“ আমার ভাবতে পারাটা প্রমাণ করে যে আমি আছি।” কথাটা বলে একটা দর্শণচিন্তার জন্ম দিয়েছিলেন রেনে দেকার্ত। আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে যখন ডরোথী নামের এক ফরাসী তরুনীর সাথে হঠাৎ আলাপ হয় চট্টগ্রাম আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ-এর ছোট্ট কাফেতে, তখন সবে দেকার্ত-এর নাম শুনেছি, জেনেছি ফ্রান্সের পশ্চিমদিকের শহর পোয়াতিয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে কালক্রমে আধূনিক দর্শণের পুরোধা বনে যান তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতেই দেকার্ত-এর দর্শণ আমাকে আকৃষ্ট করেছিল বেশ, তাই কথাপ্রসঙ্গে ডরোথী যখন জানাল পোয়াতিয়ে শহরেই তার জন্ম, বেড়ে ওঠা আর পড়াশোনাও সেই বিখ্যাত পোয়াতিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যার নামের সাথে জড়িয়ে আছে দেকার্তের নাম আমি তখন পোয়াতিয়ের ব্যাপারে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠি। এর বছর কয়েক পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়তে চলে যায় প্রিয় অপূর্ব যার সাথে আমার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব বয়সের সীমারেখার ঊর্ধ্বে। আমি মধ্যবিত্ততার গেঁড়াকল আর মেধাহীনতার চক্করে পড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশন জটেই আটকে থাকি আর ফেসবুক মারফত অপূর্ব-র পাঠানো পোয়াতিয়ের ছবি দেখে বিষাদে আক্রান্ত হই। মনে মনে শপথ করি যে করেই হোক বৃত্তি একটা বাগিয়ে পোয়াতিয়ের শহরে বই-খাতা নিয়ে হাজির হবই। কিন্তু এরকম আরো অনেক শপথের মতই ওটাও শপথ পর্যন্তই। মাঝখানে এসে দানবের মত দাঁড়িয়ে থাকে আমার মেধাহীনতা আর আলস্য। পোয়াতিয়েকে ভোলার জন্য তাই সেশন জটের বিশ্ববিদ্যালয়টাকেই ভালবাসতে শুরু করলাম। সে ভালবাসার প্রতিদান হিসেবে প্রায় দশ বছর পর সে আমাকে উপহার দেয় মহার্ঘ্য একটি কাগজের সনদ। ততদিনে আমার মাথার চুল আর বেশী অবশিষ্ঠ নেই।
কাকতালীয়ভাবে ২০০৮ সালে ছোট্ট একটা কোর্স করার জন্য ফ্রান্সে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যাই আমরা তিনজন বন্ধু। তখন ফ্রান্সে শরতকাল, তবে আমাদের দেশের সাথে তুলনায় সময়টাকে শীতই বলা যায়। প্রথমবার ইউরোপ দেখার ঘোর কাটতে না কাটতেই কোনদিকে দুসপ্তাহ কেটে গিয়েছিল টেরই পাইনি, তার উপর আমাদের কোর্সটা ছিল দীর্ঘ, একঘেঁয়ে আর ক্লান্তিকর। ছিলাম পশ্চিম ফ্রান্সের ছোট্ট শহর বোজঁসঁতে, কুলকুল করে বয়ে যেত ছোট একটা নদী দু, তার সামনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের দেশে শরতকালে নির্মেঘ আকাশ, নদীর পাড় ঘেঁষে কাশের বন। ফরাসী দেশের শরতের আকাশ গোমড়ামুখো, দিনমান ঝিরঝির বৃষ্টি, কনকনে ঠান্ডা হাওয়া আর প্লাতান গাছের পাতাগুলো উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে চলে শহরের এমাথা থেকে ওমাথা। সন্ধ্যায় যখন রু ফেলিক্স গিয়াকোমত্তি-র