ধলপহরের উজ্জল কমলারঙা সূর্যরশ্মির প্রখরতায় আঁধার ক্রমশ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে যাত্রাপথ থেকে, আলোর বন্যায় ভাসছে চারিদিক, গাড়ির শক্তিশালী ইঞ্জিনের আওয়াজ এড়িয়ে কানে আসছে পাখ-পাখালির জেগে ওঠার আভাস, জেগে উঠছে একে একে আমার সহযাত্রীরাও।
মধ্যরাতে বাল্টিক সাগর তীরের ক্ষুদে দেশ এস্তোনিয়ার রাজধানী তাল্লিন থেকে রওনা হয়ে সারারাত অনেক কাপ কফির সাহায্যে ঘুম তাড়িয়ে একটানা গাড়ীতে বাল্টিকের দুই দেশ এস্তোনিয়া, লাটভিয়া পাড়ি দিয়ে এখন লিথূয়ানিয়াতে। গন্তব্য উত্তর লিথূয়ানিয়ার সিউলাই শহরের ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিশ্বের বুকে একমেবাদ্বিতীয়ম এক স্থান, যাত্রাপথের চমক হিসেবে তখনো জানানো হয় নি অন্যদের এই সম্পর্কে। কাজেই পার্কিং-এ যখন পৌঁছালাম অন্য তিন সহযাত্রী সিপু ভাই, অপু, হামিদুল সদ্য ঘুমভাঙ্গা চোখ রগড়াতে রগড়াতে একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল হাঁ হয়ে, গাইড বইয়ের সৌজন্যে এর ছবি অনেকবার দেখা হলেও আমিও অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রয়লাম বিশ্বের বিস্ময়, ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের সদস্য লিথূয়ানিয়ার পবিত্র ক্রুশের পাহাড়ের পানে।
সে এক অবাক করা জায়গা, উঁচু নিচু কয়েকটা টিলার সমন্বয়ে গঠিত, চারপাশে সবুজের বান আর সেই টিলাগুলোর পাদদেশ থেকে শুরু করে শীর্ষ হয়ে অপর প্রান্ত পর্যন্ত চলে গেছে ক্রুশের মিছিল! নানা আকারের, নানা বর্ণের, নানা পদার্থের- রকমারি, নকশাদার হাজার হাজার ক্রুশ।
মহাকালের ঠিক কোন পর্যায়ে এই পবিত্র ক্রুশের পাহাড়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা নিশ্চিত ভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় নি, কিন্তু ইতিহাসের ঝরে যাওয়া কিছু বিবর্ণ পাতা সাক্ষ্য দেয় এর যাত্রা সম্ভবত শুরু হয়েছিল ১৮৩১ খৃষ্টাব্দের দিকে। সেই সময়ে অসংখ্য স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী লিথূয়ানিয়ান শিকার হয়েছিলেন তৎকালীন রাশান শাসকদের দমন পীড়নের, ফলশ্রুতিতে নিহত অনেকেরই লাশ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় নি নিখোঁজদের আত্মীয়স্বজনদের পক্ষে। সেই শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যরাই সর্ব প্রথম মনের সান্তনা ও মৃতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শুরু করেন সেই পাহাড়ে ক্রুশ পুতে রাখা। ফি বছর বাড়তে থাকে দর্শনার্থী ও ক্রুশের সংখ্যা, ভিনদেশী পর্যটক আর স্বদেশী লিথূয়ানিয়ানদের কাছে এক তীর্থে পরিণত হয় এই স্থান।
কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন ঘটে ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, এর পরপরই যেহেতু লিথূয়ানিয়া পরিণত হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্রে, মস্কো থেকে পরিচালিত রাষ্ট্রযন্ত্র ধর্ম ও রাজনৈতিক কারণে বারংবার চেষ্টা চালিয়েছে ক্রুশের পাহাড়কে জনসাধারণের কাছে নিষিদ্ধ এলাকা করতে, নতুন করে ক্রুশ পোতা নিরুৎসাহিত করতে তারা তিন-তিনবার সমস্ত পাহাড়কে বুলডোজারের সাহায্যে প্রায় মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল কিন্তু