এ ও সে ও : ০১ রঙের পৃথিবী

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: শনি, ১৭/০৯/২০১১ - ৮:৩২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

: পৃথিবীর সাথে আমার সম্পর্কটা অভিমানের।
: তোমার নিজের কথা বলছো?
: হ্যা। আমারই।
: আগে অন্য কারো মুখে একথা শুনেছি বোধহয়।
: শুনতে পারো। আমার অনেক কথাই আমি অন্যের কাছে প্রথম শুনেছি।
বাজার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু এ বাজারে সওদা করার কিস্যু নেই...
এইতো সেদিন মীর্জা গালিব বিড়বিড় করতে করতে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হাতে অভিমানের সরাব। ভঙ্গীতে বিষন্নতা। অষ্ফুট স্বরে বেজে ওঠা শব্দগুলো শুনে আকাশ থেকে চাঁদের কান্নারা ঝরে ঝরে পড়ছিল। জমিনে নেমে আসার পর কান্নার ফোটাগুলো জঁমাট বেঁধে উঠেছিল। হৃদপিণ্ডের গভীরে যেমন রক্ত জঁমাট বাঁধে। ঝিনুকের খোলে যেমন মুক্তোদানা বড় হয়। কিন্তু কেউ দেখে না। গালিব বিড়বিড় করতে করতে যে শব্দগুলো বলছিলেন তা আসলে আমারই কথা।
মাঝে মাঝেই এরকম কত কত কথা নিঃশ্বাসের সাথে ভাবনার মধ্যে উঠে আসে। পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আমারতো প্রায়ই মনে হয়- এই যে বিশাল জনপদ, সত্যিই এখানে কোন মানুষ নেই। কেবল মানুষের মতো দেখতে অনেক প্রাণী চড়ে বেড়াচ্ছে। মীরের গজলের খাতায় দেখি- ঠিক তাই। ইয়ে আদম নেহী হ্যায়, সুরৎ এ আদম বহুৎ হ্যায় ইহাঁ ... একইতো কথা হলো, তাই না? জীবনানন্দ দাশের কবিতার খাতা খুললে - পাতা জুড়ে শুধুমাত্র আমারই অনুভূতি। শব্দগুলো খালি জীবনানন্দের।
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমি কথাগুলো বলি।
নীল জলে ঢেউগুলো সাতার কাটতে কাটতে তীরের দিকে এগিয়ে আসছে। নেচে নেচে লাফিয়ে উঠা ঢেউগুলোর ডগায় সাদা সাদা ফেনা বাতাসের বুড়বুড়ি তুলে ফুসে উঠে আবার ভেঙে পড়ছে - মানব জনমের শত সহস্র আশা যেমন করে জেগে উঠে আবার তিক্ত মৌনতায় আছড়ে পড়ে, অনেকটা সেইরকম করে। একটা অ্যালবাট্রস সাদা স্বপ্নের মত দূর আকাশ দিয়ে চক্রাকারে মাথার উপরে উড়ে বেড়াচ্ছে। সমুদ্রের ঢেউগুলো বালুগুলো ভিজিয়ে দিয়ে -আবার ফিরে যাচ্ছে।
এই ভেজাবালুর উপরে বসে আমরা কথা বলছি।
আমরা মানে আমি আর আমি। প্রায়ই এরকম হয় আমার। এই আমিটাই অনেকগুলো টুকরোয়- টুকরো টুকরো হয়ে যাই। স্মৃতি আর চিন্তাগুলো আলাদা আলাদা হয়ে নিজেরা নিজেদের সাথে কথা বলতে শুরু করে। কখন যে এক হয়ে আবার একলা আমি হয়ে যাই, টেরও পাই না। এই সময় খামোকা খামোকাই চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আসে।
চোখ বন্ধ। তবু নোনা বাতাস আর একটানা গর্জনের মধ্যে সমুদ্রটা দেখতে পাই। কি বিশাল এই সমুদ্র।
চোখ খুলে সমুদ্রটাকে এবার দেখি। একটু আগে মনের মধ্যে দেখা সমুদ্রটার সাথে মিলিয়ে নি। ভাল লাগে। অনেক ঝকঝকে চারদিক। ঢেউগুলো- মাথায় রোদ পড়ে চকচক করছে। সোনা আর রূপালী সুতায় বোনা নীলরঙের একটা নক্সী কাঁথা যেন। দিগন্তে কালো কালো বিন্দুর মত কয়েকটা ছোট্ট নৌকা, ঢেউয়ে ঢেউয়ে একবার সমুদ্রের তলে তলিয়ে যাচ্ছে আবার ভেসে উঠছে। মানুষের কি অসীম সাহস! ভাবতেই - বুকের মধ্যে শীত শীত লাগে। কলম্বাস এক একটা ।
সামান্য কাঠের একটা জাহাজে চেপে অচিন একটা দেশ আবিষ্কার করার জন্য এই বিশাল সমুদ্র পাড়ি দেয়া! বাপরে!! কেমন করে যে পাড়ি দেয় !!!
