সিলভা।

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২৭/০৮/২০১১ - ৯:৩৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সিলভা
- সুমাদ্রি শেখর।

সিলভার মুখে সেই তেজ আমি আর দেখতে পাইনা। ওকে দেখলে এখন ঝড়ে ভেঙ্গে পড়া কোন কুটিরের কথা মনে পড়ে।

অথচ এই সেদিনও এই চেহারাতে কী দীপ্তিটাই না ছিল। আমার সাথে দেখা হলেই সলাজ হাসি দিয়ে কুশল জিজ্ঞেস করত। আর আমি ওকে আরও লজ্জায় ফেলে দেওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করতাম, “ তোমার বান্ধবীর কী খবর? বিয়ে করছ কবে?” আমাদের ক্যাম্পের পাশেই ওদের গ্রাম কাসিয়াপ্লু। ক্যাম্পের ছোট্ট হাসপাতালটাতে মঙ্গলবার যখন আশে-পাশের গ্রাম থেকে রোগীরা এসে ভীড় করে, সিলভা তখন দোভাষী হিসেবে কাজ করে আমাদের ডাক্তার স্যারের সাথে, বিনিময়ে আমরা তাকে দিই মুরগীর মোটা চামড়া যেটা দিয়ে তার মা রাতের খাবারের জন্য একটা সস তৈরী করে। ছাব্বিশ বছরের সমর্থ যুবক হিসেবে পরিবারকে এর চেয়ে বেশী কিছু সাহায্য করতে না পারায় বেচারা সবসময়ই কুন্ঠিত হয়ে থাকে।

ছোটখাটো গাট্টা-গোট্টা গড়নের ছেলেটার বুদ্ধির আভাস পাওয়া যায় ওর কথা-বার্তায়। মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে দূরের কোন গ্রামের পথে গেলে আমরা নানা বিষয় নিয়ে আলাপ করতাম। তখন আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বলত আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সাহিত্য, দর্শন এমনকি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথাও। ওর সাথে দেখা না হলে অন্য সবার মত আমিও হয়তো ভাবতাম এই জংগলাকীর্ণ প্রত্যন্ত আফ্রিকান গ্রামে আর যাই থাকুক সভ্য মানুষের দেখা হয়ত মিলবেনা। সিলভা আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমার মানসও আসলে বর্ণবাদী সংস্কৃতির ছায়ায় ঢাকা। একদিন ওর গ্রামে কী একটা কাজে গেলে ওর বাড়িতে একটা ঢুঁ মারি। সাধারণ আফ্রিকান বাড়িগুলো দেখেছি একটু অপরিচ্ছন্ন হয়। কিন্তু সিলভাদের ছোট্ট বাড়িটার সবখানে রুচির ছাপ। আমাকে ও দেখাল তার ছোট্ট ঘরটা, ওর বইয়ের তাক, ছবি আঁকার খাতা। মানিব্যাগ থেকে বের করে দেখাল ওর বান্ধবীর ছবি। একটা ঝর্ণার পাড়ে তোলা ছবি। ওকে আবারও একটু লজ্জ্বা পাইয়ে দেওয়ার জন্য বলেছিলাম, “ বাহ, বেশ মিষ্টি দেখতে তোমার প্রেমিকা। তো, বিয়েটা করছ কবে তোমরা?” মুখে সেই লাজুক হাসিটা টেনে সিলভা বলেছিল, “ খুব শীঘ্রই। সামনেই আমাদের দেশের পাবলিক সার্ভিস কমিশন পরীক্ষা। আমি জোর প্রস্তুতি নিচ্ছি।“ ওর আত্মবিশ্বাস দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম। তাই বলেছিলাম, “ ধর যদি তুমি চাকরীটা না পাও, আহা ধরই না, চাকরীতো আর আভোকাদো ফলনা, তাও আবার প্রথম শ্রেণীর সরকারী চাকরী, তখন তোমার প্রেমিকার হাত বদল হয়ে যাবেনাতো আবার?” কথাটার কী বুঝল সে কে জানে, আমাকে সরাসরি বলেছিল, “ দেখ আমি বুদ্ধিমান ছেলে, চাকরী আমার না হয়ে যাবে কোথায়? ভেবনা, তুমি আফ্রিকান বিয়ে দেখে যেতে পারবে।”