অতিথি বাড়িতে এসে পৌঁছাতাম তখন কারও সাথে বাংলায় কথা বলার জন্য মনটা আনচান করে উঠত। অপূর্বকে কখনো ফোনে পেতাম, কখনো পেতামনা। ডরোথী তখন শঁবেরী নামের একটা শহরে আইনের ভারী ভারী বইয়ের নীচে পিষ্ঠ। হিসেব করে দেখলাম সময় আর অর্থ যা আছে তাতে পোয়াতিয়ে বা শঁবেরী গেলে প্যারিস আর যাওয়া হবেনা। শেষ পর্যন্ত ফোনালাপেই সন্তুষ্ট থেকে আবারও মনে মনে শপথ করলাম যে করেই হোক পরের বার পোয়াতিয়ে শহরে আসবই আসব। তারপর প্যারিসে ঘোর লাগানো অদ্ভুত পাঁচটা দিন। ভার্সাই-এর রাজপ্রাসাদ,
ল্যুভ মিউজিয়াম(Musée de Louvre) , শঁজে লিজে(Les Champs Elysées), আর্ক দ্য ত্রিয়ম্ফ(Arc de Triomphe),
নোত্র দাম গীর্জা(Notre Dame),
সীন নদী আর তার সেতুগুলো,
আইফেল টাওয়ার(Tour Eiffel), সাক্রে কর্ ব্যাসিলিকা(Sacré Coeur) আর প্যারিসের মানুষজন দেখতে দেখতেই একদিন নিজেকে আবিষ্কার শার্ল দ্য গ্যল বিমানবন্দরে বোর্ডিং পাস নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। আহা প্যারিসটা দেখা হলনা ভাল মতন। মনে মনে তাই আবার শপথ নিলাম...
কপালের ফের!তিন বছর যেতে না যেতেই ইউরোপ দেখার সুযোগ মিলল আবার। তবে যাত্রাপথ এবার ভিন্ন আর নিজের গাঁটের পয়সা খরচ হবে দেদার। আবিদজান থেকে এয়ার মারোকের বিমানে করে লিওঁতে যখন নামলাম তখন ইউরোপে গ্রীষ্মকাল। গতবার যখন শুনেছিলাম শরতকালে প্যারিস যাচ্ছি, শার্টের নীচে হালকা একটা টি-শার্ট ছাড়া আর কিছুই পড়িনি, ভেবেছিলাম ঢাকায় যা গরম, প্যারিসেও নিশ্চয় তার কিছুটা আঁচ লাগবে; শার্ল দ্য গ্যলের উষ্ণ এয়ারপোর্টের বাইরে আসা মাত্রই ঠান্ডা বাতাস হাড়ের ভেতরের মজ্জা পর্যন্ত জমিয়ে দিয়েছিল আর কি। ভাগ্যিস! পিটার এসে দ্রুত ওর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ীতে আমাদের তুলে নিয়েছিল বলে ঐ যাত্রায় রক্ষা। এবার তাই আমি আর কারো কথায় কান দেবোনা। টি শার্ট, কফি শার্ট এর উপরে একটা ভারী জ্যাকেট চাপিয়ে বিমানে যখন উঠলাম তখন অনেককে দেখলাম ভূত দেখার মত আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লিওঁ-র সাঁ এক্সুপেরী-র বাইরে আসামাত্রই মনে হল গায়ে কে যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এবার তো আর পিটার নেই, আমাকে হাঁসফাঁস করতে দেখে সহযাত্রী একজন বলল,“ হাঁদারাম,ইউরোপে এখন গ্রীষ্ম।”
লিওঁ-তে কয়েকটা দিন কাটিয়ে একদিন চলে এলাম প্যারিস। আবার ঘুরঘুর, ঘুরঘুর। শহরের ১৩ তম আরন্দিসমঁ(Arrondissement)-তে আমার ফরাসী ভাষার শিক্ষক স্তেন ল্য বেরিগো-র বাসায় গিয়ে উঠলাম। উনাকে নিয়েই ঘুরে এলাম অর্সে মিউজিয়াম(Musée d’Orsay) যেখানে দেখা হল ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের আঁকা দূর্দান্ত ছবিগুলো(ভ্যান গঘের বিখ্যাত আত্মপ্রতিকৃতিটির সামনে অনেকক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে থাকায় একজন তো আমাকে মাদাম তুসোর কোন অখ্যাত মূর্তি ভুলক্রমে এখানে চলে এসেছে ভেবে গুঁতো মেরে বসেছিল), কার্তিয়ের লাতাঁ(Quartiers Latins) বা ল্যাটিন কোয়ার্টারস
