বই বিষয়ক আবজাব

নিটোল এর ছবি
লিখেছেন নিটোল [অতিথি] (তারিখ: সোম, ১৯/০৯/২০১১ - ২:৩৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

‘বই’ নামক জিনিশটিকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়? বিজ্ঞজনের বক্তব্য আর সমস্ত অভিধান এক পাশে সরিয়ে রাখি। এখন নাকি ডিজিটাল যুগ। তাই ‘বই’কে ব্যাখ্যা করতে গেলেও এর মাঝে ‘ডিজিটালত্বে’র ছোঁয়া ত অবশ্যই থাকতে হবে। তবে আমার ধারণা, বইয়ের সংজ্ঞা একেক জনের কাছে একেক রকম। প্রতিটি মানুষই বইকে তার নিজের মতো করে অনুভব করে। কারো কারো কাছে কিছু বই সাক্ষাৎ যমের মতো, যাদেরকে পরীক্ষার আগে দেখলেই শরীরের তাপমাত্রা উর্ধ্বমুখী হয়; কারো কারো কাছে কিছু বই আবার বউয়ের মতো যাদেরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়!

আমার কেন যেন মনে হয় বইয়ের সাথে মানব সভ্যতার উর্ধ্বযাত্রার একটি গভীর সম্পর্ক আছে। মানুষের সাথে অন্য যেকোনো প্রাণীর পার্থক্য বুদ্ধিশুদ্ধিতে,জ্ঞানবিজ্ঞানে। অন্য যেকোনো প্রাণী তার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান তার মস্তিষ্কে রাখে। এটা ছাড়া তার আর কোনো উপায় নাই। কিন্তু মানুষ এ দিক থেকে স্বাধীন। যখন থেকে মানুষ লিখতে শুরু করেছে তখন থেকেই তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিবর্তন অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। জটিল কোনো বিষয় কিংবা তথ্য মনে রাখার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে। কোনো কিছু জানতে চাইলেই বই খুলে দেখে নিলেই হয়। তবে বইয়ের উদ্ভবের পর সবচেয়ে বড়ো যে অগ্রগতি হয়েছে সেটি হলো মানুষ তার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, আহরিত তথ্য, দর্শন ইত্যাদি অনেক মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। এমনকি কয়েক প্রজন্ম পরের মানুষের সাথে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছে। ব্যাপারটা একটু অন্যভাবে দেখি। ধরা যাক, সুন্দরবনের একটা বাঘ। সে তার অভিজ্ঞতা, শিকার ধরার কৌশল ইত্যাদি তার সন্তানকে শিখিয়ে গেল। কিন্তু সাইবেরিয়া অঞ্চলের একটা বাঘের অভিজ্ঞতা তার সন্তানেরা জানতে পারছে না। মানুষ বইয়ের মাধ্যমে সেই সীমাবদ্ধতাটুকু অতিক্রম করেছে। আমরা কখনো মরুভূমি না দেখেও সেখানকার বাসিন্দার জীবনযাত্রা সম্পর্কে অবহিত হতে পারি, বইয়ের মাধ্যমে।

আরও ব্যাপার আছে। প্রাচীনকালে লেখালিখির ব্যাপারটা খুব একটা সহজ ছিল না। প্যাপিরাস, গাছের বাকল, পশুর চামড়া ইত্যাদি নানা জায়গায় অনেক কায়দা করে লেখালিখি করতে হতো। ফলে অধিক সংখ্যক লোকের কাছে সে লেখা পৌঁছুতে পারত না। তাই সভ্যতার অগ্রযাত্রার গতি ছিল গরুর গাড়ির মতো। রেনেসাঁর সময়ে ইউরোপে যে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিস্ফোরণ ঘটে এর পেছনে খুব সম্ভবত ছাপাখানার আবিষ্কার অনেক বড়ো ভূমিকা পালন করেছে। ছাপাখানার মাধ্যমে একইসাথে এবং অনেক সহজে অধিক সংখ্যক বই ছাপানো গেছে এবং অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া গেছে।