আমি সমুদ্রের দিকে একমনে তাকিয়ে ত্রিস্টোফার কলম্বাসের জাহাজটা দেখি।
ঢেউয়ের তালে তালে শান্তা মারিয়া নামের জাহাজটা কলার মোচার খোলের মত - নেচে চলেছে। আগে পিছে আরো দুটি জাহাজ।
সান্তা মারিয়ার ডেকের খোলাপ্রান্তটায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। একাকী। সময়ের ঝাপটা সহ্য করে টিকে থাকা প্রাচীন জমিদার বাড়ির দেয়াল থেকে যেমন একটা কাঠিন্য ঠিকরে বেড়ায়- ঠিক তেমনি এক দৃঢ়তা কলম্বাসের শরীর জুড়ে বর্মের মত জড়িয়ে ধরে আছে। একটা বিশাল নীল তিমি একটু দূরত্ব বজায় রেখে জাহাজটার সাথে সাথে যাচ্ছে। একদৃষ্টিতে তিমিটার দিকে তাকিয়ে আছেন কলম্বাস। তিমিটার দিকে তাকিয়ে আছেন ঠিকই, কিন্তু আসলে তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। তার চোখজোড়া ভাল করে খেয়াল করলে বোঝা যায় - কাঠিন্যের আকাশে সন্ধ্যাতারার মত একটা স্বপ্ন সেখানে জ্বলজ্বল করছে। এক খণ্ড মেঘ এসে তারাটাকে ঢেকে দিয়ে যায়।
: ২৪ ঘন্টা। আর ২৪টা ঘন্টা ...
নাবিকদের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর কলম্বাস স্পষ্ট কানে শুনতে পান।
: এর একটা ঘন্টাও বেশি না...
ওদের কেউ কেউতো আরো মারমুখো। পারলে তাকে মেরেই ফেলে আরকি। এসব তিনি পরোয়া করেন না। কিন্তু জড়ো হওয়া ক্রুদ্ধ নাবিকদের মধ্যে একজোড়া চোখ তাকে থামিয়ে দিয়েছিল। সেই চোখজোড়া মনে করে কলম্বাস শিউরে ওঠেন। একটা শীতল হীমস্রোত তার মেরুদন্ড বেয়ে বয়ে যায়। ঐ চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট কলম্বাস দেকিতে পেয়েছিলেন- লোকটা তাকে পাগল ভাবছে। কলম্বাস আর কথা বলতে পারেন নি। উল্টো তাদের সব কথা মেনে নিয়েছেন। আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে তীরের কোন সন্ধান না পেলে তারা জাহাজ ঘুরিয়ে দেবে।
তারপর জাহাজ নিয়ে তারা ফিরে যাবে নিজের দেশে।
কলম্বাসের স্বপ্নও ওদের সাথে সাথে ফিরে যাবে। কলম্বাস দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়েন।
সমুদ্র পাড়ি দিয়ে একটা অজানা দেশ আবিষ্কার করার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি শৈশব থেকেই। সেই ১৯ বছর বয়স থেকেই তিনি সাগর ময় ছুটে বেড়াচ্ছেন। এবার ৯০ জন সাহসী নাবিকের একটা দল তিনটি জাহাজে চেপে তার স্বপ্নের সারথী হয়েছে। এবারের যাত্রাটা যেন অন্যরকম। দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। অথৈ সমুদ্রের মধ্য দিয়ে একটানা যাত্রা। কিন্তু কলম্বাসের সেই অচিনদেশের কোন চিহ্নই এতদিনে মিললো না। কলম্বাসের স্বপ্ন এখনও মরে নি। কিন্তু দিনে দিনে অন্য সবার কাছে ঐ স্বপ্ন হয়ে উঠেছে অসম্ভব। অ¯ম্ভব থেকে অবাস্তব। অবাস্তব থেকে অলীক।
: ওরা এখন আমাকে পাগল ভাবতে শুরু করেছে। আসলে কি আমি পাগল? এই স্বপ্ন কি পাগলামী? কিন্তু আমি তো তা মনে করি না। আমিতো বিশ্বাস করি- নিশ্চয় এই সমুদ্রর শেষে নিশ্চয়ই আছে সেই দেশ...
