পরের দিন সকালে ৫ টায় উঠে একটু পরেই আমরা বেড়িয়ে পড়লাম, কমপ্লেক্স সকালেই খুলে যায়, সূর্যের প্রথম আলোতে অসাধারণ লাগে জায়গাটা, দেখলেই একটা অপার্থিব অনুভূতি তৈরী হয়, পাথরের সুউচ্চ মন্দিরগুলোর গায়ে যখন সোনালী আলো পরে তখন মনে হয় পুরো জায়গাটাই সোনা দিয়ে মোড়ানো
এবার ইতিহাসটা একটু বলে নেই, মধ্যযুগের এই মন্দিরগুলো ভারতের সাতটি বিস্সয়ের অন্যতম ধরা হয়, সারা বিশ্ব থেকে পর্যটক আসে এখানে, স্থাপত্য বিদ্যার অসাধারণ নিদর্শন এই মন্দিরগুলো সব ধরনের শিল্প অনুরাগীদের বিমোহিত করে রাখে, ১০-১২ শতাব্দীতে এই শহর ছিলো তত্কালীন শাসকগোষ্টি চানডেলা রাজপুতদের শিল্প সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ৯৫০-১১৫০ এই ২০০ বছর ধরে গড়ে উঠেছিলো মন্দিরগুলো, পুরো জায়গাটিতে ৮০ টি মন্দির ছিলো যার মধ্যে ২৫ টি এখনো প্রদর্শনের উপযুক্ত অবস্থায় আছে, ২০ বর্গ কি.মি জায়গা নিয়ে মন্দির গুলো ছড়িয়ে আছে| স্থাপত্যশৈলীর অসাধারণ নিদর্শন এই মন্দিরগুলো সেন্ডস্টোন এ নির্মিত, কোনধরনের মর্টার ব্যাবহার না করে, শুধুমাত্র বিশাল বিশাল পাথর খন্ড ব্যাবহার করে তৈরী করা হয়েছে| সেই সময় এত নিঁখুত কারুকার্য কিভাবে সম্ভবপর ছিলো আমার মাথায় তা এখনো ঢোকেনা, প্রতিটি মন্দিরের বাইরে এবং ভিতরে এমন কোনো জায়গা বাকি নেই যেখানে কোনো কাজ করা হয়নি, মনোমুগ্ধকর এই কাজগুলো কোনো আধুনিক যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া শুধুমাত্র হাতুড়ি ও লোহার সাহায্যে পাথর খুদে খুদে তৈরী করা হয়েছে, এটা ভাবলেই অবাক লাগে| সুউচ্চ মন্দির গুলোর শিখর পর্যন্ত হাতের কাজ, এক একটা পাথরের ওজন কয়েক টন| এই পাথর গুলোকে দূর দুরান্ত থেকে এনে এত নিঁখুত ভাবে একটার উপর একটা বসিয়ে তৈরী করা মন্দির গুলোকে দেখলে একসময় মিশরের পিরামিডের কথা মনে পরে যায়| স্থাপত্য শিল্পীরা বংশানুক্রমে ২০০ বছর ধরে তৈরী করে গেছেন এই মহান কীর্তিগুলো| কিছু মন্দিরের বাইরের দিকের দেয়ালে নর-নারীর মিলনের কিছু দৃশ্য তৈরী করা আছে| মন্দির গুলোর প্যাটার্ন দেখে যা মনে হলো, গঠনশৈলী মোটামুটি এক, তবে কিছু ক্ষেত্রে গম্বুজ আকৃতির ছাদ ব্যাবহার করা হয়েছে| বিভিন্ন দেব-দেবী আর তত্কালীন সামাজিক জীবনের চিত্র কি সুনিপুন হাতে ফুঁটিয়ে তোলা হয়েছে, একবার দেখা শুরু করলে তাকিয়ে থাকতে হয়|
আমি দেখতে দেখতে এতই আশ্চর্য হচ্ছিলাম যে একসময় হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখছিলাম, কি মসৃন কারুকার্য, এত এত বছর পরেও টিকে আছে, এখনো মনে হয় এইতো সেদিনের তৈরী| কিছু কিছু মন্দিরের গায়ের কাজ ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন যুদ্ধের সময়, এছাড়া মোটামুটি অক্ষত অবস্থায়ই আছে পুরো জায়গাটা| আর বক বক করে দীর্ঘ করছিনা, অনেক ছবি তোলা হয়েছিল, তার মাঝে কয়েকটা দিয়ে দিলাম এখানে পর পর-