( এতটুকু লেখার পর মনে পড়লো, আমিতো আবজাব লিখতে বসেছি, মানুষকে জ্ঞান দিতে বসিনি। লেখা পড়ে মনে হচ্ছে বিশাল গবেষণা-ধর্মী প্রবন্ধ ফেঁদে বসেছি। অতএব এই লাইন বাদ। এবার অন্য লাইনে হাটঁব।)

ব্লগে ব্লগে ঘুরে একটা বিষয় উপলব্ধি করলাম। মানুষ নিজের কথা সবাইকে বলতে চায়। নিজের অভিজ্ঞতা,সে যতটুকু ছোটই হোক না কেন মানুষকে জানাতে চায়, মানুষের মন্তব্য চায়। আমি এসব চাইনা- একথা বলে নিজেকে আলাদা প্রমাণের কোনো চেষ্টাই করছি না। নিজের বইপ্রীতি শুরুর দু’চার কথা বলেই ফেলি।

সেবার ফুপির বাসায় বেড়াতে গেলাম। দিনক্ষণ মনে নেই, শুধু মনে আছে- সে অনেক আগের কথা। ছোটবেলার কথা। বড়োরা জমিয়ে আড্ডা মারছে। বড়োদের আড্ডায় আমি খুব আগ্রহ নিয়ে উপস্থিত থাকতাম। খুব ছোট ছিলাম বলেই হয়ত তারা আমার উপস্থিতি মেনে নিত। হয়ত ভাবত ছোট্ট এই মগজে কিছুই ঢুকবে না। কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমি সবই বুঝতাম। শুধু আমি না, আমার ধারণা, সব বাচ্চাকাচ্চাই বড়োদের সব কথা বোঝে কিন্তু এমন ভান করে যেন কিছুই শোনেনি! সেদিন বড়োদের আড্ডায় কেন যেন মন বসল না। অন্য এক রুমে একলা বসে রইলাম। হঠাৎ এক কোণে রাখা বইয়ের তাকের দিকে নজর গেল। দেখলাম অনেক রকম বই দিয়ে শেলফ একেবারে বোঝাই। চোখ বন্ধ করে একটা বই তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। প্রথম দু’পৃষ্ঠা পড়েই আমার চোখ বইটাতে একেবারে আঠার মতো লেগে গেল। এমন অদ্ভুত গল্প এর আগে কখনো শুনিনি,কেও বলেনি। গল্পের নায়কের বাসায় একদিন আসে অদ্ভুত এক ঘড়ি। প্রতি ঘণ্টায় ঘড়ি থেকে একটা পাখি বেরিয়ে এসে শব্দ করে সময় জানান দেয়। এক রাতে নায়ক নিছক মজা করেই পাখিটাকে ধরে উলটো ঘুরিয়ে দেয়। এরপর শুরু হয় একের পর এক অবাক করা কাণ্ড। সে অতীতে ফিরে যাওয়া শুরু করে। প্রতি সকালে ঘুম থেকে ওঠে সে দেখতে পায় যে, সে আগের দিনের চেয়ে বয়সে ছোট হয়ে যাচ্ছে। এই যে সময়ের স্রোত অতীত-মুখী এটা শুধু সেই অনুভব করে, আর কেও না। এভাবে দেখতে দেখতে সে একেবারে দুধের বাচ্চা হয়ে যায়। এরপর কীভাবে সে তার স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায় সে এক লোমহর্ষক কাহিনী।