থেকে শুরু করে হেঁটে হেঁটে ঘুরেছি সরবোর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়,
শেক্সপীয়র এন্ড কোম্পানী, ক্লুনি মিউজিয়াম(Musée de Cluny),মঁ-পার্নাস-এর ভুবনভোলানো গীর্জা ল্য সাক্রে কর(Sacre Coeur)বা পবিত্র হৃদয়। প্যারিসের গল্প করতে গেলে পোয়াতিয়ে যাওয়া এবারও হবেনা আর আমাকে আবারও শপথের পথে যেতে হবে। তাই পরদিন মঁপার্নাস স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে বসলাম। যাব রেনে দেকার্তের স্মৃতি-মাখা পোয়াতিয়ে শহরে, অপূর্ব-কে দেখতে।
ফ্রান্সের গ্রাম বা উপশহরের ভেতর দিয়ে যখন ট্রেন চলে তখন মনে হয় যেন কোন জীবন্ত ছবির ফ্রেমে ভুল করে ঢুকে পড়েছি। ইউরোপের গ্রীষ্ম তার মোহনীয় রুপ ছড়িয়ে রেখেছে মাঠে-প্রান্তরে-বনে-আকাশে। এ এক দূর্লভ দৃশ্য। সাড়ে তিন ঘন্টার যাত্রাটাকে তাই মোটেও ক্লান্তিকর মনে হলনা, সামনের আসনে বসা প্রৌঢ়া মনস্তত্তবিদের সাথে খেজুর বিষয়ক আলোচনা(খাজুইরা আলাপ)করতে করতে জানলাম অনেক কথা। স্টেশনে গিয়ে দেখলাম অপূর্ব তার পরিচিত হাসি আর অপরিচিত লম্বা চুল নিয়ে ফুল ছাড়াই দাঁড়িয়ে আছে। মনের ডাক্তারের বোনপো দেখলাম আবার অপূর্ব-র ইয়ার। টুকটাক আলাপ সেরে বিদায় জানিয়ে অতঃপর দুজনে বেরিয়ে পড়লাম স্টেশনের বাইরে।
পোয়াতিয়ে রোমানদের হাতে গড়া সুন্দর ছোট্ট শহর। মূলতঃ এর কেল্টিক অধিবাসী পিক্তোন-দের(Pictones) নামানুসারেই এর নাম হয় পোয়াতিয়ে। ঐতিহাসিকভাবেও এ শহরের বেশ গুরুত্ব আছে। ৭৩২ খ্রিস্টাব্দে এখানেই উম্মাইদ খিলাফতের আগ্রাসন রুখে দিয়েছিল ফ্রাঙ্ক সেনাপতি শার্ল মার্তেল। আবার ইংরেজদের সাথে শতবর্ষের যুদ্ধে ১৩৫৬ সালে দারুণ মার খেয়েছিল ফরাসীরা এখানেই। শহরে কোলাহল নেই, ছোট ছোট উঁচু-নীচু রাস্তা, এক পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে শান্ত নদী ক্লাঁ(Clain)।
অপূর্ব’র স্টুডিও বাসার সামনেই একটা পার্ক। ওখান থেকে ক্লাঁ নদী সহ পুরো শহরটাই দেখা যায়। বিকেলে আমরা এই পার্কের ভেতর দিয়েই যখন মূল শহরের দিকে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম কয়েকজন মিলে ফ্রান্সের ঐতিহ্যবাহী খেলা পেতাঙ্ক্ খেলছে। খেলাটা আসলে মার্বেলের মত, তবে লোহার মার্বেলগুলো আকারে ক্রিকেট বলের মত, এইটুকুই খালি পার্থক্য
। অপূর্ব পরিচয় করিয়ে দিল ওর জাপানী বন্ধু কিতো’র সাথে। ছেলেটা দারুণ একটা ডকুমেন্টারী করছে, জাপানের সাম্প্রতিক সুনামি এবং তৎপরবর্তী পারমানবিক বিপর্যয়ে সমব্যথী বিভিন্ন জাতীয়তার পোয়াতিয়েবাসীদের হাসিমাখা ছবি আর স্বাক্ষর সংগ্রহ করছে। আমিও ওর খাতায় বাংলাতে লিখে দিলাম কিছু কথা, আর ছবি তুললাম দাঁত কেলিয়ে। জুলাই মাসে গ্রীষ্মের ছুটিতে ছাত্রদের শহর নামে পরিচিত পোয়াতিয়ে পুরোটাই ফাঁকা, যারা পড়ে রয়েছে তাদের হয় কোথাও যাবার জায়গা নেই, নতুবা ছুটিতে ডাবল কাজ করে কিছু বাড়তি ইউরো কামিয়ে নেওয়ার মতলব।