কলম্বাস এ কথাগুলোই বলছিলেন নিজেকে নিজে। কথাগুলো ঘিরে ঢেউয়ের লুটোপুটি আর একটানা বাতাসের শব্দ - একটা রাগিনী সঙ্গীতের মতো বেজেই চলেছে... যা মনে হয়, কোনদিনও শেষ হবে না।
: ওদের আর কি দোষ। সুদীর্ঘ স্বপ্ন নিয়ে সবাই বেঁচে থাকে না। আমাকে না হয় আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।
শব্দগুলো নিরীহ, শান্ত, কোমল। কিন্তু এর পেছনে যে অসম্ভব হতাশা, ক্ষুদ্ধতা, নৈরাশ্য ও কান্না খেলা করছে- তা সমুদ্রের চেয়েও এত বিশাল আর গভীর যে আমাদের এই পৃথিবীও সেটা ধরে রাখতে পারে না।
সেই একই অভিমান। মানুষের প্রতি। পৃথিবীর প্রতি।
কলম্বাস অবশ্য জানেন না - কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা সবুজ গাছের ভাঙা ডাল জাহাজটার পাশ দিয়ে ভেসে যাবে। নাবিকেরা উল্লাসে মেতে উঠবে ডাঙার নেশায়। নিশ্চুপ কলম্বাস তখন আরও শান্ত ,আরও স্থির চোখে নিরীহ ডালটির দিকে তাকিয়ে ভাববেন- ‘আমার স্বপ্ন পূরণ হলো।’
সেই ডালটার দিকে তিনি আরও ভাল করে তাকাবেন, দেখবেন- ডালের মধ্যে একটা ইতিহাস ভেসে চলেছে। নিয়তি চিহ্ণের মতন।
সেই চিহ্ণ ধরে রেড ইন্ডিয়ানদের রক্তের উপর শেতাঙ্গ উপনিবেশ গড়ে উঠবে, সেই শেতাঙ্গ বংশধরদের একটা দল এই দখলকৃত ভূমিকে আর উপনিবেশ নয় - তাদের নিজেদেরই দেশ বলে ঘোষণা করবে। দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে দেশটা এগিয়ে যাবে নতুন পথে, ব্যক্তিগত মানুষের স্বাধীনতার গল্প সেখানে জঁমাট বাধবে, হিরোশিমা আর নাগাসাকি ঝলসে উঠবে পোড়া মানুষের গন্ধে, আকাশের মায়াবী চাঁদে মানুষ পা দেবে, ভিয়েতনামে আগুন জ্বলবে। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে নিগৃহীত একক মানুষের চিন্তার মুক্তির স্বপ্ন হয়ে উঠবে আবার সুদূর মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন জনপদে বোমা পড়বে বৃষ্টির মত। আফগানিস্তানের পাথুরে উপত্যকা মানুষ বিহীন বোমারু বিমান থেকে ছোড়া মারণাস্ত্রের আঘাতে পোড়া বারুদের গন্ধে ভরে উঠবে... আর মৃত্যু, মৃত্যু, মৃত্যু।
সৃষ্টির অভিযান মানুষের বিশ্বাসকে পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যায়। কিন্তু সেই সৃষ্টির হাত ধরেই যখন মানুষের মৃত্যু, ধ্বংশ আর বিনাশ আসে- তখন কোন বিশ্বাসকে, কি করে ধরে রাখবে সে?
তীব্র অভিমানে সমস্ত বিশ্বাস, রোদের মধ্যে- টলোমলো বালকের হাত থেকে খসে পড়া আইসক্রীমের টুকরোটার মত গলে পড়তে থাকে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন - মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। এরপরও- যদি কখনও বিশ্বাস হারিয়ে যায়, তখন কী হয়?