স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ দেশবাসী গোপনে ঠিকই চালিয়ে যেতে থাকে তাদের কর্মকান্ড। শেষ চেষ্টা হিসেবে রাশানরা পরিকল্পনা আঁটে পার্শ্ববর্তী কুলভে নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে বিরাটাকার জলাধার তৈরির মাধ্যমে সলিল সমাধি ঘটানোর পুরো এলাকার। সেটা বাস্তবায়নের আগেই পতন ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের। আবার তীর্থভূমি হিসেবেই বিশ্বমানচিত্রে পুনরাবির্ভাব ঘটে পবিত্র ক্রুশের পাহাড়ের।
তখন থেকেই নিত্য নতুন ক্রুশে ভরে উঠতে থাকে চারপাশ। ১৯৯৩ সালে পোপ ২য় জন পল আসে এই ক্রুশ মহাতীর্থে, আর সবার মতই তার ভ্রমণের স্মৃতি হিসেবে একটি ক্রুশ স্থান পায় এইখানে। পরবর্তীতে ইউনেস্কোর বিশ্ব সম্পদ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় পবিত্র ক্রুশের পাহাড়। ধারণা করা হয় বর্তমানে লক্ষাধিক ক্রুশ আছে সেইখানে আর বছরের প্রতিদিনই এই সংখ্যা বাড়ছে ক্রমবর্ধমান হারে।
ক্রুশের পাহাড়ের পাদদেশে পৌছাতেই বিস্ময়াভুত আমরা, কিসের ক্রুশ নেই সেখানে! ইট, কাঠ, পাথর, নানা ধরণের ধাতব পদার্থ সবই উপস্থিত। সেই সাথে নানা আকারের, সব ধরনের নকশার । কোনটা হয়ত মাত্র কয়েক ইঞ্চি লম্বা, আবার কোন কোনটা ১২ ফুটেরও অধিক লম্বা। শুধু যে ক্রুশের মেলা তাও নয় যীশু আর মেরীর নানা আকারের মূর্তিও সেখানে স্থাপন করেছে ভক্তরা। দেখলাম ক্রুশের সারি এক পাহাড় থেকে চলে গেছে আরেক পাহাড়ে, এমনকি সেই প্রান্তসীমা পেরিয়ে নিচের সমভূমি পর্যন্ত।
এর মাঝেই কিছু আঁকাবাঁকা কাঠের পাটাতন বিছানো পথ তৈরি হয়েছে পরিদর্শনকারীদের জন্য। কোন কোন বৃহদাকৃতির ক্রুশের উপর ঝুলছে ছোটখাট শখানেক ক্রুশ! এত সকালেই আমাদের মত বিদেশীদের দেখে ফোকলা হাসি দিল বৃদ্ধা কেয়ারটেকার। এমন অদ্ভুত জায়গায় আসিনি এর আগে কেউই, কেমন যেন মন খারাপ করা নির্জনতায় মোড়া, গুরুগম্ভীর ভৌতিক আবহে ডুবে থাকা।
অবশেষে পবিত্র ক্রুশের পাহাড়ে অবস্থানকালীন সময়ে প্রয়াত পোপ ২য় জন পলের কথাটি স্মরণ করে লিথূয়ানিয়ান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সিউলাই শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হল আমাদের- Thank You, Lithuanians, for the hill of Crosses which testifies to the nations of Europe and to the whole world the faith of the people of this land. (ধন্যবাদ তোমাদের, লিথূয়ানিয়ানরা, এই পবিত্র ক্রুশের পাহাড়ের জন্য, যা ইউরোপের জাতি গোষ্ঠী এবং সমগ্র বিশ্বের কাছে এই ভূখণ্ডের মানুষের দৃঢ় বিশ্বাসের পরিচয় দিচ্ছে )
যদিও সেই দেশের বন্ধুদের সাথে মিশে আমার কাছে মনে হয়েছে এই ক্রুশের পাহাড় ধর্ম বিশ্বাসের চেয়ে অনেক বেশী প্রচার করে একটি জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, স্বকীয়তা নিচে বাঁচার আকুতি আর অত্যাচারিতের রুখে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা।
মন্তব্য
facebook
facebook
বিষয়টা অজানাই ছিল । মারাত্মক ব্যাপার-স্যাপার সব।
হুমম , এই জায়গাটি অতটা পরিচিতি পায় নি আমাদের অঞ্চলে। আমি প্রথম দেখেছিল এক ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের পাতায়।
facebook
ঠিক ঠিক
তারেক অণুর ই-বই চাই
তাড়া কিসের
facebook
বাব্বাহ!