পোয়াতিয়ে শহরের একমাত্র বঙ্গসন্তান অপূর্ব। দারুণ মিশুক প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পী ছেলেটাকে প্রায় পুরো শহরটাই চেনে। একটু পরপরই তাই দেখলাম কেউ না কেউ এসে চকাস চকাস করে ওর গালে চুমু বসিয়ে দিচ্ছে। আমার বেলায় শুধুই করমর্দন, কী কপাল নিয়ে যে জন্মেছিলাম! হাঁটতে হাঁটতে আমরা গেলাম শহরের মূল চত্ত্বরে(Centre de ville) যেখানে মেয়র অফিস অবস্থিত। ইউরোপের প্রতিটি শহরেই দেখলাম এই বিশাল চত্ত্বরের সিটি সেন্টার, যেখানে বসে মানুষের মিলনমেলা, উৎসব, কনসার্ট, সভা। কোনার একটা পানশালার টেরাসে বসে বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে দেখছিলাম অপূর্ব মেয়র হাউসটাকে। সন্ধ্যের আলোর রোশনাই লেগে তার যে কী রুপ হয় তা দেখেছিলাম পরদিন। গরমকালে ইউরোপের সূর্যটা ডুবতেই চায়না, রাতের নয়টা পর্যন্ত সে পশ্চিমাকাশ আলোকিত করে রাখে। আঁধার হবার আগেই তাই আমরা ঘুরে ফেললাম প্রায় পুরো শহরটা। ফ্রান্সের প্রত্যেক শহরের প্রধান গীর্জার নাম নোত্র দাম, পোয়াতিয়ের নোত্র দামের গায়ের মূর্তিগুলোর অনেকেরই দেখলাম মুন্ডুপাত করা। বুঝলাম প্রথমদিকের সংস্কারপূর্ব খ্রিস্টানধর্ম প্যাগান প্রতীকবিরোধী ছিল বলেই মূর্তিগূলোর এ দশা। নোত্র দামের চূড়ার ওপর বিকেলের আলো পড়ে যে সৌন্দর্য তৈরী করছিল তা অপার্থিব।
দেখা হল ৩৬০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত ফ্রান্সের সবচেয়ে পুরোনো গীর্জা বাপ্তিস্তিয়ের সাঁ জঁ। তার সাথেই লাগানো পোয়াতিয়ের সবচেয়ে বড় মিউজিয়াম সাঁন্ত্ ক্রোয়া(Musée Sainte Croix) যেখানে আছে বিখ্যাত ভাস্কর কামিই ক্লদেল আর রঁদার শিল্প-কর্ম। আমাদের দূর্ভাগ্য, বন্ধের দিনই আমরা এসে পড়েছি। এরপর আমরা গেলাম বারো শতকে নির্মিত গথিক রীতির অদ্ভুত সুন্দর কাথিড্রাল সাঁ পিয়ের-এ। এটি পোয়াতিয়ের উচ্চতম গীর্জাও বটে। বেশ কিছু সময় এখানে কাটিয়ে আমরা আবার শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে পা বাড়ালাম।
যে পাকিস্তানী দোকানে অপূর্ব কাজ করে তার সদাশয় মালিক মুনীর সাহেবের দেয়া ভদকা খেয়ে তার পরদিন ঘুম ভাঙ্গল বেশ বেলাতে। মাথাটা পাথরের মত ভারী হয়ে আছে, পেটে খাদ্যের বদলে আছে কিছু বদ এলকোহল। অপূর্ব তার মা’র দেয়া রেসিপি মোতাবেক ঝটপট রেঁধে ফেলল ডিমের দোপেঁয়াজা আর মুরগীর ঝোল। আমি শুধু পেঁয়াজ কাটলাম আর কাঁদলাম। খেয়ে দেয়ে কুককে বাহবা দিলে সে তার লম্বা চুল আঁচরাতে আঁচরাতে বলল,“যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।” আমার চুল চুলোয় গেছে, তাই রাঁধতে গিয়ে কাঁদতে বসি। বিকেলে আমরা আবার বেরুলাম। এবার গেলাম শহরের উল্টোদিকে। পোয়াতিয়ের পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়টা দেখলাম, এখনও এখানে আইন আর সঙ্গীত বিভাগের ভবন দুটোতে নিয়মিত ক্লাস হয়। একটা রাস্তার নাম রাখা হয়েছে দেকার্তের নামানুসারে(Rue