অধরা ছিটমহল বিনিময়

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: বুধ, ২১/০৯/২০১১ - ৪:৪৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৬-৭ তারিখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-এর বাংলাদেশ সফরকালে উভয় দেশের মধ্যে যে সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সীমান্ত চুক্তি। এই চুক্তিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল হস্তান্তরের কথা রয়েছে। আমরা জানি, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১০৪টি এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৯০টি ছিটমহল আছে। তাছাড়া ছিটের ভেতর ছিট বা চন্দ্রছিট আছে ভারতের ৪টি ও বাংলাদেশের ২১টি। আলোচ্য ১৬২টি ছিটমহলের মধ্যে কোন দেশের কতগুলো তার বিশদ আমরা জানতে পারিনি। তবে, মোটামুটি জানা গেছে এই বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারত থেকে ৩৫৭.৫ একর আর ভারত বাংলাদেশ থেকে ১,২৪০ একর জমি পাবে। আমার প্রশ্ন কে কার কতগুলো ছিটমহল পাবে বা কতটুকু জমি পাবে সেটি নিয়ে নয়। প্রশ্ন হচ্ছে এই চুক্তিটির বাস্তবতা নিয়ে।

বাংলাদেশ-ভারতের ছিটমহল বিনিময় চুক্তির শুরুটা হয় ১৯৫৮ সালে ১০ই সেপ্টেম্বর নেহেরু-ফিরোজ খান নুন চুক্তির মাধ্যমে। সেখানে বলা হয় জলপাইগুড়ি জেলার বেরুবাড়ি থানার ১২ নং ইউনিয়নের একাংশ ভারত ও অন্য অংশ পাকিস্তান (পরবর্তীতে বাংলাদেশ) পাবে। দুই দেশের শীর্ষনেতা এই চুক্তি করলেও চুক্তিটি ভারতে আইনী জটিলতায় পড়ে। চুক্তিটি র‍্যাটিফাই করার জন্য ১৯৬০ সালে ভারতের সংবিধানের নবম সংশোধনী কালে Acquired Territories (Merger) Act 1960 সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ১৯৬০ সালের ১৪ই মার্চ ভারতের সুপ্রিম কোর্টের আট সদস্য বিশিষ্ট বেঞ্চ রায় দেয় যে, অন্য রাষ্ট্রের কাছে ভারতের জমি হস্তান্তরের এখতিয়ার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নেই। ফলে বেরুবাড়ি সমস্যার সমাধান অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। এই সমস্যার এক প্রকার সমাধান আসে ১৯৭১ সালের ২৯শে মার্চ ভারতের সুপ্রিম কোর্টের দেয়া এক রায়ে। সেখানে হিন্দু অধ্যুষিত দক্ষিণ বেরুবাড়ির ১২ নং ইউনিয়নের ১১.২৯ বর্গ কিলোমিটার ও কোচবিহার জেলার চারটি ছিটমহল, যাদের আয়তন ৬.৮৪ বর্গ কিলোমিটার, ভারতকে হস্তান্তর করার এবং বিনিময়ে মুসলিম অধ্যুষিত ১৮.৬৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের রংপুরের ছিটমহল দহগ্রাম ও আঙরপোতা পাকিস্তানকে (বাংলাদেশকে) হস্তান্তর করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এই রায় ঘোষণার পাঁচদিন আগেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় এই রায় বা নেহেরু-নুন চুক্তির বাস্তব কার্যকারিতা আর থাকে না।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বেরুবাড়ি সমস্যা সমাধানের জন্য ভারত বাংলাদেশের কাছে নতুন করে প্রস্তাবটি নিয়ে আসে। এই প্রস্তাব মোতাবেক দক্ষিণ বেরুবাড়ির পুরোটাই ভারত পাবে, বিনিময়ে বাংলাদেশ দহগ্রাম-আঙরপোতাসহ তাদেরকে পাটগ্রাম থানার পানবাড়ি মৌজার সঙ্গে যুক্ত করার জন্য ১৭৮ মিটার দৈর্ঘ ও ৮৫ মিটার প্রস্থের (তিন বিঘা) করিডোর পাবে। ১৯৭৪ সালের ১৬ই মে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে তিন বিঘাসংক্রান্ত এই প্রস্তাব পাশ হয়। চুক্তিটিকে র‍্যাটিফাই করার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৪ সালের ২৮শে নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে দক্ষিণ বেরুবাড়ি ভারতের নিকট হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। কিন্তু অপর পক্ষে আজ পর্যন্ত কোন ভারত সরকার তিনি বিঘা করিডোর হস্তান্তরের জন্য অনুরূপ সংবিধান সংশোধনী প্রস্তাব লোকসভায় উত্থাপন করেনি।

