অনেক, অনেক ছোটবেলার কথা । ১৯৯৪ সাল । তখন আমি বগুড়া জিলা স্কুলের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র । বাসা ছিল কানছগাড়ী নামের একটা জায়গায় । ঠিক দুষ্টের শিরোমণি লঙ্কার রাজা না হলেও একেবারে কম ছিলাম না । আশেপাশের বেশ কয়েক বাসার সমবয়সী পিচ্চিদের নিয়ে মোটামুটি একটা বড় গ্রুপ ছিল যাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এলাকার বড় মানুষদের ভাল লাগার কোন কারন ছিল না ।
এরমধ্যে হঠাৎ ঘটে গেল বেশ বড়সড় একটা বিপত্তি । আমাদের স্কুলের একজন স্যার থাকতে এলেন পাশের বাসায় । স্যারের বাসার ঠিক সামনেই আমাদের ছোট্ট খেলার মাঠ যেটা আমাদের সবকিছুর কেন্দ্রস্থল । এহেন হেডকোয়ার্টারের সাথে স্যার থাকলে তো মুশকিল । মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মত স্যারের সাথে আগে থেকেই পারিবারিক ভাবে পরিচয় ছিল আমাদের বাসার সবার । তাই আমার বিপদটা অন্যদের থেকে একটু বেশিই ।
যথারীতি কয়েকদিনের মধ্যেই স্যারের বাসায় যেতে হলো আম্মুর সাথে । বেশ ভয়ে ভয়ে বাসায় ঢুকলাম । আর তারপরেই খেলাম সবচে বড় ধাক্কা । চোখ আটকে গেল স্যারের বুক শেলফে । সারি সারি বই । এমন শত শত বই আগে কারো বাসায় দেখিনি । বসার পরিবর্তে দাঁড়িয়ে থাকলাম শেলফের সামনে । নজরটা বেশি তিন গোয়েন্দা, ওয়েস্টার্ন, কিশোর ক্লাসিকের দিকে । বের হওয়ার সময় ভয়ে ভয়ে স্যারকে বললাম যে কয়েকটা বই পড়ার জন্য নিয়ে যেতে চাই । নাহ্, স্যার আপত্তি করলেন না । সেদিন থেকেই স্যারের সাথে সম্পর্কটা হয়ে গেল অনেক সহজ । ভয় আর করতো না খুব একটা । কয়েকটা করে বই নিয়ে আসতাম, পড়া হলে ফেরত দিয়ে আবার আরো কয়েকটা নিয়ে আসতাম ।
এইভাবেই চলছিল । এরমধ্যে একদিন আম্মু সিদ্ধান্ত নিল যে স্কুলে যাওয়া আসা করবো স্যারের সাথে । আমারও খুব একটা আপত্তি ছিলনা । সেইসময়ে বাসা থেকে স্কুলের রিকশা ভাড়া ছিল দুই টাকা । প্রথম দিন রিকশা থেকে নেমে ভদ্রতা করে পকেট থেকে টাকা বের করলাম, যদিও জানতাম যে ভাড়াটা স্যারই দিবেন । টাকা বের করতেই স্যার বলে উঠলেন -
“থাক্ তুমি দিও না । এইভাবে আট নয়বার দুই টাকা করে বাঁচালে একটা বই কিনতে পারবা ।”
স্তব্ধ হয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ । বই পড়তে ভালো লাগতো, কেউ বই কিনে দিলে ভালো লাগতো, কিন্তু দুই টাকা দুই টাকা করে বাঁচিয়ে যে নিজেই বই কেনা যায় এটা কখনো মাথায় আসেনি । সেই থেকে শুরু, এরপরে স্কুল-কলেজ জীবনটা যেভাবে যত টাকা পেয়েছি - বৃত্তির টাকা, হেঁটে হেঁটে রিকশা ভাড়া বাঁচানো টাকা, টিফিন না খেয়ে বাঁচানো টাকা - তার প্রায় সবই গেছে বই কিনতে ।
সব মানুষের জীবনেই বোধহয় একটা দুইটা ঘটনা থাকে যা জীবনটাকে পরিবর্তন করে দেয় । সেদিনের এই ছোট্ট একটা কথা আমার জীবনটাকেও পরিবর্তন করে দেয় সারাজীবনের জন্য ।
-- তাসকিনুর
মন্তব্য
একটা মন ছুঁয়ে যাওয়া ঘটনা অনাড়ম্বর ভাষায় লিখেছেন, ভাল লাগল। ওই শিক্ষকের মত লোক আরো বেশি হওয়া দরকার। আমি নিজেও ইস্কুলে বাসভাড়ার টাকা জমিয়ে জমিয়ে অনেক বই কিনতাম।
সচলে স্বাগতম।
অট: আপনাকে বইপড়ুয়া গ্রুপে দেখেছি বোধহয়।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
> আপনাকে বইপড়ুয়া গ্রুপে দেখেছি বোধহয়।
দেখতে পারেন । ওখানে মাঝে মাঝে পোস্টাই ।
সত্যি, খুব ভাল লাগল। রিকশা ভাড়া বাচিয়ে বই কেনাটা নেশা হয়ে গিয়েছিল প্রায়, কিন্তু এমন শিক্ষক ছিল না আশেপাশে--- কিন্তু শুভাকাঙ্ক্ষীরা ছিলেন বরাবরই
facebook
সচলায়তনে তোমাকে দেখে অনেক ভালো লাগলো সাজিদ। নিয়মিত লিখতে থাকো।
আপনি কী বইপড়ুয়া গ্রপের?
এমন শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা
> আপনি কী বইপড়ুয়া গ্রপের?
হুম, এই নামের একটা ফেসবুক গ্রুপের সদস্য বটে ।
পরিমলদের এই জমানায় মানুষ গড়ার সেই কারিগরেরা ফিরে আসুক।
সচলে স্বাগতম।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ
বোধের অনুরণন ভালো লাগলো।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
আমার এক শিক্ষকের কথা মনে পড়ে গেল। উনি ক্লাশ এ- প্রায়ই পাঠ্যপড়ার বদলে জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়াতেন...
পরিমলরা যা নষ্ট করেছে, সেই ভক্তি ফিরে আসবে এরকম ঘটনার সংখ্যা বাড়তে থাকলে। আপনার শিক্ষককে শ্রদ্ধা।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
নতুন মন্তব্য করুন