আবাবিল আমাদের ক্লাসের শুদ্ধতম ছেলেগুলোর একটি। আমরা? আমরা তাহলে কী? আমরা সব হিসেব কষা ছেলেপেলে। নিজের কথা বলতে পারি। ঈদ কিংবা জন্মদিনের সহজ শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েও আমি হিসেব কষি। কাকে দিলে আমার কী ফায়দা আর কাকে না দিলেই নয়---এমনতরো সব এলগরিদম কষে সামাজিক হবার প্রবল চেষ্টা করি। আবাবিলকে আমরা কখনো হিসেব কষে চলতে দেখিনি। বন্ধুত্বের ডেবিট-ক্রেডিটের হিসেব না মিলিয়েও সে অতি সহজে আমাদের একজন হয়ে গেছে। ঈদের পরদিন ঘুম থেকে উঠে তাই যখন প্রিয় বন্ধুটির বাবার ম্ত্যু সংবাদ শুনি, মনটা বড্ড বেশি রকমের খারাপ হয়ে আসে। যে বন্ধুটি আমাকে ফোন করে এই দুঃসংবাদ জানায়, সেও বেশিক্ষন কথা বলতে পারে না। হঠাৎ করে আমরা সবাই কেমন যেন নির্বাক, মূক হয়ে যাই। একটা প্রবল সত্য এসে আমাদের সবাইকে বড় রকমের ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। ঈদ আনন্দ, বুমার্স-কেএফসি আর শাকিব খান অভিনীত 'কে হবে কোটিপতি'---সব কিছুই বড্ড অর্থহীন মনে হয়।
প্রিয় মানুষটিকে চিরদিন ধরে রাখার সামর্থ্য আমাদের নেই। হোমো স্যাপিয়েন্স নামক এই অদ্ভূত প্রজাতিটি ম্ত্যুর কাছে আজ অব্দি অসহায়। আমরা তাই সর্বক্ষন প্রিয় মানুষটির কাছে কাছে থাকার চেষ্টা করি। কাছে থাকার এই আকুলতা আমাদের হঠাৎই প্রবলভাবে চেপে ধরে এই রমজানের শেষে এসে। আমরা অনুভব করি, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এটাই আমাদের শেষ রমজান। সিদ্ধান্ত নিই, কুছ ভি হো, যে কদিন ক্লাস চলবে, প্রতিটা ইফতার আমরা বন্ধুরা 'হাম সাথ সাথ হ্যায়' করবো। আর ইফতারের পর ডিফল্ট আড্ডা তো আছেই। আড্ডায় গান, গীটার, কবিতা আব্ত্তি---এইসব সুশীল বিনোদন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আত্নশুদ্ধি ও আত্নচর্চাই হবে এই মহতী আড্ডার এক এবং অদ্বিতীয় উদ্দেশ্য। বলা বাহুল্য, আড্ডার বিষয়বস্তু আত্নচর্চার নীরস অঙ্গনে সীমাবদ্ধ ছিলো না, আড্ডার স্বাভাবিক নিয়মেই তা পরচর্চার সরব রাজপথে প্রবেশ করেছে মাঝে-মধ্যেই। আমাদের ক্লাসের সেরা গল্প-বলিয়েদের একজন আবাবিল ছিল সেই আড্ডার কেন্দ্রবিন্দুতে। গল্প বলার এক সহজাত ক্ষমতা আছে আবাবিলের। তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ডিটেইলসও সে অনায়াসে তার হার্ডডিস্কে সেভ করে রাখে এবং আমাদের মত শ্রোতাভক্তদের হতাশ না করে সে তার গল্পের ঝুলি থেকে একটার পর একটা প্রভুখন্ড বের করতে থাকে। সেই গল্প শুনে তিতুমীর হলের ২০১০ নম্বর রুমের জনবসতি পাগলের মত হেসে গড়াগড়ি খায়। আমরা কেউই তখন জানি না, কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের এই প্রিয় বন্ধুটি তার খুব কাছের কাউকে হারাতে যাচ্ছে।