১৯৮২ সালের ৭ই অক্টোবর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ আর শামস-উদ্‌-দোহা ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পি ভি নরসীমা রাও-এর মধ্যকার স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ভারত আবারও তিন বিঘা করিডোর হস্তান্তরে সম্মত হয়। কিন্তু এই চুক্তি ও মুজিব ইন্দিরা চুক্তি উভয়টিই তিন বিঘা হস্তান্তরসংক্রান্ত ব্যাপারে ভারতে জনরোষের কবলে পড়ে। বিশেষতঃ দহগ্রাম-আঙরপোতা সংলগ্ন ভারতীয় এলাকা কুচলিবাড়ি, ধাপারহাট ও মেখলিগঞ্জের মানুষ তিন বিঘা করিডোর হস্তান্তরের তীব্র বিরোধিতায় নামে। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। সত্যটা হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশ আজো তিন বিঘা করিডোর পায়নি। বাংলাদেশকে এটি দিয়ে দেবার জন্য ভারতের সংবিধান সংশোধনের যে বাধ্যবাধকতা আছে সেটি আর কোনদিন সম্ভব বলে মনে হয় না। কারণ, ৩৭ বছর পরে আজকের ভারতের রাজনৈতিক বাস্তবতা ভিন্ন। আজকের ভারতে কেন্দ্রিয় সরকার গঠিত হয় ডজনখানেক দলের কোয়ালিশনের মাধ্যমে। সংসদে বিরোধী জোটের শক্তিও থাকে ভারসাম্যমূলক। সেখানে কেউ এ’ধরনের বিল তুললে অন্যদের বিরোধিতায় সেটি পাশ হবার সম্ভাবনা শূন্য। ভবিষ্যতেও ভারতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কোন দল ক্ষমতায় যাবার সম্ভাবনা শূন্য। তাছাড়া ভারতের কোন সংসদীয় দল আজ পর্যন্ত তিন বিঘা করিডোর হস্তান্তরের বিষয়টি সংসদে উত্থাপন করেওনি।

পূর্বাভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, হাসিনা-মনমোহন চুক্তিতে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময়ের কথা থাকলেও সেগুলোর পরিণতি তিনি বিঘার মতোই হবার কথা। ইতিমধ্যে আসামের প্রধান বিরোধী দল অসম গণ পরিষদ (অগপ) জমি বিনিময় চুক্তির প্রবল বিরোধীতায় নেমেছে। তাদের ভাষ্য - আসামের জমি দেবার মালিক আসামের জনগণ; আসামের জমি বাংলাদেশকে দেবার এখতিয়ার ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা আসামের মুখ্যমন্ত্রীর নেই। প্রাসঙ্গিক হিসাবে ১৯৬০ সালের ভারতের সুপ্রিম কোর্টের কথাও আলোচনায় চলে এসেছে। তাছাড়া সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন নিয়ে শেখ হাসিনার পক্ষে যে বিল পাশ করানো সম্ভব সেখানে মাত্র ৩৮% আসন নিয়ে মনমোহনের পক্ষে ভারতের লোকসভায় সে ধরনের বিল পাশ করানো সম্ভব নয়। আমরা দেখেছি, মনমোহন সিং-এর এই সফরকালেই তিস্তা চুক্তি নিয়ে মমতা ব্যানার্জীর অনমনীয় মনোভাবের জন্য তিস্তা চুক্তি হতে পারেনি। ব্যাপারটি ভারতের কেন্দ্রিয় সরকারের জন্য বিব্রতকর হলেও মমতার এই সিদ্ধান্ত তাকে পশ্চিমবঙ্গে ভালো অবস্থান দিয়েছে। মমতার সিদ্ধান্ত আসামে অগপ নেতা প্রফুল্ল কুমার মোহান্তের জন্য উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং তিনিও জমি বিনিময় নিয়ে রাজ্যে কংগ্রেসী তরুণ কুমার গগৈ সরকার ও কেন্দ্রে মনমোহন সিং সরকারকে এক হাত দেখে নেবার চেষ্টায় আছেন।

