দুই দুইবার নায়াগ্রা গিয়েও রাতের নায়াগ্রা দেখতে পাইনি তাই এবার কানাডা ডে’র লং উইকেন্ডে চিন্তা করলাম যে নায়াগ্রা যাওয়া যায়।
সেখান থেকে গেলাম নায়াগ্রা অন দি লেইক নামে একটি শহরে। শহরটি বেশ সুন্দর, ছোট কিন্তু ছিমছাম। আমার বেশ ভালো লেগেছিল। সেখানে দেখলাম ‘ফোর্ট মিসিসাগা’। তেমন বড় কোন কিল্লা না, আমাদের লালবাগ কিল্লা তার চেয়ে অনেক বড়, বৈচিত্রময়।
সেখান থেকে নায়াগ্রা যেতে যেতে প্রায় ১১টা। রাতে তখনো কিছু খাওয়া হয়নি। কোনমতে হোটেলে চেকইন করেই ছুটলাম খাওয়ার জন্য। যেটায় উঠেছিলা সেটা আসলে ঠিক হোটেল না, বি এন্ড বি। এক বুড়ো আইরিশ দম্পতি তাদেরই বাড়ির বিভিন্ন ঘর ভাড়া দেয়। সকালের নাস্তাও তারাই দেন। বেশ ছিমছাম, ঘরোয়া পরিবেশ। আইরিশ দম্পতিটিকেও আমাদের বেশ ভালো লেগেছিল। আমরা খেতে যাব শুনে আমাদেরকে বলে দিল কয়েকটি ভালো কিন্তু সস্তা রেস্টুরেন্টের নাম। আমি গাড়ি নিয়ে যেতে চাই শুনে আমাকে বলল যে ক্লিফটন হিল এ (যেটা নায়াগ্রা ফলসের পর্যটন রাস্তা বলা চলে) গাড়ি পার্ক করা বেশ ঝক্কি এবং খরচের কাজ। হেঁটে যাওয়াই উত্তম। তাছাড়া রিভার রোড ধরে হেঁটে গেলে দূর থেকে নায়াগ্রা আর আমেরিকার পাশের নানা রঙের আলোকসজ্জাও দেখা যাবে। আমরা তার কথা শুনে কনভিন্সড হয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কিন্তু ক্ষুধা পেটে কাঁহাতক আর হাঁটা যায়?! অনেকক্ষণ হাঁটার পরে অবশেষে খাবারের দোকানের কাছে পৌছুলাম। খুঁজেপেতে একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। ভালোভাবে উদরপূর্তি করে বের হয়ে ক্লিফটন হিল রোডে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম। তখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে কিন্তু রাস্তায় লোকজন দেখে অবশ্য সেটা বোঝার কোন উপায় ছিলনা। এরপরে চড়লাম নায়াগ্রা স্কাইহুইলে। সেটা ছিল এক অনন্য অনুভূতি, শুরুতে আমার ওয়াইফ একটু ভয় পাচ্ছিল কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সেটা কেটে গিয়ে মুগ্ধতায় পরিণত হয়। আমি কয়েকটা ছবি তোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু একেতো রাত তার উপরে কামড়াটা দুলছিল। ছবি তেমন একটা আসেনি। অবশেষে আবার সেই একই রাস্তা ধরে হোটেলে ফেরা, হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছিল রাস্তা আর শেষ হচ্ছে না। ঘুমে দুচোখ ভেঙে পড়ছিল। এরচেয়ে গাড়ি নিয়ে আসলেই হত। যাহোক শেষমেষ হোটেলে ফিরে একঘুমেই রাত কাবার।
পরদিন আমরা নায়াগ্রা আর তার আশেপাশের এলাকা ঘুরে ঘুরেই কাটালাম। আমার একটু মেরিনল্যান্ডে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু সেটা আর যাওয়া হয়নি। বিকেলের দিকে আমরা ফলস দেখতে আসলাম। কিছু ছবি তুললাম, দুটো ফলস-এরই। সন্ধ্যা হওয়ার পরে আমরা দেখতে পেলাম জলপ্রপাতগুলোর আরেক রূপ, আসলে আরেক না বলে বলা আরো অনেক রূপ। কানাডিয়ান সাইড থেকে দুটো ফলসের উপরেই বিভিন্ন রঙের আলো ফেলা হয় যার ফলে দুটি ফলস বিভিন্ন রঙে ধরা দেয় দর্শনার্থীর চোখে। ট্রাইপড নিয়ে না যাওয়ার খুব আফসোস হচ্ছিল। রাতে ছিল ফায়ার ওয়ার্কস যা সামারের অন্যতম আকর্ষন নায়াগ্রা ফলসে। যদিও খুব বেশিক্ষণ হয়নি কিন্তু মন ঠিকই ভরিয়েছিল আমাদের। নেন, কিছু ছবি দেখেন রাতের নায়াগ্রা আর ফায়ারওয়ার্কস এর।
