পূর্ব কথন: কোন এক বেসরকারী সংস্থার পানি বিষয়ক সেমিনার। ইথিওপিয়া সহ আফ্রিকার বহু দেশে মানুষ মরে পানি দুস্প্রাপ্য বলে। বাংলাদেশের মানুষ মরে পানির অতিরিক্ত প্রবাহে। সেমিনারের আয়োজকরা পানির যথাযথ ব্যবহারে গুরুত্ব দিচ্ছেন এই সব দেশকে উদাহরন ধরে নিয়ে। সে সব দেশের মানুষ কী ভাবে পানির হাতে নিগৃহিত হচ্ছে তা উদাহরণ সহ দেখাতে ডাক পড়ে আমার। দেশে থাকতে দেশ নাটকের মাথায় ছাতা ধরতাম। নাটকের মাধ্যমে ভয়াবহ ব্যপারটা নির্ভয়ে উপস্থাপনের সুবিধা আছে অনেক। একেবারে শিশু-কিশোরদেরকেই বোঝাতে হবে পানির গুরুত্ব, যাতে তারা জীবনের অপর নামকে যত্নসহকারে ব্যবহার করতে শেখে। তাদের বাপ-দাদাদের কর্মস্থল; কল-কারখানার ধোঁয়া যে পরিবেশের বারটা বাজিয়ে আমাদের সলিলসমাধি ঘটাচ্ছেন, সেদিকটা অন্ধাকারেই থাকে।
আমি রাস্তার কুশীলব। আমন্ত্রন পেয়ে আনন্দাশ্রুর মতো লিখে ফেলি দুর্যোগ নাটক। আমন্ত্রন আসতে থাকে আরো আরো দর্শনীর। বছর পাঁচেক চলার পরে অচল হয়ে পড়ে নাটকটি, মূলত কুশীলবদের ক্লান্তিতে। বহু বছর আগে ফ্রাংকফুর্টের একটি নাট্যদলের জন্য বাংলা অনুবাদটি শুরু করেও শেষ করতে পারিনি সময় মতো। নির্ধারিত নাটকের অনুপস্থিতিতে ইতিমধ্যে ফ্রাংকফুর্টে হাসির নাটক মঞ্চস্থ হয়ে গেছে। তাই নাটকটি সচল করতে দিলাম সচলায়তনে।
দুর্যোগ
ভূমিকা,
প্রায় প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষ ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যায় প্রিয়জন এবং সহায় সম্বল সব হারায়। খোদার গজবের মত অসহায় মানুষগুলো এই দূর্যোগ মাথা পেতে নেয়। এছাড়া আর কোন উপায় ক্ষতিগ্রস্থদের নেই। দেশি-বিদেশী দান-খয়রাত বেঁচে থাকতে কিছুটা সাহায্য করলেও, কোন স্থায়ী সমাধান দিতে পারে না।
সমস্যাসাটা আদৌও সমাধানের অতীত? যেখানে মানুষের কোন হাত নেই? মানব সভ্যতার যান্ত্রিক উৎকর্ষে এই আপাত অসম্ভব দানবের দমন কৌশল অজ্ঞাত? নাকি বাংলার গরীব জনগনের আর্থিক সীমার বাইরে এই পাগলা ঘোড়ার লাগাম?
আমার নাট্য-পরিকল্পনা মানুয়েলা নাটারার এবং ষ্টেফি ক্লেমেন্টের অক্লান্ত পরিশ্রমে জার্মান ভাষায় অভিনীত হতে পারল। তাদের কাছে আমি আন্তুরিক ভাবে কৃতজ্ঞ। অসংখ্য ধন্যবাদ নাটকটির প্রথম মঞ্চায়নের সব কুশীলবদেরকে। তাদের মতামত ও চিন্তাধারা এই নাটককে সমৃদ্ধ করেছে।
মিথুন কায়সার
আউগ্সবুর্গ, জার্মানী
মে ১৯৯৪
চরিত্র
কলিম: গ্রামের চাষী,
মনু: কৃষানী (কলিমের স্ত্রী)।
নবী: কলিম ও মনু-র ছেলে।
কমলা: প্রতিবেশীনি।
সেলিম, আজিজ, মোসলেম একই গ্রামের চাষী।
জনৈক পুলিশ কন্টেবল।
জলোচ্ছাসে কিছু মৃতদেহ এবং আহত।
প্রথম দৃশ্য
(শহরের ফুটপাথে, চট, প্লাষ্টিকের বস্তা, ছিন্ন মলিন কয়েকটি কাঁথা-বালিশের উপর বিছানা পেতে গল্প-গুজব করছে কয়েকজন নারী-পুরুষ)
মোসলেম: ও কলিম ভাই, একখান গান শুনাইবা নি?
