সানাই বাজছে। বড় বড় সাউন্ড বক্স বসানো হয়েছে বাড়ির সিঁড়িত, ছাদে, লনে। এত জোরে শব্দ হচ্ছে আশেপাশের সব বাড়িগুলোর মানুষ আজকের রাতে ঘুমাতে পারবেনা জানি। এটাও জানি, কেউ কিছু মনে করবেনা। আজকে এটা বিয়ে বাড়ি, আমার বিয়ের আয়োজন চলছে এখানে।
হুম, আজকে আমার বিয়ে। মেয়েদের জীবনে যে কয়েকটা উপলক্ষ তারা সারাজীবন মনে রাখে, আজকে সেরকম একটা দিন। ডাইরি লিখি না, লিখলে নিশ্চিন্ত মনে এই দিনটাকেই একেবারে সোনার কালিতে লিখে রাখতাম । আমি আবার নিজেকে অন্যদের থেকে আরও বেশি ভাগ্যবতী বলব, যাকে সারাটাজীবন পাশে চেয়েছিলাম, তাকেই পেতে যাচ্ছি একমাত্র নিজের করে। আমাদের পাঁচ বছরের সম্পর্কটা আজ পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। জানতাম বাবা মা বেশি আপত্তি করবেন না, কিন্তু আসলেও যে ব্যাপারটা এত সহজে ঘটে যাবে, এমনটাও চিন্তা করিনি।
হেসে খেলে বেড়াচ্ছি আমি। আমাকে দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে, আজকের আয়োজনের মধ্যমণি আমি। দেখতে শুনতে মোটামোটি ভালই, তবে আহামরি যে কিছু তা বলবনা। অথচ কি আশ্চর্য, আজকে আমাকে দেখতে পরীদের মত লাগছে। যেই শুভেচ্ছা জানাতে আসছে, তাদের মুখে প্রশংসাবাণীর অভাব হচ্ছেনা। সবকিছু স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।
অনুষ্ঠানটা এখানে হবেনা, তাতে কি। বাবা মা তাদের বড় মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে কোন কার্পণ্য করছেন না। আমাদের বাসার প্রথম বিয়ে আজ, সবাই অতিরিক্ত উত্তেজিত। নানা রকম ভুল হয়ে যাচ্ছে, তবুও উৎসাহের কমতি হচ্ছেনা। এটা কম পরছে, ওটা নষ্ট হচ্ছে, বিয়ে বাড়ির হ্যাপা তো আর কম নয়। কিন্তু সবাই এই বিয়েটাকে একদম "পারফেক্ট" বানাতে চেষ্টার ত্রুটি করছেনা।
সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত, আমার মা। ভীষণ জাঁদরেল মহিলা। ভীষণ হাশিখুশি, একইসাথে ভীষণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। আমাদের আত্মীয়স্বজনসহ পুরো পরিবারটিতে আমার মায়ের মত নারী আমি আর দেখিনি। আমার মাকে সবাই ভীষণ সম্মান করে, একটু একটু ভয়ও পায়। আমি আমার মায়ের সবচেয়ে কাছের, আর আদরের। আমার সাথে মায়ের যে সম্পর্ক, বন্ধুত্ব বললেও কম বলা হয়। মাকে দেখতে ভাল লাগছে, তিনি আজ তার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবীটার ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর।
আমার ছোট বোনটাও, কম যায়না। তার আপুর বিয়েতে সে কি কি করবে, এটা সারাজীবন প্ল্যান করে এসেছে। শেষ পর্যন্ত তার সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটা চলে এসেছে, তার খুশি আর ধরছেনা।আমার থেকেও অনেক বেশি সাজুগুজু করেছে আমার পুতুলটা। ওকে যে কি ভীষণ সুন্দর লাগছে! আমি মুগ্ধ হয়ে তাকাচ্ছি বারবার। ওর ইচ্ছা পূরণ হয়েছে, ওর মনের মত একটা লেহেঙ্গা পরে উড়ে বেড়াচ্ছে সারাবাড়িময়।
কিন্তু একটা মানুষকে অনেকক্ষণ ধরেই আশেপাশে দেখতে পাচ্ছিনা। এতক্ষণ আসলে ওতটা ভালভাবে খেয়াল করিনি, ছোটখাটো মানুষটা যে কখন কোথায় যায়, ঠিক বুঝা যায়না। অফিসে তার দোর্দণ্ড প্রতাপ, কিন্তু বাসায় আসলে এই মানুষটা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যায়। তাকে ঠিক মত বুঝা যায়না, ঠিক মত উপলব্ধিও করা যায় না। সবসময় গাম্ভীর্যের একটা দেয়াল সামনে দিয়ে রেখেছেন যেন।
