দেশ দেশান্তর

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১২/০৯/২০১১ - ৯:৪৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হাস্পাতালে টোটাল নী রিপলেস্মেন্ট অপারেশানের তৃতীয় দিনে ঘুমে যখন চোখটা একটু লেগে এসেছে, ঠিক তক্ষুনি নার্স এসে মোলায়েম সুরে জাগিয়ে বললো তার সাথে হাটতে যেতে। তার সাহায্য বিছানা থেকে নেমে ক্রাচে ভর দিয়ে রুম থেকে বারান্দায় বের হোলাম। আমার ঠিক সামনে আমার মতন ক্রাচে ভর করে হেটেঁ চলেছেন আমার পড়শি। অপারেশান হওয়া পা ফুলে একদম কলাআআআ গাছ। নার্স আমাকে বারান্দার শেষ প্রান্তের গন্তব্যর সীমানা দেখিয়ে দিল, যেখানে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা ইতালীয়ান লেদার চেয়ার গুলি বিশ্রামের জন্য আমন্ত্রন জানাচ্ছে। পাঁচ মিনিটের পথ পঁচিশ মিনিটে শেষ হোল। পড়শির সাথে পরিচয় করিয়ে, দুজনের সামনে দুটি টোস্ট এবং এক কাপ করে রং চা দিয়ে বললো, ‘তোমরা বিশ্রাম, গল্প করো, দশ মিনিট পরে সিড়িতে ওঠা নামা প্রাক্টিস করে রুমে ফেরত যাবে’।

পড়শির নাম জেনিফার, জেনি, মৃদু হেসে আমাকে যা বললো তা বাংলায় এরকম ‘গতকাল তোমার অনেক বন্ধু এসেছিলো, তোমার ঘরতো ফুলেল উপত্যকা হয়ে গেছে’। আমি সন্মতির হাসি দিলাম। সে এরপর জিজ্ঞেস করলো ‘কিছু মনে করোনা, তোমরা কোন দেশি, কোন ভাষায় কথা বলছিলে?’ মনে মনে একটু চমকালাম, হাস্পাতালেও দেশোওয়ালী ভাই বোনেরা একসাথে হোলে স্থান কাল পাত্র ভুলে জোরগলায় কথা বলা শুরু করি। আমি বলি, ‘বাংলাদেশি, আমরা বাংলায় কথা বলছিলাম’। জেনির পরের প্রশ্ন ‘কোলকাতার বাংলা আর তোমাদের বাংলা কি একই? ভাষাটা খুব মিস্টি লেগেছে আমার কানে’। গর্বে আমার গদাপায়ের ব্যাথা ভুলে গেলাম, বললাম ‘হ্যা একই’। চায়ে চুমুক দিয়ে সে বললো তার বাবারা তিন পুরুষ কোলকাতার বাসিন্দা ছিলেন। তার বাবার দাদা পিটার ইংল্যান্ড থেকে বৃটিশ আর্মি অফিসার হিসেবে কোলকাতায় যান, পরে বড়দাদী সারা জাহাজে সুয়েজ খাল ঘুরে কোলকাতাতে আসেন। আর ইংল্যান্ডে ফেরত যান নি তাঁরা, কোলকাতাতেই জেনির বাবার বাবা চাচারা জন্মগ্রহন করেন, বিয়ে শাদি করেন, জেনির বাবা মার্ক এবং ফুফু মার্গারেটের জন্মও সিমলাতে। তিন পুরুষ বৃটিস আর্মিতে ছিলেন। পিটার, সারার মৃত্যু এবং কবর হয়েছে যেদেশে, প্রাচুর্য, আরাম আয়েসের সেই জীবনে দেশটিকে জন্মভুমির মতই ভালোবেসেছিলেন।

