শুরুর গল্পটা সবারই জানা। রোজারিওর এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম, এগার বছর বয়সে দুরারোগ্য হরমোন রোগে আক্রান্ত হওয়া, বার্সেলোনার ক্রীড়া পরিচালক কার্লোস রেক্সাসকে ট্রায়ালে মুগ্ধ করা, সাথে সাথে টিস্যু পেপারে সই করিয়ে নেওয়া। আর বাকিটা, যেমনটা বলা হয়... ইতিহাস।
নিজ দলের কোচ প্রিয় শিষ্যের ক্ষমতা বোঝাতে গিয়ে বিশেষণহীন হয়ে পড়েন, বিপক্ষ দলের কোচ ‘সে মানুষ না, প্লে-স্টেশনের খেলোয়াড়’ হিসেবে রায় দিয়ে দেন। কারো মতে জাদুকর,কারো মতে শিল্পী। কেউ বলেন মেসিডোনা, কেউ বলেন মেসাইয়াহ, যীশু। আর পাঁচ ফুট সাড়ে ছয় ইঞ্চির ছোটখাট ছেলেটা চিরকালের লাজুক চোখে শিশুর মতো কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে বলে —‘আমি আর কেউ না, আমি মেসি,শুধুই লিওনেল আন্দ্রেস মেসি।’
ম্যারাডোনা,পেলে,জর্জ বেস্ট,প্লাতিনি,জিকো,ডি স্টেফানো –এদের খেলা কখনো দেখা হয়নি।তবে দেখেছি সেরা ফর্মে থাকা রোনালদিনহোর বল পায়ে অলৌকিক কারুকাজ,জিনেদিন জিদানের মাখন মাখানো পায়ে বল কন্ট্রোল, আর্সেনালের অঁরি,বার্গক্যাম্পের দমবন্ধ করা সব গোল, ডি-বক্সের ভেতরের সেরা প্লেয়ার মোটু রোনালদোর ওভারস্টেপিং-এ গোলকীপারকে বোকা বানানো, বেকহামের ফ্রি-কিক...কিন্তু মেসি এই কয়েক বছরে নিজেকে যে উচ্চতায় তুলে নিয়ে গেছেন, সেটা বোধহয় স্পর্শের বাইরেই চলে যাচ্ছে।
রাতের পর রাত জেগে থাকি শুধু বাঁ পায়ের জাদুকরি কিছু মুহূর্ত দেখতে, ঢুলুঢুলু চোখে দেখি মাঠের ডান কোণা থেকে অদৃশ্য এক চুম্বক সাথে নিয়ে বল পায়ে এঁকেবেঁকে দৌড়, অবিশ্বাস্য বডি-ডজে মার্কারকে ছিটকে ফেলা, আলতো পরশে বল নিয়ে ভিনগ্রহের ক্লোজ-কন্ট্রোলে অল্প অল্প করে এগিয়ে যাওয়া,বুলেটের মত শটে হাওয়ায় ভাসিয়ে বা আচমকা মাটি-কামড়ানো শটে অদ্ভূত ফিনিশিং, গোলকীপারের সাথে হাতমেলানো দূরত্বে থেকে কীভাবে যেন (অন্য কোন বিশেষণ সম্ভব না) চিপ করে বল জালে জড়িয়ে দেওয়া... সংখ্যা,গোল,পরিসংখ্যান দিয়ে এই মেসির শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করা সম্ভব না। সে শুধু যে দেখে, সে-ই জানে।
মেসি কত গোল করেছেন, কত গোল করিয়েছেন; এসব কাগুজে হিসেব তাকে পরিসংখ্যানের ভাষায় হয়ত তাকে সেরা করে তুলবে, কিন্তু দিনের পর দিন এই ‘ছোট্ট যাদুকর’ এর দেখানো পায়ের যাদুকে কিভাবে বর্ণনা করবে ! গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে গোল করতে মেসির জুড়ি নেই। ২০০৯ এ বিশ্বক্লাব কাপ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইন্যালে ক্রস থেকে মাথা না ছুঁইয়ে সবাইকে বোকা বানিয়ে বুক দিয়ে গোল(যেটিকে কোচ গার্দিওলা পরে বলেছিলেন- ‘Messi Scored That Goal with His Heart’),দুইটি চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইন্যালে ম্যাচজয়ী গোল, প্রথম এল-ক্লাসিকোতেই হ্যাটট্রিক আছে তাঁর।
