: লর্ড ক্লাইভের মত একটা খলনায়কও আত্মহত্যা করেছিল। কেন জানিস? সাতসমুদ্র পাড়ি দিয়ে আরেকটা দেশ জয় করতে যে শক্তিটা লাগে ওর সেটা ছিল। কিন্তু চারপাশের আত্মসন্মানহীন আমাদের নায়কদের দিকে তাকা। পারবে ওরা? ওরা পারবে না। ঐ শক্তিই নেই।
লাস্টবেঞ্চি উজ্জ্বল তারার মত জ্বলতে থাকে। তার আলোর তীব্র বিচ্ছুরনে আমি অন্ধ হয়ে বসে থাকি।
: বঙ্গবন্ধু... তার মৃত্যুর কথা ভাব। কী আশ্চর্য্য আর অপূর্ব এক আয়োজন।
বঙ্গবন্ধুর সিঁড়িতে পড়ে থাকা নিথর দেহ পুরো শরীরটায় জীবনানন্দ দাশের অভিমান ছড়ায়। এইভাবে কেউ তার পিতৃত্বের প্রতীককে উপড়ে ফেলে! রক্তগুলো কান্না হয়ে যায়। কোন মানে নেই। এখানে বেঁচে থাকার কোন মানে নেই। লাস্টবেঞ্চি এই মৃত্যুটাকে অপূর্ব বলছে! তাতো বলবেই। ও তো মৃত্যু। বঙ্গবন্ধু ছিলেন জীবন। পিতা। মৃত্যুতো জীবনের ধ্বংশস্তুপ দেখতে ভালইবাসবে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে কি আর এত অন্ধকার নেমে আসতো! লাস্টবেঞ্চি আমাকে মৃত্যু বিষয়ে এত জ্ঞান দিতে পারতো! আমি ফুসে উঠি।
: উলঙ্গ হয়ে তোকে থুথূ মারি।
কারো প্রতি চূড়ান্ত ঘৃণা প্রকাশ করতে হলে এভাবেই চিৎকার করে উঠতেন দেলওয়ার কাকা। কেন জানি না আমার মধ্যে দেলওয়ার কাকার রাগ ফিরে আসে।
হাঃ হাঃ হাঃ করে অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে লাস্টবেঞ্চি। হাসির সামনে আমি থতোমতো খেয়ে বোকার মত চুপ করে যাই। কিন্তু রাগ বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে। ও হাসতেই হাসতেই বলে
: মুজিবকে কে মেরেছে?
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সেই মূহূর্তটাকে আমি অনেকবার দেখেছি। ষ্টেনগান হাতে আততায়ীগুলোর চেহারা মনে পড়লেই দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
: মুজিবকে কেউ মারে নি। তোরা যাদের বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী বলিস, মুজিবকে তাদের কেউ মারে নি। ওরা কী করে মুজিবকে মারবে? মুজিব এত দূর্বল!
বিভ্রান্ত মূহূর্তগুলো আমাকে অবশ করে রাখে। কী বলে ও!
: মুজিব জানতো কী হবে। মুজিব চাইলে বাঁচতে পারতো। মুজিব সব ইচ্ছে করে করেছে।
মুজিব পঁচাত্তরে বাঁচতে পারতো। গোটা পৃথিবী ওর কথা শুনতো।
কেন, তাকে কেউ কী সতর্ক করে নি?
বলেনি ৩২ নাম্বার বাড়িটা থেকে চলে গিয়ে বঙ্গভবনে থাকতে?
বলেনি... তোমাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে?
কারও কথা সে শোনে নি কেন?
মুজিব বুঝতে পেরেছিল কীভাবে মৃত্যুর উপর জয়ী হওয়া যায়।
আমার পিতা যে আমাকে চিনে
সে জানে আমি কী হবো বড় হয়ে।
সে আমার জনক - সে আমাকে চিনবে।
সে প্রত্যেকটা মানুষকে এভাবে চিনেছে।
সে জানতো তাকে কারা মারবে। কারণ সেই তাদের তৈরী করেছে।
সে ইচ্ছে করে সব করেছে। তার ইচ্ছার বাইরে কিছুই হয় নি।
তার মৃত্যুও না।
তাজউদ্দিন এটা জানতো।
সে মৃত্যুর আগে মৃত্যুর কথা বলে যায় নি? বলেনি?
লাস্টবেঞ্চি চোখের তারা যেন আগ্নেয়গিরির মত জ্বলতে শুরু করে। তার চোখের মণি যেন লাভামুখ। সেখান থেকে থেকে অফুরন্ত লাভাস্রোতের মত বেরিয়ে আসতে থাকে মহাশূন্যের অসীম অন্ধকার। ধীরে ধীরে সবকিছু সেই অন্ধকারে ডুবে যায়। কোথাও কোন স্পন্দন নেই। মনে হয় অনন্তকাল ধরে জীবন- মৃত্যুর অতীত কোন কালের নিস্তরঙ্গ, অসীম রহস্যময় এক শূন্যতা একটা ছায়াপথের মত ছড়িয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত প্রশান্ত সবকিছু।
একটু ভয় ভয় লাগে আমার, একটু অসহায় লাগে। আমি আবার চিৎকার করে উঠি।
- আমি কোথায়?
কোন সাড়া নেই। নিজের শরীরের ভেতরে নিজেরই ডাকটা গড়িয়ে পড়ে। আমি ভয়ে কুঁকড়ে ছোট হয়ে যেতে থাকি। আমি ছোট হতে হতে একটা বিন্দুতে পরিণত হই। চারপাশের অসীমতা বেড়ে যেতে থাকে। শূন্যতার ভেতর থেকে আজফারভাইয়ের বেহালার সুর ভেসে আসে। একটা তারা জ্বলে উঠে।
আমি তারাটাকে চিনতে পারি।
তাজউদ্দিন আহমেদ। একদিন বঙ্গবন্ধু যেই স্বাধীনতার সূর্যটা জন্ম দিয়েছিলেন তিনি সেই সূর্যটাকে পেড়ে আনতে ডানা মেলে আকাশে উড়ে যাচ্ছেন, দৃশ্যটা মনে পড়ে। এখন তিনি নিজেই তারা হয়ে গেছেন। তার গা থেকে ছড়িয়ে পড়ছে একটা রূপালী আলোর নদী। রূপালী আলোর নদীটা প্রবাহিত হয়ে একটা শব্দে পরিণত হয়।
: আমি জানতাম মুজিবভাই...
পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে তারাটার শরীর আরো টলটলে হয়ে যায়। যেন কাঁদছে। আমি তাকিয়ে দেখি নীল শাড়ি পড়ে পৃথিবীটা নেচে চলেছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগে ওকে।
একটা স্মিত হাসির মিষ্টি ধ্বনি সমস্ত স্বত্তা জড়িয়ে ধরে। আকাশের কোনে আরেকটি তারার উদয় হয়েছে। আমি না তাকিয়েও বুঝতে পারি। বঙ্গবন্ধু।
: জানতে? বঙ্গবন্ধু বললেন।
: আমি টের পাচ্ছিলাম। আমাদের মৃত্যুর সময় হয়ে এসেছে। আমাদের পৃথিবী ছেড়ে চলে আসতে হবে। কিন্তু আমাদের মধ্যে কে আগে এখানে আসবে সেটা বুঝতে পারি নি?
বঙ্গবন্ধু আবার হাসেন। এবার স্মিত নন। প্রাণখুলে। তার হাসি ব্রহ্মাণ্ড ছাড়িয়ে আরো দূরে দূরে চলে যায়।
তাজউদ্দিন আহমেদ অবাক হয়ে বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকেন। বঙ্গবন্ধু হাসি থামিয়ে এক মুহূর্তের জন্য স্মৃতির ভেতরে টুপ করে ডুব দিয়ে এলেন।
: আমার উপর তোমার অনেক অভিমান, না?
তাজউদ্দিন একটু চুপ করে থাকলেন। হয়তো পুরনো অভিমান এখনও মরে নি - তাকে কথা বলতে এখনও বাঁধা দিচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু দূরে নীল পৃথিবীটার দিকে চেয়ে থাকলেন। আনমনে কী জানি ভাবলেন, তারপর তাজউদ্দিনের দিকে চেয়ে বললেন,
: বললে না কতটুকু অভিমান? এই পৃথিবীর চেয়ে বেশি?
তাজউদ্দিনের গলা একটু যেন কেঁপে উঠলো।
: না মুজিব ভাই। ছোট্ট একটা কষ্ট রয়ে গেছে আমার মধ্যে।
: কী সেটা?
তাজউদ্দিন আহমেদ দূরে কোথায় জানি তাকালেন।
ওখানে ১৯৭১ সালে পৃথিবী থেকে বিচ্ছুরিত আলোক কণাগুচ্ছ মহাশূন্যের পথে যাত্রা শুরু করে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। তাজউদ্দিন আহমেদ ধূমকেতূর রূপ ধরে আলোর চেয়ে অনেক তীব্র গতিতে ছুটন্ত সেই আলোক কণাগুচ্ছগুচ্ছের কাছে গিয়ে তাদেরকে মুঠোয় বন্দী করলেন।
চিন্তারও তরঙ্গ আছে। আছে ধ্বনিরও। সেগুলোর গতি এবং প্রকৃতি আলোক কনার মত নয়। তারা মহাবিশ্বের একেক জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তিনি ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই সব তরঙ্গগুলোকেও তুলে নেন। একবার দেখেন । তার মন যেন পরিপূর্ণ হয় না। তিনি আরও কিছু দৃশ্য, ধ্বনি এবং চিন্তা মুঠোয় ধরতে উড়ন্ত ধুমকেতু হয়ে এখানে ওখানে ছুটে বেড়ালেন। সবকিছু মুঠোর মধ্যে আবার একবার দেখে নিলেন।
এবার তার মনের মত হয়েছে মনে হয়।
এবার তিনি একছুটে চলে এলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
তাজউদ্দিন মুঠোভর্তি আলো, ধ্বনি এবং চিন্তার কণাগুলোএকটু একটু করে মুক্ত করেন।
সঙ্গে সঙ্গে সেই অলৌকিক সিনেমার শুরু।
এই মহাবিশ্ব যেন একটা সিনেমা হল। আর মহাশূন্য সেই সিনেমাহলের পর্দা। তাজউদ্দিনের মুঠো থেকে মুক্ত হয়ে সেই আলোককণাগুলো ৭১ এর পৃথিবীর ধ্বনি চিন্তা দৃশ্যগুলো মহাশূন্যে ফুটিয়ে তোলে। বঙ্গবন্ধু নিবিষ্ট দর্শকের মত সিনেমার মধ্যে ডুবে যান।
শুরুতে নক্ষত্ররাজিজুড়ে একটা ধ্বনির মৃদু কম্পন পুরো ছায়াপথে ছড়িয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে সেই ধ্বনি বাড়তে বাড়তে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাশি।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বেলা ৩ টা বেজে ১৫ মিনিটে এই গানটি ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে আসছে।
সেই সকাল থেকেই বেতার ভবনে কর্মরত বাঙালী কর্মকর্তা কর্মচারী সবারই রক্তের মধ্যে একটা মৃদু স্পন্দন সারা শরীরে একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ তেমন কথা বলছে না। সবার মনে একটা অপেক্ষা নীরবে ব্যগ্রতা বুনে চলেছে। চোখ একটু পরে পরেই হাতের কব্জিতে বাঁধা ঘড়িটায় চলে যায়। সময় যেন চলতেই চায় না।
একটু পরেই বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে ভাষন দেবেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষনটা যেন গোটা দেশের মানুষ একসাথে সবাই শুনতে পায় এজন্য সরাসরি সম্প্রচারের বিরাট দায়িত্ব নিয়ে তারা আজকে অফিসে আটকে রয়েছেন। সম্প্রচারের সব প্রস্তুতিই নেয়া হয়ে গেছে। কর্তৃপক্ষ প্রথমে রাজী হতে চাননি। কিন্তু বেতারে কর্মরত বাঙ্গালী কর্মচারীদের অনঢ় দাবীর মুখে কর্তৃপক্ষ শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেন -বঙ্গবন্ধুর ভাষন তারা সরাসরি প্রচার করবেন। বেতারে এ সংক্রান্ত ঘোষণাও দেয়া হয়ে গেছে। তারই প্রস্তুতি হিসেবে বেলা ২:১০ মিনিট থেকে দেশাত্মবোধক সঙ্গীত বেজে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আগ পর্যন্ত একটার পর একটা বাংলা দেশাত্মবোধক গান বাজতে থাকবে।
এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
প্রত্যেকের মগজে প্যাচানো আঁকিবুকি রেখায় একটা প্রশ্ন নানাভাবে জড়িয়ে থাকে।
কী বলবেন বঙ্গবন্ধু? আজই কী মুক্তির ঘোষণা আসবে?
