২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে আমরা তিন বন্ধু (এবং কলিগ) ট্রেকিং এ (জয় করেছি বলতে কিঞ্চিত লজ্জা হচ্ছে) গিয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ চূঁড়া সান্দাকফু হয়ে কাঞ্চনজংঘার খুব কাছে ফালুট পর্যন্ত। বিগত কয়েক বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের কেওকারাডং সহ ছোট বড় নানা পাহাড় ঘুরে নিজেদের বেশ কেউকেটা মনে হচ্ছিল আর তাই সিদ্ধান্ত নিলাম এবার সিরিয়াস একটা ট্রেকিং করতে হবে। সে লক্ষেই বেশ কিছুদিন ওয়েবসার্ফিং করে শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ বিন্দু সান্দাকফু যাবো আর শারিরিক অবস্থা যদি অনুকুলে থাকে তাহলে কাঞ্চনজঙ্ঘার কাছে ফালুট চূঁড়া পর্যন্ত।
গুগলিং করে বিভিন্ন উৎস থেকে সান্দাকফু ট্রেক সম্পর্কে যা জানলাম, দেখলাম তাতে মাথা মোটামুটি ফট্টি নাইন। একপাশে বরফা মোড়া পর্বত আর অন্যদিকে সবুজ পাইন আর রডোড্রেনডন এর বন, এর মাঝ দিয়েই বয়ে গেছে পথ। পথেই পড়বে বিখ্যাত শিংগালিলা ন্যাশনাল পার্ক যা কিনা বিরল রেড পান্ডার সবচেয়ে বড় আবাসস্থল। এছাড়া এই ট্রেকে দেখা মিলবে কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও মাউন্ট এভারেষ্ট, মাকালু, লঠসে, পানদিম, থ্রি সিষ্টার্স সহ আর ও অনেক বিখ্যাত পর্বত শৃঙ্গের।
অসাধারন এই ট্রেকটি মাঝারি ধরনের শ্রমঘন (strenous এর চেয়ে ভালো বাংলা করতে পারলামনা, সরি) আরোহন শীর্ষবিন্দুতে যার উচ্চতা ৩৬৩৬ মতান্তরে ৩৬৫৮ মিটার অথবা ১২০০ ফিটের কিছু বেশি। পুরো ট্রেকটি মোটামুটি তেরাবেকা ধরনের লম্বাটে উপবৃত্ত যার শুরু আর শেষ বিন্দু ইন্ডিয়া আর নেপাল বর্ডারের ছোট্ট শহর (শহর বললে অবশ্য সন্মান করা হয়) মানেভঞ্জন যার মালিকানা ইন্ডিয়ার। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই আরোহন-অবরোহন সমৃদ্ধ হন্ঠনের দুরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার এবং এটি বিভিন্ন বার নেপাল আর ইন্ডিয়ার ভেতর ঢুকেছে, বেরিয়েছে। সুতরাং যাবো বলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ও নব্বই কিলো হাটতে হবে ভেবে নিজেদের সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহের দোলায় দুলছিলাম। কিন্তু আরেক কলিগ ও সিরিয়াস ট্রেকার এই পথে আগে ঘুরে এসেছেন, অতঃপর তার উৎসাহ, আশ্বাস আর আসন্ন জমজমাট অ্যাডভেঞ্চারের লোভে বেশ কিছুটা উৎকন্ঠা নিয়েই নিজেদের লক্ষে স্থির রইলাম।