বইটার প্রভাব আমার ওপর খুব ভালোমতোই পড়ে। পরপর কয়েক রাত আমি ছোট হয়ে যাচ্ছি-এই জাতীয় স্বপ্ন দেখে ফেললাম। সেই শুরু হলো আমার বইয়ের নেশা। যখন যাই পাই, তাই পড়ে ফেলতে শুরু করলাম। এক আত্মীয়র বাড়িতে একবার চটি পর্যায়ের বইও পড়ে শেষ করে ফেললাম, এরপর সব বুঝে গেছি- এই ভঙ্গি করে কয়েকবার মাথা দোলালাম! যদিও এখন জানি, তখন কিছুই বুঝিনি। কিছু বুঝি আর না বুঝি, বই-প্রেম আমার বেড়েই চলল। আরেকটু বড়ো হয়ে মজে গেলাম তিন গোয়েন্দায়। তিন গোয়েন্দা সিরিজের এমন কোনো গল্প বাকি ছিলোনা যা পড়া হয়নি। পড়তে পড়তে অদ্ভুত এক রিয়্যাকশন দেখা দিল। নিজেকে কিশোর পাশা ভাবতে শুরু করলাম! কোনো কিছু ভাবতে গেলেই কিশোর পাশার মতো চিমটি কাটতাম। সবকিছুই দেখতাম সন্দেহের দৃষ্টিতে। যদিও মা বলে সেটা নাকি চোরের দৃষ্টি। যাই হোক, এরপরে জাফর ইকবাল স্যারের বইয়ের নেশায় পড়ে গেলাম। এবং অতঃপর আর সব সাধারণ বাঙ্গালী পাঠকের মতোই পড়েছি হুমায়ুন আহমেদের অনেক বই।

বই নিয়ে আমার একটা অন্যরকম আগ্রহ আছে। যারা বই-প্রেমী আরা যেকোনো উপায়ে বই সংগ্রহ করেন আর দ্রুত পড়ে ফেলেন। আমিও সংগ্রহ করি কিন্তু সেটা অন্য কারো কাছ থেকে নয়, দোকান থেকে। কারো কাছ থেকে চেয়ে পড়ার চেয়ে বইটা কিনে তারপর পড়তে আমার বেশি ভালো লাগে। অন্যের কাছ থেকে নেয়া বই আমার কেন যেন পরপর লাগে! নতুন কোনো বই পড়ার আগে হাতে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে যে বইটা আমার। এ স্বভাবের কারণে পকেট থেকে অনেকগুলো টাকা বেরিয়ে গেলেও একটা লাভ হয়েছে। নিজের একটা বেশ ভালো সংগ্রহ দাঁড়িয়ে গেছে।

আর কিছুই বেরুচ্ছে না মাথা থেকে। লেখা এখানেই সমাপ্ত।

পুনশ্চ: লেখার শুরুতে বইয়ের সংজ্ঞার কথা বলেছিলাম। নিচের সংজ্ঞাটা আগে কোথাও শুনেছেন কিনা বলুন ত? চাল্লু

Instruments are record , analyze, summarize, organize, debate in explained information that I illustrative in non illustrative hard bound paper bag jacket in non jacketed with forward introduction, table of content, index, that is intended for the enlightenment, understanding, enrichment, enhancement and education of human brain's sensory route of vision...sometimes touch!


মন্তব্য

ফাহিম হাসান এর ছবি

আপনার লেখার মান ক্রমশ ভাল হচ্ছে। তবে লেখার বিষয়বস্তু আরেকটু বিস্তৃত করলে ভাল হত। বই নিয়ে আপনার চিন্তাগুলো জানতে চাই। বই যে যোগাযোগের মাধ্যম তা তো সবাই জানে। আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অংশটুকুই বরং আমি বিস্তারিত জানতে আগ্রহী। কী ধরনের বই আপনাকে এখন প্রভাবিত করে, কেন করে ইত্যাদি।

তবে বাঘের উদাহরণটা একদমই লাগসই হয় নি। অপ্রাসঙ্গিক ও অনাবশ্যক মনে হয়েছে। যুক্তিটাও বোঝা যায় নাই।

নিটোল. এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ফাহিম ভাই। আমার প্রথম লেখাতেই আপনি একেবারে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন! ইয়ে, মানে... এখন আপনি বলছেন লেখার মান ভালো হচ্ছে-এটা শুনে বেশ স্বস্তি পেলাম! হাসি

আপনার পরামর্শটুকু মনে থাকবে। লেখা আরো উন্নত করতে চাই বলেই ত এখানে লিখি।

তারেক অণু এর ছবি

জীবনে ৩টা জিনিস দরকার- বই, বই এবং বই।---- তলস্তয়

নিটোল. এর ছবি

ঠিক তাই।

কল্যাণF এর ছবি

চিন্তিত

নিটোল. এর ছবি

ইয়ে, মানে...