আসলে ছবি দেখে কতটুকু বোঝা যায় জানিনা, তবে কাছে থেকে দেখার অন্য রকম শিহরণ কাজ করে| আমাদের হাতে সময় কম ছিলো, সেদিনই চলে আসতে হবে, তাই বলতে গেলে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে দেখতে হয়েছে, যতটুকু মনে আছে প্রথম মন্দিরটা আমি ২ ঘন্টা সময় নিয়ে দেখেছিলাম প্রায়, ভালো করে সব কাজ দেখতে হলে পুরো একদিন লাগতো| তারপর ভালোলাগা আর বিস্সয়ের মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে যখন বাইরে বের হয়ে আসলাম, তখনো আসলে বুঝতে পারছিলামনা কোথায় আছি| পুরাতত্ত্ব এভাবেই আমার পছন্দের বিষয়, তার উপরে এরকম একটা জায়গায় দাড়িয়ে থাকার অনুভূতিটা অন্যরকম| বাইরে একটা রেস্টুরেন্টে সকালের খাবার খেলাম, সত্তি বলতে এত ভালো সেন্ডউইচ পাবো ভাবিনি এখানে| দারুন কাটলো সময়| এবার ফেরার পালা| তবে ফেরার সময় রাস্তা চেনা, তাই প্রস্তুতি আছে| তবে "পান্ডভ ফলস" দেখে যাবো|
শহর থেকে বেশি দূরে নয় জায়গাটা, ৪০ কি.মি এর মতো দুরত্ব| অনেকটা নিচে হেঁটে নামতে হয়, পাথুড়ে সিড়ি বেয়ে বেয়ে, নিচে দেখলাম সেইসময়ের পাহাড়ের গা খুদে তৈরী করা ছোট ছোট ঘর, ঘাটও বানানো আছে দেখলাম| কথিত আছে যে, মহাভারতের পঞ্চপান্ডব কে যখন বনবাসে পাঠানো হয় তখন তারা কিছুদিনের জন্য এই ঝর্নার পাদদেশে অবস্থান করেছিলো| সেখান থেকেই এর নাম হয়ে গেছে পান্ডভ ফলস| দেখলাম ঝর্নার জল যেখানে জমা হচ্ছে জায়গাটা অনেক গভীর, নিচে না নামার সতর্কবাণী লেখা আছে দেখলাম| ঘর গুলো কিছুটা পাহাড়ের গায়ে গুহার মতো| ভিতরে ঢুকে দেখলাম প্রচন্ড পিছল| পা পিছলে পড়তে পড়তে বাঁচলাম|
এরপর আবার ছুটে চলা, এবারে আর থামার কোনো জায়গা নেই| মাত্রই দেখে আসা জায়গাগুলোর মোহ কাটেনি, তাই দুজনেই চুপ চাপ| আসার পথে বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনা থেকে বাঁচলাম| একবার ভুল রাস্তায় চলে গিয়েছিলাম ৩০ কি.মি| তার উপরে তেল শেষ হয়ে এসেছে বাইকের, অনেকখন ধরে রিজার্ভে চলছিলো, কিন্তু রাস্তায় পুরো ১০০ কি.মি এ কোনো পেট্রোল পাম্প নেই| আমরা ভাবি এই বুঝি বাইক দিয়ে গেলো, আর দাড়িয়ে গেলেই হয়েছে, চারিদিকে কোনো লোকালয় থাক গাড়িও নেই রাস্তায় কোনো| এভাবে চলতে চলতে একসময় পেয়ে গেলাম পাম্প| তারপরে আর বিশেষ থামা হয়নি| পাক্কা ৮ ঘন্টার জার্নি করে রাতের বেলা পৌঁছলাম এলাহাবাদ| পরপর ২ দিনের ১৬ ঘন্টা আর প্রায় ৬৫০ কি.মি জার্নির ধকলে তখন আর কথা বলার অবস্থায় নেই আমরা| সাথে রইলো অপার্থিব ভালো লাগার কিছু অনুভূতি|
মন্তব্য