জানালা দিয়ে দেখা যায় একটুকরো মেঘ ভেসে চলে গেল। ঐ মেঘটাও একটা শ্লোগান সবার বুকের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে গেল ।
তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা।
একটা ভেজা মাটির গন্ধ নাকে এসে লাগে। মাটিকে এত স্পষ্ট করে আগে একসাথে অনুভব করে নি কেউ। ঠিক তখনই রাস্তা দিয়ে চাপা সমুদ্রের গর্জনের মত শব্দ তুলে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য নিজের চোখে দেখতে আর একটা মিছিল চলে গেল। কিন্তু তারা নিজেরা যেতে পারছেন না এ জন্য বুকের কাছটায় একটা শূন্যতা দলা পাকিয়ে উঠে। কিন্তু গোটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যকে স্বকণ্ঠকে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব এই শূন্যতার চেয়ে অনেক বড়।
বেতারের প্রতিটি বাঙ্গালী কর্মী সৈনিকের পরম কাঠিন্যে নিজেকে মুড়ে বঙ্গবন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছেন।
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি - গানটা শেষ হয়। এখন কোন গানটি বাজবে? তারা অপেক্ষা করেন। কিন্তু কোন গান কিংবা শব্দ- কোনকিছুই বাজে না । যন্ত্রটা নিশ্চুপ, নিথর হয়ে পড়ে থাকে।
কয়েক মূহূর্ত। সবাই হতকচিত , বিভ্রান্ত, কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে এ ওর দিকে চেয়ে থাকে।
কী হলো? কারিগরী কোন ঝামেলা বেঁধেছে? এদিকে বঙ্গবন্ধুর ভাষনের সময়তো হয়ে এলো।
সবাই নড়ে চড়ে বসে। চারেিক একটা দৌঁড়াদৌড়ি - হুলুস্থুল অবস্থা।
এরমধ্যে একজন খবর নিয়ে আসে - কারিগরী কোন ঝামেলা না, মিলিটারীর আদেশে ঢাকা বেতারের সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
অনেকগুলো কণ্ঠস্বর টুকরো টুকরো জ্বলে ওঠে- জ্বলন্ত কয়লার মত গনগনে। এক মুহূর্ত পড়ে কী পড়ে না- এলোমেলো কয়লার লাল টুকরোগুলো একটা অগ্নিশিখা হয়ে রেসকোর্সমুখী রাস্তার জনস্রোতে মিশে যায়।
সেই জনস্রোত আরো অসংখ্য জনস্রোতের সাথে মিশে একটা জনসমৃদ্রে পরিণত হয়।
জনসমুদ্র অপেক্ষা করছে।
সবার মনে একই প্রশ্ন। একই প্রত্যাশা।
বঙ্গবন্ধু ভাষন দিতে উঠে দাঁড়ালেন। এক মুহূর্ত সামনে তাকিয়ে জনসমুদ্রের উত্তল উত্তাল তরঙ্গের শক্তি অনুভব করলেন। বুকের মধ্যে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিলেন। সেই নিঃশ্বাসে বাংলাদেশের মাটি আর নদীর জলকণা তার হৃদয়কে ভিজিয়ে দিল।
তিনি এবং বাংলার সমস্ত জনগণ একই রক্তের প্রবাহে আবদ্ধ হলেন। তিনি তাদের তুমি বলে সম্মোধন করলেন।
তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাপায়ে পড়...
এবারে সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম...
কিন্তু.রেসকোর্স ময়দানটা পুরো দেশ নয়।
পুরো বাংলাদেশের মানুষ কম্পিত হৃদয়ে অপেক্ষা করছেন বঙ্গবন্ধু কী বললেন তা জানার জন্য।
কিন্তু সাড়ে সাতকোটি মানুষ তার এই কণ্ঠ শুনতে পারলোনা। ঢাকা বেতার তখন নিস্তব্ধ।
ঢাকা বেতারের কর্মী এবং কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ বুকের মধ্যে নিয়ে রাজপথে মিছিলের মানুষ হয়ে বেতার ভবনে ভাষন প্রচারের দাবীতে সোচ্চার হয়ে উঠলেন।
তাদের অনমনীয় অবস্থানের কারণে পরদিন সকাল আটটায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি বেতারে ভেসে আসে।
পুরো দেশ সেদিন রেডিওর সামনে বসে। চাষী, মজুর, জেলে, শিক্ষক, গৃহবধু, স্কুল পড়–য়া বালিকা সবার কান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দিকে। যার যা কিছু আছে... তাই নিয়ে ঝাপিয়ে পড়। ... এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
বঙ্গবন্ধুর ডাকের আলিঙ্গনে সবাই জড়িয়ে পড়ে।
আর সেই আলিঙ্গনে নিজেকে জড়াতে আর সবার মতই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুটিকয়েক বাঙ্গালী অফিসারের একজন মেজর জিয়াউর রহমানও তার বাঙ্গালী সহকর্মীর সঙ্গে বসে এই বঙ্গবন্ধুর ভাষন শুনছেন।
এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। . . . .
স্পষ্ট বার্তা। কেউ কোন কথা বলেন না। তারা নিজেকে দিয়েই অন্যকে বুঝতে পারেন। ভাষণের শব্দগুলো আসলে তারা আগেই অনেকবার শুনেছেন। দৈনন্দিনতার সাধারন টুকরো টাকরো কথাবার্তার ভেতরে এই শব্দগুলো অসংখ্যবার বলা হয়ে গেছে। তবে এখন এটাই সেই মুহূর্ত। স্পষ্ট বার্তা। গোটা দেশবাসীর সাথে মিশে গিয়ে এখন একে চুড়ান্ত রূপ দেবার সময় এসে গেছে।
কিন্তু কীভাবে? তারা বুঝতে পারেন না এই মূহূর্তটাকে। একটা ছটফটানি মাথায় নিয়ে তারা অপেক্ষার চিন্তার মধ্যে ডুবে যান।
প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় দু পক্ষেই। বাঙ্গালীরাও সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য মনস্ত¡াত্তিকভাবে তৈরী হতে শুরু করেছে। প্রকাশ্য রাজপথে ছাত্ররা ডামি রাইফেল নিয়ে মিছিলে নেমেছে। মেয়েরাও পিছিয়ে নেই, তারাও রাজপথে নেমে পড়েছে। গাজিপুরে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরীতে ছোট ছোট অস্ত্র তৈরী করে ভবিষ্যত যুদ্ধের রসদ তৈরীর কাজ চলছে পুরোদমে।
২৩ মার্চ,১৯৭১। ছুটির দিন। ছুটির কথা ছিল না। বঙ্গবন্ধু এদিন ছুটি ঘোষণা করেছেন। ছুটির দিনের ঘড়ির কাটা ভোর পাঁচটা ছুলো। বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনের বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। এটা এখন তার বাসা নয়। পুরো বাঙ্গালী জাতির স্বপ্ন আর আকাঙ্খার কেন্দ্রভূমি। বঙ্গবন্ধু এই কেন্দ্রভূমিতে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে দিলেন।
এই দিনটাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন দল এবং ছাত্র সংগঠন বিভিন্ন নামে পালন করে। ভাসানী ন্যাপ ’স্বাধীন পূর্ব বাংলা’, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ’স্বাধীন বাংলাদেশ’ নামে এই দিবসটি পালন করে। সকাল নয়টায় পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা ছাত্র পরিষদের উদ্যোগে ’আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ’জয় বাংলা বাহিনী’র কুঁচকাওয়াজ শুরু হয়। কুঁচকাওয়াজ শেষে এই বাহিনী মার্চ করতে করতে ঢাকা শহরের এই রাস্তা ওই রাস্তা প্রদক্ষিণ করে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পৌছে। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রনায়কের ভঙ্গিতে জয়বাংলা বাহিনীর অভিবাদন গ্রহন করলেন।
আলোচনার নামে ইয়াহিয়া আর ভুট্টো এসেছেন। আসলে এটাও তাদের প্রস্তুতির একটা অংশ। এই বিরাট দেশটায় তাদের সামরিক অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নেবার জন্য কিছুটা সময় দরকার। আলোচনার ফাকে বেসামরিক বিমানে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আর্মি আসছে দলে দলে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সোজা উড়ে এসে পূর্ব পাকিস্তানের তেজগাঁও বিমানবন্দরে পা রাখতের্ই বিভ্রান্তির শিশির তাদের বোধবুদ্ধির উপর চকচক করে ওঠে ।
এটা কোন জায়গা? তাদেরতো আসার কথা পূর্ব পাকিস্তানে - কিন্তু সেখানে না গিয়ে,তারা এ কোথায় আসলো?
এদিক ওদিকে তাকিয়ে দেখে - সবুজের মধ্যে লাল বৃত্ত, সেই লালের মধ্যে হলুদ রঙের একটা মানচিত্র আঁকা পতাকা -পতপত করে সবদিকে উড়ছে। এই পতাকা তারা কোনদিন দেখে নি। তাহলে কী তাদের প্লেন ভুল করে অন্য কোন এক দেশে নামিয়ে দিয়ে গেল? তা কী করে হয়?
না- প্লেন ঠিক জায়গাতেই নেমেছে। ঐতো সেই চেনা টারমিনাল বিল্ডিং, তার ছাদ থেকে একটা চাঁদ তারা পতাকা উড়ছে। বিষন্ন, নি®প্রাণ, নিঃসঙ্গ। তাহলে কিসের পতাকা এগুলো?