বোধসম্পন্ন যে কেউ বুঝবেন বাংলাদেশ আর ভারতের শীর্ষ নেতা পর্যায়ে জমি বিনিময় নিয়ে যতো চুক্তিই হোক ভারতে সংবিধান সংশোধন করে সেটির র‍্যাটিফিকেশন সম্ভব নয়। অতীতে ভারতের এমন আচরণে ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও কেউ কেউ যে র‍্যাটিফিকেশন ঠেকানোর জন্য আদালতের দ্বারস্থ হবেন না সেটি হলফ করে বলা যায় না। বর্তমান ব্যবস্থায় তিন বিঘা করিডোর দিনরাত খুলে রাখার ব্যবস্থাটিও টেকসই নয়। কারণ, যে কোন সময় ভারত সরকার বা তার সংশ্লিষ্ট যে কোন প্রতিষ্ঠান (যেমন, বিএসএফ, পুলিশ, জেলা কর্তৃপক্ষ, সামরিক বাহিনী, আদালত ইত্যাদি) নূন্যতম নোটিশে বা বিনা নোটিশে এই করিডোর বন্ধ করে দিতে পারে। তাহলে, উভয় দেশের সরকার এই চুক্তিগুলো কেন করে? এই কেন’র উত্তর বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য ভিন্ন।

ভারত সীমান্ত চুক্তি বা ছিটমহল বিনিময় চুক্তিগুলো করে একাধিক চুক্তির একটি প্যাকেজের অংশ হিসাবে। ছিটমহল ইস্যুটি বিতর্কিত ও বহুল আলোচিত বলে প্যাকেজের বাকি চুক্তিগুলো আর তেমনভাবে আলোচনায় আসে না। ফলে বাকি চুক্তিগুলোতে বাংলাদেশের স্বার্থ যথাযথভাবে সংরক্ষিত না হলেও সেটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে কম। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকার দ্বিপাক্ষিক চুক্তিসমূহের বিবরণ এমনভাবে গোপন করে যে তাতে সাধারণ মানুষের আর ঐসমস্ত চুক্তিগুলোর ব্যাপারে কিছু জানার বা বলার উপায় থাকে না। ফলে অর্থহীন ছিটমহল চুক্তির আড়ালে ভারতের স্বার্থের অনুকূলে অন্যান্য চুক্তি সম্পাদিত হয়ে যায়। কূটনীতির হিসাবে ভারতের এই ভূমিকা প্রশংসনীয়।

বাংলাদেশও সীমান্ত চুক্তি বা ছিটমহল বিনিময় চুক্তিগুলো করে একাধিক চুক্তির একটি প্যাকেজের অংশ হিসাবে। ভারতের প্রস্তাবিত ছিটমহল বিনিময় চুক্তি মেনে নিলে বাংলাদেশ যদি ভারতে আরো কিছু বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশ, নেপালের সাথে ট্রানজিট, বিদ্যুৎ ক্রয়, ঋণপ্রাপ্তি ইত্যাদি বিষয়ে সুবিধাজনক চুক্তি করতে পারে তাহলে তা মন্দ কী। কূটনীতির হিসাবে বাংলাদেশের এই অবস্থানও সঠিক।