২০০৭-এ গেটাফের সাথে ৬২ মিটার দূর থেকে দৌড় শুরু করে, ছয়জনকে কাটিয়ে ম্যারাডোনাকে মনে করিয়ে দেয়া সেই গোল মেসির আগমনীগান শুনিয়েছিল সবাইকে।বার্সার মেরুন-নীল জার্সি গায়ে এর মধ্যেই ১৮৬ গোল হয়ে গিয়েছে তাঁর। ম্যান-টু-ম্যান মার্কিং করে কখনো মেসিকে আটকানো সম্ভব হয়নি, তাই ডিফেন্ডাররা একটু নির্মমই থাকেন মেসির প্রতি। কিন্তু কখনো ইচ্ছে করে পড়ে ফাউল আদায় করতে দেখিনি। প্রায় রাতে টিভিতে খেলা দেখে এসে স্ট্যাটাস দিতে হয়েছে আমার মত অনেককে, আমার চেয়ে বয়সে ২৮৭ দিনের ছোট এই ছেলেকে নিয়ে- Incrdible close control/Magical Touch/ You are Freak,You are Incrdible,You dare to Destroy/Impossible Messi/ The Little Magician.. এইসব বিভিন্ন বিশেষণে।
আমি বার্সেলোনা কিংবা আর্জেন্টিনা কোন দলেরই সমর্থক না, কিন্তু মেসি এমন মোহাচ্ছন্ন করে রাখে, যার খেলা দেখে মাঠে প্রবল প্রতিপক্ষেরও হাততালি দিতে ইচ্ছে করে।
নিন্দুকেরা কথা বলার,খুঁত ধরার কিছু উপলক্ষ্য খুঁজে নেন। ডান পায়ে জোর নেই,ভাল ফ্রি-কিক নিতে পারেননা, হেডে দুর্বল,জাভি-ইনিয়েস্তা আছে বলেই এমন খেলতে পারেন এবং আরো একজন খেলোয়াড়, যে তার সবটুকু দেয় ক্লাবের জন্য। ক্লাব ফুটবলে এখন নিজের শতভাগ নিংড়ে দিতে হয়। দেশের জন্য সবটুকু চাইলেও দেয়া যায়না অর্থের ঝনঝনানির এইযুগে এসে। এখন অনেকেই আছেন, যারা ডিফেন্ডার হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার করার কথা ভাবেন। তাই গত কয়েক বছরে ফুটবলের সবটুকু সৌন্দর্য নিয়ে ফুটলেও আকাশি-নীল জার্সি গায়ে অনুজ্জ্বলতার এই বদনাম যায়না। এতে দোষ কিন্তু সহ-খেলোয়াড়দেরই বেশি।
নীল চোখের পাওলো মালদিনি কিংবা ‘ব্ল্যাক স্পাইডার’ লেভ ইয়াসিন কখনো বিশ্বকাপ পাননি। কিন্তু সর্বকালের সেরা একাদশে এই দুইজনের নাম না রাখলে আপনার ফুটবল-জ্ঞান নিয়েই প্রশ্ন উঠবে।এরকম উদাহরণ আরো প্রচুর। একটা বিশ্বকাপে চুমো দিতে পারলেই হয়ত মেসির অনেক দোষ ক্ষমা পেয়ে যাবে, বছরের পর বছর দর্শকের চোখে মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাওয়া সার্থক হবে। এসব প্রশ্নের উত্তর হয়ত পরে মিলবে। সব ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখি।
কিন্তু মেসি যে জায়গায় সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন, তা বুঝতে হলে একটা শব্দই যথেষ্ট - নিষ্কলঙ্ক। অন্য ফুটবলাররা যেখানে কিছু খ্যাতি,অর্থ পেলেই নারী,মদ,জুয়া,ড্রাগ এর নেশা, নাইট ক্লাবের উদ্দামতায় নিজেকে সঁপে দিতেন, দাম্ভিকতায় মাটির দু-এক ইঞ্চি উপর দিয়েই হাঁটতেন, সেখানে এই গ্রহের সেরা তারকা মেসির জীবন আশ্চর্য ব্যতিক্রম, যেন ‘ফুটবলের শচীন’।
ধন্যবাদ মেসি, এদেশের ফুটবলের সবচে সুন্দর সন্ধ্যা উপহার দেবার জন্য।
ধন্যবাদ, লিওনেল আন্দ্রেস মেসি, আমাদের প্রজন্মের সাথে বড় হয়ে ওঠার জন্য...
-প্রিয়ম
মন্তব্য
অনেক অনুভূতি মিলে যাওয়ায় ভালো লাগলো লেখাটা।
...
ভালো লাগল লেখাটি।
অনেক ভালো লাগলো লেখাটি।ধন্যবাদ মেসি, আমাদের প্রজন্মের সাথে বেড়ে ওঠার জন্য।
আমরা অনেক lucky messi কে আমাদের প্রজন্মে পেয়ে।অনেক ভালো লাগলো লেখাটা।
আপনার বন্দনামূলক লেখাগুলো বেশ হয়! এর আগে শচীন, আবুল হাসানকে নিয়ে লেখা পড়েছি। মাঠে বসে আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া ম্যাচখানা ক্যামন উপভোগ করলেন তার একটা বিবরণ থাকলে এই লেখাটির আকর্ষণ আরও বেড়ে যেত বৈকি।
লিখতে থাকুন হাত খুলে।
বুক দিয়ে মেসির সেই গোল
pmo নাকিরে?
