একগুচ্ছ হতাশার গল্প

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৮/০৯/২০১১ - ৭:৪৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নিকশ কালো অন্ধকার। মাঝে মাঝে ময়লা হলুদ ছোপ ছোপ। ব্যাকগ্রাউন্ডে নীল, মাঝে সাদা সাদা ছিটে। একটা আবছা ধোঁয়াশা অবয়ব। এই মধ্যরাতে জনশূন্য রাজপথ আর একলা আকাশের মাঝে মিতালির সাক্ষী হয়ে মৃদু ছন্দে হেঁটে হেঁটে চলে যাওয়া এক কিশোর। কে জানে, তার গন্তব্য কোথায়? কিশোরের একটা নাম দেয়া যাক। ধরা যাক, তার নাম শুভ। চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা, ছিপছিপে গড়ন। পরনে ফুলহাতা শার্ট- কনুই পর্যন্ত গোটানো, আর জিন্সের প্যান্ট। চোখের রং গাঢ় কালো, আর দশটা ছেলের মতোই। তবে চোখের দৃষ্টি যে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে- তা ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। মনে হয়, সে আসলে কিছুই দেখছেনা। হয়তো তার মনে মাঝে চলছে অজস্র স্বপ্নের আঁকিবুকি। হয়তোবা ঝড় উঠেছে ভেতরে। মৃদুমন্দ হাঁটার ছন্দ আর চোখের অনির্দিষ্ট দৃষ্টি দিয়ে তার মনের খবর পাওয়া ভার।

মাঝরাতের আলো-আঁধারিতে যেন সঙ্গীহীন, বন্ধুহীনদের মেলা বসে। একেলা আকাশ, স্বজনহীন রাজপথ আর ধূসর গাছগুলো অদ্ভুত নীরবতায় বয়ান করে যায় তাদের মনের সব কথা। নীরবতার ভাষা শুনতে হলে ফাঁকা রাজপথে হাঁটতে হয়, শহরবাসী সব ঘরে ফেরার পর। আসতে হয় খোলা আকাশের নীচে। হয়তো একটা বুড়ো বড় গাছের নীচে বসা যেতে পারে। এখানে সবাই বক্তা। সবাই শ্রোতা। এমনকি, ময়লা হলুদ ছোপ ছোপ আলো বিলানো ল্যাম্পপোস্টগুলোও। এদের সাথে এই একাকীত্ব ভাগাভাগি করে নিতে যদি মাঝরাতে কেউ এখানে আসে, তবে ধরে নিতে হয়, তার থেকে নিঃসঙ্গ একাকী মানুষ আর নেই। শুভ নিশ্চয়ই সেরকম একজন মানুষ।

হাঁটতে হাঁটতে খানিকটা টেনে টেনে নিঃশ্বাস নেয় সে। গাড়ীর ধোঁয়ার গন্ধ আর অফিসফেরত লোকদের ঘামের গন্ধ মিইয়ে যেতে শুরু করেছে। সে স্থান দখল করেছে গাছের পাতার গন্ধ। বুনো কাঠবিড়ালীদের, নীড়ে ফেরা পাখিদের গন্ধ। এমনকি, রাস্তার আর আকাশের গন্ধ। প্রতি নিঃশ্বাসে বুকভরে প্রাণভরে সে গন্ধ উপভোগ করে শুভ। হাতে তুলে নেয় বোর্ড-কাগজ-পেন্সিল। শখের আঁকিয়ে সে। প্রতিরাতেই সে কাগজ-পেন্সিল নিয়ে ছবি আঁকতে চলে আসে আকাশের নীচে। একই আকাশ, একই রাজপথ- তবু একেক দিনের ছবি কেন যেন একেক রকম হয়। প্রতিদিনের গন্ধ একরকম হয় না। প্রতিদিনের নিঃশব্দতার ধ্বনি এক সুরে বাজে না। তাই তার আঁকা ছবিগুলোও বদলে যায় প্রতিদিন একটু একটু করে।