যাই হোক গন্তব্য তো ঠিক হলো এবার প্রস্তুতির ব্যাপার। পুরো ভ্রমনে অনিশ্চয়তার ছড়াছড়ি, কি রকম শারিরিক সামর্থ্য লাগবে, উচ্চতাজনিত সমস্যা হবে কি না, খাব কি, থাকবো কোথায়, টাট্টি করবো কোথায়, এত ঠান্ডা সহ্য হবে কি, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে কি হবে এই সব। এ ব্যাপারে ভীষন হেল্প করলো ইন্ডিয়ান ট্রেকারদের ফোরাম indiamike.com এর কয়েকজন সদস্য (ওয়েবসার্ফিং করতে গিয়ে চমৎকার এই ফোরামের সন্ধান পাই এবং যথারীতি সদস্য)। তবে বিশেষ ভাবে যার কথা উল্লেখ্য সে হচ্ছে কলকাতার এক তরুন ট্রেকার। প্রথমেই সে আমাদের ভ্রমনসুচি ঠিক করে দিলো, দুদিন অতিরিক্ত যোগ করে দিলো এক্লেমাটাইজেশনের জন্য। এছাড়া ও তার কাছ থেকে কাপড় চোপড় সহ আনুষাঙ্গিক সরঞ্জামাদি কি কি লাগবে তার বিশদ বিবরন পেলাম।
আমাদের যাত্রার দিন পনের আগে থেকেই হাটার সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গুলশানে আমার অফিস গুলশান থেকে বাসা (রামপুরা) অব্দি হেটে যাওয়া শুরু করলাম। ইতিমধ্যে এক শুভদিনে বঙ্গ, নিউমার্কেট আর ঢাকা কলেজ চষে বেড়িয়ে নকল নর্থফেস ডাউন জ্যাকেট, উইন্ড চিটার, ফ্লিসের জ্যাকেট, গ্লাভস্, থারমাল ইনার, দু পরতের ট্রাউজার আর মাউন্টেইন ডাফল ব্যাগ কিনে আনলাম। আমাদের হাবভাবে বেশ একটা অভিযাত্রি অভিযাত্রি ভাব এসে গেলো। ভাবখানা যেন আমুন্ডসেন বা লিভিংস্টোন, জয় করতে যাচ্ছি দক্ষিন মেরু কিংবা এক শতাব্দী আগের দুর্গম আফ্রিকা।
গাইড আর থাকা খাওয়ার ব্যাপারে ইন্ডিয়ামাইক থেকে পরামর্শ দিলো মানেভঞ্জনের এক স্কুল শিক্ষক এবং কমিউনিটি লিডার জীবনদার সাথে কথা বলার জন্য। পাহাড়ী এই ভদ্রলোক ওখানে শিক্ষকতার পাশাপাশি একটি আবাসিক হোটেল চালান এবং ওই পথে ট্রেকার আর পর্বতারোহীদের নানা ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট দেন। মাস্টারজী নামেই উনি সমাধিক পরিচিত। যাই হোক ফোরাম থেকে সেল নাম্বার নিয়ে জীবনদাঁ কে ফোন করে আমাদের উদ্দেশ্য আর অসহায়ত্ব বয়ান করলাম। উনি আশ্বাস দিলেন কুঁছ পরোয়া নেহি, আপ্নেরা চলে আসেন, ব্যাবস্থা করে দেব। নিশ্চিন্ত হলাম যে সবচেয়ে বড় ঝামেলাটা মিটলো।
পরবর্তী ঝামেলা হচ্ছে যার যার বাসা থেকে অনুমতি নেওয়া। এম্নিতে আমরা বেশ ঘোরাঘুরি করি কিন্তু সেগুলো মোটামুটি ঝুকিহীন (পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় শ্রেনীকে এই ষ্ট্যান্ডার্ডে ঝুকিহীন বলাই যায়) কিন্তু এবার অবস্থা ভিন্ন। প্রায় নব্বই কিলো হাটতে হবে তাও আবার এমন উচ্চতা দিয়ে যেখানে মাউন্টেইন সিকনেস হতে পারে। সুতরাং বিপদ ঘটলেও ঘটতে পারে।
অগ্রপশ্চাৎ ভেবে আমি আর বাসায় জানালাম না যে পাহাড়ে চড়তে যাচ্ছি। শুধু বললাম দার্জিলিং যাচ্ছি দুজন বন্ধুর সাথে। আর একজন আমার পথ ধরলো কিন্তু তৃতীয়জন সত্যবাদি যুধিষ্টির, সে বাসায় জানালো যে ট্রেকিং এ যাচ্ছে। আংকেল (ওর বাবা) বয়স্ক হলেও খুবই আইটি এনাবেল্ড লোক। গুগলিং করে ঠিক ই জেনে গেলেন পথের ঝুকি। অতঃপর দলের আদুভাই কাম আয়োজক হওয়ায় আমাকে ফোন। অনুরোধ করলেন সেফটি ফার্স্ট ব্যাপারটা যেন সব সময় মেনে চলি (চলতে পারিনি শেষ পর্যন্ত যদিও) আর অধিক উচ্চতায় যখনই কারো কোনও শারিরিক অসুবিধা দেখা দিবে, তৎক্ষনাৎ যেন নিচের দিকে নেমে আসি। যথারীতি আমাদের রাজনীতিবীদদের মত অজস্র প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিয়ে আংকলকে আশ্বস্ত করলাম।