আইভরী কোস্টের রাজধানী আবিদজানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেছে সিলভা। আবিদজানের গল্প ওর কাছ থেকেই শোনা। কাসিয়াপ্লু গ্রামে জন্ম হলেও ও বেড়ে উঠেছে এই শহরে। ও বলত, “ আবিদজান গেলে তোমার খুব ভাল লাগবে। জানোতো এ শহরকে আফ্রিকার প্যারিস বলা হয়। চারদিকে শুধু লেগুন। বড়, বড় সব দালান। দক্ষিণ থেকে ভেসে আসে আটলান্টিকের নোনা হাওয়া। তোমাকে আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় দেখাতে নিয়ে যাব সুযোগ পেলে।” আবিদজান আমি গিয়েছিলাম ঠিকই কয়েক মাস পর, তবে জৌলুসের বদলে এ শহর আমাকে তখন উপহার দিয়েছিল ধ্বংসস্তুপ আর পোড়া মানুষের গন্ধের বিভৎস এক ছবি। এর লেগুনগুলোতে ভেসে যেতে দেখেছি পেটফোলা মরা মানুষের পচা লাশ।

প্রায়শই ও আমাকে বলত, “ জানো, ফ্রান্স আমাদের দেশটাকে কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে দেবেনা। তোমরা জানো ফ্রান্স হল শিল্প-সাহিত্যের তীর্থভূমি। ফরাসী দার্শনিকদের বুলি তোমাদের অনুপ্রাণিত করে। অথচ আমাদের দেশটাকে এখনও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে রেখে, আমাদের টাকায় ওরা শিল্পোন্নত, সুপার-পাওয়ার হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এদেশের সমস্ত সমস্যার মূলে কোথাও না কোথাও ফ্রান্সের দুষ্ট হাত লুকোনো থাকে।” আমি একটু আহা-উহুঁ করলে ও সুন্দরভাবে আমায় বুঝিয়ে দিত আফ্রিকাকে কীকরে নানা কৌশলে এখনও শোষন করে যাচ্ছে ফ্রান্স। তারপর মুখে একটা দৃঢ় প্রত্যয়ের ভাব এনে সে বলত, “ তবে দেখ, একদিন আমরা মাথা তুলে দাঁড়াব।”

তারপর আইভরী কোস্টে শুরু হল নির্বাচনোত্তর সহিংসতা। বিদ্রোহী বাহিনীর হাতে একের পর এক শহরের পতন ঘটতে থাকল। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলে লেগে গেল নৃশংসতম গৃহযুদ্ধ। দুয়েকুয়ে নামক ছোট্ট শহরে এক রাতেই অনেকগুলো গ্রাম পুড়েছে। গুরো জাতিগোষ্ঠীর হাতে গোনা কজন লোকই সে রাতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিল গভীর অরন্যে। আমরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে দেখেছি সে বর্বরতার চিত্র। আর আবিদজানে বিদ্রোহীরা পৌঁছানোর পর শুরু হল ভয়াবহ যুদ্ধ। আল-জাজিরায় সে যুদ্ধের নিয়মিত ঘটনা পরিক্রমা দেখে আমরা শিউরে উঠতাম। আফ্রিকার প্যারিস আবিদজান তখন যেন একটা মৃত্যুপুরী। এখানে ওখানে পড়ে থাকত লাশ। আর সমস্ত দোকান-পাট ঘর বাড়িতে চলেছে লুঠতরাজ আর ধ্বংসযজ্ঞ। সে কদিন বিভিন্ন কাজে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে সিলভার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার পর আমি ছুটিতে চলে এলাম ফ্রান্সে। আহা ফ্রান্স- ছবির দেশ, কবিতার দেশ! সিলভার কথা তখন আমি বেমালুম ভুলে গেছি।

মাসাধিককাল ইউরোপে কাটিয়ে যখন আইভরী কোস্টে ফিরে এলাম তখন আফ্রিকা আর আমার মনে ধরেনা। কাজে মন বসেনা। মন পড়ে থাকে ভেনিসের গোলক ধাঁধাময় রাস্তায়। মাদ্রিদের পুরোনো চত্বরগুলোতে। অস্ট্রিয়ার রাজপ্রাসাদের এখানে ওখানে। প্যারিসের বড় বড় মিউজিয়ামগুলোতে। কদিন এভাবে যাওয়ার পর গা ঝাড়া দিয়ে আবার শুরু করলাম কাজ। এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে যাওয়া। কী একটা কারণে হঠাৎ কাসিয়াপ্লু যাওয়ার প্রয়োজন হওয়ায় সেদিন সিলভার কথা মনে পড়ল। খবর দিয়ে ওকে আনালাম। ওর সেই হাসিখুশী চেহারাটা দেখতে পেলাম না। ওর দীপ্তিময় চোখদুটোতে দেখলাম বিষাদ। পরিবেশটা একটু হাল্কা করার জন্য আমি আমার পুরোনো কৌশলটাই আবার প্রয়োগ করলাম। বললাম, “ কী খবর সিলভা? তোমার বান্ধবী কেমন আছে? বিয়েটা হচ্ছে তো?” সিলভার চেহারায় কোন পরিবর্তন এলোনা, বরং মাথাটা নীচু করে থেকে কিছুক্ষণ পর আমায় বলল, “ আমায় কী যেন কাজে ডেকেছিলেন?” সিলভার বিষন্ন চোখ দুটোতে জলের আভাস বেশ টের পেলাম। ওর কাজটা ওকে বুঝিয়ে দিতেই ও “ আসি ” বলে চলে গেল। আমি ঠিক বুঝতে পারলামনা আমার কোন কথাটা ওকে এমন কষ্ট দিতে পারে।