রাস্তায় বেরিয়ে তাদের কেউ কেউ ভাঙ্গাচোরা বাংলা জানে - তাই দিয়ে একে ওকে জিজ্ঞেস করে। অবাক বিষ্ময়ে তারা শোনে - এদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। শেখ সাহেব দেশটাকে স্বাধীন করে দিয়েছে। এখন আর এ দেশ পূর্ব পাকিস্তান নয়। এটা বাংলাদেশ। এই পতাকা বাংলাদেশের পতাকা।
পুরো ঢাকা শহর বাংলাদেশের এই পতাকায় মোড়া। মোহাম্মদপুর, মিরপুর কয়েকটা অবাঙ্গালী পাড়ায় গুটিকয়েক চাঁদতারা পতাকা উড়ছে। কিন্তু হাজারে হাজারে তাদেরকে ঘিরে ফেলেছে এই নতুন পতাকা। ওদের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। ওরা সবাই জানে, ব্যাপারটার এখানেই শেষ নয়। এটা অন্য এক শুরুর গল্প। সেজন্যই ওরা এখানে এসেছে। ওরা অপেক্ষা করতে শুরু করে। অপেক্ষার মুহূর্ত বাড়তে বাড়তে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত রাত পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে।
২৫ তারিখ রাতে, ঢাকার নিউমার্কেটের পাশে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের কোয়ার্টারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সালহউদ্দীন আহমেদ ঘুমিয়ে আছেন। তার স্ত্রী এখানকার শিক্ষিকা। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষনের পর থেকে অসহযোগ আন্দোলনে সবকিছু বন্ধ হয়ে আছে। ভয়ঙ্কর একটা কিছু হতে যাচ্ছে এই আশঙ্কায় তিনি পরিবারেরর কাছে চলে এসেছেন।
ঠাঠাঠাঠা।
রাতের নীরবতা ভাঙা হটাৎ গোলাগুলির শব্দে সালাহউদ্দীন আহমেেেদর ঘুম ভেঙে গেল।
সালাহউদ্দীন আহমেদ ঘুম ভাঙা ঘোরে গোলাগুলির আওয়াজটা শুনলেন।
- আজ থেকে পাকিস্তান ভেঙে গেল। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তিনি শান্ত স্বরে কথাটা বললেন।
গোলাগুলির সাথে তখন আর্তনাদ চিৎকার ভেসে আসছে। নীলক্ষেতে তখন একটা রেললাইন ছিল। তার চারপাশে বস্তি ছিল। ওখান থেকে আসছিল চিৎকারগুলো। ভয়াবহ ব্যাপার। তিনি পাকিস্তানের ভেঙে যাওয়াটা ঐ আর্তনাদের মধ্যে দেখতে পেলেন।
ইতিহাস পড়ে একটা কনসেপশন ডেভেলপ করে- তার বলেই তিনি বুঝতে পারলেন - তিনি যে দেখতে পেলেন পাকিস্তানটা ভেঙে গেল এটা কোন ইল্যূশন নয়। এটা একটা সত্যি। সাধারন একটা সত্যি। গোলাগুলির তান্ডবটা যেন বেড়েই চলেছে। তার মনে হলো এরা এখানে ঢুকে যে কোন সময় গুলিও করতে পারে। কিন্তু আশ্চর্য এক শান্তভাব তার মনের মধ্যে কাজ করে।
তার মনে হলো- মরতে হয় একদিন মরবো।
রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে-
আমিতো ভয় করবো না ভাই করবো না
মরার আগে মরবো না ভাই মরবো না।
তার মনে হলো গানটা যেন কানের কাছে বাজছে।
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন - মরতেতো একদিন হবেই। কুকুর বিড়ালের মত মরবো কেন। লেট আস ডাই উইথ ডিগনিটি। এইযে মনের মধ্যে সাহস এসে গেল- পুরো বাঙ্গালীরই মনেই একই অবস্থা।
২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭.৪০ মিনিট।
মেজর জিয়াউর রহমান রেডিওর নব ঘুরাচ্ছেন। দেশ থেকে কোন খবর পাওয়ার জো নেই। বিদেশের খবর থেকে যদি কিছু পাওয়া যায়। হটাৎ অস্পষ্ট একটা ঘর ঘর শব্দের মধ্যে বাংলা শব্দ কানে ভেসে আসে। জিয়াউর রহমানের কপালে ভাজ পড়ে। মন দিয়ে একটু টিউন করতেই স্পষ্ট হয়ে আসে শব্দগুলো। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে একটি জরুরী ঘোষনা শোনানো হচ্ছে। আবুল কাসেম সন্দ্বীপ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে একটি জরুরী ঘোষণা পাঠ করছেন।
মধ্যরাত ১২টায় বর্বর পাক বাহিনী ঢাকার পিলখানা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অতর্কিত হামলা চালায়। ... যুদ্ধ চলছে। আমি এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। .. জয় বাংলা।
সবাই হাসছে। পৃথিবীর যত বাঙ্গালী তারা সবাই হাসছে। বাঙ্গালীদের দেশ স্বাধীনতা দেখছে। স্বাধীনতার প্রথম সূর্য কিরণের এই হাস্যজ্জ্বল মুহূর্ত সবার চোখেমুখে ঘোর লাগায়।
মহাশূন্যজুড়ে অজস্র ছায়াপথ থেকে জয় বাংলা শব্দটি প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করে।
দৃশ্য ধ্বনি চিন্তা এগুতে থাকে।
রাত ১০টা। ঠিক একই ঘোষণা ইথারে জিয়াউর রহমান আবার শুনতে পান।
অপেক্ষার চিন্তা দূর হলো।
পক্ষ বিপক্ষ ঠিক হয়ে গেছে।
প্রত্যেক বাঙ্গালীই যেন এক একজন বঙ্গবন্ধুর হয়ে স্বাধীনতার ঘোষক - এক অন্যকে স্বাধীনতার সুখবর দিচ্ছে। একে অন্যকে বলছে - জয় বাংলা। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা এখন বিদেশী। ওদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। প্রত্যেক বাঙ্গালীই এখন- মুজিবের আর্মি।
মার্চ অন।
বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর।
লেফট রাইট লেফট রাইট- লেফট রাইট লেফট।
বাংলার হিন্দু বাঙলার বৌদ্ধ বাংলার খৃষ্টান বাংলার মুসলমান- আমরা সবাই বাঙালী।
একটি আলো বঙ্গবন্ধুকে ভিজিয়ে দিয়ে যায়।
: তুমিই এই প্রথম সব বাঙালীকে এক করলে।
তাকিয়ে দেখি অনেক দূরের একটি তারা উজ্জ্বল হয়ে হাসছে। নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু।
: খন্ডিত সব বাঙালীর জন্য দুমি একটা দেশ রচনা করলে। তুমি সেই দেশের প্রতীক।
মিটিমিটি তারার আলোয় রবীন্দ্রনাথ এসে তাকে আশীর্বাদ করলেন
বঙ্গবন্ধু জ্বলে নিভে আবার জ্বলে নিভে- জ্বলে যান। আনন্দ না কী কষ্ট - কি হচ্ছে তার মধ্যে? বুঝতে পারি না।
তাজউদ্দিন আহমেদ অকম্পিত স্থির আলোর মত। মহাশূন্যের দিকে তাকিয়ে মুঠোয় ভরা আলোক কণাগুলো একটু একটু করে মুক্ত করছেন আর দৃশ্যরা মুক্তির আনন্দে আকাশের গায়ে লুটোপুটি করছে।
সব বাঙ্গালীর মতই গা ঝাড়া দিয়ে জিয়াউর রহমান উঠে দাঁড়ালেন।
২৭শে মার্চ সকালেই বিভিন্ন দিকে খোঁজখবর করে তিনি হাজির হয়ে গেলেন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের গোপন ঘাটিটিতে। বেলাল মোহাম্মদ তাকে অফিস কক্ষে নিয়ে বললেন
- আচ্ছা মেজর, আমরাতো মাইনর - আপনি মেজর হিসেবে স্বকণ্ঠে কিছু ঘোষণা করলে কেমন হয়?
জিয়াউর রহমান জানেন- স্বাধীনতা এখন নিয়তির মত। ও আসবেই। কালবৈশাখীর মতন। ঘন কালো মেঘের মধ্যে ঢাকা সূর্যের মত। তিনি মেঘের আড়াল থেকে সূর্যটা দেখেন। সেই সূর্যের আলোর রেণু গায়ে জড়িয়ে বেলাল মোহাম্মদ তার দিকে তাকিয়ে আছেন।
জিয়াউর রহমানের কাছে মনে হয় তিনি যেন এই কালুরঘাটের ছোট্ট অফিস কক্ষে নেই। তিনি একটি মানচিত্রের আকাশে উড়ে চলেছেন...। তিনি কল্পনায় এই সময় পেরিয়ে আরও দূরে ডানা মেলেন । ইতিহাসের অনাগত কালের বাতাসে তিনি শুনতে পান - তার কণ্ঠে স্বাধীনতার গান বাজছে। স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে নিজের নাম জড়িয়ে যাওয়ার বেগুনী, নীল, আসমানী, সবুজ, কমলা, লাল রঙের একটা রঙধনু অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করে। বেলাল মোহাম্মদ তার দিকে একটা সাদা কাগজ বাড়িয়ে দিলে তার ঘোর কাটে। তিনি পকেট থেকে কলমটা বের করে হাতে নেন
I Major Zia do hereby declare independence of Bangladesh.
কয়েকটা শব্দ। পড়তে এতটা সময় লাগে না। কিন্তু বেলাল মোহাম্মদ লেখাটার দিকে চেয়ে থাকেন অনেকক্ষণ। তারপর আস্তে করে মেজর জিয়ার দিকে মুখ তোলেন। তার গলার স্বর মৃদু , প্রশান্ত, গভীর ।
: দেখুন, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বলবেন কী?
