বৈজয়ন্তী ডাকে, "কী রে তুলি, কী হলো তোর? শিগগীর তৈরী হয়ে বেরো, বেড়াতে এসে ঘরে বসে থাকার মানে কী?"
আমি মোটামুটি তৈরীই ছিলাম, শুধু ব্যাগটা টেনে নিয়ে দরজা লক শুদ্ধ টেনে দিয়ে বেরিয়ে এলাম। ভারী সুন্দর দিন, কেমন নরম রোদ, কেমন অদ্ভুত একটা হাওয়া, শুধু বছরের এই সময়টাতেই এই হাওয়া বয়ে আসে, সোনালী রোদের সুরার মধ্যে কী এক আশ্চর্য যাদু মিশিয়ে দেয়। এই রোদ এই হাওয়া ঘরে থাকতে দেয় না, কেবলই বাহিরে টানে। আর বাইরে এলেই পায়ের নখের ডগা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত গভীর নেশায় ডুবিয়ে দেয়।
আমরা পাকদন্ডী পথে হাঁটতে হাঁটতে নদীর কাছে যাই, গিয়ে উঁচু পাড়ের পাথরের উপরে বসে পড়ি পা ঝুলিয়ে। পাহাড়ী নদীটার তরতর কলকল স্রোতের দিকে চেয়ে থাকি। কে এই নদীর নাম দিয়েছিলো রূপদর্শী? ঐ যে ওখানে ফার্ণের পাতার ছায়া হিলবিল করে দুলছে, কুচোজল ছিটকে লাগছে পাতায়, হীরের মতন চকমক করে উঠছে রোদ্দুরে, সেখানে আলোছায়ার ভিতর দিয়ে দৌড়ে চলেছে জলের ধারা, চলে যাচ্ছে অন্ধকার গুহাটার দিকে, আবার একটু পরেই অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে ছুটে চলেছে নিচের উপত্যকার দিকে।
আচ্ছা, যে গল্পগুলো বলতে চাই সেই গল্পগুলো কি এইরকম হবে? আলো আর ছায়া, ছায়া আর আলো? ডোরাকাটা? কিন্তু কিছুই হচ্ছে না তো! সবাই পালিয়ে যাওয়া জোনাকিদের মতন কোথায় যেন চলে গেছে! ক'দিন আগেও ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি জ্বলতো ঝোপেঝাড়ে, হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় ওদের আর দেখলাম না। এখানের জোনাকিরাও কি পাখিদের মতন যাযাবর? শীতের ভয়ে চলে যায় অনেক দক্ষিণে, চিরবসন্তের দেশে? ওরা বোঝে কী করে কবে ওদের রওনা হতে হবে?
"জয়া, জানিস, যা লিখতে চাই কিছুতেই পারি না। যা লিখি মনে হয় আগেই যেন লেখা হয়ে গেছিলো কোথাও কারুর হাতে। কী করবো জয়া? আর কখনো পারবো না? "
বৈজয়ন্তী জলের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে চুপ করে চেয়ে থাকে আমার দিকে, ওর চোখে বেদনা না করুণা কিছুই বুঝতে পারি না, ওর চোখ খুব রহস্যময়। সে চোখ শীতরাত্রির নক্ষত্ররোমাঞ্চিত আকাশের মত, যখন কেউ থাকে না কোথাও, কেউ ডাকে না চরাচরে। সেই সময়ের সূক্ষ্ম আলোর কবিতার মতন ওর দৃষ্টি, কতবার ওকে বলেছি "তুই কেন লিখিস না জয়া?" ও কিছু বলে নি, হেসেছে শুধু।
এখন ও আস্তে আস্তে প্রায় ফিসফিস করে বললো, " পারবি লিখতে। নিজের থেকে বেরিয়ে দূরে চলে যা, তারপরে সেই দূর থেকে ফিরে তাকিয়ে যা দেখবি সেই কথাই বলবি গল্পে।"
নিজের থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে কি দূরে চলে যাওয়া যায়? হাঁটতে হাঁটতে চলে যাওয়া যায় রূপদর্শীর পারে? সেখান থেকে নিরাসক্ত দু'চোখ মেলে ফিরে দেখা যায় যাপিত জীবনকে? আবার সেই জীবন বলা যায় কথার সুতোয় গেঁথে গেঁথে? এ কি হয়? এ কি কখনো সম্ভব?
এ জগৎ কেবল ঘটনাবলির স্রোত, চলছে আর চলছে। আসছে আর যাচ্ছে, কিন্তু ফুরায় না। কেবলই মুখগুলো বদলে বদলে যায়, এক থেকে আরেকে, সেই আরেক থেকে আরো আরো অন্য মুখে। এ নিছক সত্য, নিত্যতা সূত্র। সেই ঘটনাস্রোতের পারে দাঁড়িয়ে তবেই গল্পকথা বলা যায়? নইলে স্রোতের টানে সব ভেসে যাবে?
কিন্তু যে বেচারা নিজেই ঘটনাবলির অংশমাত্র, সে নিজেকে নিরাসক্ত পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় রাখবে কী করে? সে যে ভীষণ কঠিন ব্যাপার!
