বাকি রাতটা ব্যথায় ছটফট করেছে দিব্য। বাড়ির কেউ আর ঘুমাতে পারেনি। সকাল হতেই তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়ল। এক পা নিজের কাছে। আরেক পা মায়ের কোলে। মেসির সাথে ফুটবল খেলতে গিয়ে গোড়ালি এলোমেলো হয়ে গেছে। এখন ইজিবাইকে করে ছুটছে ডাক্তারখানায়।
দিব্য এবার ক্লাস থ্রি-তে উঠেছে। থাকে উপজেলা শহরে। অবশ্য শহর না বলে গ্রামও বলা যায়। গড়াই নদীর ধারে ওদের বাড়ি। নদীর ওপারেই গ্রাম। ওদের বাড়ি থেকেই দেখা যায় ওপারে ধানক্ষেত। সারি সারি তাল-সুপারির গাছ। চরের বালিতে ছেলে-মেয়েরা খেলা করে। এপারে চর নেই। কেন নেই জানতে চেয়েছিল বাবার কাছে। বাবা স্রোতের বাঁক-টাঁক বলে কী সব বুঝিয়ে দিয়েছে। দিব্যর মনে ধরেনি।
দিব্য বেশ ভাবুক টাইপের। ওর বয়সীদের মতো তেমন দুরন্ত নয়। গালে হাত দিয়ে বসে যায় আর নানান প্রশ্ন করে। বড়দের মতো পাকা পাকা কথা বলে। শুনতে অবশ্য বেশ লাগে। পাড়ার লোকেরাও মজা পায়। পাড়ার এক দাদু নাম দিয়েছে, পণ্ডিত মশাই।
বাবার সরকারি চাকরি। ছোটখাট অফিসার পদেই। মা স্কুলে পড়ায়। একটাই সন্তান বলে সাতখুন মাফ। দিব্যও নিজেকে খুব লাকি মনে করে। অন্য বন্ধুরা ওর মতো স্বাধীনতা পায় না। ওর দিদাও থাকে ওদের সাথে। দিদার পেটে শত শত রূপকথার গল্প।
িদব্য লিওনেল মেসির অন্ধভক্ত। আর্জেন্টিনা বলতে পাগল। ওর বাবা ব্রাজিলের সাপোর্টার। মাকে অবশ্য নিজের দলে পেয়েছে। প্রায়ই বেধে যায় বাপ-বেটায়। ব্রাজিল বড়, না আর্জেন্টিনা? স্কুলে ওদের ক্লাসের একটা মেয়েও আর্জেন্টিনার ভক্ত। এই নিয়ে ওর বাবা প্রায়ই খেপায়। আর্জেন্টিনা নাকি মেয়েদের দল?
দিব্যও যুক্তি খঁুজে বের করে। ওর ছোটমামাও আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। তাই বাবাকে ধরে বসল, মামা কি তাহলে মেয়ে? বাবা দুষ্টুমি করে, মামা মানে তো দুইটা মা। সেও তো ঐ মেয়েই হল।
তর্কে হারার পাত্র নয় দিব্য। ঠিক একটা বুদ্ধি মাথায় এসে গেল। বলে বসল, কালো মানুষরা ব্রাজিলের সাপোর্ট করে। বাবা কালো তো, তাই ব্রাজিল ব্রাজিল করে। মাকে গিয়ে বলল, মা, এই বাবাটাকে চেইঞ্জ করে আন তো। সবাই তো হেসেই খুন। দিদা হাসতে হাসতে বলে, আমার ছেলেটাকে নিয়ে তোরা মা-ছেলে মিলে কী বুদ্ধি পাকাচ্ছিস রে?
মেসি ঢাকায় আসছে শুনে নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেছে দিব্য। ঈদের প্রোগ্রামও দেখতে দিচ্ছে না কাউকে। কার্টুন চ্যানেলও আর মন কাড়তে পারছে না। টিভিতে কোন চ্যানেলে মেসিকে দেখাচ্ছে তাই খুঁেজ বেড়ায়। আবদারও তুলেছে মেসি আসলেই ঢাকায় যাবে। ঢাকায় গিয়ে মেসির সাথে হ্যান্ডসেক করার খুব শখ। ছবিও একটা তুলতে হবে। আর একটা অটোগ্রাফ!
মেসির নানান অ্যাকশনের ছবি ওর ঘরে। এটা ব্রাজিলের জন্যে নিষিদ্ধ এলাকা। মেসির ট্যাটু লাগায় চান্স পেলেই। গত বিশ্বকাপে রাত জেগে খেলা দেখেছে বাপ-ছেলে। ঐ যে, যেদিন আর্জেন্টিনা বাদ পড়ল। মনের দুঃখে ঘুমিয়ে পড়েছিল দিব্য। বারবার ঘুম ভেঙে যায় আর বলে, মা, কয়টা গোল? মেসি গোল করতে পারেনি। আর্জেন্টিনাও কাপ নিতে পারেনি। খুব কেঁদেছিল দিব্য।
বাপ-বেটায় সেবারও বেধে গিয়েছিল। বাবা বলল, তোর মেসি তো টাকার জন্যে খেলে। বিশ্বকাপে ইচ্ছে করে গোল করে না। আর ক্লাবে এসেই গোল আর গোল।
দিব্যর খুব মন খারাপ। তাই কথা খুঁজে পেল না। গাল ফুলিয়ে বসে রইল। পরে দেখা গেল বাবার ঘরে টাঙানো ছবিতে কাকার কয়েকটা দাঁত নেই। বাবা এবার রেগেই গেল। কারণ জানতে চাইলে দিব্য বলল, তোমার কাকা তো আমার দাদু। দাদুরা তো বুড়ো মানুষ। তাই সামনের কয়েকটা দাঁত তুলে ফেলেছি। বাবা বলল, এটা কেমন কথা হল? দিব্য ভাব নিয়ে বলে, এটাই তো রাজনীতি!