facebook
উত্তম, অতি উত্তম!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
আর বলেন না ভাই, আপনার কবিতাটা পড়ার পর থেকে মাথায় কালাহারি ঢুকে গেছে---
facebook
যথারীতি ফাটিয়ে ফেলেছেন! আপনেরে ঈর্ষা করতেও ভয় লাগে!
আরে না ফাটাফাটি থেকে দূরে থাকাই মঙ্গল
facebook
ভ্রমনকাহিনী সংকলন চাই... জলদি প্রকাশ করে ফেলুন...
----------------------------------------------------------------------------------------------
"একদিন ভোর হবেই"
তেমন প্রকাশক লাগবে রে ভাই যে লেখার সমপরিমাণ ছবি দিতে রাজি হবে বইতে
facebook
এই জায়গার কথা কোনদিন শুনিনি, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আর মন্তব্য করবোনা বলেও মন্তব্য করতেই হলো! লিথুয়ানিয়ানদের উপর শ্রদ্ধা এলো!!
শুভেচ্ছা তানিম ভাই। বাল্টিকের দেশগুলোর ইতিহাস খুব অন্য ধরনের। আরে কি কথা, মন্তব্য অবশ্যই করবেন ! কেন না !!!
facebook
নতুন বিষয় জানা হল। ভাল থাকবেন।
আপনিও। ধন্যবাদ।
facebook
দূর থেকে ভীষ্মের শরশয্যার মত লাগল!
শেষ প্যারাটা দুর্দান্ত। মানুষের আবেগের দখলিস্বত্ত্ব নিয়ে নেওয়াটা এ ব্যাটারা কবে বন্ধ করবে?
ভীষ্মের শরশয্যাই মনে হত আকাশ থেকে দেখলে ।
এই দখল শেষ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম, খুবই কম। মানুষ খুব অদ্ভুত প্রাণী, সব কাজ করে নিজে কষ্ট করে কিন্তু ক্রেডিট দেয় কল্পিত কাউকে।
facebook
আপনার আগের পোস্টগুলো সম্পর্কে পূর্ব ধারণা থাকলেও এই বিষয়টা একেবারেই জানা ছিল না
মাঝে মাঝে এমন খুব বিখ্যাত না কিন্তু অন্যরকম জায়গায় যেতে ভাল লাগে, সেই থেকেই লেখা
facebook
অনেক জায়গাই আছে যেখানে যাই নি... কিন্তু কল্পনায় অচেনা মনে হয় না। এটা এমন একটা জায়গা... যার কথা আগে কখনো ভাবি নি.... কল্পনাও করিনি...
আসলেই খুব ভিন্ন ধরনের জায়গা
facebook
অনেক জায়গাই আছে যেখানে যাই নি... কিন্তু কল্পনায় অচেনা মনে হয় না। এটা এমন একটা জায়গা... যার কথা আগে কখনো ভাবি নি.... কল্পনাও করিনি...
ভালো লাগলো।
----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি
facebook
ক্রুশের ক্রুসিফিকেশন। জব্বর লাগছে , চালাইয়া যাও, কিন্তু তোমার লেটেস্ট বিচরণের সুলুক নিয়া মুখ খুলতেছ না আর ঘটনা কি?
ক্রুশের ক্রুসিফিকেশন- হা হা যা বলেছেন দাদা । দিব দিব, সেই ফ্রি কান্ট্রি থেকে আমাকে বলেছে ব্যাটা কিউবা নিয়ে একটা আসল মানে পজিটিভ লেখা দিবি তো সারা জীবনে এখানে আসার ভিসা পাবি না, গ্যাব্রিয়েল মার্কেজ কে ভিসা দিচ্ছি না কয়েক দশক, আর তুই !