বলছি বাবার কথা। আমার বাবা , স্ত্রী আর দুটো মেয়ে নিয়েই যিনি কাটিয়ে দিয়েছেন পুরোটা জীবন। মনে পড়েনা, বাবাকে খুব বেশি কিছু করতে দেখেছি তার নিজের জন্য। শূন্য থেকে উঠে এসেছেন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সমাজের উঁচু জায়গাটায়। বাবার এই ব্যাপারে কোন অহমিকা নেই। আসলে মানুষটা মনে হয় জানেনই না, অহংকার কাকে বলে। সরকারের উঁচু টেবিলটায় বসে কাজ করেছেন দীর্ঘ সময়, কতশত বিখ্যাত ব্যক্তি আর মানুষজনের সাথে তার উঠাবসা ছিল। আমার বাবাটা সেই বাসায় আসলে অন্য মানুষ হয়ে যেতেন। বাবাকে কখনো ঘাঁটাতে যাইনি আমরা। বাবা নিজের মত থাকতেন।
কিন্তু ওই যে, বাবাতো। যতই একা একা থাকেন না কেন, নিজের দুই সন্তানের প্রতি তার ভালবাসার অন্ত ছিল না। তার দুই আদরের মেয়ে কখন কোথায় যায়, কি খায়, কি পড়াশুনা করে, সবদিকে তার সমান নজর ছিল। এই ব্যাপারটার জন্য প্রেমটা করতে আমার যে কি কষ্টটা হয়েছে! পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে বাবার পায়ে ধরে সালাম করা, আবার রেজাল্ট ভাল হলে বাবার দিগ্বিজয়ী হাসি, আজ সব মনে পরে যাচ্ছে।
সেই বাবাকে আমি দু'দিন ধরে দেখছি অনেক মনমরা। যেন কিছু একটা মেনে নিতে পারছেন না। বাবাকে খুঁজে ফিরছি আমি। পাচ্ছিনা।
সারাটা বাড়ি খুঁজে ফিরলাম। অবাক হয়ে গেলাম, যে ঘরটায় বাবার এখন থাকার কথা নয় সেখানে আবিস্কার করে। আমাদের লিভিং রুমে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন, একা। পিছন ফিরানো আমার দিকে, খেয়াল করেন নি আমি এসে দাঁড়িয়েছি কখন।পিছন থেকে বাবাকে দেখলাম, নিষ্ক্রিয় ম্রিয়মাণ বাবা আমার, সোজা তাকিয়ে আছেন আমার আর আমার বোনের ছবিগুলোর দিকে। একসাথে ঘুরেছি অনেক, বাবাই আমাদের নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বময়। তার সব স্মৃতিই ফ্রেমে বন্দী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই রুমটাতে।
আজকে এতদিন পর, বাবাকে বুঝতে পারলাম। এই বেশি কথা না বলা মানুষটার মনে যে আসলে ভালবাসার পাহাড় জমে ছিল, আগে বুঝিনি। কেন যেন দু'চোখ জলে ভরে যাচ্ছে আমার। আজকে বাবাকে ছেড়ে যাচ্ছি, কিন্তু আজকেই বাবাকে সবচেয়ে কাছের মনে হচ্ছে। বাঁধার যে দেয়ালটা আমার আর বাবার মধ্যে ছিল, আজকে ভেঙ্গে পড়লো।
কখনই যে কাজটা করিনি, আজকে করলাম। কাছে গিয়ে বাবার হাতটা ধরলাম । বাবা চমকে তাকালেন পিছনে। ভেবেছিলাম অপ্রস্তুত হয়ে যাব ,হয়তোবা বাবাও। কিন্তু আশ্চর্য, বাবা যেন জানতেন, আমি আসব। আমার চোখে জল, বাবারও। কিছু হয়তোবা বলতে চাইলেন, পারলেন না।আসলে কিছু বলতে হলনা, আমি বাবার সব কথা পড়ে ফেললাম। তার খুব আদরের মেয়েটা আজকে তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তার খুব কষ্ট হচ্ছে, খুব। আর হয়তোবা সকাল সকাল বাবাকে খবরের কাগজটা এগিয়ে দেয়া হবেনা, কখনো দুধ গুড়ে মাখানো ভাত খাওয়া হবে না বাবার হাতে।
হঠাৎ ঘুরে কিছু একটা নিলেন হাতে। আমার সামনে আনতেই দেখলাম, আমার প্রিয় চকোলেটের একটা বিশাল বড় প্যাকেট। বাবা তার আদরের বড় মেয়ের বিয়েতেও চকোলেট দিয়ে বিদায় করছেন। বুঝলাম , বাবার কাছে আমি এখনো ছোট্ট খুকিটাই রয়ে গেছি।
বাবা, কখনো বলা হয়নি, তোমাকে কতটা ভালবাসি। আজকে বললাম। কতরকম ভালবাসা আমাদের আশেপাশে, কতরকম মানুষ। কিন্তু বাবা, তোমার ভালবাসার তুলনায় এগুলো কিছুই না। ভালবাসার গল্প হয়তোবা তোমাকে নিয়ে বলা হয়না, কিন্তু ভালবাসায় তোমাকে হারানো সম্ভব না।
কখনোই না।
(গল্পটা কল্পিত। আজকে জ্বরের ঘোরে যখন আবোলতাবোল বকছিলাম, বাবা শিয়রে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, অনেকক্ষণ। বাবার সাথে সম্পর্কটা কখনোই খুব কাছের নয়। কিন্তু সবসময়ই জানি, বাবা আমাকে ভীষণ ভালবাসেন। যখন "আব্বু" বলে আমাকে ডাক দেন, বুঝি সেই ডাকের মাঝে লুকিয়ে থাকে বুক ভরা ভালবাসা...
