায় না, কিন্তু এসবে নিদারুণ আনন্দ বিশ্বাস করুন। ভালো থাকুন, শুভেচ্ছা নিরন্তর।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ঠাসাঠাসি স্মৃতিভরা। ভালো লাগলো।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
কেউ বুঝে না কী কষ্ট একটা পুরো জাতি হারানোর... কী স্বপ্ন মানুষ দেখে আর বাস্তবে রূপান্তর করতে গিয়ে কী বানিয়ে ফেলে। ওহে প্রৌঢ়, আমার বয়স কিন্তু ১৯ । তবু আমি বুঝি। অনেক ইচ্ছা করে কোনোভাবে সেই বাংলায় যদি ফিরে যেতে পারতাম! তার চেয়েও অনেক বেশি খারাপ লাগে এই ভেবে যে আমার মা র সাথে সাথে অনেক রান্নার বৈচিত্র্য আমি হারিয়ে ফেলব...
তবু আমার মনে হয় এই নতুন যুগ আমাদের জন্য অনেক বেশি সুযোগ দিয়েছে। আমরা কেবল তাকে কাজে লাগাতে পারিনি। একমত না হলে অন্য একটি উন্নত দেশে গিয়ে দেখুন। তারা পেরেছে। বরং তাদের ঐতিহ্যকে আরো বড় করে তুলতে ও গবেষণা করতে পেরেছে। প্রযুক্তির সব কিছু থেকেই আমরা বঞ্চিত। কি আফসোস কত বছর লাগলো বাংলা ভাষা কম্পিউটারে আনতে। আইফোনে ৫৩ টা ভাষা তাও বাংলা নাই। ইন্টারনেটে এই জাতির কোনো যোগ্য প্রতিনিধিত্ব নাই। হায় আফসোস আমরা এখন কেবলই তৃতীয় বিশ্বের বন্যাপীড়িত দেশ! অথচ কিছুদিন আগেও "বাংলায় ঢোকার অনেক দরজা কিন্তু বেরোবার একটিও নেই!" (প্রথম আলোতে পড়েছিলাম, কত সমৃদ্ধ এ জাতি ইউরোপিয়ানরাও ভাগ্যান্বেষণে এখানে আসতেন!)
সাদি, আয়নামতি, নীড় সন্ধানী, নজমুল আলবাব আপনাদের সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ। লেখালেখির অভ্যাস আমার কোনকালেই ছিলনা। কথা বলার তেমন কেউ না থাকায় সচলায়তনকেই বেছে নিয়েছি। কারও বিরক্তির কারন হলে ক্ষমা করবেন।
প্রৌঢ়ভাবনা
আমরা সবাই কি একই গন্তব্যের দিকে যাচ্ছি? কেন যেন নিজের ভবিষত ছবি দেখতে পেলাম
খুব ঘন লেখা, পড়তে বেশ কষ্ট হলো... তবু পড়লাম স্রেফ ভালো লাগলো বলেই
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
পাঠক, Tanvir Rabbani আপনাদেরকে ধন্যবাদ ।
নজরুল ইসলাম, অনভ্যাসবশত এরকমটা হয়েছে। বেশ কষ্ট করে পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।
দারুণ স্মৃতিচারণ।
==============================
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ
খোমাখাতা
আহা, শৈশব!
-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী
আপনার লেখায় কখনো মন্তব্য করা হয়নি। ভালো থাকবেন না ফেরার দেশে।
নতুন মন্তব্য করুন