টেরি প্র্যাচেটের চাকতি পৃথিবী

হিমু এর ছবি
লিখেছেন হিমু (তারিখ: রবি, ০৪/০৯/২০১১ - ১:৩৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার ল্যাপটপটা বুড়ি হয়ে গেছে। বহুদিন আগেই তার ব্যাটারির তেজ ফুরিয়ে এসেছিলো, সেটা খুলে রেখে পুরোদস্তুর ডেস্কটপ বানিয়ে ফেলেছি তাই। দজ্জাল শাশুড়ির স্ট্যাটাস নিয়ে সে এখন আমার ঘরে বিরাজমতী, ঘরের বাইরে নিয়ে গিয়ে আর দশজন লোকের সামনে বার করলে মানসম্মান আর থাকবে না।

অনেক লম্বা জার্নি করতে গেলে সময় কাটানো তাই একটা বিরাট মুশকিল। সেই জার্নিটা একা করতে গেলে আরো হাঙ্গামা, আট দশ ঘন্টা ট্রেনে বসে কতক্ষণই বা ঝিমানো যায়, কতক্ষণই বা চলমান নিসর্গ দেখা যায়? ফ্রাঙ্কফুর্টে নেমে কফি খেতে খেতে ঠিক করলাম, একটা মোটাসোটা পেপারব্যাক বই কিনে নিয়ে যাই। পড়তে পড়তে বাকিটা পথ আর সময় কেটে যাবে।

জার্মান বইয়ের দোকানে ইংরেজি বই তেমন একটা থাকে না, যেগুলো থাকে সেগুলোও ঠিক পোষায় না আমার। প্রেমের কেচ্ছা আনুপাতিক হারে বেশি, নয়তো ভূতপ্রেতের ফ্যান্টাসি। জার্মান সমসাময়িক উপন্যাসগুলো আমার অচেনা, জার্মান কোনো ক্লাসিক পড়ারও মুড নেই, তাই অল্প কিছু ইংরেজি বইয়ের স্তুপ ঘাঁটতে ঘাঁটতে টেনে বার করলাম টেরি প্র্যাচেটের মেকিং মানি।

তারপর ট্রেনে চড়ে ডুব দিলাম।

টেরি প্র্যাচেট যখন লেখালেখির তুঙ্গে ছিলেন, তখন তার বই আমার হাতে আসেনি। ফলে ডিস্কওয়ার্ল্ডের দারুণ সরস আর সাসপেন্সে ভরা বইগুলো একটাও পড়া হয়নি। বছরখানেক আগে দেখেছিলাম প্র্যাচেটের গোয়িং পোস্টাল অবলম্বনে করা একটা টেলিফিল্ম, মন্দ লাগেনি। কিন্তু বই পড়তে গিয়ে বুঝলাম, সেখানে প্র্যাচেটের লেখার রসের খুব সামান্যই ফুটিয়ে তোলা গেছে।

ডিস্কওয়ার্ল্ড প্র্যাচেটের অন্যতম কাহিনীকাঠামো, যেখানে একটা সমতল চাকতির মতো গ্রহ চারটা পেল্লায় হাতির ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে, সেই হাতি চারটা আবার দাঁড়িয়ে আছে এক মহাজাগতিক কচ্ছপের পিঠের ওপর। পুরাকালের মানুষের সীমিত ভূগোলকল্পনাকে ব্যঙ্গ করেই প্র্যাচেট এই চাকতিপৃথিবীর ওপর সাজিয়েছেন এক দারুণ উপভোগ্য সমান্তরাল জগত।

ছুটি কাটিয়ে ফিরে আসতে আসতে প্র্যাচেটের আরো দু'টো বই পড়া হয়েছে, নাইট ওয়াচ আর থাড!, সেগুলোও বেশ উপভোগ্য। বইগুলো কিশোরদের জন্যে লেখা, পাঠককে ধরে রাখে, আর ডিস্কওয়ার্ল্ডের আরেকটা বই পড়ার আগ্রহও তৈরি করে।