তাই ১৯৪৭ সালে যখন লর্ড মাউন্টব্যাটন, জওহরলাল নেহেরু, মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহ যখন দেশ ভাগ করছেন
তখোনো তারা ইংল্যান্ডে ফেরার কথা ভাবতে পারেন নি। কিন্তু দেশ স্বাধিন হবার আগে হিন্দু মুসল্মান দাংগা যখন আগুনের মত ছড়িয়ে পরলো তখন তাঁরা সেই বিভৎসতা এড়াতে জাহাজে চড়ে বসলেন অজানা অচেনা ‘স্বদেশ’ ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। উদবাস্ত হবার গ্লানী, জাহাজের যাত্রার ধকল দাদা এন্ড্রু এবং দাদী মেরি সহ্য করতে পারেন নি, ইংল্যান্ডে যাবার পর পরই শয্যাসায়ি হলেন। বছর না ঘুরতেই তারাঁ মৃত্যু বরন করলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের হিটলারের কার্পেট বোমার আক্রমনে বিদ্ধস্ত ইংল্যান্ডে মার্ক ঠিক থিতু হতে পারলেন না। আবার তিনি কোলকাতাতে ফেরত যাবার সিদ্ধান্ত নিলে বন্ধু বান্ধব তাকে বুদ্ধি দিল সম্ভাবনাময় কানাডা যাবার জন্য। মানতে কস্ট হোলেও যুক্তিটা মেনে কানাডার উদ্দেশ্যে লিভারপুল বন্দর থেকে ফের জাহাজে চড়লেন মার্ক। ১৯৫৮ সালে আটত্রিশ দিনের সেই কস্টকর সামদ্রিক যাত্রা শেষে হ্যালিফ্যাক্স বন্দরে অবতরন করলেন। অন্য যাত্রিদের সাথেই ইমিগ্রেশনের লাইনে দাড়ালেন।যদিও ইংল্যান্ডেই শুনে এসেছিলেন কানাডাতে শুধু ইউরোপিয়ানদেরই ইমিগ্রান্ট হিসেবে নেয়া হচ্ছে তখন।

লাইনে মার্কের ডাক যখন এলো, কানাডিয়ান অফিসার রুটিন মাফিক নাম, বাবার নাম, জন্ম স্থানের নাম শুনে, নাকের ডগায় ঝুলানো চশমার আর লোমশ ভুরুর মাঝে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে, জরিপ করে, মুখের পাইপ থেকে একগাল ধোয়াঁ ছেড়ে, পাসপোর্ট্টি ফেরত দিয়ে হাঁক দিলেন, ‘নেক্সট প্লিজ’। অসুস্থ, ক্লান্ত হতভম্ব মার্ক অসহায় কন্ঠে বল্লো ‘স্যার, আফটার অল আই এম য়্যান ইংলিসম্যান’! এক গাল ধোয়াঁ ছড়িয়ে অফিসারের উত্তর ‘বর্ন ইন ইন্ডিয়া’!! হাতের ইশারায় সরে যেতে ইংগিত করে, বললেন ‘নেক্সট প্লিজ’। ভগ্নমনোরথ, হতাশ মার্ক যখন মাথার উপর ভেঙ্গে পড়া আকাশ নিয়ে যখন রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন এক জন গার্ড দয়া পরবস হয়ে সান্তনা দিয়ে বুদ্ধি বাৎলে দিলেন। বন্দরের রেস্টুরেন্ট গুলিতে অনেক আমেরিকান আসে, তাদের কাছে খোজ করে অল্প বেতনের হোলেও একটা ওয়ার্ক পারমিট যোগার করে দুই তিন মাস কাজ করার পরে, স্থল পথে ফের চেস্টা করো। তখন পাসপোর্টের পরিবর্তে অই ওয়ার্ক পারমিটটা দেখিয়ে বোলবে ‘ইংলিস্ম্যান, ওয়ার্কিং ইন এমেরিকা’।
অনেক খোজাঁ খুজি করে অবশেষে বোস্টনে একটি অফিস বিল্ডিঙ্গের ডোরম্যান হিসেবে একটি চাকরি যোগার করেন, তারপর পরামর্শ মোতাবেক মনট্রিয়েল থেকে ইমিগ্রেশান নিয়ে অটোয়াতে নুতন জীবন শুরু করেন। নব্বই এর দশকে তিনি মৃত্যু বরন করেন, তিনি আজীবন সেই কলকাতার, সিমলার স্মৃতি চারন করেছেন, বার বার ফিরে যেতে চেয়েছেন জন্মভুমিতে, স্বদেশে নয়!!