অন্ধকার নামে। অন্ধকার অন্ধকার অন্ধকার। মৃত্যুর মত।
এইতো মহাকবি গ্যোটে শুয়ে আছেন। জীবনের অন্তিম মুহূর্তের জন্য তার এই অপেক্ষা। মৃত্যু দু-বাহু মেলে নাচতে নাচতে তার কাছাকাছি চলে এসেছে। প্রায় নিঃশেষিত শক্তিটুকু জড়ো করে শেষবারের জন্য তার ঠোঁটজোড়া কেপে ওঠে -‘আলো - এত আলো’। অথচ অন্য সবার চোখে তখন জঁমাট অন্ধকার। আমি এই অন্ধকারে বসে কল্পনা উড়াই, স্বপ্ন বুনি ইচ্ছের সুতোয়, অভিমানের অশ্র“বিন্দু হীরকখণ্ডের মতো ঝকমক করে ওঠে। দুই মলাটের ভেতরের চাঁদের পৃথিবী হেসে ওঠে। আর সেই হাসির শব্দে ঝরে পড়ে স্মৃতি।
আহা! স্মৃতি। এতগুলো বছর। দীর্ঘদিন আলগোছে পড়ে থাকা বইয়ের মলাটে জমে থাকা ধূলোকণার মত বিন্দু বিন্দু সময়গুলো এক ফুঁয়ে উড়ে বেড়ায়। তার উপর দুধে ভেজানো চিতই পিঠের মত চাঁদের আলো পড়লে কণাগুলো কথা বলে ওঠে। আমি কণাগুলোর উপর চোখ রেখে চমকে উঠি। কণাগুলো আসলে- সময়ের বিন্দু নয়, মানুষের মুখ। সময় মানেই মানুষ। মানুষের স্মৃতি।
আমি জানি স্মৃতির সত্য বাস্তবের পৃথিবীতে থাকে না। ছোট্টবেলার খেলনা গাড়ির লাল টুকটুকে রঙটা আমার মনেই কেবল জেগে আছে-ঐ রঙটার অস্তিত্ব পৃথিবীতে আর নেই। তবু স্মৃতির সত্যটা আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে হয়। সেই মুখগুলোর দিকে ভাল করে চেয়ে দেখি।
খুব চেনা চেনা মনে হয় ওদের। তবুও চিনে উঠতে একটু সময় নেয় ওরা। তারপর একে একে সবাই কোলাহল করে ওঠে। ভুলে যাওয়া সব পরিচিত মুখগুলো আমাকে জড়িয়ে ধরতে চায়। প্রথম স্কুলে যাবার দিনে প্রথমবার ফেল- সুমন চট্টোপধ্যায়ের গানের মত কৈশোর আর বালকবেলা বাজনা বাজায়। এইসব স্মৃতির মুখগুলোর মধ্যে আমি হেঁটে বেড়াই আর মনে করার চেষ্টা করি - স্মৃতির প্রথম বন্ধু ... জীবনের প্রথম বন্ধুর কথা। কে ছিল সে... কেমন ছিল ও? একটা হতবিহ্বল শূন্যতা শুধু খেলা করে। ঝরা পাতার মত দিনের পর দিন, ব্যস্ততার পর ব্যস্ততা জমা হয়ে ওর মুখ ঢেকে ফেলেছে। ওকে আর মনে পড়ে না কিছুতেই। আমি অস্থির হয়ে উঠি। মনে হয় কি জানি হারিয়ে ফেলেছি। শূন্য শূন্য লাগে। ওকে খুঁজে পাবার জন্য হন্যে হয়ে উঠি।
বিস্মৃতির ধূঁসর সীমানায় লুকোচুরি লুকোচুরি খেলা করতে করতে এইতো- হারিয়ে যাওয়া সময় বেয়ে সে আসছে। লাল সাদা একটা খেলনা রাইফেল কাঁধে ছোট্ট পা ফেলে ফেলে কাছে এসে বড় বড় ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে থাকে সে আমার দিকে। কোন কথা বলে না। শুধু বন্ধুত্বের একটা নিষ্পাপ হাসি চারদিকে আলো ছড়ায় । কোন শব্দ নেই। দুজনের মধ্যেকার সমস্ত শব্দ বর্তমান আর আগামীর ভাবনার ফেরেববাজিতে তলিয়ে গেছে। তাতে কি, স্মৃতির এইটুকু প্রসন্ন নীরবতাও কত কথাই না বলে যায়।
ওরা আসতে থাকে, একে - একে। কত নাম, না বলা কত স্মৃতির উচ্চারণ। কুয়াশার মতো বিস্মৃতির আলোয়ান গায়ে চড়িয়ে আরও কারা যেন স্মৃতির প্রান্তরে হেঁটে আসছে- ঠিক চেনা যাচ্ছে না।