কারো বাবা মুক্তিযোদ্ধা শুনলেই মানুষটির প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা চলে আসে। ইচ্ছে করে, মানুষটিকে একটু স্পর্শ করে আসি। মানুষটির স্পর্শে একটু যদি শুদ্ধ হতে পারি। আবাবিলের বাবার স্পর্শ পাবার সৌভাগ্য আমাদের হল না। তার আগেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। মানিকগঞ্জে নিজ আবাসে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়েছে। আবাবিলের বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। অথচ এই চার বছরে সে একবারও মুখ ফুটে এই কথাটি আমাদের বলেনি। ১৬ই ডিসেম্বর কিংবা ২৬শে মার্চ এলে আমরা অনেকেই ইতিহাস ঘেঁটেঘুটে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পরিবারের কার কী অবদান, তার ফিরিশতি দিতে শুরু করি। অথচ আবাবিলকে সবসময়ই দেখেছি নিশ্চুপ, নির্মোহ। সেটা কী কোন অভিমান থেকে? আমরা জানি না। কিংবা এমনও হতে পারে, প্রক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা বোধহয় এমনই হয়। নিস্প্হ, প্রচারবিমুখ। মুক্তিযুদ্ধ যে আজ অনেকের কাছেই একটি পণ্য এবং তার বিজ্ঞাপনমূল্যও যে বাজারে যথেষ্ট চড়া, এই দরকারী শিক্ষাটা তাদের পারিবারিক পাঠ্যসূচিতে সযত্নে বর্জিত হয়।
প্রিয়জন হারানোর কষ্ট কেমন- আমি জানি না। এখন পর্যন্ত আমাকে এই কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়নি। আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান যে এখনো আমার মা-বাবা দু'জনেই বেঁচে আছেন এবং তাদের অপদার্থ ছেলেটিকে মানুষ করার জন্য প্রাণপাত করে যাচ্ছেন। আমার বন্ধুটি এই মুহুর্তে কী পরিমান কষ্টে আছে-তা উপলব্ধি করার ক্ষমতা আমার নেই। তাকে যে সান্ত্বনা দেবো, সে ভাষাবিদ্যাও জানা নেই। কংক্রীট নগরে বসে আপাতত এটুকুই প্রার্থনা করতে পারি, স্রষ্টা আবাবিল ও তার পরিবারকে পর্যাপ্ত ধৈর্য ও সাহস দিন, যাতে তারা এই শোক সহ্য করতে পারে। আবাবিল ও তার ছোট ভাইটি যেন তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌঁছুতে পারে। আমেন
মন্তব্য
কোমল একটা লেখা।
------------------------
ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল
ভালো লাগল লেখাটা।
কিছু অংশের বর্ণনা ব্যাপক হৃদয়স্পর্শী।
--------------------------------------------------------
ভাষার বুকে ভেসে যাওয়া এক প্রেতচ্ছায়া ।
ভাল হোক।
আবাবিল ছেলেটার জন্য আমারো খারাপ লাগছে দোস।
হার্ডকোর পাকি সাপোর্টার বলে এই ছেলেটাকে আমরা কম জ্বালাতন করিনি। একবার যখন সে ফেসবুকে দাবি করে বসলো, তার বাবারও নাকি মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট আছে, হেসে গড়াগড়ি খেয়েছিলাম আমরা। ওর আরো অনেক চাপাবাজির মত এইটাও একটা মহাগুল ছিল বলেই ভেবেছিলাম।
রেস্ট ইন পিস।
সহপাঠির নিবাস কি শেরেবাংলা হল?
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
আপনার বন্ধুর জন্য শুভেচ্ছা রইলো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
কিছু বলার নেই। রাজীবের সাক্ষাৎকার মেজাজটা বিগড়ে দিলো আর এখন সচলে ঢুকে দেখি একের পর এক মন-খারাপ লেখা!
_______________________________
খাঁ খাঁ দুপুরে, গোধূলিতে আর রাতে বুড়ি পৃথিবী
কেবলই বলছে : খা, খা, হারামজাদা, ছাই খা!
(ছাই: মণীন্দ্র গুপ্ত)
মনটা খারাপ হলো.....................
_____________________
Give Her Freedom!
আবাবিলের বাবার আত্মা শান্তি পাক।
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
নতুন মন্তব্য করুন