বাবা আর রাগ দেখাতে পারেনি। বরং ছেলের কথা শুনে দাঁত বের করে হেসেছে। সত্যিই তো, কথায় যুক্তি আছে। মায়ের লাফালাফি দেখে কে? নিজের পক্ষের জয়। তাও আবার ছেলের বুদ্ধিতে!
সকালের দিকে ভীড় একটু কমই থাকে ডাক্তােরর চেম্বারে। টিপে-টুপে দেখে ডাক্তার সাহেব বললেন, এক্স-রে লাগবে না। হাড়-টাড় ভাঙেনি। কিন্তু হল কী করে?
ওর বাবা বলল, কী আর বলব, ডাক্তার সাহেব? সে এক বিরাট ইতিহাস!
- ইতিহাস?
- মেসি কেলেঙ্কারিও বলতে পারেন।
মুখ থেকে কথা কেড়ে নিল দিব্য। ডাক্তার সাহেবকে বলল, আঙ্কেল, বাবা আপনাকে উল্টাপাল্টা বোঝাচ্ছে। সবাই হো হো করে হেসে দিল ওর কথা শুনে।
ডাক্তার সাহেব দিব্যর আরেকটু কাছে এসে বললেন, কিন্তু পা ভাঙল কী করে, বাবু? বাবাকে এবারও থামান গেল না। বললেন, ঐ যে, দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাতে গিয়েছিল। স্বপ্নে গোল করতে গিয়ে লাথি মেরেছে আমার দেয়ালে। তারপর ভাঙা পা নিয়ে এখন ডাক্তার খানায়!
এই ডাক্তার সাহেব বেশ রসিক মানুষ। অন্য ডাক্তারদের মতো তাড়াহুড়ো করেন না। স্বপ্নে ফুটবল খেলার কথা শুনে আগ্রহ বেড়ে গেল যেন। দিব্যর মুখ থেকেই পুরো ঘটনা শুনতে চাইলেন।
দিব্য বলে গেল, মেসি খেলতে এসেছে আমাদের স্কুল মাঠে। আমাদের দলের ক্যাপ্টেন। আরেক দলে কাকা। বাবার কাকা আর আমার দাদু! মেসি আমাকে বল পাস করে দিয়েছে। গোলপোস্ট বরাবর মারতে যাচ্ছি। হঠাৎ কাকা এসে আমার পায়ে মেরে দিল। ব্রাজিল তো, মেরেই খেলে। আমি ব্যথা পেয়ে 'মা' বলে চিৎকার দিয়েছি। সাথে সাথে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি আমার ডান পা দেয়ালে লেগে আছে। মশারি ছিঁড়ে পড়েছে গায়ের উপর।
ডাক্তার সাহেব খুব মজা পেয়ে বললেন, খুব ইনট্রেস্টিং তো। তুমি বোধহয় খুব স্বপ্ন দেখ?
- হ্যাঁ, রোজই তো দেখি!
- আর কী কী স্বপ্ন দেখেছ?
- রেলগাড়ির স্বপ্ন দেখেছি। মেঘের উপর ডিগবাজি খাওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। তারপর দেখেছি ভূতের স্বপ্ন!
- ইস! আমি যদি তোমার মতো স্বপ্ন দেখতে পারতাম!
ডাক্তার সাহেব খুশি হয়ে সি-ভিট খেতে দিলেন দিব্যকে। ওর মা-বাবাকে বললেন, আপনাদের ছেলের মাথায় অনেক বুদ্ধি। ও অনেক কিছু কল্পনা করে। ওকে ভালোভাবে কেয়ার করবেন। অনেক বড় হবে ও।
একে তো নাচুনে বুড়ি, তার উপর ঢাকের বাড়ি। দিব্যর স্বাধীনতা আরও বেড়ে গেল। এখন বায়না ধরলে মিটানোর চেষ্টা করে মা-বাবা। না পারলে বুঝিয়ে বলে। ওর আজগুবি প্রশ্ন শুনে কেউ আর বিরক্ত হয় না। বরং বেশ কিছু বই কিনে দিয়েছে। ছোটদের বিজ্ঞান, ছড়া ও গল্পের বই, ধাঁধাঁর বই। মা-বাবা নিজেরাও পড়ে। প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারলে দিব্য খেপায় যে। গুণী ছেলে বলে কথা!
এগিয়ে চলেছে দিব্যর স্বপ্ন দেখা। মা-বাবা-দিদা দেখছেন আরও বেশি। সবার চোখ সামনে।
......................................................................................................................................................................
- দেবানন্দ ভূমিপুত্র
মন্তব্য
এই গল্পটা বেশ লেগেছে।
সচলায়তনে ছোটদের জন্যে লেখা অনেক কম আসে। আশাকরি নিয়মিত লিখবেন। আমি ছোটদের জিনিস পড়তে ভালু পাই।
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
মন্তব্যটা আগে খেয়াল করিনি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। শিশু সাহিত্যই আমার লেখালেখির ক্ষেত্র করতে চাই। দোয়া করবেন।
নতুন মন্তব্য করুন