স্মৃতির চাঁদ আরও উজ্জ্বল হয়ে যখন সেই শেষ বিকেলের মতো কোমল আলো ছড়ায়- ও এসে দাঁড়ালো। জানি না কেন, আমার দিকে তাকিয়ে ওর সে কি হাসি। সেই হাসি সারা সন্ধ্যা বুকের ভেতর ওঁম ছড়ায় - পড়া ভুলে বর্ণমালা খাতায় লুকিয়ে লুকিয়ে -‘রানু’র নাম লিখি পাতাভর্তি করে। র, া, ন, ু, র, া, ন, ু ...অক্ষরগুলোকে কি যে আপন মনে হয়। নাম ভর্তি পাতাটা বুকের মধ্যে নিয়ে বসে থাকি। পাতা জুড়ে কি মিষ্টি যে একটা গন্ধ! গন্ধটা রানুর নাম থেকে আসছে মনে হয়।
সেই থেকে প্রতিদিন যে ঘুড়ি উড়ানো দেখার বিকেল - তাও রানুর জন্য বাঁধা হয়ে গেল।
‘হিউম্যান ডাক্তার, ও হিউম্যান ডাক্তার- কই গেলে হে’ - দাদুর মিষ্টি গলা শুনতে পাই।
‘মৌলভি, একটু দাঁড়াও। আসছি।’ - বন্ধুর জন্য বন্ধুর উত্তর ভেসে আসে।
মহকুমা শহরের সরকারী হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত ইসলাম ধর্ম শিক্ষক দাদু আর তার ব্রাহ্মন বন্ধু পুরনো কালের এল এম এফ ডাক্তার শশীভূষণ চক্রবর্তী- আমাদের শশী দাদু, রানুর শুধুই - দাদু। প্রতিদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা, সাদা সফেদ পাজামা পাঞ্জাবী আর সাদা শুভ্র রঙের ধূতি আর হাওয়াই শার্ট উড়িয়ে দুজনে টুকটুক করে হাঁটবেন আর কথা বলতে থাকবেন।
ছোটবেলায় শরীরের একটু এদিক ওদিক হলেই শশী দাদুর কাছে যেতে হতো। কপাল, জিব আর নাড়ি -দেখে শুনে টিপে টেনে- কাঠ রঙের আলমারীটার কাঁচের দেরাজ খুলে ওষুধ বের করে বলতেন - একটু হা করতো দেখি। ওষুধ মানে সেই একই সিরাপ, প্রতিবার। কালো লালচে লাল রঙের রঙ, সাদা বোতলে মোড়া। বিদঘুটে কড়া তেতো ওষুধটা যখন গলা বেয়ে বুকের ভেতরে নেমে আসতো তখনো আসলে আমি উড়ছি। রানুকে যদি একটু দেখা যায়...
এক শেষ বিকেলের কথা মনে পড়ে।
পুষ্পদি- বিনুদির সই। দু’জন দু’জনের হাতে রাখি বেঁধে সই পাতিয়েছিল ওরা। রাখি বাঁধা সম্পর্ক নাকি কোনদিন শেষ হয় না। বিনুদির হাত ধরে পুস্পদির ঘরে গিয়েছি। ওটা রানুরও ঘর ছিল। পুষ্পদি- রানুর বড়বোন। পুষ্পদি নেই। পুষ্পদির খোজে বিনুদিও উধাও। আমি ঠাই একা দাঁড়িয়ে থাকি। কি ঠাণ্ডা লাল একটা মেঝে ওদের ঘরটায়। আড়চোখে চেয়ে দেখি, সেই লালের মধ্যে রানু ভাসছে। শাপলা ফুলের মত। ওর ঝলমলে হাতে একটা বই ফড়িংয়ের মত বসে আছে। বইটার হলুদ রঙের মলাটে লাল মোটা মোটা অক্ষরে লেখা - মার্চেন্ট অব ভেনিস। আমি অবাক হয়ে রানুর দিকে তাকিয়ে থাকি। আর কিছু মাথায় থাকে না।
ফেরার পথে বিনুদির বকুনিতে কান ঝা ঝা করে। তুই এত ভ্যাবলা কেন রে? আমি মাথা নিচু করে হাঁটতে গিয়ে দেখি একটা শুয়োপোকা রোম ফুলিয়ে ফুলিয়ে কোথায় জানি যাচ্ছে। পাশের বাড়ির দারোয়ান চাচা একবার বলছিল শুয়োপোকা নাকি বুড়ো হলে প্রজাপতি হয়। কেমন কথা শোন। একটা বোয়্যেমে শুয়োপোকা ধরে ভরে রাখতে হবে। প্রজাপতি হলে তারপর গিয়ে রানুকে দেখাবো। বিনুদিকে বলা যাবে না। বিনুদি জানলে ঠিক রাগ করবে। অবশ্য রাগ করলেও বা কি- হু কেয়ার্স ?