ইমিগ্রান্টদের দেশ কানাডা। দুর্ভিক্ষ, দাংগা, দুর্যোগ, উৎপিড়িত শাষকের রোষানলের হাত থেকে নিস্কৃতি পাবার আশায়, উন্নত, শান্তিপুর্ন জীবনের আশায় পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে মানুষ এসে বসত করছে এদেশে, কিন্ত প্রত্যেকের মনেই রয়েছে নাড়ী ছেড়ার, শিকড় ছেড়ার দগদগে ক্ষতের অনুভুতি!! ছেড়ে আসা জন্মভুমিতে ফিরে যাবার এক অব্যাক্ত আকুতি মনের গভীরে লালন করেও নুতন একটি দেশকে প্রিয় স্বদেশ বানানো, কঠোর পরিশ্রমে ফের জীবনে প্রতিস্থিত হওয়ার সংগ্রামই ইমিগ্রান্ট জীবনের ইতিহাস।

মানষ পটে রইলো আকাঁ কোন সুদুরের দেশ,
এই জীবনের চলার পথটি হোত যদি সেই খানেতে শেষ।
ছবির মত দেশটি, কল্পনাতে ছড়ায় কোন আলো,
মনের ম্যাপে পথটি চিনে শুধু ইচ্ছেপ্রদীপ জ্বালো।

বাস্তুভিটের বংশধারা ছিন্ন করে, আকাংখারই টানে,
পথে নেমে পথিক হয়ে গন্তব্যকে জানে।
নুতন করে জীবন গড়া, নুতন পরিচয়,
কোন যাদুতে ভিন্ন বিদেশ, আপন স্বদেশ হয়।

সাঝেঁর বেলা আকাশ কোনে কাজলা রঙ্গের মেঘে,
জীবন স্মৃতি থমকে থাকে শ্রাবন আবেগে।
দেশে যখন ঘরে ঘরে শাঁখের আওয়াজ,
মোড়ে মোড়ে সুরের আযান,
মুশল ধারে বৃস্টি পড়ে, মনে ভেজে
কদম সুবাশ স্মৃতির বাগান।।

আসমা খান, অটোয়া


মন্তব্য

অপছন্দনীয় এর ছবি

অনেকদিন পরে লিখলেন - ওয়েলকাম ব্যাক হাসি , কিন্তু আপনার পোস্টের পুরোটাই প্রথম পৃষ্ঠায় চলে এসেছে - মডুদের অনুরোধ করলে হয়তো ঠিক করে দিতে পারে হাসি

ক্যানাডার রেসিজম আমি যেখানে থাকি সেখানে অতটা প্রকট নয়, কিন্তু তারপরেও কিছু ঘটনা ঘটেই। বেশ কয়েকদিন দেখেছি কিছু বাসে উঠতে গেলে ড্রাইভার আমার সামনের জনকে গ্রিট করে, আমার পেছনের জনকে করে, মাঝখানে আমাকে বাদ দিয়ে যায়। তবে এদের সংখ্যা খুবই কম।

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

বায়োনিক ওম্যান হবার প্রাক্টিস করতেছিলাম, এজন্য একটু ছুটি নিয়েছিলাম। টোটাল নী রিপ্লেস্মেন্ট অপারেশানের পরে এখন একটু ভালোর দিকে।
যখন কলেজে পড়ি, ফিলোসফির অধ্যাপক কালাম স্যারকে আমি কখনো প্রথমে সালাম দিতে পারিনি, উনি নিজেই ছাত্রিদেরকে প্রথমে সালাম দিতেন, শ্রদ্ধেয় সেই শিক্ষকের পথ ধরে, আপনি নিজে যে কাউকেই সহাস্যে প্রথমে গ্রিট করেই দেখেন !!!

আশালতা এর ছবি

মনে মনে অনেকদিন ধরেই খুঁজছিলাম আপনাকে, লেখা পেয়ে ভালো লাগলো। হাসি

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

কেউ মনে মনে আমাকে খুজছে, শুনে মনটা যে দারুন ভালো হয়ে গেলো!! ভালো থাকবেন আশালতা!

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

বাহ, বেশ তো!
শেষে জুড়ে দেয়া কবিতাটির টোন খুবই আপন মনে হলো।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

লেখা এবং কবিতা ভালো লেগেছে জেনে খুশী হলাম, অশেষ ধন্যবাদ!!

রু (অতিথি) এর ছবি

ভালো লাগলো।

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

লেখাটি ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। অশেষ ধন্যবাদ রু!

নিটোল. এর ছবি

সুন্দর লিখেছেন। আরো লিখেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।