দেখি হাতে বেশ কিছু লেখা জমে আছে, কাল আবার আম্মু এখানে আসবে, থাকবে কয়েক সপ্তাহ, এর ফাঁকে আপনাদের সাগর তলা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসব
facebook
অণু তোমার লিস্টে ভিক ফলস, কালাহারি, কিলিমাঞ্জারো আর ক্রুগার রেখ কিন্তু। তোমার সাগর তলের ছবি দেখার জন্যে জান বের হয়ে যাচ্ছে, হাঙ্গর-টাঙ্গর পাইছিলা দুই-একটা? আন্টির তো ভালই মজা, বেশ ভ্রমন হয়ে যাচ্ছে, আমাদের সালাম দিও।
শিরোনাম দেখে ভাবি নাই এইরকম অবাক করা একটা জায়গা দেখবো। আর বাকিটুক যদি না-ও বলি, শেষ কটা কথার জন্য ।
facebook
লিথুনিয়া্নদের কিছু গল্প জানা ছিল বটে তবে এই ক্রুশের পাহাড়ের ব্যাপারটা সম্পুর্ণই অজানা ছিল।
আপনার পোস্ট মানেই ব্যাপক জ্ঞান। ধন্যবাদ। ভাল লাগা জানিয়ে গেলাম
ওরে বাবা, তার মানে আপা কি বলতে চাইছেন নিরেট তথ্য বেশী হয়ে যাচ্ছে ! তাইলে আবার মুস্কিল।
facebook
আরে না। ধ্যুরো, তাই বললাম নাকি?! আপনার সাবলিল গল্প কথা লেখার ছলে দেওয়া তথ্যগুলো চমৎকৃত করার মত তাই-ই বললাম। কোনই মুস্কিল নয়। লিখতে থাকুন ফাটিয়ে আমরা তো বসেই আছি পড়ার জন্য
যো হুকুম ! সারপ্রাইজ আসছে আগেই বলে রাখলাম!
facebook
_____________________
Give Her Freedom!
facebook
তারেক ভাই। এইরকম কিছু যে আছে সেটাই জানতাম না।
কত অজানারে ভাই আমাদের চারিধারে--
facebook
সব সময়ের মতো । অভিজ্ঞতার বর্ণনা অনবদ্য। শেষ লাইনটি মনে বিশাল একটা দাগ কাটে।
ছবি গুলো ফাটাফাটি
ভাল থাকবেন তারেক ভাই। শুভেচ্ছা রইল।
ডাকঘর | ছবিঘর
ধন্যবাদ তাপস দা, আপনি কি বর্তমানে আগরতলায় আছেন, একবার যাবার শখ আছে সেদিকে, দেশে গেলে।
facebook
হ্যাঁ, ভাই আমি আগরতলাতেই আছি।
ত্রিপুরা আপনাকে স্বাগত জানায় তারেক ভাই
ডাকঘর | ছবিঘর
সত্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র কালের রেঁদার টান!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
রেঁদা তো নয় দাদা, পুরা ছেঁদা !
facebook
পারফেক্ট ভ্রমন-কাহিনী !
পারফেক্ট, বলছেন---
facebook
শেষ লাইনটায়
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
যাহ্, তাহলে শেষের আগের লাইনগুলো !! আর আপনিতো শুরুই করেছেন উল্টো দিক দিয়ে পড়া নাকি !
facebook
এইটা তো শুরু থেকেই পড়লাম, তাই না শেষের লাইনটা মনে বেশি দাগ কাটলো!
___________________
ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখি না,
স্বপ্নরাই সব জাগিয়ে রাখে।
কত অজানারে জানাইলেন আপনি ভাইয়া। আর সচলায়তনে না এলে তো আপনাকেও পেতাম না। সচলায়তন কে এবং আপনাকে।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা, আপনাকেও
facebook
অণু ভাই, আপনি না লিখলে কতো কিছুই অজানা-অধরা থেকে যেতো! আপনার চোখ দিয়ে বিশ্বটাকে দেখে চমৎকৃত হচ্ছি নিয়ত।
-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী
আরে না সুমন ভাই, কোন না কোন ভাবে অবশ্যই আমরা সবাই জানতাম । অনেক ধন্যবাদ নিখাদ প্রশংসার জন্য
facebook
নতুন মন্তব্য করুন