ডিস্কওয়ার্ল্ডের যে ক'টা বই পড়লাম (এখন পড়ছি পিরামিডস), প্রত্যেকটিই আঙ্খ-মর্পর্ক শহরকে ঘিরে। সেই শহর শাসন করেন প্যাট্রিশিয়ান লর্ড ভেটিনারি, সেই শহরে টহল দিয়ে বেড়ায় শহরের ওয়াচমেন, শহরের নানা পেশার মানুষদের সঙ্ঘ নানা রাজনীতির চাল চালে, এবং শহরে মানুষ ছাড়াও বাস করে ডোয়ার্ফ, ট্রল, গোলেম, নোম, ওয়্যারউল্ফ, ভ্যাম্পায়ারসহ আরো নানা রূপকথার জীব। শিশুতোষ গালগল্পের বিষয়গুলোও প্র্যাচেটের হাতে পড়ে নানা রোমাঞ্চকর কাহিনীর অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। সে শহরে জাদুকরদের নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় যেমন আছে, তেমন আছে আততায়ীদের স্কুল, সেখানে মায়ানেকড়ে যেমন পুলিশের সার্জেন্ট, তেমনি দাগী ঠগবাজ পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার জেনারেল। কিছুটা মধ্যযুগ, কিছুটা ভিক্টোরিয়ান আমল আর কিছুটা সমসাময়িক সমাজের মিশেল দিয়ে ডিস্কওয়ার্ল্ডের পৃথিবী খুবই উপভোগ্য এক বাস্তবতা তৈরি করে তার মাঝে ডুবে আছে। হ্যারি পটারের গল্প যেমন মোটামুটি একটি বিন্দুকে উদ্দেশ্য করে এগিয়ে চলে, এটি তেমন নয়। কিন্তু পটার বা প্রোফেসর শঙ্কুর নির্লিপ্ত, ব্যাখ্যার অতীত বাস্তবের স্বাদ রয়েছে প্রত্যেক গল্পেই, যেমনটা ফ্যান্টাসি গল্পে আমরা আশা করি।

ডিস্কওয়ার্ল্ডের বইগুলো পরম্পরাহীন, তাই যে কোনো একটা থেকেই শুরু করা যায়, যদিও কিছু কিছু জিনিস ধরতে সময় লাগে। কিন্তু সব মিলিয়ে বেশ উপভোগ্য, অন্তত দীর্ঘ যাত্রার একঘেয়েমি দূর করার জন্যে তো বটেই।

আমাদের বাংলা সাহিত্যে ফ্যান্টাসির স্পেকট্রামটা আমরা কোনো কারণে প্রশস্ত করতে পারছি না, হয়তো লেখকের মনোযোগের অভাবে, কিংবা পাঠকের অবহেলায়, পূর্বসুরীরা যা রেখে গেছেন, তারই জাবর কেটে আমাদের তারপর হাত বাড়াতে হচ্ছে অনূদিত ফ্যান্টাসির দিকে। কোথাও একটা সুতো ছিঁড়ে ঝুলছে শূন্যে, যে কারণে আমরা নিজেদের ফ্যান্টাসিগল্পের উপকরণগুলোকে হারিয়ে বা সরিয়ে রেখে হ্যারি পটার পড়ে মুগ্ধ হচ্ছি। প্র্যাচেটের লেখাগুলো পড়ে মনে হলো, লেখক চাইলেই পারেন। ফোকলোরের উপকরণগুলো তাঁর হাতে পড়ে রহস্য-রোমাঞ্চের মাণিক্যে পরিণত হতে পারে, শুধু একটু চেষ্টাই যথেষ্ট।


মন্তব্য

কালো কাক এর ছবি

আপনিই শুরু করেন হাসি

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

লিস্টে যুক্ত করলাম। সময় পেলেই জোগাড় করে পড়ে ফেলবো। ধন্যবাদ।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

পাঠক এর ছবি

হাসি

ফাহিম হাসান এর ছবি

বাংলায় ফ্যান্টাসি প্রসঙ্গে সহমত। সমস্যা হল ফ্যান্টাসি নিয়ে তো আর নাটক-টেলিফিল্ম হয় না, ইন্সেন্টিভ কম।