অঙ্ক কষার নাম করে একটা সাদা পাতা চোখের সামনে রেখে আমি ভাবি।
আমার বুক পকেটের একটায় সাহসের সিংহ আর অন্যটায় সন্ত্রস্ত বিড়াল মাথা দুলাচ্ছে।
একটা সাদা পাতার জীবনে কত কিছু হবার থাকে .. মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়।
কতবার রানু এসে চোখ জুড়ে বসেছে আর আমাকে সারারাত ঘুমুতে দেয় নি। এইজন্য তাকে একটু বকে দিয়ে চিঠি দেবো ভাবছি - কিন্তু বিড়ালটা গুটিশুটি মেরেই থাকে। বিনুদি ততক্ষণে গটগটিয়ে আসে। তারজন্য মনে মনে সিংহটাকে রেডি করে রাখি। কিন্তু তার আগেই সে হাঙরের দাঁত দেখিয়ে চলে যায়। আমি সাদা কাগজটায় তাকাতেই দেখি - নয়ের ঘরের নামতা ইদুরের মত দাঁত বের করে কেলিয়ে কেলিয়ে হাসছে।
এইভাবে আমরা বড় হয়ে যাই।
আমাদের বড় হয়ে যাওয়ার নীরব রাস্তায় রানুর উজ্জ্বল মূর্তি ম্লান হয়ে আসে। রানুকে সরিয়ে অন্য এক মুখ আবছায়াময় আলো অন্ধকারে উঁকি মারে। মাথার মধ্যে ‘তুলি... তুলি’ শব্দের ঘূর্ণি ওঠে। সেই ঘূর্ণিতে আমি আমাকে দেখি। স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণ পরপর বসিয়ে শব্দ লেখার পর্ব শেষ হয়ে গেছে। এখন শব্দের পর শব্দ বসিয়ে বাক্য বানিয়ে অনুশীলন খাতার পাতা ভর্তি করা আর সারাদিন টুকটুক করে হেঁটে বেড়ানোই হলো কাজ। হাঁটতে হাঁটতে কখনও চোখের নাগালের বাইরে একটু বেশি সময় বয়ে গেলেই বড়রা চমকে উঠে। এটা সেই সময়ের গল্প। দুটো বাসা পরেই থাকতো ছোট্ট একটা মেয়ে। ওর নাম তুলি। একদিন ও দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। আমি গিয়ে ওর পাশে দাঁড়াই। কেন যে ওর হাত ধরি, কী ভেবে মনে পড়ে না। কিন্তু হাতে হাতটা রাখতেই তুলি বড়দের মত লাল হয়ে উঠে। আমি লজ্জা পেয়ে হাতটা ছেড়ে দেই। কিন্তু হাতের মধ্যে কিসের একটা স্পর্শ লেগে থাকে। আমি একটা সাদা পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে লিখি
তুলি - আমার বউ
কী বুঝে কে জানে। আসলে ঠিকমতো না বুঝেই। তুলিকে নিয়ে আর কোন স্মৃতি ঢেউ তোলে না। ও যেন ছিল স্মৃতির একটানা ঢেউয়ের মধ্যে উচুঁ একটা ঢেউ। কিন্তু ঢেউটা মিলে যায় পরের ঢেউয়ে, আলাদা করে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বিস্মৃতি ওর পাশে হাটু গেড়ে বসে হাত বাড়ায় রানুুর দিকে। ততদিনে দাদু, শশী দাদু দুজনেই মরে গেছে আর আমাদের শহর ছেড়ে রানুরা চলে গেছে অনেক দূরের কলকাতা শহরে। সুতো কাটা ঘুড়ির মত উড়তে উড়তে চোখের আড়ালে অন্য এক দেশে হারিয়ে গেছে।
কিন্তু মানুষ কি সবকিছু হারায়? এই যে মনে পড়ে রানুদের বাসায় জীবনের প্রথম কোকাকোলার স্বাদ। কি ঝাঁঝ। গলা দিয়ে নেমে আসতে থাকে বুক পর্যন্ত। এর আগে ফান্টা পর্যšতই ছিল দৌড়। বড়দের কোকাকোলার নিষিদ্ধ আনন্দের জ্বলুনীতেই আমি যেন বড় হয়ে যাই। রানুর কোকাকোলা- আমাকে ফাঁদে ফেলে আবার যেন উড়িয়ে নিল।
বন বন বন।
দুপায়ে যত জোর আছে সব প্যাডেলের উপর। আর সাইকেলটা উড়ছে। রা¯তার দুপাশে রঙীন রঙীন সব মেয়েরা সরে সরে যায়। প্রত্যেকটি দিনই কি উত্তেজনাকর, কি রোমাঞ্চকর।
আহা!
