কীটপতঙ্গের নানা অপকীর্তির কারণে তাদের ভালো ভালো কাজগুলো আমাদের চোখের আড়ালে থেকে যায়। ব্যাপারটা আমাদের,মানে মানুষের সাথে মিলিয়ে দেখি। আমাদের সমাজে যেমন চোর-ডাকাত-খুনির সংখ্যা ভালো মানুষের চেয়ে অনেক অনেক কম, ঠিক তেমনি কীটপতঙ্গের বেলায়-ও তাই। এক হিসাবে দেখা গেছে, মানুষের জন্য ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গের পরিমাণ মাত্র এক শতাংশ। বাকী শতকরা ৯৯ ভাগ কীটপতঙ্গই নানাভাবে আমাদের উপকারে আসে। আসলে আজকের লেখার মূল প্রতিপাদ্য এটাই। আমরা কোনো জিনিশ পড়লেই তার গুরুত্ব,প্রয়োজনীয়তা,উপকারিতা-অপকারিতা ইত্যাদি নানান বিষয় জানতে চাই। আমাদের দেশের প্রশ্নপত্রগুলো অমুক বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা,তমুক জিনিসের উপকারিতা- ধরনের প্রশ্নে বোঝাই থাকে। আমার লেখা পড়ার পর আমার এক বন্ধুরও একই কথা- এসব কীট-ফিট দিয়ে হবেটা কী? আগের পর্বে ভূমিকার পর ভেবেছিলাম এই পর্বে ট্যাকনিকাল বিষয়ে ঢুকব। তবে পরে মনে হলো এই বিষয়টি নিয়ে আগে কিছু লিখি।
কীটপতঙ্গের সবচেয়ে বড় ভূমিকা বোধ হয় ফুলের পরাগায়ন ঘটানো। পৃথিবীর বেশিরভাগ শাকসবজি, ফলমূল, বীজ কীটপতঙ্গের সাহায্য ছাড়া হয় না- এটা আমরা জানি। পুরুষ ফুলের পরাগ যদি স্ত্রী ফুলে না পৌঁছে তাহলে ফুলের গর্ভসঞ্চার হবে না। আর সেটা যদি না হত তাহলে আমরা পেতাম না ওইসব মজার মজার ফলমূলগুলো যেগুলো আমরা আজকাল ফরমালিন সহকারে আগ্রহ নিয়ে খাই। আমরা তো নিশ্চয়ই জানি- ফুলের এসব রেণু বা পরাগ কীটপতঙ্গের পায়ে বা পাখায় অথবা শরীরের যেকোনো অংশে লেগে ফুল থেকে ফুলে ছড়িয়ে যায়। মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে পুষ্পক উদ্ভিদ আর কীটপতঙ্গের বিবর্তন হাতে হাত ধরে এগিয়েছে। সময়ের সাথে সাথে নানা রকম কৌশল উদ্ভাবিত হয়েছে আর উভয়েই প্রকৃতিতে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে।
মানুষ যেহেতু নিজে থেকে খাদ্য উৎপাদন করতে পারে না, অন্যের ওপর নির্ভর করে, সেহেতু ফুলের পরাগায়নের সাথে মানুষের অস্তিত্বের একেবারে সরাসরি সম্পর্ক আছে। বিখ্যাত কীটতত্ত্ববিদ এডওয়ার্ড উইলসন তার ‘The Diversity of Life’ বইয়ে সরাসরি বলেছেন, “ যদি তারা (কীটপতঙ্গ) সবাই এই মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যায়, তাহলে মানবসভ্যতা খুব সম্ভবত কয়েক মাসের বেশি স্থায়ী হবে না”।
কীটপতঙ্গ আমাদের পরিবেশের খাদ্য-শৃঙ্খলেও( Food chain) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনেক কীটপতঙ্গ তৃণভোজী মানে গাছের পাতা খেয়ে বাঁচে, তারা হলো প্রথম শ্রেণীর খাদক। এসব প্রথম শ্রেণীর খাদক অর্থাৎ কীটপতঙ্গ খেয়ে বেঁচে থাকে দ্বিতীয় শ্রেণির খাদক। তারা প্রয়োজনীয় আমিষ সরবরাহ করে। কিছু দ্বিতীয় শ্রেণীর খাদক যেমন- সাপ, মাকড়শা, ব্যাঙ; কীটপতঙ্গ ছাড়া বেঁচেই থাকতে পারবে না। আবার ভালুক, শিম্পাঞ্জির মতো সর্বোচ্চ খাদকও অন্যান্য প্রাণীর পাশাপাশি কীটপতঙ্গ খেয়ে বেঁচে থাকে।
যাক, খাওয়াদাওয়া তো হলো। এর পরে কী? উপরে দেখেছি কীটপতঙ্গ কখনো আমাদের জন্য খাদ্য তৈরি করেছে;কখনোবা নিজেরাই খাদ্য হয়েছে। খাওয়াদাওয়ার পর আসে বর্জ্য। সেই বর্জ্য-ব্যবস্থাপনাতেও কীটপতঙ্গ সমান কার্যকরী ভূমিকা রাখে। তারা জৈবিক পদার্থগুলোকে বিশ্লিষ্ট করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়ার কাজটা ত্বরান্বিত করে। এই বিশ্লিষ্ট পদার্থগুলোই আবার উদ্ভিদের বেড়ে ওঠার কাজে অতি প্রয়োজনীয় উপাদান। তো, আমরা দেখতে পাচ্ছি, খাদ্যের যোগান দেয়ার পাশাপাশি খাদ্য উৎপাদনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আবার কিছু কীটপতঙ্গ তো প্রতিরক্ষার কাজও করছে আমাদের ফসলের জন্য ক্ষতিকারক অন্য কীটপতঙ্গ মেরে ফেলে।
তবে আমার কাছে কীটপতঙ্গের গুরুত্ব অন্য জায়গায়। কীটপতঙ্গ আমাদের পৃথিবীকে ইন্টারেস্টিং জায়গায় পরিণত করেছে। আমরা সারা বেলা পার করে দিতে পারি পিঁপড়ার কাজকর্ম দেখে দেখে। মৌমাছি না থাকলে ছেলেবেলায় মৌচাকে ঢিল ছোঁড়ার আনন্দটুকু কোথায় পেতাম, বলুন ত? হাজার হাজার প্রজাতির নানা রঙের প্রজাপতিগুলো আমাদের রঙের পৃথিবীকে যেভাবে রাঙ্গিয়ে দিয়েছে আর কোনো একক প্রজাতি কি তা পেরেছে?