আজিজ: অয়, কলিম ধর একখান গীদ।
কলিম: কী গান গামু? আমাগো গানই কত মাইনষে গায়!
সেলিম: গাও কলিম ভাই, গাও একখান গান।
(কলিম কিছুক্ষন ভেবে সত্যিই একটা গান ধরে)
ঢেউ উঠলো সাগরে রে
কেম্তে পাড়ি ধরি রে
হায় মাঝি রে।।
ও মাঝিরে
যারা ছিল চতুর নাইয়া
তারাই গেল বাইয়ারে মাঝি
তারাই গেল বাইয়া
আমি অধম রইলাম বইয়া
হায় হায় আমি অধম রইলাম বইয়া
আমার ভাঙ্গা তরী লইয়ারে
নদীর কূলে বইয়া।।
ঢেউ উঠলো সাগরে রে
কেম্নে পারি ধরি রে
হায় মাঝিরে।।
(কলিম পরের কলি ধরার আগেই কমলা চেঁচিয়ে উঠে)
কমলা: বেবাক বেক্কল মর্দা! কাম-কাইজ একটা কিচ্ছু জোগানের কোন ধান্দা নাই! নিশি রাইতে মাগি-গ লাহান সুর কইরা বিলাপ ধরসে!
মোসলেম: কী করমু কও কমলা! কামের লাইগ্যা চেরেষ্টা তো কম করি নাই!
কমলা: একটা কিছু তো করোন লাগব! এইম্তে পথে বইয়া কয়দিন থাকুম!
সেলিম: ঠিক কইস, তয় করমুডা কী!
কলিম: বেয়ানে যামু চঞ্চ ঘাটে, সরদারের লগে কতা অইসে, হেয় আমাগ কুলির কাম দিব। হের বাদে বস্তিতে থাহনের জায়গাও কইরা দিব। রাইত বহুত অইসে, অহন ঘুমাও বেক্তে।
(সবাই শোয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে, এমন সময় জনৈক পুলিশ কন্টেবলের প্রবেশ)
পুলিশ: হেই হেই করস কী এইখানে? এইটা মানুষের চলাফেরার রাস্তা, তোমাগ শোয়নের হোটেল না! লোটা-কম্বল নিয়া ভাগ এহান থেইক্যা!
সেলিম: এত রাইতে কৈ যামু?
মোসলেম: ঘর-বাড়ি, জমি-জিরাত, গরু-বাছুর বেবাক ভাইস্যা গেসে! পোয়াতী বউ গেছে মারা!
আজিজ: আমাগ কোন বাড়ি-ঘর নাই দারগা সাব!
কমলা: দুধের সাওয়াল পানিতে ভাইস্যা গেসে, হেরে ধরতে গিয়া হের লগে ভাইস্যা গেছে সোয়ামী। বড় দুঃখি আমরা দারগা সাব, আমাগো কেউ নাই, কিছু নাই!
সলিম: পানি আমাগ সহায়-সম্বল বেবাক নিসে! মোরা রাস্তার ফকির আইয়া গেছি!
পুলিশ: তোদের এত কথা শোনার টাইম নাই। কই যাবি, কই থাকবি, হের আমি কী জানি? রাস্তা কিলিয়ার কর। এহান থেইক্যা ফুট।
কলিম: আহারে পানি! রাইতের ভিতরে বেবাক কাইরা নিলি। বউ-বাচ্চা, ভিটা-মাটি, সোনার সংসার, সুখের বসতি। ভূত-ভবিষ্যৎ ভাসাইয়া নিলি!