আর মায়া...
বাবাদের নিয়ে সব গল্পগুলোই মনে হয় এমনই হয়...)
-আফরিনা হোসেন রিমু
মন্তব্য
অসাধারণ সহজিয়া প্রকাশ। অনেক আকাশ থেকে মুঠি ভরে ভরে কেউ যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিল ঝিকিমিকি তারার আলো। এমন মন খুলে নিয়মিত লিখবার মিনতি জানিয়ে গেলাম।
এটি একটি সার্থক গল্পে পরিণত হতে পারত যদি শেষ দুটো স্তবকে পাঠককে চমকে দেবার মত কোন ঘটনার অবতারণা করতে পারতেন। এই ধরুণ ব্রাকেটবদ্ধ স্তবকটিকে আরেকটু বদলে দিয়ে ঘুমের ঘোর থেকে জেগে উঠে স্বপ্নভঙ্গের সুর তুলতে পারতেন বিষণ্ণ ভায়োলিনের মতো। অবশ্য এ আমার একান্তই নিজস্ব অভিমত। এমন কোন ম্যাজিক দেখানোর যোগ্যতা হয়তো আমার নিজেরও নেই।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
বলার জন্য ধন্যবাদ। আসলেও হয়তোবা এমনটা বললে ভাল হতো। কি জানি, মাথায় অমনটা ছিল না।
ভালো লাগা অনুভূতি, সবার জীবন এরকমই হোক.....
"বাবা"-চরিত্রটা বড়ই অদ্ভূত। এই চরিত্রটার সাথে যত ঘনিষ্ঠভাবে থাকা যায়, ততই নতুন বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। আর চরিত্রটা সম্পূর্ণ বুঝা যায় যখন কেউ নিজে "বাবা" ডাক-টা শুনতে পায়।
লেখাটি ভালো লেগেছে। আশা করি, এরকম আরো লেখা পাবো......
ধন্যবাদ। আরও লিখতে চেষ্টা করব।
বাহ। সচলায়তনে স্বাগতম। লিখতে থাকুন।
লেখাটা অবশ্য আমার কাছে গল্পের চাইতে স্বপ্ন বেশি মনে হল
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
স্বপ্নই তো। এমনটা যে আমার জীবনে ঘটবে না, কে জানে।
স্বাগতম জানানোর জন্য ধন্যবাদ।
আপনার কল্পনায় আমাদের বাবাদের আদি অকৃত্রিম শ্বাশত রুপ দেখে ভাল লাগছে।
এখন যে একটা অস্থির সময়ে আমরা বাস করছি, সেখানে আবেগের দাম অনেক কম।
আমাদের পরিবার আমাদের হয়তো এখনই একমাত্র জায়গা যেখানে আমরা আবেগের প্রকাশ দেখতে পাই।
ধন্যবাদ।
লেখাটা ভাল লাগল। বাবার প্রতি গোছানো আবেগে মুগ্ধ হলাম। এত সহজ করে কনক্রিট আবেগ প্রকাশ কারার যে অদ্ভুত ক্ষমতা দেখলাম সেটি বহুবার দেখতে চাই। ভাল থাকুন।
হুবহু একটা ক্যাডবেরির বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়লো। লিখতে থাকুন।
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
লেখা ভাল লাগল। আসলেই যখন মেয়েরা বাবার বাড়ি ছেড়ে যায় তখন তার মনের অবস্থা কেমন তা জানার ইচ্ছা অনেক দিনের, বুক ফাটা সংক্রমিত কান্না দেখেছি, কিন্তু ঐ অনুভূতিটুকু কারোর কাছ থেকে জানতে পারিনি, কারো লেখায় পড়িনি কখনো। দেখতেই এত ভয়াবহ খারাপ লাগে, যে আসলেই এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তার না জানি কেমন লাগে!
অট: আমার মনে হল নীচে আপনার ব্যাখ্যাটুকু না দিলেও চলত। যা হোক, লেখা চলুক।
~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...
নতুন মন্তব্য করুন