ছবিগুলো দেখে মন ভরেনি কারণ আরো দেখতে ইচ্ছা হচ্ছিল। ছবি সুন্দর হোয়েছে, খুব ভাল লেগেছে। আর আমারো বেড়ানো হল আপনার সাথে সাথে। তবে বাইকে এতো লম্বা দূরত্ব যাওয়া ঠিক হয় নাই অবশ্যই।
বাইকে এতদূর যাওয়া ঠিক হয়নি তা জানি, কিন্তু বেঠিক কাজগুলো করেই তো মজা, যা সবাই করে তা করলে আর এডভেঞ্চার কি করে হবে ..
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
ছবিগুলোর লাইনদুয়েক বর্ণনা থাকলে মন্দ হত না বোধহয়। আর বাইক বেচারা এত অবহেলিত কেন? তার কোন ভালো ছবি দেখলাম না যে।
ধন্যবাদ, বর্ণনা দিয়ে আর খামোকা বড় করলামনা, ভাবলাম কিছু জিনিস দেখেই ভালো উপলব্ধি হবে ...
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
সহমত, ছবিগুলোর স্পিরিট নিয়ে লিখতে পারেন। কেন তা বাৎস্যায়নের 'কামসূত্র'-এর স্পিরিট থেকে আলাদা সেটি জানতে পারলে মন্দ হতো না।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
খুব সুন্দর ছবিগুলো, লেখাও!!! অর্ফিয়াসদাকে তো চিনে ফেললাম, আর সমুদ্রের দিকে মুখ ফিরে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই.............
_____________________
Give Her Freedom!
হে হে হে !!! ওটা ট্রেডমার্ক স্টাইল ..
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
ডবল
কি বলব, আমি তো ছবি গুলো দেখেই (এলবিডব্লিও) আউট , তারপর আপনার কথা পড়ে তো একেবারেই রান আউট, এবার ভাবছি এখানে এসেই ক্লিন বোল্ড হব।
ডাকঘর | ছবিঘর
হুমম জায়গাটা ক্লিন বোল্ড হবারই মতন, চলে আসুন ..
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
সরাসরি পছন্দের পোষ্টে নিলাম, তারিয়ে তারিয়ে পড়বো অনেকবার!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
দেয়ালে খোদাই করা কামলীলার অংশগুলো সম্পর্কে একটি ব্যাখা আছে, লক্ষনীয় যে, কোনো মন্দিরের ভেতরের দেয়ালে কোনো মিলনদৃশ্য খোদাই করা হয়নি, প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, মোহ ত্যাগ করে সৃষ্টিকর্তার সামনে নিজেকে অর্পণ করা প্রকাশ পেয়েছে এখানে, মানে কাম-মোহ সব মন্দিরের বাইরে রেখে তারপর ভেতরে প্রবেশ করো, এছাড়া আরও ব্যাখা আছে, সবগুলো দেয়াল জুড়েই প্রাচীন জীবনধারা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, এখানে নর-নারীর মিলনও দেখানো হয়েছে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে, একে অস্বীকার না করে বরং সত্যিটাই তুলে ধরা হয়েছে| তবে মিলনদৃশ্য খুব বেশি নয়, সামাজিক জীবন আর যুদ্ধের অংশই বেশি দেখলাম|
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
দেরিতে পড়লাম, কিন্তু পোস্ট ভালো
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
নতুন মন্তব্য করুন