আমাদের যাওয়ার রুট হচ্ছে ঢাকা থেকে লালমনিরহাট হয়ে বুড়িমাড়ি/চেংরাবান্দা বর্ডার। সেখান থেকে বাসে করে শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিঙ্গের কিছু আগে উপমহাদেশের সর্বোচ্চ রেলষ্টেশন ঘুম। ঘুম থেকে সুখিয়াপোখরি নামক ছোট একটি জনপদ অতঃপর সেখান থেকে মানেভঞ্জন। উল্লেখিত প্রতিটি জায়গাতেই ভেহিকল চেঞ্জ করতে হবে। আর ট্রেকিং শুরু করার পর কোথায় কোথায় রাত্রি যাপন হবে সে প্ল্যান করা হবে জীবনদার সাথে বসে। সব মিলিয়ে প্রায় ৮ থেকে ১০ দিনের প্ল্যান। যাত্রার আগের দিন চুড়ান্ত প্রস্তুতি হিসাবে লাগতে পারে এমন সব ঔষুধ আর অন্যান্য আনুষাঙ্গিক মেডিক্যাল কিট নিয়ে নিলাম। অবশেষে নভেম্বরের শীতের হিম হিম এক রাতে শ্যামলী পরিবহনে করে আমরা তিন মাস্কেটিয়ার্স রওনা হলাম বুড়িমাড়ির উদ্দেশ্যে।
এই বর্ডার আমাদের অতি পরিচিত। তিনজনই দার্জিলিং ভ্রমন করেছি বেশ কয়েকবার করে। সুতরাং বর্ডার পেরিয়ে শিলিগুড়ি হয়ে ঘুম পর্যন্ত কোন চিন্তা নেই। অতএব কানে ইয়ার ফোন গুজে অ্যাল ষ্টুয়ার্টের অতি সুমধুর গান ‘অন দ্য বর্ডার’ শুনতে শুনতে নিদ্রাদেবীর কোলে সমর্পন করলাম নিজেকে। বাকিদের অবস্থাও তথৈবচ।
মন্তব্য
সঙ্গে আছি। ভালো লাগছে। তবে আরেকটু বিস্তারিত হলে ভালো হয়। চলুক।
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
জ্বি, বুঝতে পারছি একটু জোরেই চলছে। আরো একটু বিস্তারিত হলে ভালো হত। বানান ভুল আর সম্পাদনাজনিত দুর্বলতাও আছে। প্রথম লেখার উত্তেজনায় এমনটি হয়েছে। পরবর্তীতে শুধরে নেবার চেষ্টা করবো। ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
ছবি নাই ?
আমার খালি ছবি দেখতাম মঞ্ছায়
মাহমুদ
ছবি আসবে সামনে। ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
ওয়াও, যাইতে ইচ্ছা হইতাছে, ছবি টবি দেন প্লীজ।
অনেক ছবি দেয়ার ইচ্ছে আছে পরবর্তী পর্ব গুলোয়। ইন ফ্যাক্ট ছবি দিয়েই যতখানি চালিয়ে দেয়া যায়। লেখার যা ছিরি . . ধন্যবাদ।
আরে, দুর্ধর্ষ! এমন মানুষই তো আমি খুঁজছিলাম।
আমি বেশ কয়েকবার দার্জিলিং এর দিকে গিয়েছি। প্রত্যেকবারই সান্দাকফুর নামটা শুনি, আর মনের মধ্যে একটু একটু করে আগ্রহ তৈরি হয়। গেলোবার ভ্রমনেও ড্রাইভারের সাথে বেশ 'বাতচিৎ' হলো সান্দাকফুর ব্যাপারে। আপনার লেখাটার ব্যাপারে তাই খুবই আগ্রহী, এতে যাচাই করতে পারবো যে ট্রেকিং করার মতো শারীরিক অবস্থা আমার আছে কিনা, আর মনের জোর তো অবশ্যই।
খুবই ভালো লাগলো লেখাটা। পরের পর্বে আরো একটু বিস্তারিত লিখলে ভালো হয়। প্রতিটা জায়গার নামের সাথেই সম্ভব হলে একটু বর্ণনা, এবং সম্ভব হলে আরো ম্যাপ ট্যাপও দিতে পারেন।
হাত খুলে লিখতে থাকুন !