কল্যাণF এর ছবি

আরে ভাই দুঃশ্চিন্তার কিছু নাই, আপনার লেখা পড়ে মেলা পুরান কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো তাই চিন্তার ইমো দিছিলাম। আরো লেখা চাই। চলুক

ইস্কান্দর বরকন্দাজ এর ছবি

হাততালি

নিটোল. এর ছবি

লইজ্জা লাগে

তিথীডোর এর ছবি

কাল এক পোস্টে বই নিয়ে মনমাঝির মন্তব্যটা চমৎকার লেগেছিল!
শুধু বই পড়ার লোভে কত কুকর্ম যে করেছি। চোখ টিপি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

নিটোল. এর ছবি

বইপ্রেমীদের সব কুকর্ম বইকে ঘিরেই হয়!

মর্ম এর ছবি

বই নিয়ে অনেক কুকর্ম মেনে নেয়া যায় কিন্তু রবিবুড়োর 'কু-বুদ্ধি' মেনে 'মার্ক টোয়েনীয়' পন্থা অবলম্বনে বই সংগ্রহকর্মটিকে একেবারেই সমর্থন করিনে!

~~~~~~~~~~~~~~~~
আমার লেখা কইবে কথা যখন আমি থাকবোনা...

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আপনার নীতিগত অবস্থানটি কি "মার্ক টোয়েন" এর দৃষ্টিকোণ থেকে? চিন্তিত
না কি, তাঁর "বন্ধু" দের দৃষ্টিকোন থেকে? খাইছে

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখকঃ অতীত এর ছবি

কিছু কিছু বিষয় আছে যেগুলো আসলে সংজ্ঞায়িত করার উপযোগিতা বা আবশ্যকতা আছে বলে আমার মনে হয় না। বই এমন একটি জিনিস। যাইহোক, আপনার লেখাটা আমার বরং বইএর উৎপত্তির ক্রমইতিহাস হিসেবে মনে হয়েছে, যেটা আমার জানা ছিলো না। আমি ফাহিম ভাই এর সাথে একমত। বই সম্বন্ধে যদি আমাকে বলেন, আমি বলবো বই একটি জগত, একটি সময়, একটি ঘটনা, একটি অস্তিত্ব, একটি সত্ত্বা, একটি সভ্যতা, একটি অনুভূতির সেতু, একটি কল্পনা ইত্যাদি ইত্যাদি। বই কী তা ব্যাখা করা যেতে পারে কিন্তু বই কাকে বলে তা আসলে কতটুকু বলা সম্ভব বা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা খটকা আছে আমার কাছে।

আপনার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা পড়ে মজা পেলাম। আর লেখনীতো চমৎকার আছেই। আমাদের এমন আরও কাহিনি লিখে শোনান দেঁতো হাসি

অতীত

নিটোল. এর ছবি

আপনার চমৎকার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

রিশাদ_ ময়ূখ এর ছবি

বই বই এবং বই। আর কোনো কথা নাই। আপনার লেখা ভালো লাগল। বই পড়া চলুক

নিটোল. এর ছবি

হ, কোনো কথা নাই। চলুক।

উচ্ছলা এর ছবি

বই-আবজাব ভালো লেগেছে চলুক

আমার কাজের একটি অন্যতম অংশ হলো 'Book review' লেখা। বিভিন্ন লেখকদের কাছ থেকে 'সৌজন্য review copy' পাওয়াটা এখন পান্তভাত হয়ে গেছে। তবুও নতুন একটা বই পড়ার আনন্দ, উত্তেজনা কিছুতেই পুরোনো হয় না হাসি

বই না পড়ে মানুষ বাঁচে কেম্নে? বাড়ে কেম্নে??!

নিটোল. এর ছবি

বই না পড়েও মানূষ বাঁচে। তবে সে বাঁচাটা মানূষের মতো হয় না।

আশফাক আহমেদ এর ছবি

আবজাব সবসময়ই ভালো লাগে। আর সেটা যদি বই বিষয়ক হয়, তাহলে তো কথাই নেই।
বই বিষয়ক আরো অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন, অপেক্ষায় রইলাম

-------------------------------------------------

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

সুমন তুরহান এর ছবি

বই নিয়ে আপনার ভাবনা ভালো লেগেছে। আরো লিখুন সচলে।

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।