দুদিন পর সিলভার বন্ধু হেনরী আমার কাছে এলে ওকে জিজ্ঞেস করি, “ আচ্ছা তোমার বন্ধুর হঠাৎ কী হল? অমন চুপ মেরে গেছে কেন? ওর পরীক্ষাটার কী হল?” হেনরী একটু চুপ থেকে বলল, “ আপনি কিছু শোনেননি?” বললাম, “ না, কেন কী হয়েছে?”

- “ ফাতু, মানে সিলভার বান্ধবী গুরো সম্প্রদায়ের। দুয়েকুয়েতে ওদের গ্রামটাতে যেদিন রেবেলরা হামলা চালায়, ফাতু সেদিন গ্রামেই ছিল। ওর কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা সেদিনের পর থেকে। আপনি বুঝতেই পারছেন ওর ভাগ্যে কী ঘটেছে। ও গ্রামের দুয়েকজন ছাড়া বাকি সবাইকে কচুকাটা করেছে ওরা। তারপর থেকেই সিলভা চুপ হয়ে গেছে। আর এ গন্ডগোলে সব পরীক্ষাই বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।”

আমি কী বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল সিলভার লাজুক হাসিটার কথা। আর একটা কাল মিষ্টি মেয়ের ছবি যার পেছনে নেচে বেড়াচ্ছিল ছোট্ট একটা পাহাড়ী ঝর্ণা।


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

অনুগ্রহ করে ইমেইল চেক করবেন।

সুমাদ্রী এর ছবি

অচলাবস্থা থেকে উদ্ধার করেছেন বলে অশেষ ধন্যবাদ মুর্শেদ ভাই।

অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।

দ্বিতীয় সুবর্ণরেখা এর ছবি

মনটা খারাপ হয়ে গেলো......

নজমুল আলবাব এর ছবি

মন খারাপ হয়ে গেলো।

আমার ছেলেটা শুধু আফ্রিকা যেতে চায়। টিভিতে সবুজ আর অনেক রকমের পোকা-মাকড়, পশু-পাখি দেখে তার এই শখ। এভাবে জ্বলতে থাকলেতো স্বপ্নের আফ্রিকার আর কিছুই থাকবে না।

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

মন খারাপ

হাচলত্ব প্রাপ্তির অভিনন্দন সুমাদ্রিদা। হাততালি সব সময়ই ভালো লিখেন..............


_____________________
Give Her Freedom!

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

খুব ভালো লেখা। মন খারাপ করা! আহারে...

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

সুমন তুরহান এর ছবি

হাচলত্বের অভিনন্দন! হাততালি

লেখায় চলুক

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

শাব্দিক এর ছবি

ভাল লেগেছে। চলুক

রু (অতিথি) এর ছবি

মন খারাপ হয়ে গেল।

মৌনকুহর এর ছবি

হাচলাভিনন্দন! হাততালি

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালো লাগলো
কিন্তু এটা কি গল্প নাকি স্মৃতিচারণ? ট্যাগ তো দুদিকেই আছে দেখলাম
আর ট্যাগে এতোকিছু কেন?

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

কল্যাণF এর ছবি

আফ্রিকা সুন্দর, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এই শোষণের ছোবিটা মনে হয় পুরো আফ্রিকা জুড়েই এক। আমি মোজাম্বিকেও পর্তিগীজদের নৃশংস অত্যাচারের কথা শুনেছি স্থানীয়দের কাছে। প্রক্রিতপক্ষে ইউরোপিওদের এই সম্রিদ্ধির পেছনে উপনিবেশিক শোষণ ছাড়া আর কিছু নেই মনে হয়।

মহাস্থবির জাতক এর ছবি

অভিনন্দন জুলিয়াস! ছবি কিছু দিতে পারতে আর কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরের লিংক, আগ্রহীরা আরো কিছুটা জানতো। ব্লগের ভিন্নমাত্রার সুযোগ নিতে পারতে।

হাচলাভিনন্দন!

Au revoir, Monsieur.

_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!

(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।