René Déscartes)। একটু এগুতেই চোখে পড়ল একটা চত্ত্বরে পরিচিত একটা মূর্তি, আরে এ যে আমাদের স্ট্যাচু অব লিবার্টি। তবে ক্ষুদ্র সংস্করণ যাকে বলে আর কী! শহরের এই অংশে দেখলাম বেশ পুরোনো একটা দেওয়ালের ধ্বংসাবশেষ। অপূর্ব জানাল এই দেয়াল নির্মিত হয়েছে চতুর্থ শতকে নগরকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য। মনে মনে ফরাসীদের তাদের ইতিহাস সচেতনতার জন্য আবার স্যালুট জানালাম, আর নিজ দেশবাসীদের ইতিহাস ভুলে যাওয়া আর ভুলিয়ে দেওয়ার মূঢ়তার জন্য ধিক্কার দিলাম। আরও জানলাম জোয়ান অব আর্ক-কে এই পোয়াতিয়েতেই এনে বিচার করা হয়েছিল আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মাণ বোমারু বিমান এ শহরটাকেই বিশেষ টার্গেট করেছিল তার সামরিক গুরুত্বের জন্য। অধিক হাঁটায় অধিক ক্যালরি ক্ষয় হওয়ায় পেটে বেশ টান পড়ল, সামনে একটা চীনা রেস্টুরেন্ট এ ঢুকে চীনা খাবার খেয়ে জিহ্বাটাকে আরো বিস্বাদ করে বুঝলাম ভারতীয় উপমহাদেশের খাবারের সাথে অন্যকিছুর তুলনাই করা চলেনা। সে সন্ধ্যায় অপূর্বর বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে আর হুল্লোড় করে রুমে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল।
তৃতীয়দিন আমার চলে আসার পালা। আমি গাড়ী ধরব পাশের শহর তুর-এ গিয়ে। উদ্দেশ্য রথ দেখা এবং কলা বেচা।সকাল সকাল উঠেই তাই আমরা দুজন বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য পোয়াতিয়ের বিশ্ববিদ্যালয়। আমার ধারণা ছিল ১৪৩১ সালে নির্মিত ফ্রান্সের প্রাচীনতম এই বিশ্ববিদ্যালয়টি হবে পুরোনো কিছু বিল্ডিং এর সমাহার। কিন্তু না এ যে দেখছি তার পুরো উল্টো। রেনে দেকার্ত, ফ্রান্সিস বেকন, ফ্রঁসোয়া রাবলে-দের সেই জ্ঞানপীঠ আজ ফ্রান্সের অন্যতম গবেষণা কেন্দ্র যা প্রায় ২৭,০০০ ছাত্রছাত্রীর পদচারণায় মুখরিত থাকে সারা বছর। অপূর্ব আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অনেকগুলো ফ্যাকাল্টি দেখাল,কিন্তু গরমের ছুটিতে সবাই লাপাত্তা,ক্যাম্পাসে কয়েকটা কুকুর ছাড়া বিশেষ কাউকেই দেখা গেলনা। কথা ছিল পোয়াতিয়ের অন্যতম আকর্ষণ থিম পার্ক ফুতুরোস্কোপ(Futuroscope)যাবার, কিন্তু টিকেটের দাম শুনে হিসেব কষে দেখলাম ওটাকায় আমার ইউরোপের অন্য শহরে ঢোকার ট্রেন ভাড়া হয়ে যাবে। তাই বাদ, ওপথে যাবনা, বাচ্চাদের প্রমোদে মন ঢেলে দেওয়ার বয়স আমার নেই (আঙুর ফলতো টকই হয়)। অপূর্বকে বিদায় জানাতে গিয়ে কোন কথাই বলা হোলনা। আবার কখনো আসা হবে কিনা এ শহরে জানিনা, শপথও আর করলাম না কোন। ট্রেন ছেড়ে দিলে জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি লম্বা চুলের মিষ্টি চেহারার ছেলেটা অমলিন একটা হাসি নিয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে।
মন্তব্য
আচ্ছা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত মার্গারিটের বাড়ী এই পোয়াতিয়ে-তেই ছিল না ! লুদা নামের এক গ্রামে?