অলমিতি বিস্তারেণ
চেষ্টা করবো হাত খুলে লিখতে কিন্তু এই প্রথম কিছু লিখছি, জড়তা হয়তো সহজে কাটবেনা। আর অবশ্যই ঘুরে আসবেন। সারাজীবন মনে রাখার মত একটি ভ্রমন হবে কথা দিতে পারি।
চলুক.................
পরপর দুইটা ঈর্ষনীয় ভ্রমণকাহিনী পড়লাম সচলে...
নিজেকে একটা কুনোব্যঙ ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না
সিরিজ চলুক... আরো বিস্তারিত লেখেন... আর ছবি অবশ্যই
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
কিন্তু অভিযাত্রীর নাম কই?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
ধন্যবাদ নজরুল ভাই পড়ার জন্য। অধমের পরিচয় আসবে সামনে।
শুরুটা চমৎকার লাগলো।
চলুক।
...........................
Every Picture Tells a Story
ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই।
চমৎকার!!!
_____________________
Give Her Freedom!
ধন্যবাদ।
পড়ছি
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।
ধন্যবাদ।
ভালো লেগেছে।
-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী
ভালো লেগেছে জেনে খুব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।
বেশ ভালো লাগছে। ...
পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করছি।
ভালো লেগেছে জেনে ধন্যবাদ। চেষ্টা করছি দ্রুত লিখে যাওয়ার।
রবি বুড়ার কথামতো বাড়ির উঠানের দুর্বাঘাসে শিশির বিন্দুই দেখা হইলো না। আর কোথাকার কোন সান্দাকফু-ফালুট।
চলুক।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
চমৎকার, পরের পর্বে অপেক্ষায় রইলাম। ছবি জুড়তে ভুলবেন না।
________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...
ধন্যবাদ তাসনীম ভাই। ছবি ও দিবো যদিও সিম্পল পয়েন্ট অ্যান্ড শ্যুটে তোলা। ঈদের শুভেচ্ছা।
ভালো লাগল। মিটার আর ফিটের ব্যাপারটা উল্টা-পাল্টা হয়েছে নাকি!
facebook
জ্বি, ঠিক ই ধরেছেন, তবে শুধু ফিট উল্টাপাল্টা হয়েছে। ১২০০০ ফিট হবে। ধন্যবাদ আর ঈদের শুভেচ্ছা।
দারুণ! সান্দাকফু যাওয়ার ইচ্ছে অনেকদিনের। আগ্রহ নিয়ে পরের পর্বগুলোর অপেক্ষায় থাকলাম
ডিটেইলস কয়েকটা ম্যাপ জুড়ে দিয়েন
______________________________________
যুদ্ধ শেষ হয়নি, যুদ্ধ শেষ হয় না
ধন্যবাদ ওডিন। আপনার কুমায়ুন হিমালয়ের কাহিনী গোগ্রাসে গিলেছি। আমারো ইচ্ছে আছে ঐ অঞ্চলে যাওয়ার, বিশেষ করে আলী বুগিয়াল, বেদনী বুগিয়াল হয়ে ৫০০০ মিটার উচ্চতায় রুপকুন্ড স্কেলিটন লেক পর্যন্ত।
রাজীব, লেখাটা বেশ লাগলো! ছবিটবি আরো কিছু দেওয়া যেতো বোধহয়।
যাহোক, সঙ্গে আছি।
কী যে গৃহায়িত হয়ে পড়লাম!
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
হিল্লোল আশা করি বানান আর গ্রামার ভুল ধরে আমার ইজ্জতের ফালুদা করে দিবিনা। বাংলা লেখাটা এমনিতেই বেশ একটা প্রসব বেদনার মত ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে। ছবি আসবে ক্রনোলজি অনুযায়ী। ঢাকা থেকে সীমান্ত যাত্রার আর কি ছবি দিবো? তুই যে পড়েছিস তাতেই আমি সন্মানিত বোধ করছি। সত্যি বলছি।
নতুন মন্তব্য করুন