অক্ষরে অক্ষরে কত শব্দ ...কত তরঙ্গ... কত বর্ণ... কত গন্ধ।
আমরা মলাটের ভেতরে বসে টের পাই- তার কিছু অক্ষর কিছু ধ্বনির মত বেজে ওঠে, কিছু অক্ষর সুরেলা- কান পাতলেই টের পাওয়া যায়, কিছু অক্ষর যেন সুগন্ধী আতর- চারদিক মৌ মৌ করে, তার কিছু অক্ষর রঙে রঙে বোনা - চোখ আর ফেরানোই যায় না ...
ছোট্ট বেলায় জানালার ঘুলঘুলিতে একবার একজোড়া চড়াই বাসা বানিয়েছিল। একদিন তাদের কি চাঞ্চল্য - তাদের খঁড়কুটো দিয়ে তৈরী বাসা থেকে চি চি মিহি কতকগুলো গলা ভেসে আসছে। বিনুদির মুখ হাসিতে ভরে উঠে। চড়াইগুলোর বাচ্চা ফুটেছে। সারাক্ষণ - কখনো বাবা চড়াই, কখনো মা চড়াই- উড়ে যাচ্ছে তো এই উড়ে আসছে, কি উৎসব তাদের চোখে মুখে। হটাৎ এক দুপুরে সেই বাচ্চাগুলোর একটা বাচ্চা ঘর থেকে পড়ে বেতের সোফার উপর গোল হয়ে থাকে। আহ্ কি তুলতুলে তার শরীর। কোত্থেকে ভাইয়া এসে ছো মেরে সেটিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে কি লাফালাফি। বিনুদি চিৎকার করে ওঠে ... আহা চড়াই পাখির বাচ্চাটা - দেখো দেখো কেমন অসহায় চোখ করে তাকিয়ে আছে - ভয়ে কি রকম কাপছে । দস্যি ছেলেটা, ছেড়ে দে ওকে, ছেড়ে দে বলছি ... ঘরময় দাপিয়ে বেড়ায় বিনুদি। ভাইয়া কি আর ছাড়ে? কিছুটা সময়, আমোদ জাগিয়ে ও মরে গেলে - বিনুদির সে কি কান্না!
বিনুদি বোধহয় কোনদিন সেই চড়াই- ছানাটাকে ভুলতে পারে নি। এক ঈদে বাবা বিনুদির জন্য কালচে খয়েরী আর ছাই ছাই মিশেল রঙের একটা জামা কিনে এনে দিয়েছিলেন, বিনুদি জামাটা কিছুতেই পড়বে না। পরে এক সন্ধ্যের ভূতুড়ে অন্ধকারে বিনুদি ফিসফিস করে বলছিল- জামার রঙটা নাকি সেই চড়াই ছানার পালকের রঙ দিয়ে তৈরী। এরপর থেকে আমার খয়েরী- ছাই এর মিশেল কোন রঙ দেখলেই অসহায় চড়–ইটার কথা মনে হত। মৃত্যুর কথা মনে হতো। বিনুদি কি যে মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে ছাই- আমি সবকিছুর রঙ খুঁজি। সবকিছুতে রঙ দেখি।
দস্যিপানার রঙ শ্যামলা। আমার বড় ভাইয়ের রঙ। সারাদিন টই টই। আকাশ মেঘে কালো কিংবা রোদে ঝলসানো - কি যায় আসে- দূরন্ত গতিতে সে ছুটছে কেবলি ছুটছে।
উদাসীনতার রঙ কালো - সে রঙ আমার বাবার। অফিস থেকে বাসায় ফিরেই বাবা মোটা কোরআন শরীফের সবুজ রঙের পাতায় ডুবে যান। বাবার কণ্ঠে পবিত্র সুরার সুরেলা শব্দ - আমাদের চারপাশে এই পঞ্চইন্দ্রিয়ের বলয়ের বাইরে থেকে অলৌকিক এক সুবাস ডেকে নিয়ে আসে। প্রতিদিন সেই সুবাসের মধ্যে আমার মা গভীর মমতায় সংসার আগলে রাখেন। মায়ের কারণেই আমার সব মেয়েদের - গাছের মতো মনে হয়। শেকড় ছড়াতে থাকে মাটির গভীরে, আরো গভীরে। ছোট্ট এক টুকরো জায়গায় কি অপরিসীম ধৈর্য্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে গোটা জীবন। গৌতম বুদ্ধের মূর্তির মত।