facebook
হায় হায়! ভুলেই গিয়েছিলাম। ধন্যবাদ। তবে সুনীলের বিবরণ তো! সবটুকু বিশ্বাস করা যায়না।
এতো দেখি তারেক বাবাজির মিনি সংস্করণ।
লেখাটা খুবই সুন্দর। এই ধরনের লেখা থেকে সারা বিশ্বটাকে খুবি কাছের মনে হয়।
ডাকঘর | ছবিঘর
কী যে বলেন! তারেক অনু নমস্য। ধন্যবাদ।
বেশ ঘুরলাম...
বাহ! সচলে দেখি ভ্রমণকাহিনীর মেলা বসেছে! যাই হোক, এমন লেখা আরো চাই।
ফ্রান্সে যেতেই হবে- লেখাটা পড়ে এটাই মনে হলো!
সুমিমা ইয়াসমিন
ঘুরে আসুননা। ভাল লাগবে গ্যারান্টি দিলাম। তবে যাবার আগে ৩০ দিনে ফরাসী ভাষা শিক্ষার বইটা কিনে নিতে ভুলবেননা যেন। ধন্যবাদ।
বহুদিন পড়ে সুমাদ্রির লেখা পড়লাম। বর্ণনার ছটা যথারীতি টিকরে বেরুচ্ছে!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
লেখা বরাবরের মতই ভালো লেগেছে।।।
পোয়াতিয়ে নিয়ে লেখাতে প্যারিসের ছবি এসেছে বেশি। ভ্যান গগের আত্ম-প্রতিকৃতি বা ইমপ্রেশিনস্ট শিল্পীদের কথা যেহেতু এসেছে তাদের দুই/তিনটা ছবি দিলে আরো ভালো লাগত।
লেখা আসুক আরো......
বাণীব্রত
ওই সেই একই ঝামেলা, ছবি দিই কিন্তু পেজ-এ আসেনা। আর অর্সে মিউজিয়ামে ছবি তোলা নিষেধ ছিল, দেখি সামনের বার গেলে চোরা-গোপ্তা হামলা করা যায় কিনা।
গোগ্রাসে পড়লাম আর ফটোস্ দেখলাম।
ধন্যবাদ
সামলে পড়বেন, গলায় না আবার আটকে যায়। :)হাহা। ধন্যবাদ।
অনেক ভাল লেগেছে লেখাটা। চমৎকার বর্ণনা। এখন মনে হচ্ছে একবার যেতেই হবে।
পরবর্তী পোষ্ট এর অপেক্ষায় থাকলাম...
দশ মিনিটেই পোয়াতিয়ে ভ্রমণ...
পাঠকদের এমন লেখা উপহার দেওয়ার জন্য সুমাদ্রী দা কে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ জিনিয়া। ফ্রান্সে এই গরমে এগারোটা শহর দেখেছি। দেখি একটা একটা করে লিখতে পারি কিনা!
চমৎকার লেখা আর বর্ণনা, ভালো লেগেছে!
-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী
ধন্যবাদ! একটু দেরিতে করে হলেও লেখাটা পড়ে বেশ ভাল লাগলো। দেখা হবে নিশ্চই, অনতিবিলম্বে!
আপনাদের ধন্যবাদ, আপনারা আমার দিগন্ত বিশাল করে দিচ্ছেন
নতুন মন্তব্য করুন