ডানায় লেগেছিলো কখনো রোদ্দুর
কখনো রাত্রির শীতবাতাস-
কখনো ছুঁয়ে গেছে করুণা-জলকণা
কখনো ঝঞ্ঝার সর্বনাশ।
দিগন্তপ্রিয় সেই ছোট্টো পাখিটিকে আবার দেখতে পাই, আকাশপৃথিবী ধুয়ে দেওয়া দুধজ্যোৎস্না একদিন যাকে ডাক দিয়ে নীড়ের বাহির করে এনে ছেড়ে দিয়েছিলো আকাশে। তারপর আর কোনোদিন তো তার ফেরা হয় নি, কেবলই সে উড়ে চলেছে। নিচে কখনো জল কখনো ডাঙা, কখনো সবুজ শান্তির দেশ কখনো জ্বলন্ত মরুবালুরাশির আর্তনাদ। কখনো দারুচিনি দ্বীপের মায়াভরা আশ্রয়শাখা কখনো বা ঝড়ের সমুদ্রের কূলকিনারাহারা কান্না। এই সবের ভিতর দিয়ে সে কোথায় চলেছে, কোথায়?
মন্তব্য
অসম্ভব পর্যায়ের সুন্দর একটা লেখা।
অবিভুত হলাম, তাই ভাললাগার কথা জানিয়ে গেলাম।
ডাকঘর | ছবিঘর
অনেক ধন্যবাদ তাপস।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
কোথায় ?? উদাস লাগে যে বড় ...।।
কোথায়?
কেউ জানে না। জানে কি?
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
এটা মনে হচ্ছে গপ্প আর কোবতের লিনিয়ার কম্বিনেশনে আছে - তাইলে বুঝিনি
আহা লিনিয়ার কম্বিনেশনই হোক আর নন-লিনিয়ারই হোক, তাতে কী? পড়ার সময় তো ডিটেকশন হয়েই যাচ্ছে, যেভাবে পড়বে সেভাবেই পাবে।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
এই ছন্দ, আজকে কিন্তু টানেলিং করে ফেলেছে অন্যেরা।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
তা বটে দিদি, কিন্তু এটা তো ইস্কুলবেলাও নয় আর উপকথাও নয় কাজেই সমস্যা নেই...
আহা নয় কেন? এটা হয়তো ইস্কুলবেলা আর উপকথার লিনিয়ার কম্বিনেশন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
[আমার চারপাশ]-[ফেবু]-[টিনটিন]
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
কাল থেকে একটা চেনা কষ্ট দিক ওদিক ঘুরঘুর করছিল। লেখাটা পড়তেই মনের কার্নিশ ঘেঁষে বেশ পা ঝুলিয়ে বসে হাসতে হাসতে বললে, এইবার ?! কোথা পালাবি ?!
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
আশালতা, ছাদে ঘোরো নাকি? স্নানের পরে মাথার ভিজা চুল শুকাও?
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
খুব খুব ভালো লাগলো। কেন লাগলো? ভাবনায় গভীরতা আছে। একটা দার্শনিক আবেশ অনুভব করলাম। ভাষাটাও ঝরঝরে। একটাই আফসোস- এতো ছোট কেন?
অনেক ধন্যবাদ দেবানন্দ ভূমিপুত্র।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
একটা বিষাদ ভর করে এলো! কোথায় সে ডানা!!
সেই তো। ডানা ফোটে নি যে এখনো। ডানার কুঁড়ি রয়ে গেছে ভিতরে, তাই কেবলই মন চঞ্চল হয়ে ওঠে।
যেদিন ডানা ফুটে বেরোবে, সেদিনই উড়ে চলে যাবে অচিন পাখি।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
আহ, ফিরে আসলেন যেন ট্রেনভর্তি শেফালি নিয়ে!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
ধন্যবাদ রোমেল চৌধুরী।
আহা মনে করিয়ে দিলেন শেফালি, সেই তারার মতন করুণ কোমল শুভ্রদেহ, কমলা বৃন্ত। আর অপার্থিব সে সৌরভ।
সেই শরতনীল আকাশ, শিশিরে নতুন রোদের ছোঁয়া, তুলো তুলো মেঘ, আর তার নিচে এই শারদীয়া ফুল, ঝরে পড়ছে সবুজ ঘাসে, কোথা থেকে ছুটে আসছে শিরশিরে হাওয়া। সবটা না মিললে হয় না, সবটা মিলে একটা গানের মতন, সব সুরগুলো মিলে সে গান সম্পূর্ণ হয়। আহা, কতকাল হয়ে গেল তাদের দেখি না!
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
এ জগত কেবল ঘটনাবলীর স্রোত, চলছে আর চলছে.............এত ঘটনার ভীড়ে কতো কিছু যে হারিয়ে যায়!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ঠিক, নীড় সন্ধানী। "সহস্র বিস্মৃতিরাশি, প্রত্যহ যেতেছে ভাসি ----"
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
খুব ছুঁয়ে গেল।
অনেক ধন্যবাদ মিলু।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
খুব ভালো লেগেছে, তুলিদি...................
_____________________
Give Her Freedom!
শুনে আমারও ভালো লাগলো খুব।
ভালো থাকবেন।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
নতুন মন্তব্য করুন