অতিথি অন্যকেউ এর ছবি

ভালো লাগছে। আপনার অনুভাবনগুলা ভালোমতোই ট্রান্সফার কৈরা দিলেন।

মন_মাঝি এর ছবি

জার্মান ফ্যান্টাসি ঔপন্যাসিক হান্স বীম্যান -এর 'দ্য স্টোন এ্যান্ড দ্য ফ্লুট' অনেক আগে পড়েছিলাম। দুর্দান্ত লেগেছিল তখন। এর সিকুএল Erwins Badezimmer (আরুইনের বাথ্রুম) ইংরেজি অনুবাদে পাইনি।

অস্ট্রিয়ান ক্রিস্টোফ র‍্যান্সমেয়ারের 'দ্য লাস্ট ওয়ার্ল্ড'ও আমার দারুন প্রিয় একটা বই। বইয়ের ব্লার্বে বইটাকে অবশ্য 'মেটাফিজিকাল থ্রিলার' বিশেষন দেয়া হয়েছে। দুর্দান্ত।

সুরঞ্জনা এর ছবি

খুবই সুপাঠ্য রিভিউ হাসি

বাংলায় ফ্যান্টাসি ওরকম ভালো লেগেছিলো শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্পগুলো। সেগুলো তো চর্বিত-চর্বন মনে হয় নি, প্রথম দিকের গল্প গুলো বিশেষ করে। নতুন গল্প গুলোয় অবশ্য টানটান উত্তেজনার ভাবটা নেই, তবুও ভদ্রলোক ভূত-প্রেত-বিজ্ঞান-রহস্য মিলে খুব উপভোগ্য আবহাওয়া তৈরী করতে পারেন। আপনার লেখার ক্ষমতা এত ভালো, আপনি লিখলে নিশ্চয়ই দারুণ কিছু গল্প পাওয়া যাবে। দেঁতো হাসি

অপেক্ষায় থাকলাম। দেঁতো হাসি

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

রিসালাত বারী এর ছবি

সব রকমের ফ্যান্টাসির ভক্ত আমি। পড়ার আগ্রহ হচ্ছে। ডিস্কওয়ার্ল্ডের দুই-এক্টা লিঙ্ক-টিঙ্ক দেন।

আশফাক আহমেদ এর ছবি

প্র্যাচেটের বই কি অনলাইনে পাওয়া যাবে?
বলা বাহুল্য, ফ্রি তে?

-------------------------------------------------

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

 তাপস শর্মা  এর ছবি

চলুক
লেখাটা খুবই ভালো লেগেছে দাদা।

তবে একটা প্রশ্ন মনে উকি মারছে যে , সাহিত্যের ভেদাভেদিতে আমার বাংলা কতটা এগিয়ে এই সব কল্পবিজ্ঞানের শাখায় । কেননা দিনের পর দিন যে জিনিসটা সবচেয়ে ভাবিয়ে তুলছে তা হল বর্তমান প্রজন্মের যুবক এবং কিশোররা সাহিত্যপাঠে ব্যাপক অনাগ্রহী , পাশাপাশি কৈশোর বয়সেও আর -ঠাকুমার ঝুলি নিয়ে মাথা ঘামায় না আজকের বাচ্চারা । তো এই জায়গায় কিন্তু ইংরেজী কিংবা জার্মান অথবা ফরাসী সাহিত্যে তা অটুট। ফ্যান্টাসি কিন্তু সেই জায়গা গুলোতে আজও বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম । আমার বাংলায় কিশোর সাহিত্য চর্চায় কিন্তু এই গ্যাপ টা তৈরী হয়ে রয়েছে। তা ভরাট করা খুবই প্রয়োজন । কেন না ওই বয়সে তৈরী হওয়া সাহিত্য অভিলাশাই কিন্তু ভবিষ্যতের সোপান । নইলে, অতঃপর হ্যারিপটার এবং...................