জিয়াউর রহমান থমকে যান। বেলাল মোহাম্মদের কথাগুলো অনুরোধের মত শোনালেও তাতে প্রচ্ছন্ন আদেশ মেখে থাকে। ইচ্ছের ডানা গুঁটিয়ে আগামী ইতিহাসের পাতা থেকে তিনি মাটিতে নেমে আসেন। এই দেশের প্রতিটি মানুষ বঙ্গবন্ধুর জন্য উৎসর্গিত। আর তিনি একজন মেজর মাত্র। স্বাধীনতার যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর একজন সৈনিক মাত্র।
- জ্বি, ঠিকই বলেছেন।
একটা গাম্ভীর্যের মুখোশের ভেতরে নিজেকে পুরে দিতে দিতে নিজের নামের শেষে তীর-চিহ্ণ দিয়ে তিনি আবার লিখলেন
on behalf of our Great national leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman …
চট্টগ্রামের সবুজ পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বঙ্গোপসাগর নীল জল বিছিয়ে শুয়ে আছে। শান্ত সমুদ্র। নীল জলে সাদা ফেনারা খেলা করে। দু’একটা কঙ্কপাখি আরেকটু উচুঁতে উড়ে আবার নেমে আসে। একটু গভীর সমুদ্রে একটা জাহাজ অলসভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। মাস্তুলের মাথায় বাতাসের তালে তালে অষ্ট্রেলিয়ার পতাকা উড়ছে। জাহাজের ট্রান্সমিশন কক্ষে সিগনাল অফিসার কয়েকটা জায়গায় যোগাযোগ করছেন। তারা বিশ্বের বিভিন্ন খবর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক গোলযোগের কথা জানতে পেরেছেন। তারা পূর্ব পাকিস্তানের সমুদ্র সীমায় অবস্থান করা সত্ত্বেও নিজেরা কিছুই জানতে পারছেন না। এমন সময় অস্পষ্ট একটা বার্তা ভেসে আসে। সিগনাল অফিসার যন্ত্রটা এ্যাডজাষ্ট করে নিতেই তাতে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা বার্তা সুষ্পষ্ট স্বরে বেজে ওঠে। সিগনাল অফিসার চমকে ওঠেন। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন দেশ হয়ে গেছে। তারা যেই দেশে এসেছিলেন সেটা এখন অন্য একটা রাষ্ট্র। সিগনাল অপারেটর সারা বিশ্বে সেই বার্তাটি প্রেরন করেন। বাঙ্গালীর পাজর ছেঁড়া সেই নিঃশ্বাসের শব্দ জিয়াউর রহমানের কণ্ঠ হয়ে সারা পৃথিবীতে বয়ে যায়।। পৃথিবীর সবাই জানলো - পৃথিবীতে একটি নতুন দেশের জন্ম হয়েছে।
মহাশূণ্যের বিশাল পর্দায় সেই নতুন দেশ ভেসে ওঠে।
কিন্তু সেই নতুন দেশের কোমল বাতাসে তখন বারুদ ভাসছে। সঙ্গে মানুষের আর্তনাদ, মিছিলের অস্পষ্ট ধ্বনি। ধোঁয়া, আগুন, বুলেটের তীব্র শীষ। ট্যাংকের ঘর্ঘর, পলায়নপর বিধ্বস্ত মানুষ, স্বন্ত্রস্ত চোখ। গেরিলা, যুদ্ধবিমান, রক্তের স্রোত।
এর ভেতর দিয়ে তাজউদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধুর জাগিয়ে তোলা স্বাধীনতার সূর্যকে পেড়ে নিয়ে আসতে ডানা মেলে উড়ে চলছেন। উড়তে উড়তে একটি রেখা তার চোখের সামনে চলে আসে। তিনি থমকে থেমে যান। সীমান্ত। এই তার রেখা। পুরনো সীমান্তরেখা। কিন্তু এখন নতুন পরিচয়ের।
রেখার ওপারেই ভারত। নিরাপদ ভূমি। রেখার এপারে তার নিজের দেশ আজ শত্র“ আক্রান্ত - যুদ্ধষ্ফুট। এই সীমারেখাটা আজকের মত তিনি কোনদিন এত মন দিয়ে দেখেননি।
সীমান্তরেখার উপরে দািড়য়ে তাজউদ্দীন আহমদ অনুভব করেন - তার দেশ আজকে বিপদ আক্রান্ত। পুরনো অতীত তাকে হিংস্র থাবার মধ্যে আটকে রেখেছে। পুরো দেশটাই এখন শত্র“র দখলে। ওদের কাছ থেকে মুক্তি পাওয়াই এখনকার প্রথম কাজ। বাস্তবতাটা তিনি বুঝতে পারেন।
এই সময়ে দেশটাকে শত্র“মুক্ত করার জন্য ভারতের সাহায্য প্রয়োজন। ভারত একটি আলাদা রাষ্ট্র। প্রতিবেশী এই রাষ্ট্রের ঠিকঠাক সাহায্য সহযোগিতা নিশ্চিত করার গুরুদায়িত্ব তিনি নিজের উপর অনুভব করতে পারেন। বঙ্গবন্ধু নেই। শতজনের সহস্র অনুরোধেও বঙ্গবন্ধু নিজে তার বাড়ি ছেড়ে আসেন নি। তাজউদ্দিনের বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো মনে পড়ে।
: আমাকে তোমরা কোথায় নিয়ে যাবে? আমার কী বাংলাদেশের বাইরে যাওয়া সম্ভব? আমাকে তোমরা কোথায় লুকাবে?
তাজউদ্দীন আহমেদের সহগামী আমিরুল ইসলাম তখন সামনের কঠিন সময়ের কথা ভাবছিলেন। আত্ম নিয়ন্ত্রনের দাবীতে উত্তাল বাঙ্গালীকে দিকনির্দেশনা দেবার জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্রধান করে যে ৫ সদস্যের হাইকমান্ড গঠিত হয় সেখানে তাজউদ্দিনের উপর অসহযোগ আন্দোলনের পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নের ভার অর্পিত হয়। তরুন আইনজীবি আমির-উল ইসলামের দায়িত্ব পড়ে তাজউদ্দীন আহমেদকে সহযোগিতা করার। তখন থেকেই তিনি তাজউদ্দীন আহমেদের সাথে ছায়াসঙ্গীর মত চলছেন। বেশ কিছুদিন ধরেই তাজউদ্দীন আহমেদ তাকে ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন- এই অসহযোগ আন্দোলন একটি সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একদিন তিনি একটা পিস্তল সংগ্রহ করে সেটি চালানো অভ্যাস করলেন। কোত্থেকে একটা রাইফেলও জোগাড় করে ফেললেন। আমির-উল ইসলাম তাজউদ্দিন আহমেদের দিকে এ ব্যাপারে স্বপ্রশ্ন চোখে তাকালে তার মুখে একটা হাসি ছড়িয়ে পড়েছিল -
: আপনারাও এইসব আর্মসের ট্রেনিং নেন, এগুলোর দরকার আছে।
: কেন?
: আমাদের সকলেরই একটা প্রস্তুতি থাকা দরকার। আমরা যেভাবে অতীতে রাজনীতি করেছি, এটা যে ধরনের রাজনৈতিক ধারা, এবার কিন্তু এটা ভিন্ন প্রকৃতির হতে যাচ্ছে এবং আমরা একটা সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি দ্রুত।
তাজউদ্দীন যেই নীরব ধ্বনির ইঙ্গিত সেদিন দিয়েছিলেন, তা এখন স্বশব্দে ফেটে পড়েছে। পুরো দেশ এখন খই এর মত ফুটছে। তারা এই কয়েকদিনে যতটুকু স্বচোক্ষে দেখেছেন, ঢাকা থেকে আসার পথে এদিক ওদিক থেকে যেটুকু খবর পেয়েছেন মাগুরা, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদা, চুয়াডাঙ্গা সব জায়গায় হাজার হাজার সাধারন মানুষ সশস্ত্র প্রতিরোধে নেমে এসেছে, ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে তারা এর দখল নেয়ার জন্য ফুসছে । আর্মিরা গুলি করে যাচ্ছে- একটানা- দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম দ্রিম। গুলির মুখেও দু –একজন, দু -একজন করে সাহসী মানুষ একটু একটু একটু করে এগিয়ে আসে। তাদেরকে থামানোর জন্য বারুদভর্তি বন্দুকের তাক তাদের বুকে এসে স্থির হয়। ঠা ঠা ঠা ঠা। গুলি খাওয়া পাখির মত দেহগুলো ছটফটিয়ে ওঠে। একবার শূন্যে লাফিয়ে উঠে একসময় নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। প্রতিরোধী মানুষের দেয়াল আর একটু পিছিয়ে যায় তারপর আবার গুটিগুটি এগুতে থাকে। এইরকমটা চলতেই থাকে।
বঙ্গবন্ধুর কথা মনে পড়ে আমিরুল ইসলামের। তিনি কী বেঁচে আছেন? তিনি অন্ধকার প্রকোষ্ঠের মধ্যে একটা সিংহকে গর্জন করে এপাশ ওপাশ করতে দেখেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে তার শেষ কথপোকথনের শব্দগুলো মনে পড়ে । ২৫ মার্চ রাত ১২টায় তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে হয়ে হাজির হয়েছিলেন। উত্তেজিত। খানিকটা বিভ্রান্ত। অনেকটা উদ্বিগ্ন।
: আর্মি সমস্ত শহর টেকওভার করে নিচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু গেঞ্জি পরে আছেন। এক মুহূর্তের জন্য তিনি উনসত্তুরে আগরতলা মামলার এই মেধাবী তরুন আইনজীবির দিকে তাকান। এই স্থির শান্ত চোখজোড়ার পেছনে কী কাজ করছে সেটার হদিশ এই তরুন আইনজীবি খুঁজে পান না।
: আমি খবর পেয়েছি, ইয়াহিয়া খান যাবার পর পরই এখানে ধরপাকড়- গোলাগুলি শুরু হবে। আমার যা বলার সব কথাই বলে দিয়েছি। ৭ই মার্চ বলেছি। আজকেও বলেছি। বাকি কিন্তু আমি কিছু রাখি নি। তোমরা এখনই আমার বাড়ি থেকে চলে যাও।
: আমরাতো আপনাকে এখান থেকে না নিয়ে যাবো না।
: আমি যা বলবো - আমার নির্দেশ তোমরা মানতে বাধ্য। আমি তোমাদেরকে কোনদিন আদেশ করি নাই। আমি এই মুহূর্তে তোমাদেরকে আদেশ করছি, তোমরা আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাও।
তাজউদ্দীন আহমদের ডাকে আমিরুল ইসলামের ঘোর ভাঙে।
: আমরা আত্মগোপন করে সীমান্ত অতিক্রম করবো না। আমরা সীমান্ত অতিক্রম করবো স্বাধীন দেশের সরকারের মুখপাত্র হিসেবে। তৌফিক আর মাহবুব কোথায়?
মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক আর ঝিনাইদাহের এসডিও মাহবুব এগিয়ে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহর থেকেই এই দুই সরকারী কর্মকর্তা স্বাধীন বাংলার পক্ষে কাজ শুরু করেছেন।
: তোমরা স্বাধীন দেশের অফিসার, তোমাদেরকে আমরা ভারতে পাঠাচ্ছি, তোমরা গিয়ে বলবে, স্বাধীন বাংলাদেশের যে হাইকমান্ড, তার প্রতিনিধি তাজউদ্দীন আহমেদ এবং আমির-উল- ইসলাম এসেছেন। একটি স্বাধীন দেশের প্রতিনিধিদেরকে যেভাবে সন্মান দিয়ে গ্রহন করতে হয়, সেইভাবে তারা আমাদেরকে গ্রহণ করতে রাজি আছে কিনা জানালে আমরা ভেতরে যাব।
তৌফিক আর মাহবুব সীমান্ত পেরিয়ে ধীরে ধীরে ভারতের ভূমিতে হারিয়ে গেলেন। তাজউদ্দীন আহমেদ আর আমির-উল ইসলাম যতক্ষণ তাদের দেখা যায় তাকিয়ে রইলেন।
সন্ধ্যা নেমেছে। প্রচণ্ড গরমে গাছের পাতারাও নড়ছে না। একটা কালভার্টের উপর তাজউদ্দীন আহমেদ আর আমিরুল ইসলাম শুয়ে পড়েন। মাথার উপর অসীম উদার আকাশ। এই আকাশের নিচে পুরো বাংলাদেশ তখন জ্বলছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হিংস্র আক্রমনে ছিন্নভিন্ন পোড়া জনপদে ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ভেতরে স্বাধীনতার নেশায় মুক্তিপাগল মানুষের মনের ভেতর জ্বলতে থাকা অগ্নিশিখা তারা হয়ে ফুটতে শুরু করেছে।
তাজউদ্দীন আহমেদ আকাশে একটা দুইটা করে ফুটতে শুরু করা তারার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু মনের ভেতরে - মানুষের এই স্বতঃস্ফুর্ত জনপ্রতিরোধকে কীভাবে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া যায় তা নিয়ে নানা ভাবনা জেগে ওঠে। এই ঝাপিয়ে পড়া মানুষদের একত্রিত করা, প্রয়োজনীয় সহযোগিতার ব্যবস্থা করা, এবং পরিচালনার জন্য একটা সরকার দরকার এবং সেই সরকারের একটা শক্তিশালী সেন্ট্রাল কমান্ড দরকার। যদি এখনই একটা দায়িত্বশীল এবং আইনানুগ সরকার গঠন না করা যায় বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে বিপ্লবী সরকার গড়ে উঠবে এবং সেক্ষেত্রে কোনটা বৈধ সরকার এটা নিয়ে বিতর্ক আর বিভ্রান্তি দেশের স্বাধীনতার মূল লক্ষ্যকেই বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে। প্রায় আত্মহত্যার মত। সময় সামনে বেশি নেই। খুব দ্রুত, খুবই দ্রুত একটা কিছু করা দরকার।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেখা করে তাদের সাহায্য কতটুকু পাওয়া যাবে সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। হাতে একদম সময় নেই। রাস্তায় দেখে আসা প্রতিবাদী জনতার টগবগে শরীর, পাকিস্তানী সৈন্যের রক্তাত্ত বেয়োনেটের চকচকে মুখ, গুলি বৃষ্টির মধ্যে আতংকিত চোখ, বঙ্গবন্ধু... মাথার মধ্যে ভাবনাগুলো কাটাকুটির ঘুড়ির মত উড়াউড়ি করতে থাকে। কোন ভাবনায় স্থির থাকা যায় না।
ভাবনার সব সুতো কেটে হটাৎ একটা বিউগল বেজে ওঠে। আকাশের সবঘুড়ি নিমিষে শূন্যে মেলায়। ভারত থেকে আকাঙ্খিত ডাক ভেসে আসে। তাজউদ্দিন আহমেদ দিল্লী উড়ে চলেন।
ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি ওখানে আছেন ।
মহাকাশের সিনে পর্দায় এইতো ছোট ছোট পায়ে সোজা এগিয়ে আসছেন তিনি - ওখানে তাজউদ্দীন আহমেদ দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছেন।
তাজউদ্দীন আহমদের বুকের হৃদস্পন্দন একটু দ্রুততর হয়। আসন্ন মুহূর্তের উপর নির্ভর করছে অনেককিছু।
শ্রীমতি ইন্দিরাই ছোট্ট প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে প্রথম শুরু করেন।
: শেখ মুজিব কেমন আছেন?
ব্যক্তিকে ঘিরে ছোট্ট একটা প্রশ্ন। কিন্তু এর উত্তর একটি দেশের। তাজউদ্দীন আহমদ সেটা জানতেন।
: আমার যখন তার সাথে দেখা হয় তখন তিনি সমস্ত বিষয় পরিচালনা করছিলেন। তার যে পরিকল্পনা ছিল সে মতই আমাদের কাজ চলছে এবং হাইকমান্ড হিসেবে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। যার যেটা দায়িত্ব সেইভাবে কাজ করছি এবং আমি আমার দায়িত্ব হিসেবে এখানে এসেছি।
ইন্দিরা গান্ধীকে মনে হয় গোটা ব্যাপারটা বুঝে নেয়ার চেষ্টা করছেন।
: আমরা কীভাবে আপনাদের সহায়তা করতে পারি?
তাজউদ্দীন খুব স্পষ্ট স্বরে ইন্দিরা গান্ধীকে বুঝিয়ে বললেন
: এটা আমাদের যুদ্ধ। আমরা চাই ভারত এতে জড়াবে না। আমরা চাই না ভারত তার অস্ত্র দিয়ে আমাদেরকে স্বাধীন করে দিক। এই স্বাধীনতার লড়াই আমাদের নিজেদের এবং এটা আমরা নিজেরাই করতে চাই। এই ক্ষেত্রে আমাদের যা দরকার হবে তা হচ্ছে, আমাদের মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলবার জন্য আপনার দেশের আশ্রয়, ট্রেনিংয়ের সমস্ত রকম সুবিধা এবং সে ব্যাপারে আপনাদের সাহায্য সহযোগিতা এবং অস্ত্র সরবরাহ।
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বিষ্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেন তাজউদ্দীন আহমদের কথার মধ্যে কীভাবে একটি নতুন দেশের অস্তিত্ব পথ খুঁজে পাচ্ছে। তিনি মৃদু স্বরে তাজউদ্দীন আহমদের কথা পুনরাবৃত্তি করেন।
: এটা আপনাদের যুদ্ধ?
: অবশ্যই আমাদের যুদ্ধ। এবং এই যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমাদের দেশে পাকিস্তানী বাহিনী যেভাবে নিরস্ত্র সাধারন মানুষের উপরে ঝাপিয়ে পড়েছে তাতে মনে হয় যে - দুই এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রচুর শরনার্থী আপনার দেশে ঠাই নেবে, তাদের আশ্রয় আর আহারের ব্যবস্থা ভারত সরকারকে করতে হবে। কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও আপনার দেশ আমাদের পক্ষে বিশেষ অবদান রাখবে এটা আশা করি।
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি এক মুহূর্ত চুপ থাকেন। তাজউদ্দীন আহমেদ শান্তভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছেন। ইন্দিরা গান্ধীর জবাবের জন্য তিনি অপেক্ষা করছেন।
: নিশ্চয় আমরা আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করবো।
ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিশ্র“তিতে একটা বদ্ধ বাতাস যেন যেন একটা খোলা জানালা পেয়ে হুড়মুড়িয়ে উঠল। সেই বাতাসে পাল উড়িয়ে তাজউদ্দীন আহমেদ চলতে শুরু করেছেন। বঙ্গবন্ধু নেই। তার সেই ছবিটা আছে। এইতো একজন একজন তার সঙ্গে আসতে শুরু করেছে, তার হাতে লাঠি। তারপর আর একজন, সে নিয়ে এসেছে ক্ষেতের কাস্তে। এইতো এক জেদী তরুন, তার কাঁধে রাইফেল, একটা মিষ্টি চেহারার মেয়ে - সেও যোগ দিয়েছে দলে। এক এক করে আসতে শুরু করেছে সবাই। কত্ত বড় একটা লাইন। সবাই যুদ্ধে চলেছে।
কলকাতা শহরের একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট। অনাড়ম্বর দুই রুমের। এখানেই বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার এর অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের কাজ পরিচালনা করছেন। পাশের একটি ছোট রুমে তার নিজের থাকার ব্যবস্থা। কাপড় ধোয়াসহ গৃহস্থালী কাজটা নিজেরই করতে হয়। দেশ শত্র“মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি কোন পারিবারিক জীবনে জড়াবেন না এই প্রতিজ্ঞা করেছেন। থাকার রুমের পাশে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ একটা রুমে একটা বড় টেবিল বসানো। তাকে ঘিরে কয়েকটা চেয়ার ফেলে মিটিং রুম সাজানো হয়েছে। এই প্রবাসী সরকারের মন্ত্রীদের মিটিং রুম। প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটা চেয়ার আলাদা করে রাখা। তাজউদ্দিন আহমেদেরই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই চেয়ারে বসার কথা। তাজউদ্দিন আহমেদ চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার। তাজউদ্দিন আহমেদের অন্যরকম লাগে। সবসময় সঙ্গে রাখা বঙ্গবন্ধুর ছবিটা বের করে ভাল করে তাকিয়ে দেখেন। তিনি যতœ করে চেয়ারে ছবিটা রাখেন। এই চেয়ার বঙ্গবন্ধুর জন্য। তিনি তার হয়ে শুধু কর্তব্যটা পালন করে যাবেন।
বঙ্গবন্ধু ছবিটা থেকে যেন কথা বলে উঠেন।
: চেয়ারটায় আমার ছবি বসালে যে?
তাজউদ্দিন আহমেদের মুখে লাজুক একটা হাসি ফুটে।
: মুজিব ভাই, আমিতো কোনদিন আপনাকে সামনে না রেখে কোনকিছু ভাবি নি।
: কিন্তু এখনতো তোমাকেই সব সামলাতে হবে। আমিতো আগেই তোমাকে দায়িত্ব দিয়ে রেখেছি। সেই অসহযোগ আন্দোলনের আগ থেকে।
: সবসময় আমিতো আপনার হয়েই আমার দায়িত্ব পালন করে এসেছি। প্রত্যেকে আপনার হয়েই তার দায়িত্ব পালন করছে। এই চেয়ারটায় আপনার ছবি আমাকে আমার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেবে। সবাইকে তার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেবে। আর...
তাজউদ্দিন আহমেদ চুপ করে যান। øেহার্ত চোখে বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাজউদ্দিন সেই দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে মনের ভেতরের সব ভাবনার দরজা খুলে দেন-
আমিতো কখনোই আপনাকে ছাড়া চিন্তা করি নি। আমার কোন প্রকাশ নেই। আমার সব চিন্তার প্রকাশই আপনার ভেতর দিয়ে। আপনার নির্দেশ আমার চিন্তা - আমার কাজ আর আমাকে অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়। এখানেতো আমি নেই। আপনি আছেন। এখানে কেউ নেই। পুরো বাঙালীর হৃদয়ে শুধু আপনি মুজিব ভাই, শুধু আপনি। আমরা সবাই আপনার হয়েই নিজেদের দায়িত্বকে খুঁজে নিচ্ছি। ঐ যে শুনুন, মুজিবভাই। শুনতে পাচ্ছেন আপনার হয়ে সবার মুখে আপনার হৃদয় কথা বলছে-
প্রথমে আস্তে। তারপর জোর বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে গুঞ্জনের মত। একটা সুর। কথা হয়ে বাজে।
আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালবাসি
বাঙলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ বঙ্গবন্ধুর হয়ে মিলিত কণ্ঠে আকাশে বাতাসে একটা মিষ্টি তান ধরে ।
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাশি
সেই গানের মধ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। পুরো দেশ জুড়ে। বিভ্রান্তি, বিরোধ, শঙ্কাকে দৃঢ়হাতে সামাল দিয়ে বাঙ্গালীর প্রতিরোধকে আরও তীব্র করতে যুদ্ধাক্রান্ত বাংলাদেশে যুদ্ধকালীন একটা সরকার গঠনের প্রক্রিয়া আরম্ভ হলো। তাজউদ্দিন আহমেদ এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নবীন রাষ্ট্রগঠনের সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করছেন। তার নির্দেশনা নিয়ে আমিরউল ইসলাম সারা পৃথিবীর জন্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট আর অঙ্গীকারকে ভাষা দিলেন। গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের ম্বাধীনতার ঘোষণাপত্র একটা যুদ্ধ, একটা জাতি, একটা রাষ্ট্র, ইতিহাস এবং আগামীর ছবি হয়ে পৌঁছে গেল পৃথিবীর সব মানুষের কাছে।
“... পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ন্যায়নীতি বর্হিভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন
এবং
সেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভুত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষের অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সনের ২৩শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগনের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।
... সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়াছেন সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করিয়া পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য - সেইহেতু আমরা বাংলাদেশকে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি এবং উহা দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করিতেছি। ...