(ধীরে ধীরে পর্দা পরবে বা লাইট নিভে যাবে)
দ্বিতীয় দৃশ্য
(ভোরের আলোতে দেখা যাবে একজন কৃষক বলদের ঘাড়ে জোয়াল বেঁধে, জোয়ালে লাঙ্গল বাঁধছে। একটু একটু করে আলো বাড়বে, সকালের সোনালী আলোতে সে হাল বাওয়া শুরু করেছে, আমি এই দৃশ্যটা মঞ্চে পেন্ট মাইমের আশ্রয় নিয়ে করেছিলাম )
কলিম: হুরররর.... হট হট! হট হট হুররর। আর একটা পাক, তয় আরাম। আমরা খায়াম, তরা খাবি। বেলা বাড়ার আগে ক্ষেত চাষ অইলে গাঙ্গে নাইয়া বাড়ি যাবি।
(এসব বলতে বলতে কয়েক পাক ঘোরার পরে লাইট আরো বাড়বে, দুপুরের মত উজ্জল হবে মঞ্চ। মঞ্চের কোনে দাঁড়িয়ে নবী, লুঙ্গিতে বাঁধা ভাতের থালা তার হাতে)
নবী: বাজান, খাইয়া লও।
কলিম: তুই বয় বাজান। আমি গরুগুলান গাঙ্গে পানি খাইতে দিয়া, গতর ধুইয়া আই।
(কিছুক্ষনের জন্য কলিম গরু নিয়ে প্রস্থান করবে, নবী গাটুরী খুলে ভাতের থালা বিছিয়ে রাখবে, এর মধ্যে কলিম আবার মঞ্চে প্রবেশ করবে।)
কলিম: কী রানসে তোমার মায়ে?
নবী: পুটি মাছ।
কলিম: তোমার মায়এ পুটি মাছ কৈ পাইল?
নবী: আমি ধরসি, পুকুর থন।
কলিম: বাজান, পড়া-লেখা থুইয়া মাছ ধরতে যাইতে মানা করছি না!
নবী: পড়া শেষ কইরাই মাছ ধরতে গেসি বাজান।
কলিম: সইত্য কথা? রাইতে পড়া ধরলে বুঝুম। তয়, তুমি খাইস? (ভাতের লোকমা ছেলের মুখের দিকে এগিয়ে দেয়)
নবী: খাইসি বাজান।
কলিম: এক নলা খাও বাজানের লগে! (নিজে খেতে খেতে ছেলেকে প্রশ্ন করে) আইজ কী পড়স?
নবী: বাংলা, ইংলিশ, অংক।
কলিম: একটা কবিতা কও হুনি!
নবী: আমাদের গ্রাম খানি ছবির মতন....
কলিম: এক কবিতা আর কয়দিন হুনাইবা বাজান! আইজ রাইতে নতুন কবিতা হিকবা একখান।
নবী: হ্যাঁসূচক মাথা নারে।
কলিম: ভাল কইরা না পড়লে, বাবার মতন আল বাইবা। আর ভালা কইরা পড়লে, কোট-পেন্ট পিন্দা অফিস-আদালতে বইয়া, লেখা-পড়ার কাম করবা বাজান। পরির মত সুন্দর মাইয়া দেইখ্যা বিয়া করামু।
নবী: হ বাবা, মায়ে কইছে, বড় অইলে আমি ডাক্তর অমু।
কলিম: যাও বাজান, অহন বাড়ি যাও।
নবী: তুমিও জলদী বাড়িত আইও বাজান।
কলিম: হ বাজান আমু, মায়ের কথা হুইন্নো।
তৃতীয় দৃশ্য
(কলিমের বাড়ি, কলিমের স্ত্রী মনু রান্না ঘরের সামনে মাটিতে খোদাই করা চুলায় রান্ন করছে, বিকেল বেল।)
কমলা: ভাবী, কেমন আসেন?
মনু: কমলা! আও, (পিড়ি এগিয়ে দিতে দিতে) বও। আসি বইন, তোমাগ দোওয়ায় ভালাই আসি। তোমরা কেমন আস? মাইয়া কৈ?
কমলা: খোদার কাছে হাজার শুকরিয়া ভাবী। ক্ষেতের, ঘরের বেক কাম শেষ। মাইয়ার বাপে মাইয়ারে লইয়া হাটে গেছে। মাইয়ার লাইগ্যা ইসকুলের জামা বানাইব।
মনু: পিন্দনের শাড়ি আগে দেহি নাই! নয়া নাকী?
কমলা: হ, আপনের ভাইয়ের কারবার! তিনকুড়ি টেহা দিয়া আনসে।
মনু: হেই রহম জিনিশ! দাম তো অইব ই। তোমারে খুব মানাইসে। আমার দেওরের পছন্দের তারিফ করন লাগে!
কমলা: আপনের পোলা হের বাপেরলগে লগে হাটে গেসে বুঝি?