পরদিন আমাদের প্ল্যান ছিল হোটেল চেক-আউট করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরবো আম্রিকার উদ্দেশ্যে। কিছু কেনাকাটা করবো, আমেরিকান ফলসটা দেখবো আর তার আশেপাশের কিছু এলাকাও দেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সকালে উঠে আমরা ঠিক করলাম যে সেখান থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে ‘ওয়াটারলু’ নামে একটি শহর আছে সেখানে যাব, ঘুরতে সাথে কেনাকাটাও হবে। আসলে আমরা দেখতে চাচ্ছিলাম কানাডার ওয়াটারলু আর আমেরিকার ওয়াটারলুর মধ্যে কী তফাত। আর তাছাড়া আমার গাড়ি চালানোও কিছুটা প্র্যাক্টিস হবে (নতুন লাইসেন্স পেয়েছি তো, হাত নিশপিশ করে )। ইউ.এস বর্ডারে খুব বেশিক্ষণ লাগেনি যদিও আমার ওয়াইফের প্রথমবার আম্রিকাগমন। ওয়াটারলু যেতে যেতে অনেকটা সময় চলে যায়, তারপরে সেখানে কেনাকাটা করতে করতে রাত প্রায় নয়টা বেজে যায়। এরপরে চিন্তা করলাম যে ঠিক আছে এখন আমেরিকার নায়াগ্রাটা দেখে কানাডার ওয়াটারলুতে ফিরে যাব। সে অনুযায়ী রওয়ানা দিলাম। পথে আসতে আসতে দেখলাম আমেরিকার কয়েকটি শহরে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ফায়ার ওয়ার্কস হচ্ছে। একবার গাড়ি থামিয়ে দেখতে চাচ্ছিলাম কিন্তু দেরি হয়ে যাবে দেখে আর থামানো হয়নি। আমেরিকান নায়াগ্রা সিটিতে পৌছাতে পৌছাতে ১২টা পার হয়ে গেল। এসে দেখি কোন মানুষজন নেই, ভেবেছিলাম আজ ওদের স্বাধীনতা দিবস অনেক ঝাঁকজমক থাকবে কিন্তু প্রচন্ড হতাশ হলাম। ভাবলাম যাহোক ফলসটা দেখে কানাডায় চলে যাই। কিন্তু জিপিএসে আর ফলস খুঁজে পাইনা। মেজাজ তখন খারাপ হওয়া শুরু করল। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম, কাউকে যে জিজ্ঞাসা করবো তারও উপায় নেই, সব কিছু বন্ধ। শেষে ভাবলাম ঠিক আছে কানাডাতেই ফেরত যাই। কিন্তু জিপিএস এ কানাডার ঠিকানা সেট করতে দেখি দেখাচ্ছে ১৩৫০ কিলোমিটার রাস্তা, অথচ আমি কানাডার নায়াগ্রা শহরের আলো দেখতে পাচ্ছি গাড়ি থেকে। আমারতো মাথাখারাপ দশা তখন। অনেকবার চেষ্টা করলাম, রিস্টার্ট দিলাম কয়েকবার জিপিএস কিন্তু তথৈবচ। শেষে চিন্তা করলাম ঠিক আছে বাফালোতে যাই। বড় শহর, সেখান থেকে নিশ্চয়ই কানাডা যাওয়া যাবে। যেতে যেতে আমি একটা এক্সিট মিস করলাম হাইওয়েতে, গিয়ে পড়লাম টোলবুথের কাছে। সেখানে জিজ্ঞাসা করলাম কিভাবে কানাডা যাওয়া যায়, মহিলা আমাকে রাস্তা বাতলে দিল। আমি সে অনুযায়ী রওয়ানা হলাম। কিন্তু হঠাৎ করে যে এক্সিটটা নেয়ার কথা ছিল সেটা না নিয়ে তার আগেরটা নিয়ে ফেললাম। এখনতো আর জিপিএস রাস্তা দেখায় না অথচ এতক্ষণ ঠিকই দেখাচ্ছিল। মেজাজ তখন আমার সপ্তমে। মনে হচ্ছিল জিপিএসটাকে ধরে একটা আছাড় দেই। আবার আমরা বাফালোর দিকে যেতে লাগলাম কেননা এটা জিপিএসে ঠিকই দেখাচ্ছিল। বাফালো পৌছে পিস ব্রিজের নীচে থেকে আবার চেষ্টা করলাম জিপিএসে কিন্তু তখনো জিপিএস দেখায় ১৪০০ কিলোমিটার রাস্তা। শেষে একটি গ্যাস স্টেশনে থেমে জিজ্ঞাসা করে রাস্তা জেনে নিলাম। এবার আর কোন ভুল করিনি। কানাডার ইমিগ্রেশন অফিসারদের দেখে আমি যে কী স্বস্তি পেয়েছিলাম সেদিন সেটা বলার নয়। ‘ওয়েল্কাম টু কানাডা’ দেখে মনে হচ্ছিল আমি অবশেষে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। তারপরে সাততাড়াতাড়ি গাড়ি চালিয়ে ওয়াটারলুতে ফিরলাম প্রায় ভোর রাতে। ফেরার পথেও একবার এক্সিট মিস করে অনেক সরু হাইওয়ে ধরে ফিরতে হয়েছিল। "আমি হাইওয়েতে গাড়ি চালিয়েছি আর এক্সিট মিস করিনি" এই তত্ত্বের সার্থকতা আরো একবার প্রমাণ করার জন্যই মনে হয় করেছিলাম সেটা।
পরদিন যার জিপিএস (আমারটার হোল্ডার হারিয়ে যাওয়ায় নিতে পারিনি) তাকে বললাম যে আমরা তিনচার ঘন্টা বেহুদা ঘোরাঘুরি করেছি আমেরিকায়। শুনে উনি বললেন যে উনি নিজেও তাই করেছেন কেননা উনার জিপিএসে টোল দিতে হয় যেসব রাস্তায় সেগুলোকে অটো বাদ দেয়ার অপশনটা সিলেক্ট করা আছে আর আমেরিকা কানাডার মত এত উদার না, সেখানে অনেক রাস্তাতেই টোল দিতে হয় (যদিও সেটা পরিমাণে সামান্যই মোটেই চার ঘন্টা ড্রাইভের সমতুল্য না)।