তাজউদ্দিন আহমেদ তার মুঠ পুরোটা খুলে দিলেন।
কলকাতার সেই ছোট্ট ফ্ল্যাটটা একটুক্ষণের জন্য আবার ভেসে উঠলো। প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারটায় বঙ্গবন্ধুর ছবি। তার সামনে একাগ্র চিত্তে বসে আছেন তাজউদ্দিন।
ধীরে ধীরে ছবিটা মুছে গেলে চারপাশে জেগে রইলো শুধু ছায়াপথ, অগুনতি নক্ষত্র, নিহারীকা আর গ্রহ উপগ্রহ খচিত মহাশূন্য। তারা আবর্তিত হতে থাকে দুটি স্মৃতিকাতর তারাকে কেন্দ্র করে, যারা ফেলে আসা ঐ নীল পৃথিবীর নিঃশেষিত জীবনের জটিল পার্থিব দূরত্বের হিসেব মেটানোতে মগ্ন দুটি শিশুর মত নিঃশব্দে বসে আছে।
মহাকালের নীরবতা শীতল শূন্যতায় প্রবাহিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুই তাজউদ্দিন আহমেদের দিকে তাকান। তাজউদ্দিন আহমেদ নিরবে বসে আছেন।
বঙ্গবন্ধু : তারপর?
তাজউদ্দিনের আলো একটু জ্বলে উঠে। কিন্তু সেই জ্বলে ওঠার মধ্যে একটু অভিমান মেশানো থাকে।
তাজউদ্দিন : তারপরটা কোনদিন জানতে চাইলেন না মুজিবভাই। আমার এই একটাই কষ্ট।
আপনি কোনদিন আমার কাছে জানতে চাইলেন না, তাজ -আমি ছিলাম না, এতবড় যুদ্ধটা তুমি কীভাবে করলে? কীভাবে সামলালে এতকিছু ? আপনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্রতিটা মুহূর্ত আমি অপেক্ষা করেছি, আপনাকে আমি বলবো কীভাবে আমি আপনার হয়ে বেঁচে থেকেছি। কীভাবে আপনার হয়ে প্রতিটা পা ফেলেছি। কিন্তু আপনি একটিবারের জন্যও জানতে চাইলেন না। কতবার আমি বলতে গিয়ে আপনার মুখের শীতলতা দেখে ফিরে এসেছি। এই একটাই কষ্ট আমার বেঁচে থাকার প্রতিটা মুহূর্ত মৃত্যুর হীম শীতলতায় ঢেকে দিয়েছে। এই একটাই কষ্ট মুজিব ভাই।
মহাশূন্যে একটা ঝড় ওঠে। ছায়াপথ, গ্রহাণুপুঞ্জ, এই সৌরজগৎ সমস্ত কিছু মনে হয় কাপছে। একটা হীম শীতল শৈত্য প্রবাহ দামাল দস্যূর মত কেশর উড়ানো পাগলা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যায়। বিন্দু বিন্দু আলোর কনা বর্ণিল সূচের মত চোখের মণি ফুঁড়ে মগজে গিয়ে তোলপাড় করে ওঠে। চোখ খুলে রাখা যায় না। শক্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে উবু হয়ে থাকি। যেন তাতেই সব থেমে যাবে - উটপাখির মত ভাবি। একটা সময় সত্যি সত্যিই পৃথিবীর আর সবকিছুর মতই এই প্রলয়ও থেমে যায়। আমি ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে তাকাই। বঙ্গবন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে হীম হয়ে যাই। মনে পড়ে - যুদ্ধশেষে বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগারের ফাঁসির দড়ি থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে এসেছিলেন - তখনও তিনি অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। অপরূপ কোমল সেই কান্নার প্রতিচ্ছবি - পৃথিবীর আর কোন কান্নায় আমি দেখিনি। কিন্তু এ কেমন কান্না বঙ্গবন্ধুর! প্রলয়ের পর যেমন লণ্ডভণ্ড হয়ে হয়ে পড়ে থাকে গাছ, ফসলের মাঠ, বিধ্বস্ত ঘর, মানুষ আর প্রাণীদের প্রাণহীন দেহ - বঙ্গবন্ধুকে দেখে ঐ দৃশ্যগুলোর কথা মনে হয়। এতক্ষণে বুজতে পারি, ঐ ঝড়- ঐ প্রলয় বেদনাতাড়িত বঙ্গবন্ধুর হৃদয় নিঃসৃত যন্ত্রণার প্রবাহ। যন্ত্রণার ঝড় থেমে গেলেও এখন একটা মৌন বেদনা তাকে আচ্ছন্ন করে থাকে।
পাশে তাজউদ্দিন দাঁড়িয়ে আছেন, নিকটতমের কাছে বহুদিনের জমে থাকা অভিমান বলা হয়ে গেলে চেহারাটা যেমন একটু নত হয়ে থাকে ঠিক তেমনি।
ধীরে ধীরে মুখ তোলেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু : সেই রাত।
তোমরা একে একে আসলে। কতভাবেই না সবাই তোমরা একই কথা বলে গেলে।
তোমরা দেখলে-
আমি তোমার এবং তোমাদের সবার অনুরোধ মিনতি উপদেশ উপেক্ষা করে রয়ে গেলাম।
আসলে তোমরা বলছিলে আর আমি ভাবছিলাম-
কোথায় যাবো আমি? কোথায়? কোথায় যেতে পারি আমি?
আমি
সাড়ে সাত কোটি মানুষের হয়ে যে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ।
তার লুকিয়ে যাওয়া মানেতো সাড়ে সাত কোটি মানুষের লুকিয়ে যাওয়া ...
তার পালিয়ে যাওয়া মানেতো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পালিয়ে যাওয়া ...
সেটা কি হয় কখনও?
সেটা কি সম্ভব কখনও?
সেটা কি হতে পারে কখনও?
শুধুমাত্র একটা ধ্বনিই আমি শুনতে পাচ্ছিলাম।
না।
সাড়ে সাত কোটি মানুষ পালাতে পারে না।
সাড়ে সাত কোটি মানুষ লুকোতে পারে না।
সাড়ে সাত কোটি মানুষের হয়ে একা আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম।
নিজেকে ওদের সামনে দাঁড় করিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে মুক্ত করে দিলাম।
সাড়ে সাত কোটি মানুষ জানে তাদের গন্তব্য কোথায়। কোন বিভ্রান্তি নেই।
তোমরাও জানো আমার চিন্তা। লক্ষ্য। উদ্দেশ্য।
এর বাইরেতো আর কোন পথ নেই।
এর বাইরেতো কোন কিছু হবার নেই।
আমার যা কিছু বলার আমি বলে দিয়েছি। যা কিছু জানাবার তা জানিয়ে দিয়েছি।
এখন আমার নতুন করে বলবার কিছু নেই। নতুন কিছু জানাবার নেই।
যা হবার তা নির্ধারিত হয়ে গেছে।
এর কোন অন্যথা হবার কোন উপায় নেই।
সবাই যে যার পথে হেঁটে গেলেও তা একটা বিন্দুতে মিলবেই।
আমারও আর কিছু করার নেই। শুধু অপেক্ষা ছাড়া।
তোমরা চলে গেলে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম।
ওরা এলো অবশেষে। ওরা আমাকে নিয়ে গেল । আমি সাড়ে সাত কোটি মানুষকে রেখে গেলাম।
বিমানের জানলা দিয়ে শেষবারের জন্য দেখে নিচ্ছিলাম সারি সারি আলোর বিন্দু।
রাতের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। অন্ধকারের ভেতরে আরও কালো ধোঁয়া কালো কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে।
আমি সেই আগুনের দিকে তাকিয়ে ভাবি-
অতীত স্মৃতি। অনাগত ভবিষ্যত।
কীভাবে একটি দেশ বারবার স্বাধীন হয়ে আবার পরাধীনতার শেকলে নিজেকে বন্দী করে...
৪৭ সালের কথা মনে পড়ে।
সেদিনও একটা স্বাধীনতা এসেছিল। রক্ত আর মৃত্যুর উপর দাঁড়িয়ে বিশ্বাসী মিছিল নেমেছিল। স্বাধীনতার আনন্দে মেতে উঠেছিল মানুষ।
কিন্তু সেটা ভুল ছিল। অথবা আজকের দিনটার জন্য সেই ভুলটা ঠিক ছিল।
আজকে কাঙ্খিত সেইদিন এসে গেছে। সেই মূহূর্ত। আগুনের দিকে তাকিয়ে মনে হয় পুরনো বিশ্বাসের মূহূর্তগুলো পুড়ে পুড়ে আকাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে আগামী দিনের পথটা তৈরী করে যাচ্ছে। কিন্তু ওরা এত সহজে সব হতে দেবে না। আমি মানুষের কথা ভাবি। আমি রক্ত দেখতে পাই। ঠিক কত মানুষের রক্ত ঝরবে... আমি ভাবতে পারি না। হাজার, লাখ, ...। এক একটা মানুষ- এক একটা জীবন। আমি এক একটা জীবনের মৃত্যুর কথা ভাবি।
এই যে এত মানুষের যে রক্ত ঝরছে, এই মুহূর্তে যে মানুষটা মরে যাচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে যতগুলো মৃত্যু অপেক্ষা করছে, সবকিছুর জন্য কি আমি দায়ী?
এ কথা মনে হতেই বুকের কাছটা জমে আসে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।
এতটা ভার আমি কোনদিন বহন করিনি।
সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবন এবং মৃত্যুর ভবিষ্যত আমারই উপর,
এতগুলো মানুষের জীবন মৃত্যুর ভার একজন মানুষ কীভাবে সহ্য করবে?
এই অসহনীয় ভার বহন করতে করতে আমার ঈশ্বরের কথা মনে হয়।
গোটা পৃথিবীর ভার কীভাবে বহন করেন ঈশ্বর? ভাবি আমি।
কিন্তু আমি ঈশ্বর নই। ঈশ্বর যা সহ্য করতে পারেন আমি তা মানুষ হয়ে কীভাবে সহ্য করবো?
তবু এই সাড়ে কোটি মানুষের জীবন ও মৃত্যুর দায়িত্ব আমি অস্বীকার করতে পারি না।
আমি এই যন্ত্রণা এড়াতে পারি না।
অবিরাম কষ্টের ভেতরে ডুবে যেতে যেতে আমি আমাকে ভুলে যেতে চাই।
ভাবতে চেষ্টা করি
এই জীবন এবং এই মৃত্যুর দোলা
সে আমার হাতে নয়।
আমার চোখের সামনে কেবল জেগে ওঠে একটি দেশ।
স্বাধীন একটা দেশ।
একটি দেশের জন্য মৃত্যু কিংবা জীবন- কোনটাই বড় প্রশ্ন নয়।
প্রশ্ন শুধু একটাই।
সেটি - দেশ।
বিষয়টা শুধু একটা দেশ। আমি একটা নিমিত্ত মাত্র। প্রতীক মাত্র।
আমরা সবাই তাই।
স্বাধীন একটা দেশের প্রশ্নে নিজেকে পাথর বানিয়ে ফেলি।
আমি অনুধাবন করতে পারি
ঈশ্বরের নির্বিকারত্ব।
আমি পাথর হয়ে অপেক্ষা করি।
লড়াই, মৃত্যু, ধ্বংসস্তুপ সবকিছুই একটি নিয়তির দিকে নিয়ে যায়।
একটি দেশ। স্বাধীনতা। একটি স্বাধীন জাতি।
আমার কানে বাজতে থাকে হিমশীতল একটি বাক্য।
আমাদের কথা মেনে নাও না হলে তোমার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার শাস্তি অপেক্ষা করছে-
বুটের আওয়াজ তুলে ওরা বললো আমাকে।
আমি ওদের কথা শুনি, চোখে ভাসে যুদ্ধ, জাতি, দেশ।
আমি শান্ত স্বরে বলি, শাস্তি দাও।
ওরা শুনে হাসলো। পরক্ষনেই চোখ আগুন বানিয়ে বললো - ‘এর শাস্তি কী জানো? ফাঁসি!’