মনু: পোলার কথা আর কইও না, বইন। বেয়ানে ইসকুলে যায় আর সারা দিন শয়তানের পোন্দে বাঁশ দেয়। বাপে ঘরে থাকলে এট্টু পড়তে বয়। বড় আশা করসিলাম পোলারে ডাক্তর বানামু। পড়তে বইলে কয় বেক পারি। আমি জানিনা লেখা-পড়া, কেম্নে বুঝুম হাসা কয় না মিসা কথা কইয়া মূখ্য মা-রে বুঝ দেয়!
কমলা: আমাগ মাইয়ার লাইগ্যা মাষ্টার রাখুম। নবীরে হের ধারে পাঠাইতে পারেন। হুনসি পোলায় পড়া-হেখায় ভালা। তয় ছোড মানুষ এট্টু খেলা-ধূলা তো করবই। হের লাইগ্যা চিন্তা কইরেন না ভাবী।
মনু: দোয়া কইর বইন।
কমলা: পোলা, লেখা-পড়া শিক্ষা মানুষের মতন মানুষ অইলে খালি বাপ-মার খুসি! গেরামের বেবাক মাইনষের গর্ব। হের দেহা-দেহী অন্য পোলাপাইনরা পড়ব। পরাণ ভইরা দোয়া করি ভাবী; আমাগ নবী যেন খুব বড় বিদ্যান হয়।
মনু: (মুড়ির পাত্র কমলার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে) নেও বইন, এট্টু মুড়ি মুখে দেও। ভাত অইলে খাইয়া যাইবা।
কমলা: না বইন, হাটের তন আইয়া পরব আপনার দেওর। বাইত্তে যাই।
মনু: খাওয়ার লাইগ্যা এট্টু পানও তো দিলাম না! খালি মুখে যায় নিহি!
কমলা: হ, এট্টু পান খামু, বইন। ভাশুররে কইয়েন, নবীরে যেন আমাগ বাইত মাষ্টারের ধারে পড়তে পাঠায়। আম্নের দেওরে এই সম্বাদ দিয়া পাঠাইসে।
মনু: (পানের বাটা কমলার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে) ভালা কথা, তোমার ভাশুরের অমত করব না। হেরে কমু আমি। মাষ্টার আইব কবে?
কমলা: আইয়ে দিন আওনের কথা।
মনু: বেতন কত?
কমলা: দশ টাকা মাসে, দুইজন এক লগে পড়লে পনোর টাকা। মাষ্টার খুব ভালা। ধনু মুন্সীর পোলা, হের ধারে পইড়া, বিত্তি পাইছে!
মনু: কও কী! মুরগীর ডিম বেইচ্চাই মাষ্টারের বেতন দিতে পারুম আমিই। কাইল থন নবী তোমাগ মাষ্টারের ধারে পড়তে যাইব। কথা পাক্কা।
চতুর্থ দৃশ্য
(সন্ধ্য, কলিমের ঘরের মেঝে বিছানা পাতা। কুপির আলোতে নবী পড়ছে। কলিম মন দিয়ে ছেলের পড়া শুনছে। মনু পাশে বসে আছে।)
নবী: বাবা ঘুম ধরসে!
মনু: পড়তে বইলেই হের ঘুম ধরে! সারা দিন কাইয়ার ছাও-বগার ছাওয়ের পিছে পিছে ঘুরার সময় ঘুম ধরে না!
কলিম: ঠিক আছে বাজান, শুইয়া পর।
(নবী বই বন্ধ করে মনুর কোলে মাথা গুজে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পরে।)
মনু: কোন খবর পাইলেন?
কলিম: মাষ্টার কইল দশ লম্বইরা বিপদ!
মনু: খুব বড় বিপদ?
কলিম: বেকতে হেই কথাই কয়!
মনু: কী অইব?
কলিম: তুফান আইব, জলস্তি আইতে পারে!
মনু: গরু-বাছুর ভালা কইরা বানসেনে নি?
কলিম: হ, কিন্তক জলস্তি আইলে গরু-বাছুর বাইন্দা লাভ কী?
মনু: আল্লায় আমাগ বেক বালা-মুছিবত থেইক্যা বাচাইব। দেখবেন ইনশাল্লাহ জলস্তি কুনু ক্ষতি করব না!
কলিম: আল্লাহর উপরে ভরসা ছাড়া অহন আর গতি কী!
