দেলওয়ার কাকা। শুধু বড়দের কাছে শুনেছি- ছেলেবেলার এইসব জটিল সামাজিক টানাপোড়েনে দেলওয়ার কাকা একটু আধা পাগলা হয়ে গিয়েছিলেন। সমাজের উপর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। বিয়ে করেছিলেন আর বিয়ের পর এক এক করে তিন কন্যার জন্ম দিলেও এক ধরনের সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার নেশাটা তার একটুও কমেনি। মেয়েরা বড় হলে তিনি গো ধরলেন তিনি নিজে তাদের শিক্ষা দেবেন। কোন বিদ্যালয়ে তাদের পাঠাবেন না। এই নিয়ে কাকীর সাথে প্রতি রাতেই বাধত। তখন দেলওয়ার কাকার সে কি চিৎকার। কাকীও কি কম যায়। আমাদের পড়ার টেবিল, টেলিভিশনে ইংরেজী মুভির সিরিজ তাদের ঝগড়ার তুমুল শব্দে উড়ে পালাতো।
: ওদের পড়াশোনা করতে হবে না, দেলোয়ার কাকা রাগলে গলাটা একদম অন্যরকম লাগে।
: তাহলে কী রিকশা চালাবে?
: মেয়েদের দেখেছিস- রাস্তায় ইট ভাঙতে, রাত দিন রাস্তায় বসে ইট ভাঙছে। আমার মেয়েরা ইট ভাঙবে না। দরকার হলে রিকশা চালাবে। ছুটতে শিখবে। এক জায়গায় বসে থাকবে না।
: রিকশা চালাবে, এ্যা- এত সোজা...
: এত সোজা - জীবন এতই সোজা। পেপারে দেখিসনি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ছেলেকে মেরে ম্যানহলে ফেলে রাখছে। আর কটাকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি আমার মেয়েকে পড়াবো? যেখানে অভিভাবকত্ব নাই সেখানে আমার মেয়েদেরকে পাঠাবো?
: হ্যা পড়াতে হবে। সবাই পড়ায়।
: আমি ওদের মধ্যে একটা সুন্দর ঈশ্বর দিয়ে যেতে চাই আর কিচ্ছু চাই না। আমি বাচ্চাদের শুধু অহংকারটা দিয়ে যেতে চাই। ওরা ত্যাগ করে বড় হতে শিখবে। নিজের ব্যক্তিত্ব বিক্রি করার শিক্ষা আমি ওদের নিতে দেবো না। কোন সভ্যদেশে দাসত্ব করার জন্য পড়াশোনা করে না। এই দেশে কেউ প্রচ্ছদ বুঝে, প্রকাশক বুঝে, ভূমিকা বুঝে, অলংকরন বুঝে, তুই বুঝিস ? জানিস শিক্ষা কী - সভ্যতা কী? জানবি কী করে? নোট বই পড়ে শিক্ষিত হয়েছিস- শিক্ষা বুঝবি কী?
: আমি চলে যাবো। পাগলের সাথে সংসার করা সম্ভব না আমার পক্ষে ।
: বল বল। আর কী বলবি....উন্মাদ পাগল না হয় উন্মাদ শয়তান। আর কোন ডেজিগনেশন জানিস নাকি তুই? তোর সোসাইটির ঐ কচ্ছপ ইনটেলেকচুয়ালদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর, আরও কিছু ডেজিগনেশন জানিয়ে দেবে।
: যাবোই তো। ওদের কাছেই যাবো।
: দাঁড়িয়ে আছিস কেন, যা না। ওদের কাছেই যা। কোন মানুষের কাছে যাস না। ওরা তোকে ঘেষতে দেবে না। এত গন্ধ তোর শরীরে। মনের গন্ধ মাংস পর্যন্ত পৌছায় জানিস তো, নাকি সেটাও জানিস না?