ঠিক যেন , এরকমই একটা লিখা লিখতে চাচ্ছিলাম মেসিকে নিয়ে। ধন্যবাদ ব্লগার ভাই, সেই কাজটি করে দেওয়ার জন্য।
মেসিরে একটু বেশিই লাইকাই, অন্ধ সমর্থক বলতে পারেন, অবশ্য অন্ধ হবার প্রয়োজন বিশেষ নেই কারণ সে আসলেই অনন্য ফুটবলার!!! আর তার মতো বিনয়ী-ভদ্র-সাধারণ প্লেয়ার কমই দেখেছি, আসলে বেশিরভাগ প্রকৃত মহীয়ান মানুষগুলো বিনয়ী-ভদ্র-সাধারণই হয়ে থাকেন!!!
সুন্দর লিখেছেন!!!
-------------------------------------------------
ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !
দে সে, গড ওয়াজ বোরড, সো হি ওয়ান্টেড প্লেইং সাম সকার। দ্যান হি কেইম টু আর্থ ইন দ্যা ফর্ম অফ 'মেসি'
আসল কথাটা লেখার শেষেই বলে ফেলেছেন- 'ফুটবলের শচীন'। আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই!
আর্যভট্ট-এর মন্তব্যে
@ চতুর্বগ ভাই : মেসি-রে মাঠে দেখে এত মুগ্ধ, এখনো ঘোর কাটেনি... ওইদিন নিয়ে কি লিখব,তাই বুঝছি না...
তবে এইটুকু মনে আছে, ২৭ মিনিটের সময় মেসি যখন ৪/৫ জনকে কাটিয়ে প্রায় গোল করে ফেলেছিল আর মারিয়া গোল দিল, তখন প্রায় কয়েক সেকেন্ড নির্বাক হয়ে ছিলাম... এরপর গলা ফাটিয়ে চিৎকার !
আর মেসির ড্রিবলিং, মুভ- প্রায় রাতেই দেখা, তাও চর্মচক্ষে দেখার অনুভূতি-টাই অন্যরকম।
আর,বাকিরা, যারা পড়েছেন, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ...
হয়তোবা দেশের হয়ে গোল পায় না কিন্তু একটু পরিসংখান ঘাটলেই দেখতে পাবেন ৮০শতাংশ গোল এ রয়েছে তার প্রত্যক্ষ অবদান। দেশের হয়ে এত গোল বোধ হয় জাভি-ইনিয়েস্তা ও করায়নি। আর যারা বলেন জাভি-ইনিয়েস্তা ছাড়া মেসি অচল তাদের উচিত গত মৌসুম এর মেসির গোল করানোর পরিসংখান দেখা। যাই হোক খুবই ভালো লাগলো লেখাটি পড়ে। লেখককে ধন্যবাদ।
মেসি ২০০৭-০৮ এ ১৩টা, ২০০৮-০৯ এ ১৮টা, ২০০৯-১০ এ ১১টা আর ২০১০-১১ এ ২৪ টি গোল করিয়েছেন বার্সার হয়ে। আর আর্জেন্টিনার হয়ে এইবছর মানে ২০১১ সালে ১০ ম্যাচে ১২ গোল করিয়েছেন।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ
মেসিকে চোখের সামনে দেখতে পারাটা আমার জীবনের সবচে বড় ঘটনা।আমার দেশের মাটিতে খেলে যাওয়া ছোটো জাদুকর বিশ্বকাপে চুমু দিবে এই দৃশ্য দেখার প্রতীক্ষায় আছি।
লেখাটি পড়ে সত্যিই খুব ভালো লাগছে।
লেখা
কিন্তু খেলা দেখার অভিজ্ঞতা, নিদেনপক্ষে খান দুই ছবি পোস্টালে আরো ভাল হত আর কি।
--------------------------------------------
যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি-বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।
আসলে মেসির খেলা নিজ চোখে দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে তেমন কিছু তো লিখতে চাইনি। পরে হয়্ত কোনদিন লিখব।
লেখা ভাল লেগেছে। মেসিকে আমি এভাবেই দেখি!
------------------------
[ওয়েবসাইট] [ফেইসবুক] [ফ্লিকার ]
"দে সে, গড ওয়াজ বোরড, সো হি ওয়ান্টেড প্লেইং সাম সকার। দ্যান হি কেইম টু আর্থ ইন দ্যা ফর্ম অফ 'মেসি'"
-আর্যভট্ট
নতুন মন্তব্য করুন