যদিও কীটপতঙ্গের অনেক উপকারী দিকের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি কীটপতঙ্গের যে অপকারী কাজকর্মগুলো আছে সেগুলো ভুলে গেলে চলবে না। সামান্য মশার কারণে আজ পর্যন্ত যতো লোক অক্কা পেয়েছে তত লোক পৃথিবীর ইতিহাসে যতো যুদ্ধ হয়েছে তাতেও পায়নি! তাই এদের নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন সতর্কভাবে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বেশিরভাগ মানুষই ওইসব কীটপতঙ্গ চেনে না যাদের দ্বারা সে উপকৃত হয়, বরং সেসব কীটপতঙ্গই ভালোমতো চেনে যাদের দ্বারা সামান্য পরিমাণও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জীবজগতের সবচেয়ে বড়ো গ্রুপটির প্রতি আমাদের সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি পালটানো দরকার; আমাদের অস্তিত্বের স্বার্থেই।
(চলবে...)
আগের পর্বঃ কীটপতঙ্গ-কথা (১)
মন্তব্য
চলুক।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
আপনাকে ধন্যবাদ।
(উপর হতে নীচ)১ আর ৩ নং ছবিটা দেখলাম কপিরাইটকৃত। তথ্যসুত্র উল্লেখ করলে ভালো হতো।
love the life you live. live the life you love.
ছবির ব্যাপারটা খেয়াল করিনি। খেয়াল করার জন্য ধন্যবাদ। জিনিশটা সবারই মাথায় রাখা দরকার। আমিও রাখব।
এইটুকুন কেনো পোস্ট! আরেকটু লেখতেন, পড়তে না পড়তেই পোস্ট শেষ। এসব সাধারণ ঘটনাগুলো কমবেশি জানা হয়ত আমাদের অনেকেরই। তাই অনুরোধ কীটপতঙ্গের কিছু চমকপ্রদ ঘটনা নিয়ে লেখুন। ওগুলো পড়তে আমার বেশি মজার লাগে ফটুকসমৃদ্ধ পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।
লেখা বেশি ছোট হয়ে গেছে? আচ্ছা, পরের পর্ব থেকে আরেকটু বড় করব। আর কীটপতঙ্গ নিয়ে চমকপ্রদ কিছু লেখার বিপদ আছে। তখন দেখা যাবে লেখাটা 'আপনি কী জানেন' জাতীয় চুটকি টাইপ লেখা হয়ে যাবে। আগামী পর্ব থেকে একটা একটা করে প্রজাতি নিয়ে লেখব। তখন কিছু মজার বিষয় তো উঠে আসবেই।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ
লেখাটা বেশ লাগলো!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
ধন্যবাদ। মন্তব্যও বেশ লাগল!
লেখাটা ভাল, পড়ে মনে হল বায়োলজি এক সময় আমার প্রিয় বিষয় ছিল।
আর অন্য গ্রুপের (কলা+ বাণিজ্য) বন্ধুরা প্রায়ই প্রানী বিজ্ঞান বই সিরিয়াল ধরে নিয়ে যেত ...গাঁধাগুলা
প্রাণিবিজ্ঞান আমার বেশ ভালো লাগত কিন্তু উদ্ভিদবিজ্ঞান মোটেও না।
ভালো লাগলো!
-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী
নিটোল,
এবারের লেখাটি আগেরটির চেয়েও ভাল হয়েছে। কীটপতঙ্গের উপকারী দিকগুলো সুন্দরভাবে তুলে ধরার পাশাপাশি পিঁপড়া, মৌমাছি আর প্রজাপতির আলাদা বৈচিত্র্যের উল্লেখ লেখাটিকে আকর্ষণীয় করেছে নিঃসন্দেহে! আর শেষের কথাগুলিও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য; ক্ষতিকর কীটের সাথেই আমাদের নিত্য বসবাস বলে, আমরা এ কথা কল্পনা করতেও কষ্ট হয় যে, ওরা অদৃশ্য হয়ে গেলে 'মানব সভ্যতা খুব সম্ভবত কয়েক মাসের বেশি স্থায়ী হবে না''। আর হ্যাঁ, 'কিভাবে তেলাপোকা টিকিয়া আছে', যখন 'অতিকায় ডাইনোসর লোপ পেয়েছে', তা জানতে খুবই মঞ্চায়!
ব্যাস! এটুকুই? আর কই?
নতুন মন্তব্য করুন