ফাঁসি। ফাঁসি। ফাঁসি।
আমি ফাঁসির কথা ভাবি। কিন্তু চোখে দেখি স্বাধীনতা।
বলি, ‘দাও ফাঁসি। আমি প্রস্তুত।’
আমি মানুষ আর মানুষের উন্মুখ লড়ায়ের দৃশ্য কল্পনা করতে করতে আবার বলি- আমি প্রস্তুত।
আমার হৃদয় এক নির্বিকার আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ফাঁসির দড়িটা যেন আমার সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবন মৃত্যুর অতলস্পর্শী দায়িত্ব থেকে আমাকে মুক্তি দিয়ে গেল।
আমি নিজেকে দেখি সাড়ে সাত কোটি মানুষের একজন হিসেবে।
মৃত্যুর চিন্তা এক অসহ্য ভারবহনের হাত থেকে আমাকে আলিঙ্গন করে।
আমাকে ভারমুক্ত করে।
চার দেয়ালের ছোট্ট ঘরে একটা টাংস্টেন বাতি হলুদ আলোর মধ্যে আমি অপেক্ষা করি সেই ফাঁসির দড়ির।
কিন্তু ফাঁসির দড়ি যেন অনন্ত কাল হয়ে আমার সামনে ঝুলে থাকে। সে কিছুতেই আমাকে স্পর্শ করে না।
জেল, কারাগার নতুনতো না। অনেকগুলো বছরই কেটে গেছে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে। যতবার কারাগারের বন্ধ দেয়ালে নিজেকে আটকে পড়া আবিষ্কার করেছি ততবারই মনে হয়েছে -
তোমাকে কেউই কারাগারের মধ্যে বন্দী করতে পারবে না যতক্ষণ না তুমি নিজেই তোমার চিন্তা, তোমার কল্পনা, তোমার অস্তিত্বকে ঐ প্রকোষ্ঠের মধ্যে বন্দী করছো।
এদিক থেকে আমার প্রতিটা কারাবাস নিয়ে এসেছে আত্মোপলোব্ধির নতুন জগৎ, চিন্তার অবাধ বিস্তার।
কিন্তু এবারের এই বন্দীত্ব যেন আগের থেকে আলাদা।
আমি আমার সবকিছু বলে এসেছি। যা জানানোর জানিয়ে এসেছি।
কিন্তু আমি জানছি না কী ঘটছে, কী ঘটছে না।
শুধু একটা নীরবতা ছাড়া আমার সামনে কিছুই নেই।
আমি তোমাদের কথা ভাবছি
কিন্তু ভাবনার বাইরে সত্যিকারের যে তোমরা
সেই তোমরা কেমন আছো ... কী করছো... কী করতে পারছো... কী করতে পারছো না...
কল্পনা করতে গেলেও কোন কল্পনাই করতে পারছি না।
চারদিকে ভাবনার ভেতরে বাইরে সবদিকে
একটা নিরবচ্ছিন্ন মৌনতা শুধূ ।
অবিশ্রান্ত শূন্যতা।
এছাড়া পৃথিবীতে কোন কোন শব্দ নেই।
আমি কল্পনা করছি একটা যুদ্ধের কিন্তু আমার চারপাশের নিঃস্তব্ধতার পৃথিবীতে কোন যুদ্ধের কল্পনা করাও কঠিন হয়ে পড়ছে।
আমি একটা পথের কথা ভাবছি
কিন্তু আমি জানি না এই চারদেয়ালের বাইরে সেই পথটি কোন গন্তব্য দেখাচ্ছে কি না।
একটি টাংস্টেন বাতির হলুদ আলোর মধ্যে আমি শুধু অপেক্ষা করে যাচ্ছি একটা ফাঁসির দড়ির
কিন্তু শুধু নিস্তব্ধতা ছাড়া কোন কিছুই চারদিকে নেই।
তবে কি যুদ্ধ নেই?
তোমরা নেই?
কোন কিছুই নেই?
চারদেয়ালের মধ্যে নিজেকে ভাবতে পারলেও হয়তো ভাল হতো...
কিন্তু নিজেকে মনে হচ্ছিল এক অসীম শূন্যতার কেন্দ্রে বসে আছি।
আমি আর একটা টাংস্টেনের বাতি।
কোন শব্দ নেই, কোন দৃশ্য নেই, কোন অক্ষর নেই।
আলো নেই, অন্ধকার নেই।
শুধু টাংস্টেনের বাতির হলুদ আলোর মধ্যে চারদিকে চারটি নিরেট দেয়াল শীতল হয়ে জেগে থাকে।
প্রতিটি মুহূর্ত শুধু ভাবতে চেষ্টা করি - ধরতে চেষ্টা করি - বুঝতে চেষ্টা করি।
কী হচ্ছে? কী হতে যাচ্ছে? কী হতে পারে?
চারদেয়ালের মধ্যে স্মৃতি - ভাবনা- কল্পনারা জেগে ওঠে।
তুমি, তোমরা, যুদ্ধ, রক্ত, স্বাধীনতা, সাড়ে সাত কোটি মানুষ, যুদ্ধ, পৃথিবী, বাংলাদেশ, বাঙ্গালী জাতি কত কথা কত ভাবেই না জাগতে থাকে। আর আমি আমার মধ্যে একটি স্বাধীন দেশের জন্য নিজেকে ফাসির দড়িতে ঝুলিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করি।
কিন্তু কিছুই ঘটে না।
ভাবনা স্মৃতি কল্পনা ছাড়া চারদেয়ালের পৃথিবীতে আর কোন শব্দ শোনা যায় না - আর কোন দৃশ্য দেখা যায় না- আর কোন অক্ষরও কোন সংবাদ বয়ে আনে না।
শুধু হৃদপিণ্ডের শব্দের সাথে সাথে সময়টা অনুভব করি। ভাবি যুদ্ধ হচ্ছে। নিশ্চয় এতদিন স্বাধীনতার পথে অনেকদূর এগোতে পেরেছো তোমরা। আবার দুশ্চিন্তায় মাথা ভার হয়ে আসে... তোমরা ওদের বিরুদ্ধে ঠিকমতো দাঁড়াতে পেরেছোতো?
সময় চলে যায়। কিন্তু আসলে বুঝতে পারি না, আসলে কি সময় যাচ্ছে, গেলে কতটুকু যাচ্ছে।
আমি ঠিক একটা জায়গাতে আটকে থাকি। আমি একই কথা ভাবতে থাকি, একই কথা কল্পনা করতে থাকি, একই কথা স্মৃতিচারন করতে থাকি।
পুনরাবৃত্তির মত অবিরাম একই ঘটনা ঘটতে থাকে।
টাংস্টেন বাতিটা আমার মতই একা দিনরাতশূন্য কেবল জ্বলে যায়। জ্বলে যায়। জ্বলে যায়।
এভাবে চলতে চলতে সময়টা একটা সময় স্তব্ধ হয়ে যায়। অনন্ত রূপ ধরে সে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। যেন কোনদিনই এই চারদেয়াল চোখের সামনে থেকে সরে যাবে না। এই চারদেয়ালের বাইরে যেন পৃথিবীর কোন অস্তিত্ব নেই। তুমি, তোমরা, রক্ত, যুদ্ধ, স্বাধীনতা সবকিছুর অস্তিত্ব আমার একটা কল্পনা মাত্র। একটা ভাবনা মাত্র।
এই টাংস্টেন বাতি, চারদেয়াল আর এই আমি- এর বাইরে সবকিছু শূন্য হতে শুরু করে।
আমি আবার ভাবার চেষ্টা করি- তুমি, তোমরা, দেশের মানুষ কী করছো এখন?
কোন কিছু ভাবতে পারি না। একটা অসীম শূন্যতা- চারদেয়াল, একটা টাংস্টেন বাতি আর আমাকে ঘিরে অনড় হয়ে থাকে। সেটা ভেদ করে কোন শব্দ, দৃশ্য আর অক্ষর ভেসে ওঠে না। আমি আমার ফাঁসির কথা ভাবি। আমি প্রার্থনা করি, ফাঁসিটা হয়ে যাক। ফাঁসির একটা পরিণতি আছে। কিন্তু মনে হচ্ছিল এই শূন্যতার কোন পরিণতি নাই। প্রতি মুহূর্তে আমি যেন মারা যাচ্ছিলাম। প্রতি মুহূর্তে একটা অর্থহীনতা আমার মধ্যে জন্ম নিচ্ছিল।
আমি ভয় পাচ্ছিলাম- আমাকেই। আমার ভেতরের শূন্যতার ঘোরকে।
কোন শব্দ নেই...
কোন দৃশ্য নেই...
কোন অক্ষর নেই...
একা আমি আর একটা টাংস্টেন বাতি। শুধু চারটা দেয়াল।
পাগলের মত লাগে।
একাকীত্ব গ্রাস করে।
প্রাণপনে স্মৃতি জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করি। ভাবার চেষ্টা করি তোমার আর তোমাদের মুখগুলো -যাদেরকে আমি রেখে এসেছি, যাদের উপর নির্ভর করেছি।
সমস্ত শক্তি জড়ো করে কল্পনা করার চেষ্টা করি - সাড়ে সাত কোটি যোদ্ধা একটি দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করছে ।
সবকিছুই শেষে পুনরাবৃত্তির ঘোরে শূন্য হয়ে যায়।
মনে হয় - আমি বোধহয় উন্মাদ হয়ে যাবো।
মনে হয় - স্মৃতি চিন্তা কল্পনা বলে কোন কিছু নেই আসলে। নেই কোনকিছুই।
শুধু চারটা দেয়ালের মধ্যে এই পৃথিবীতে আমি একা আর একটা টাংস্টেন বাতি ছাড়া এই পৃথিবীতে কিচ্ছু নেই। ভাবনাটাকে জোর করে সরিয়ে রাখতে জোর করে আবার ভাবি, লড়াই। কিন্তু শূন্যতা এসে সব ভাবনা গিলে ফেলে।
তবু চিন্তা করি- স্বাধীনতা। কিন্তু শূন্যতা এসে সব চিন্তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যায়।
তবু স্বপ্ন দেখি- মুক্তি। শূন্যতা এসে সবকিছুকে অবাস্তব করে দিয়ে যায়।
ভয় পাওয়ার চেষ্টা করি-পরাধীনতা। সেটাও শূন্যতা ছাড়া কিছু মনে হয় না।
এই শূন্যতার ভেতরে আমি টের পেলাম একা মানুষকে। একজন একলা মানুষকে। চিনতে পারলাম একজন একক মানুষকে।
মানুষ বলে কিছু নেই - মানুষ আসলে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের চলমান সময়ের সৃষ্টি। একজন মানুষ আসলে আরও অনেক মানুষের ফসল।
কিন্তু এখানে সময় নেই। অন্য কোন মানুষও নেই। সময়হীন, মানুষহীন অসীম শূন্যতার ভেতরে ঝুলে থাকতে থাকতে আমি নিজেও নেই।
শেষ মুহূর্তের জন্য মানুষ সমস্ত প্রতিরোধে নিজেকে শক্ত করে রাখতে পারে।
শেষ মুহূর্তের স্বপ্ন তাকে মৃত্যুর উপর জয়ী হতে শেখায়।
কিন্তু যেখানে শব্দ নেই, দৃশ্য নেই সময়হীন মূহূর্তকে সে কীভাবে গ্রহন করবে?