এভাবেই শেষ হয় আমাদের তৃতীয়বারের মতন নায়াগ্রা দেখা। যদি সময়সুযোগ হয় তাহলে সবাইকেই আমি একবার অন্তত নায়াগ্রা দেখতে যেতে বলব। এ এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা, যা এটা না দেখলে মিস হবে।
মন্তব্য
রাতের নায়গ্রা অসাধারন। ছবি গুলো অনেক সুন্দর।
দীপাবলি।
হুমম, আসলেই অসাধারণ।
ধন্যবাদ।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
অসাধারণ!!!!
_____________________
Give Her Freedom!
থ্যাঙ্কিউ মৃত্যুময় ঈষৎ।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
সোন্দর
হুমম।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
রাতের ছবিগুলো দুর্দান্ত হয়েছে। তবে প্রথম কয়েকটা ছবিতে vignetting টা চোখে লাগছে।
আহ! নায়াগ্রা, কবে হবে দেখা?
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
vignetting টা একটু টেস্ট করলাম আর কি। আমি বুঝেছিলাম যে খুব একটা ভালো হচ্ছে না, তারপরেও ভাবলাম দেখি করে, কি আর হবে।
নায়াগ্রা, হবে দেখা কোন একদিন।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
চিন্তা নাই, আমিও যামু। রাইত দিন দুইটাই দেখুম। খালি "ধারের খাতাটা" আগে একটু সাইজ কইরা লই।
সাগর
যান, যান তাড়াতাড়ি যান। দেখে ফেলেন। নাহয় ধার আরেকটু বাড়লোই।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
নায়েগ্রার এত রঙ! মন জুড়িয়ে দিলো। লেখাতেও তো নায়েগ্রার জলপতনের শব্দ!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
ধন্যবাদ রোমেল ভাই।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
ভালো লাগলো। এরপর কোনটা?
========
আমি জানি না
ধন্যবাদ।
দেখি, এরপরে কী।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
facebook
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
আমাদের লালকেল্লা কোনটা?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
লালবাগের কেল্লা হবে আসলে।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
হু... দেখতে ছোট হইলেও এটা একটা বিশাল ভুল...
এই হলো লালকেল্লা
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
হুমম, তাইতো দেখি।
ঠিক করে দিলাম।
ধন্যবাদ।
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
সরি, আমার একটা ছবি শেয়ার করি। আমার কাছে নায়াগ্রার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো জার্নি বিহাইন্ড দ্যা ফলস। যিনি নায়াগ্রাতে যাবেন, তিনি যেন অবশ্যই নীচের ডেক থেকে পানির পতন দেখে আসেন। না হলে বিরাট মিস করবেন।
নীচের ছবিটি দেখলে এখন খুব খারাপ লাগে।
যেখানে দাঁড়িয়ে ছবিটি তুলেছি ঠিক এর কাছাকাছি কোন একটা জায়গা থেকে কিছুদিন আগে একজন জাপানী ছাত্রী নায়াগ্রা ফলস-এ পড়ে মারা গিয়েছে। চারদিন পরে তার লাশ পাওয়া যায়।
ওয়াও! পিপিদা আপনার তোলা ছবিদুটো অসাধারণ।
আমার অবশ্য মেইড অফ দি মিস্ট সবচেয়ে পছন্দের। আর জার্নি বিহাইন্ড দা ফলস সম্পর্কে কয়েকজনের ফিডব্যাক ভালো ছিল না দেখে তিনবারের একবারও যাইনি। কিন্তু আপনি যখন বললেন, এর পরেরবার নায়াগ্রা গেলে অবশ্যই যাব।
জাপানী ছাত্রীর নিউজটা দেখেছি, আসলেই দুঃখজনক। তবে যতদূর জানি সে রেলিং এ বসে ছবি তুলতে গিয়েছিল যেটা নিষিদ্ধ। মানুষজন কেন যে নিয়মকানুন মেনে চলতে চায় না কে জানে?
------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।
নতুন মন্তব্য করুন