সেই থেকে ধৈর্য্য আর গভীরতার রঙ মায়ের মুখের রঙের সাথে মিলে লালচে ফর্সা।
ঐ যে চোখ রাঙাতে রাঙাতে গাড়ো খয়েরী রঙ আসছে। প্রাইমারী স্কুলের ডাকসাইটে শিক্ষক জলিল স্যারের পাঞ্জাবীর আড়াল থেকে খয়েরী বেতখানা ছপাং ছপাং শব্দ তোলে। আমাদের বুক শুকিয়ে কাঠ। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দে নিজেই কেঁপে কেপে উঠছি। তার চোখজোড়া বুকের মধ্যে এমন ধুকপুকোনী তোলে! যে দুষ্টুমী করাই হয়ে ওঠেনি সেগুলো পর্যšত দৌঁড়ে দৌঁড়ে কোথায় যেন পালায়।
নূর হোসেন। ১৯৮৭’র মিছিলে এই ফেটে পড়া রাগী চোখের কোমল যুবকের বুকে সাদা রঙে লেখা ছিল গণতন্ত্র মুক্তি পাক। বুকের উল্টা পিঠে - স্বৈরাচার নিপাত যাক। নাকি উল্টো বলছি। বুকে লেখা ছিল - স্বৈরাচার নিপাত যাক। পিঠে - গণতন্ত্র মুক্তি পাক। চোখে পুরো শরীরটাই ভাসে। কি টান টান। সাদা রঙ যে জ্বলে এর আগে দেখি নি। সেই থেকে দ্রোহের রঙ সাদা। শান্তির জন্য দ্রোহ। কিন্তু কোত্থেকে একটা লাল এসে ঝামেলা পাকাচ্ছে। একটা রক্তের ধারা। চোখটা বুজে এসেছে, একটা নিথর দেহ। ঘুমুবে বুঝি। তোরা আপোস করিস না- এই বলে সে চলে যায় ঘুমুতে। লালটা থেকে যায়। লাল তো লাল নয়, লাল হলো জীবন। তুমি বেঁচে ছিলে - ঐ লাল বুঝি তাই বলে যায়।
ছটফটে হলুদ এলো মন ভুলাতে। রানু আজকে একটা হলুদ ফ্রক পড়েছে। পোষাকের ঐ হলুদটাই চোখে লেগে আছে । ভাবছি কেমন দেখাচ্ছে ওকে। একটা দুষ্টু প্রজাপতি বলা যেতে পারে। সেখানে তাকালেই মনের মধ্যে একটা আনন্দের শিহরণ জাগে। গাছের সবুজ ডালে ডালে প্রজাপতি হয়ে ফরফর শব্দে যদি ও উড়ে বেড়াত, কেমন দেখাতো ওকে? তারপর আলতো করে আমাদের ছাদের টবে আকাশের তারার মত ফুটে থাকা বেলী ফুলগুলোর উপর এসে নামতো...। সেই থেকে হলুদ প্রেমে পড়ার রঙ।
সেই রঙ বুকের ভেতরে চেপে ধরে দাদুর সোনালী রঙের ঘড়িতে সময় গুনি।
সময়ের রঙ সেই থেকে সোনালী।
সোনালী রঙ ধরে ধরে কখন যে আমরা বড় হয়ে যাই।

এ ও সে ও - ০১


মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

শুরু আর শেষ টা বেশ অন্য মনে হল, কিছু কিছু জায়গা মন ছুয়ে যায় আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

তানিম এহসান এর ছবি

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোথা থেকে কোথা চলে যাওয়া, রানু চলে যায় আবারও ফিরে আসে, মাঝখানে তুলি আসে, আসে অন্যান্য চরিত্ররা - এর মাঝে আপনার বয়ে যাওয়া জীবনের কথাগুলো একটা বিষন্ন প্রজাপতির মত উড়ে উড়ে যায়; রঙের পৃথিবী মনে হয়না, মনে হয় রঙ হারিয়ে যাওয়া কোন এক রঙের কথা বলছেন!!

তাপস শর্মা এর ছবি

ব্যাপক। চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।