মনু: বাতি নিভায়া দেই, বহুত কাম করসেন, অহন শুইয়া পরেন। জলস্তি অন্তক আইয়ে নাই। রাইতটা কুনু রহম পার করতে পারলেই অয়।
কলিম: হ, বেক্তের যা অয়, আমাগ হেইই অইব! চিন্তা কইরা জলস্তি ঠেকাইতে পারুম!
(বলতে বলতে ছেলেকে মাঝখানে রেখে, কলিম ও মনু শুয়ে পরে। মনু ফুদিয়ে কুপি নিভিয়ে দেয়। মঞ্চ অন্ধকার)
পঞ্চম দৃশ্য
( ঝরের শব্দ, বৃষ্টি, বিজলী, ঘর দুলে উঠবে। ঘুম থেকে জেগে উঠবে মনু। মাঝে মাঝে বাজ পড়ার শব্দ, বিজলীর আলোয় আলোকিত হবে মঞ্চ। আর কোন লাইট থাকবে না।)
মনু: ওই নবীর বাপ, ওঠেন, জলস্তি আইতাসে!
কলিম: (উঠে বসে) বউ চিক্কুর পার কেন, কী অইসে?
মনু: জলস্তি আইতাসে, কেমন তুফান ঠাডা-বিজলী শুরু অইসে।
(ঝরের তান্ডব ধীরে ধীরে বাড়বে)
কলিম: খাড়াও, দুয়ার মেইল্যা দেহি।
(দরজা খোলার সাথে সাথে, বৃষ্টির ঝাপটা, বাতাস ঘরের সব লন্ড-ভন্ড করে দেবে)
মনু: এই নবী, উঠ।
(নবী উঠে মাকে জড়িয়ে ধরবে)
কলিম: শক্ত কইরা পোলাডারে ধর, আমি দেহি, মসজিদে কেউ আছে নাকি!
(ঘরের ছাউনী উড়ে যাবে। জলের ধারা সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। নবী মনুর অর্তচিৎকার শোনা যাবে। অনেক মানুষের চিৎকার চেচামেচী এক সময় থেমে যাবে।)
ষষ্ঠ দৃশ্য
( গাছের ডাল, ঘরের চাল, গবাদী পশু ও মানুষের মৃত দেহ কোন বালুচরে। মানুষের মৃত দেহগুলো পর্যেক্ষণ করছে কয়েক জন। দিনের আলো থাকবে মঞ্চে।)
কলিম: (মঞ্চের সবগুলো মৃতদেহ দেখে) গাঙ্গের বাকে বাকে তন্ন তন্ন কইরা খুজছি! খালি মানুষের লাশ! গরু-বাছুর, হাঁস-মুরগী বেক মরা! এত মানুষ মরসে! দাফন করবো কে?
মোসলেম: দিন ভইরা খুজছি, আমার ঘরের কেইরে পাইনাই। খালি মরা মানুষ। এতো লাশ আমরা কৈ থুমু?
(মৃতের মোত পরে থাকা কোন মহিলার গোঙ্গানী শোনা যাবে)
কলিম: মানইষের গোঙ্গানী হুনসনী!
মোসলেম: অয়, এ দিগের থন আইছে শব্দটা!
কলিম: লও দেহি, একজনরে বাঁচাইতে পারিনি!
সেলিম: জলদী ধর কলিম ভাই।
কলিম: মোসলেম ভাই, ঐ যে দেখ ডাক্তরের লালচানতারা বাদাম। হেন লাইয়া যামু।
( আহত মহিলাকে নিয়ে সকলের প্রস্থান)
সপ্তম দৃশ্য
(প্রথম দৃশ্যের বাকী অংশ)
পুলিশ: আজাইরা পেচাল ক্ষমাদিয়া অহন যা!
কমলা: কৈ যামু? ঘর-বাড়ি, জমি-জিরাত, আত্মীয়-স্বজন বেক ঐ বানে ভাসায় নিসে!
মোসলেম: চল গেরামেই ফিরা যাই। বেবাকে মিললা আবার নতুন কইরা শুরু করি সব। এই শহরে কি করমু আমরা?
সেলিম: ঠিক কইস মোসলেম ভাই! গেরামে আমাগরে বেকে চিনে। কিছু সায্য হেরা করব! সবাই মিললা চলো গেরামেই যাই।
কলিম: আবার পয়লা থেইক্যা বেক শুরু করতে অইব! আমাগ বাপ-দাদার লাহান, পানি সব ভাসায় নিব, আমরা নতুন কইরা আবার সব বানামু। আবার সব ভাইস্যা যাইব!