সে কী নিয়ে ভাববে - যখন তার সবই আলো এবং অন্ধকার বিহীন।
সে কী ভাবে চিন্তা করবে - যখন তার অতীত ছাড়া কোন বর্তমান নেই, নেই ভবিষ্যত।
সে কার জন্য নিজেকে প্র¯তুত করবে - যখন তার শরীর ছাড়া অন্য কিছুরই অস্তিত্ব নেই।
সে কী সিদ্ধান্ত নেবে - যখন জগতের সব কিছুই একটা কল্পনামাত্র।
সত্য বলতে নিজের রক্ত প্রবাহ, ক্ষিধে, হৃদস্পন্দন আর চারদেয়ালের ভেতরে একটি টাংস্টেন বাল্ব। কালহীন সময়ের স্রোত। একটি কালহীন চেতনার স্রোত।আলোহীন অন্ধকারহীন সময়বিহীন সময়ের স্রোত।
আর কোন স্মৃতি নেই, বর্তমান নেই, ভবিষ্যত নেই।
আমার মনে পড়লো আমি যা বলার ছিল সবই বলে দিয়ে এসেছি। সব কথা বলে দিয়ে এসেছি। আমার চেতনাকে তোমাদের কাছে দিয়ে এসেছি। আসলে আমি যে আমাকে ভাবার চেষ্টা করছি সেই আমিকে রেখে দিয়ে এসেছি সেই মুহূর্তে যখন তোমাদের নির্দেশ দিয়েছি- তোমরা যাও। আমি থেকে যাবো। কারণ এর পর আর আমার কিছুই দেয়ার ছিল না। সবকিছূই আমি তোমাদের দিয়ে এসেছি। এই যে শরীর তা একটি দেশের মুক্তির একটি প্রতীক ছাড়া কিছুই না। আমার আর কোন অস্তিত্বই আমার আর নেই। দেশ হয়ে নিজেকে একটি অনন্ত সময়ের সামনে দাঁড় করানো ছাড়া আর কিছুই করার আমার নেই।
আমি যখন তোমাদের মধ্যে ফিরে এলাম তখন আমি আসি নি ...তাজ।
তাজউদ্দিনের চোখে অঝোরে কান্না ঝরছে। তিনি যেন আর তারা নন। রক্ত মাংসের মানুষ। চোখের জল নিয়েই ধরা গলায় তাজউদ্দিন বললেন -মুজিব ভাই।
বঙ্গবন্ধু : আমি ঠিক কোন মুহূর্তে মারা গেছি তাজ জানো? যখন আমি তোমাদের ফিরিয়ে দিয়ে ওদের অপেক্ষায় বসে ছিলাম- ঠিক সেই মুহূর্তে। এর পরে তোমরা যেই মুজিবকে দেখেছো, সে আমি না। সে এই দেশ। দেশ কাউকে ফেরায় না। মায়ের মত। অবাধ্য সন্তানকেও তার ফেরানোর ক্ষমতা নেই। সে সবকিছুই তার পরিবারের মধ্যে দেখে। এই কারণে আমি কাউকে আলাদা করে বিচার করতে পারি নি। তাই আমি পিতার মত শাষন করতে পারি নি। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। তবু চেষ্টা করতে চেয়েছিলাম মাঝে মধ্যে মুজিব হতে, মাঝে মধ্যে পিতা হতে, পারি নি আমি। হয় নি। শেষ হয়ে গেল সবকিছু। চোখের সামনে। একটু একটু করে...
বঙ্গবন্ধুর চোখ ছলছল করছে বেদনায়। তিনি নিজেকে একটু সামলে নিলেন। একটু হাসলেন আপন মনে।
বঙ্গবন্ধু : আমি তোমাকে মন্ত্রীসভা থেকে তাড়িয়ে দিলাম। দূরে ঠেলে দিলাম। আমার বিরুদ্ধে অনেকেই
তোমাকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে, সেটাও জানি। সবাইই সেইসময় আমার উপরে ক্ষেপে উঠছে। একে একে সবাই কাছ থেকে চলে যাচ্ছে। কত কথা বলছে। কিন্তু তুমি কোনদিন আমার বিরুদ্ধে একটা কথাও বলো নি। কেউ চেষ্টা করেও আমার বিপক্ষে একটা শব্দও বলাতে পারে নি। নিরবে তুমি সবকিছু সহ্য করে গেছো। কেন, তাজ?
তাজউদ্দিন : আমিতো আপনার বাইরে কোনদিন কিছু ভাবি নি মুজিব ভাই।
বঙ্গবন্ধু : কেন? কেন ভাবো নি?
তাজউদ্দিন কোন কথা বললেন না। বঙ্গবন্ধু আবার মনে মনে হাসলেন একটু।
বঙ্গবন্ধু : তাজ মানে কী, তাজউদ্দিন?
তাজউদ্দিনের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করেন না বঙ্গবন্ধু। নিজেই বলতে শুরু করেন।
বঙ্গবন্ধু : তাজ মানে মুকুট। মাথায় থাকে। চিন্তা। আর শেখ মানে বিচারক। যার কণ্ঠ রায় ঘোষণা করে।
প্রকাশ। চিন্তার প্রকাশ ছাড়া কোন অস্তিত্ব নেই। তেমনি চিন্তাবিহীন প্রকাশেরও কোন অর্থ নেই। তুমি আমার চিন্তা ছিলে, আমি ছিলাম তোমার প্রকাশ। যেদিন তোমাদের ফিরিয়ে দিয়ে আমি আমাকে হত্যা করেছিলাম সেদিন তোমার প্রকাশটাও মরে গেল। আর আমার সাথে সাথে আমার চিন্তাও মরে গেল, ঠিক তখনই তোমার মৃত্যু হলো। আমাদের একজনের মৃত্যুই ছিল দুজনের মৃত্যু। এটাতো তুমি জানোই তাজ। সেইজন্যে তুমি বুঝতে পেরেছিলে, দু’জনকেই যেতে হবে। ওটা ছিল শরীরের মৃত্যু। ওটার কোন মূল্য ছিল না। আমরা মরে গিয়েছিলাম আগেই।
দুটো তারা জ্বলতে নিভতে শুরু করে। একটা কষ্টের স্রোত সেই নেভা জ্বলার মধ্যে দিয়ে ছড়াতে থাকে। আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
লাস্টবেঞ্চির কথা ভেসে আসে।
মুজিব পিতা ছিলেন। নেতা ছিলেন। দ্রষ্টা ছিলেন।
তাই তিনি নিজেই নিজের মৃত্যু রচনা করেছেন।
কেউ তার মৃত্যু রচনা করেনি। এমনকি মৃত্যুও।।
লাস্টবেঞ্চি বঙ্গবন্ধুকে কী অবলীলায় মুজিব মুজিব করে গেল। যেন বন্ধু। খুব পরিচিত কেউ। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কি তবে সব ব্যবধান মুছে যায়? হবে নিশ্চয়। সব ব্যবধানতো জীবনই তৈরী করে। মৃত্যু সবকিছূ সমান করে দেয়।
মন্তব্য
লেখাটা ভালো লেগেছে, বেশ ভালো। ... (ফরম্যাটিং এর জন্যে মাঝে মধ্যে হোঁচট খেতে হয়েছে অবশ্য)
তাজউদ্দীন আহমদের বহু আক্ষেপ ছিলো, তিনি বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭১'এর কথা বলে যেতে পারেন নি। বঙ্গবন্ধুও সেই আগ্রহ প্রকাশ করেননি...
রূপকথার মত ইতিহাস; আফসোস, আমরা সেই ইতিহাসকে প্রাপ্য সম্মান দিতে পারি নি।
আমার কেবলি মনে হয় বঙ্গবন্ধু যদি তাজউদ্দিন আহমেদের কথা শুনতেন তাহলে বাংলাদেশের যাত্রাটা ভিন্নহতো, তাদের দুজনার মধ্যকার দূরত্ব অনেকমানুষের তৈরী, সেই অনেকমানুষ তারপর থেকেই বাংলাদেশের হর্তা-কর্তা-বিধাতা হয়ে বসে আছে! ইতিহাস সে কথা কোন একদিন বলবে! একজন তাজউদ্দিন যা বলে যাননি তার কথন কোন একদিন অনুদিত হবে - সেই প্রতীক্ষায় থাকি!
আপনার লেখা অসাধারন লাগলো, তবে একটুবড় মনে হয়েছে কোথাও কোথাও, কিন্তু যে মন্ত্রনা আর আবেগ নিয়ে এই কাজটা করলেন তার জন্য আপনাকে স্যালুট! আপনার কাছ থেকে অনেক প্রত্যাশা তৈরী হয়ে গেলো!
কাব্যগন্ধী বয়ান ভালো লাগলো!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
অনেক অনেক ভালো লেগেছে। এমন লেখা পড়িনি অনেকদিন।
চমৎকার লিখেছেন, মুগ্ধ হয়ে পড়লাম, মহাকাশের প্লটটা ভাল লেগেছে। তাজউদ্দিন সম্পর্কে আরো অনেক জানতে চাই-
facebook
তাজউদ্দিন এবং বঙ্গবন্ধুর মধ্যকার সম্পর্ক ...আমাকে সেক্সপিয়েরর নাটকের কথা মনে করিয়ে দেয়। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ...
লেখার দৈর্ঘ্য দেখে ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু শুরু করার পর এক নিঃশ্বাসে শেষ হয়ে গেল। অতি অসাধারন !
~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~
মুগ্ধতা। আপনার অনুভব ভেতরটাকে স্পর্শ করে গেলো।
কর্নেল তাহেরের জীবনী বইটা, ক্রাচের কর্নেল, মনে পড়ে গেলো। কীভাবে তাজউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের পরে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে গিয়েছিলেন, আর কীভাবে চাটুকারদের কর্ডনে আটকা পড়া বঙ্গবন্ধু চিনতে ভুল করেছিলেন সত্যিকার বন্ধুদের।
আসলেই, এই দুজন মানুষের মাঝে আর ক'টা কথা যদি বেশি বলা হোত, আমাদের দেশটার ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হোত অনেকখানি।
আরেকজন প্রিয় লেখক পেলাম
নতুন মন্তব্য করুন