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

শুরু করেন। হাসি

The Reader এর ছবি

চমৎকার রিভিউ টি পড়ে বই গুলো সম্পর্কে আগ্রহী হলাম। সময় পেলেই ডিস্কওয়ার্ল্ড সিরিজ যোগাড়ে নেমে পড়ব । হাসি

স্পর্শ এর ছবি

আমার ল্যাপটপটাও বুড়ি হয়েছে। কিন্তু 'পারফরমেন্স' এখনো ভালো। তাই সুখে শান্তিতেই সংসার করে যাচ্ছি। তবে নতুন 'পাত্রী' দেখা চলছে।

ডিস্কওয়ার্ল্ড এর কথা ভাসাভাসা শুনেছিলাম। মূলত কিছু বৈজ্ঞানিক-দার্শনিক লেখায়, বিকল্প বাস্তবতা ...ইত্যকার হাবিজাবি প্রসংগে বলতে গিয়ে বক্তারা উদাহরণ টেনেছিলো। এই রিভিউটা পড়ে মনে হলো, একেবারে মনের মত জিনিস!! অনতিবিলম্বে জোগাড় করতে হবে।

ধন্যবাদ হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

 তাপস শর্মা  এর ছবি

চলুক

দ্রোহী এর ছবি

দ্য কার্পেট পিপল বহুকাল আগে পড়েছিলাম।

পিরামিডস এখনো শুরু করিনি। মন খারাপ

ভুতুম এর ছবি

প্র্যাচেট অসাধারণ! কোন জবাব ছাড়া অসাধারণ।

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

রু (অতিথি) এর ছবি

বাঙ্গালিদের মধ্যে আমি খুব কম প্র্যাচেটের পাঠক খুঁজে পাই।

আমি কিন্তু যেকোন একটা বই টান দিয়ে পড়া না শুরু করে দিয়ে সিরিয়ালি পড়া রিকমেন্ড করব। আপাত দৃষ্টিতে বইয়ের মধ্যে কোন যোগাযোগ না থাকলেও, জায়গায় জায়গায় এমন একেকটা কথা লেখা থাকবে যেটার মর্মার্থ হয় বোঝা যাবে না। তাতে অবশ্য তেমন ক্ষতি হবে না, কিন্তু পুরো মজা পাওয়া থেকে পাঠক বঞ্চিত হবেন।

যাযাবর ব্যাকপ্যাকার এর ছবি

বাহ! আমি একটাও পড়ি নাই! মন খারাপ
ফ্যান্টাসি দারুণ লাগে পড়তে। এখন পর্যন্ত পড়া ব্যক্তিগত পছন্দের শীর্ষে টোলকিয়েন আর তার মিডল আর্থ। আমার স্বপ্ন আমি বড় হইলে দুর্দান্ত ফ্যান্টাসি লিখবো! একদিন দেইখেন আমিও লিখে ফাটায়ালামু, হ! দেঁতো হাসি

___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।

স্পর্শ এর ছবি

হিমুভাইরে আরেকবার ধন্যবাদ দিয়ে যাই। কী অসাধারণ একটা জগতের সাথে পরিচয় হয়েছে এই পোস্টের মাধ্যমে।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

শিশিরকণা এর ছবি

এই পোস্টের সূত্র ধরে বা অন্য স্মরণাতীত কারণে কিভাবে যেন আমার পুরনো হার্ড ডিস্কে প্র্যাচেটের সমগ্র জমা হয়েছিল। অফিসের সহকর্মী প্র্যাচেটের এতই মুগ্ধ ভক্ত আমাদের যেকোন প্রোডাক্ট টুল এর কোডনেম দিতে হলে ডিস্কওয়ার্ল্ড থেকে ধার করে। তাই শেষ মেশ পড়তেই শুরু করে দিলাম।
এটাকে আমি টোল্কিনের মিডল আর্থ বা পটারওয়ার্ল্ড এর উপরে রাখবো। এর প্রতি শব্দে শব্দে লাইনে লাইনে, ছত্রে ছত্রে বিদ্রুপ, প্যাঁচ আর অসম্ভব সম্ভবের দোলাচল। প্র্যাচেট কখনোই তার বই থেকে সিনেমা বা চলচিত্র বানানোর অনুমতি দেন নি। একদম ঠিক কাজ। চলচিত্র এখনো এই জিনিস বানাবার পর্যায়ে আসেনি। তেমন পরিচালকও তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না। যদি কল্পনাও করতে বসি, ্পুরো কল্পনা এত সমৃদ্ধ, যে এটা দিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক ছবিতেও ফুটিয়ে তোলা যাবে না।
অনেক ধন্যবাদ এই চাকতিজগত এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।