হুনসি মানুষ চান্দে গেছে, সাগরের তলায় ডুব দিসে, হিমালয়ে উঠছে। খালি বানের লগে লড়াইটা, আমাগ একলাই করন লাগব! আমাগ সায্য কেউ করব না!
আজিজ: লও যাই, বেয়ানেই বাড়ি ফিরা যাই। লড়াই-ই আমাগ জীবন। গতরের ঘাম, শিরার লহু, বুকের সাহস, মাথার বুদ্ধি দিয়া মেহন্নত কইরা আবার বেক বানামু আমরা। লড়াই-ই আমাগ জীবন।
সলিম: লও যাই।
সবাই: লও যাই। (সবাই উঠে দাঁড়াবে, পর্দা পরবে।)
সমাপ্ত।
মন্তব্য
আগে এভাবে নাটক পড়িনি। আজকে আপনার কল্যাণে পড়া হয়ে গেলো, অনেক ধন্যবাদ সে জন্য।
চতুর্থ দৃশ্যে নবী হঠাৎ করেই পার্থ হয়ে গেলো যে ভাইয়া! শব্দটা মর্দ নাকি মর্দা? (হয়ত অন্য অঞ্চলে মর্দা বলে থাকে আমার ঠিক জানা নেই) সচলেরা নাটকটা মঞ্চায়ন করে ফেললেই তো একটা নাটক দেখা হয়ে যায় আমাদের
নাটকটা পড়ে ভালো লেগেছে
ধন্যবাদ আয়নামতি,
মূল স্ক্রিপ্টে পার্থ-ই ছিল। ঐ চরিত্রের প্রথম অভিনেতার নাম সত্যিই পার্থ। এখন অবশ্য অনেক বড় হয়ে গেছে সে।
অনুবাদের সময় সব নাম জার্মান রেখেই করেছিলাম। পরে ভেবে দেখলাম; বাংলায় ঠিক প্রমিত ভাষায় নাটকটা কেমন যেন বেমানান লাগে। বেমানান লাগে পার্থ নামটিও। মানান সই অথচ সবাই বোঝে এমন একটা আঞ্চলিক ভাষা ঠিক করাও বেশ কঠিন লাগল। এভাবেই অনেক চেষ্টা করে এই দাড়াল।
মনোযোগ দিয়ে পড়ে অসংগতিটি ধরিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। মর্দ বা মর্দা আমার ধারণা দুটোই শোনাযায় অঞ্চল ভেদে।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
নাটকটা ভালো লাগলো।
দুর্যোগে হার না মানা উজ্জীবিত এই মানুষগুলোর স্বপ্ন সপ্তম দৃশ্যের পরে তারা কিংবা তাদেরকে নিয়ে আমরা যারা দেখি, বাস্তবে সেগুলো বেশিরভাগ সময়েই অধরা থেকে যায়,
অতীত
ধন্যবাদ অতীত,
দুর্যোগে হার নামা মানুষগুলোর বেশীর ভাগ বস্তিতে ঠাঁই পায়। যাদের অন্তত সামান্যতম ভিটে-বাড়ি বা জায়গা-জমি আছে কেবল তাঁরাই ফিরে যায় বা যতে পারে।
নাটকটি ভাল লাগার জন্য ধন্যবাদ।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
পুতুল ভাই, আমিও নাটকের মানুষ। সিলেটে আমার দল কাজ করে। আমার দলের নাম নান্দিক নাট্যদল, সিলেট। যদি আপনি অনুমতি দেন তাহলে আপনার এই নাটকটা আমরা কি পড়তে এবং পরবর্তীতে যদি সম্ভব হয় তাহলে মঞ্চায়ন করতে পারি? আর যদি সম্ভব হয় তাহলে স্ক্রিপ্টটা কি আমাকে মেইল করতে পারবেন?
আমার মেইল:
আপনার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
নাটকটি ভালো লেগেছে।
ধন্যবাদ সুপ্রিয় দেব শান্ত,
খুব ভাল লাগল আপনার আগ্রহ দেখে। নান্দিক নাট্যদলকে আমার শুভেচ্ছা জানাবেন।
স্ক্রিপ্ট এখনই পাঠাচ্ছি।
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
নতুন মন্তব্য করুন