: আমি ওদের নিয়ে চলে যাবো
: ভুলে গেছিস! এটা তোর বাচ্চা। কসম খেয়ে বলতে পারবি এটা তোর এক্সপেক্টেড চাইল্ড? এ্যা। যা না- চলে যাবি যা। ওরা তোর একটা কথাও শুনতে চায় না।
: আমি কোর্টে যাবো। মামলা করবো।
কাকীর কান্নার দমকে গলা জড়িয়ে আসতো। বিড়বিড় করে কী বলতো ঠিকমত বোঝা যেত না। বা বললেও কাকা শুনতো বলে মনে হতো না। তাকে তখন বলার তোড়ে পেয়েছে।
: আমি পিতা। যার তিনটা সন্তান আছে - সোসাইটির জাজমেন্ট লাগে না ওর। ওরাই সবচেয়ে বড় বিচারক। ওরাই বলতে পারবে আমি কতটা লোভী, কতটা পাপী, কতটা নিষ্ঠুর - নির্দয় - আমি কতটা নিষ্পাপ নির্মোহ । তুই কোন মামলার ভয় দেখাস? তুই নিজে কী জানিস? একটা ডিপ্লোমেটিক প্রসটিটিউট। সিম্পলি। নিজেকে বিক্রি করা ছ্ড়াা যার আর কোন অস্তিত্ব নাই।
: আমি চললাম।
: চলে যা। ভেবেছিস ভয় দেখিয়ে বশ করবি। তোর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই। তুই খালি আমার তিন বাচ্চার মা, এ ছাড়া আর কোন ইমোশনাল এটাচমেন্ট নাই। মদ না খেলেতো তোর কাছে যেতেও পারি না।
হটাৎ করে সব শুনশান হয়ে যেত। যেন পাশের বাড়ির টিভিতে সিনেমা হচ্ছিল- হটাৎ কারেন্ট চলে গেল। কাকী কি বাড়ি ছেড়ে চলে গেল তাহলে? পরদিন থেকে কোন আওয়াজ নেই বাড়িটাতে। শুধু রাত নামলে একটা ঘরে নিঃসঙ্গ আলো জ্বলে উঠতো। কয়েকদিন বাদে দেখা গেল দেলওয়ার কাকা তিন মেয়েকে নিয়ে বাক্স পেটরা নিয়ে ফিরছেন।
: কোথায় গিয়েছেছিলেন কাকা ?
প্রশ্নের উত্তরে দেলওয়ার কাকার হাসি ঝরে পরে।
: এইতো প্লেনে করে ঘুরলাম। কয়েকদিন ফাইভষ্টার হোটেলে মেয়েদের নিয়ে থাকলাম।
: তাই! অবাক হয়ে মেয়েগুলোর দিকে তাকাই। তিন বালিকার মুখ আনন্দে ঝলমল করছে।
: কেন জানো?
: কেন কাকা?
: কোন এক্সপ্লেয়েটড পলিটিশিয়ান আর ভূইফোড় বিজনেসম্যানের পোলা যেন ওদের কোন মোহতে ফেলতে না পারে। মেয়েতো।
বলেই দেলওয়ার কাকা নাক আর কান একসাথে নাড়াতে থাকেন। আমরা অবাক। ‘ আমার নাক, কানটা কুকুরের মত। কী করে হলো জানো? মা আর বোনকে পাহারা দিতে গিয়ে...’- বলেই অট্টহাসি দিয়ে ঘরে ঢুকে যেতেন। মেয়েরা মাকে পেয়ে আহ্লাদে ডগোমগো। আর মা গলা ছেড়ে কাঁদছেন। দেলওয়ার কাকা বোকার মত পায়চারী করছেন আর বলছেন - ‘আহহা কাদছো কেন? এত কান্নার কী হলো? আমরা কত মজা করেছি, মাকে বলো তোমরা।’ মেয়েদের ঠেলা দিয়ে দেলওয়ার কাকা হৈহৈ করতেন।'
মন্তব্য
কাকা মশাই এর অনুভূতি গুলো ছুঁয়ে গেলো।
লোকের চোখে, সমাজের চোখে তথাকথিত একটা অসুস্থ মানুষের পারফেক্ট এন্ড সুস্থ দর্পণ।
ভালো থাকবেন কর্ণজয় বাবু।
ডাকঘর | ছবিঘর
চলুক।
ভাই,মনের কথাটা এই একটা লাইনেই প্রকাশ করে দিয়েছেন।পুরো লেখাটার বেশ কয়েকটা লাইন বিবেকে নাড়া দিয়েছে।কিন্তু এই কথাটা কেমন যেন ওলটপালট করা একটা সত্যি কথা......মর্মে মর্মে বুঝতেসি Truth is better than fiction.
সামাজিক
রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক
অনেকদিন পর লিখলেন। চমৎকার লিখেছেন
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
অনেক গুলি তিক্ত সত্যি কথা বলে ফেললেন।
অনেকদিন পর ফিরে এলে কেমন জানি অচেনা মনে হয়।
তবু ভাল লাগে। অনেক অচেনা আর কিছু চেনা…
ভাল লাগছে..
ধন্যবাদ…
নতুন মন্তব্য করুন