একটা অচেনা গন্ধ হঠাৎ নাকে এসে ধাক্কা লাগায়। চমকে উঠে, ভয়ে ভয়ে, মেপে মেপে আরেকবার নিঃশ্বাস নেয় সে। গন্ধ শোঁকে। একটা উৎকট বিশ্রী গন্ধ। খানিকটা চেনা চেনা, তবুও ঠিক চিনতে পারেনা। তবে তার ক্যানভাসের আকাশের রং একটু বেশি কালো হয়ে যায়। ছবির চেহারাটা আরো খানিকটা বিষণ্ন হয়। বহুদিন হলো আকাশ হাসে না। বহুদিন হলো বয়ে যাওয়া বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে গাছের পাতা নাচেনা। আজকাল ঝিঁঝি পোকারাও মাঝে মাঝে যেন ডাকতে ডাকতে হাঁপিয়ে ওঠে। শুভ ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা, তবে তার ছবির কালো রঙের শেডগুলো আরো গাঢ় হয়। বিষণ্ন থেকে বিষণ্নতর হয়। আজকের গন্ধটা কেমন যেন অন্যরকম। কেমন যেন মন-খারাপ করা গন্ধ। এ গন্ধ বুকভরে, প্রাণভরে নিতে ইচ্ছে হয় না। আজকের রাতটা যেন কেমন। ঝিঁঝিদের গলা ভেঙে গেছে মনে হয়, তাদের ডাক আজ কিছুটা ভোঁতা। তার সাথে মিশে বাতাসে ভেসে ভেসে উড়ে আসে আরেকটা চাপা শব্দ। কিসের শব্দ- তা ঠাহর হয় না, তবে কানে হাত চাপা দিতে ইচ্ছে করে। এ শব্দ কানে এলে কেমন যেন বুক ধড়ফড় করে। দম আটকে আসে। ছবি আঁকা হয়না শুভ’র। কাগজ গুটিয়ে গুটি গুটি পায়ে ঘরে ফিরে যায়। ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখে সেই আকাশের, যার ছবি সে প্রথমবার এঁকেছিলো। সেই আকাশ, যার রং কালো ধোঁয়ার বদৌলতে ধীরে ধীরে বদলে গেছে। সেই আকাশ, যা হয়তো আর ফিরে পাবার নয়।

আজকাল এমন প্রায়ই হচ্ছে। অসম্পূর্ণ ছবিতে ভরে উঠছে শুভ’র ছোট্ট ঘরখানা। প্রতি রাতে ছবি আঁকতে বসলেই সেই অচেনা গন্ধ আর অজানা শব্দ তার ক্যানভাস ভরে দেয় কালো কালো দাগে। সেই কুৎসিত ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে সে নিজেই শিউরে ওঠে। তবে, গন্ধটাকে যেন সে ধীরে ধীরে চিনতে পারছে। এ গন্ধ মানুষের গায়ের। জ্যান্ত মানুষ নয়, মরে পঁচে যাওয়া লাশের গন্ধ। ওই চাপা শব্দটাকেও যেন তার বহুকন্ঠের সম্মিলিত চাপা কান্না বলে ঠাহর হয়। এর উৎস কোথায়, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনা সে। তবে আজকাল আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠছে লাশের গন্ধে, কান্নার শব্দে।

এখন শুভ তরুণ। ছবি আঁকা ভুলে গেছে অনেকদিন হলো। শেষ ক’টা অসম্পূর্ণ কুৎসিত ছবিকে সে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে বাতাসে উড়িয়ে দিয়েছিলো একদিন। এখন আর মরা লাশের গন্ধ গাড়ির ধোঁয় কিংবা অফিসফেরত বাবুদের ঘামের গন্ধে চাপা পড়েনা। দিনরাত সবচেয়ে প্রকট গন্ধ হয়ে তার পুরো জগৎ জুড়ে বিরাজ করে সেটা। কান্নার শব্দও আর চাপা থাকেনা। সেটা শুনতে নিঃশব্দতার আড়াল লাগেনা এখন। দিনরাত মৃত মানুষের গন্ধ আর তাদের স্বজনদের আর্তনাদের মধ্যে বেঁচে থাকে তারা। শুভ, এবং আরো চৌদ্দ কোটি বাঙালি।

অনীক_ইকবাল
(darrel7756@gmail.com)


মন্তব্য

মৌনকুহর এর ছবি

হুম্‌ম...... মন খারাপ

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।