কূটনীতির হিসাব যা-ই বলুক ছিটমহলগুলো বিনিময় না হলে ছিটমহলগুলোর মানুষকে আজীবন মানবিক ও নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকতে হবে। গত চৌষট্টি বছর ধরে তারা ইউটিলিটি, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদন থেকে দূরে অমানবিক জীবন-যাপন করছেন। কিন্তু সেসব মানুষগুলোর দুর্দশা ক্ষুদ্র স্বার্থচিন্তায় অন্ধ রাজনীতিক-আমলাদের চোখে পড়ে না। মনে পড়ে, আশির দশকে একবার পতিত সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি তখন সে একবার দহগ্রাম-আঙরপোতায় গিয়েছিল। জনসভায় দহগ্রামের চেয়ারম্যান সাহেব নিজেদের দুর্দশার কথা বলতে বলতে এরশাদের পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠেন। তিনি তাঁর জনগণকে এই সীমাহীন দুর্ভোগ থেকে বাঁচানোর জন্য এরশাদের করুণা চান। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব যা জানতেন না সেটা হচ্ছে, তাঁদেরকে বাঁচানোর কোন উপায় এরশাদের কাছে ছিলনা। তাঁদেরকে বাঁচানোর কিছুটা উপায় হয়তো ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর কাছে ছিল। তবে সবচে’ বড় উপায় ছিল ভারতের লোকসভা-বিধানসভার সদস্যদের কাছে, ভারতের সুপ্রিমকোর্টের কাছে। এই দুঃখী মানুষগুলোকে দেশের আর দশটা মানুষের মতো মানবিক ও নাগরিক সুবিধার আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার মাঝে শুভবুদ্ধির উদয় হোক।


মন্তব্য

pathok এর ছবি

ভাল লাগল লেখা, কষ্ট লাগল মানুষগুলোর জন্য - "এই দুঃখী মানুষগুলোকে দেশের আর দশটা মানুষের মতো মানবিক ও নাগরিক সুবিধার আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার মাঝে শুভবুদ্ধির উদয় হোক"

মিশু তাজ এর ছবি

শুভ কামনা রইলো - আশায় আশায় ।।

রেহমান জিয়া এর ছবি

লেখাটি বেশ ভাল লাগলো। ধন্যবাদ।

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

মূল সত্যটা চমৎকারভাবে বিশ্লেষণ করলেন।

ছিটমহলবাসীর অমানবিক জীবনযাপন মেনে নিতে বড় কষ্ট হয়। মন খারাপ


_____________________
Give Her Freedom!

আকামের আবদুল এর ছবি

বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর এবং পশ্চিম বাংলার কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলা ছাড়া বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার অন্য কোন জেলায় ছিটমহল নেই কেন, এবং ছিটমহল উৎপত্তির কারণ বিষয়ে কোন লেখা কোথাও আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। বিষয়টি সম্পর্কে আপনার জানা থাকলে, আলোকপাত করুন Ñ কৃতজ্ঞ থাকব। এ ছাড়া পাকিস্তানের সাথে এ ধরনের সমস্যা ছিল বা আছে কি-না, সে বিষয়েও জানতে আগ্রহী।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

১। শোনা যায় কোচবিহারের মহারাজার সাথে রংপুরের প্রশাসক দাবা খেলতেন। তারা দাবা খেলার বাজি হিসাবে এক একটা গ্রাম বাজি ধরতেন। বাজিতে একেকবার একেকজন হেরে এই জটিল সমস্যাটি নাকি তৈরি হয়েছে।

২। যতদূর জানি পাকিস্তানের সাথে ভারতের এমন সমস্যা নেই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

পথখোঁজা পথিক এর ছবি

দহগ্রাম গিয়েছিলাম একবার। ছিটমহলের মানুষগুলোর অমানবক জীবনযাপন না দেখলে কেউই এ যুক্তিগুলোর তাৎপর্য বুঝতে পারবে না; রাজনীতিবিদরা তো নয়ই। আমরা ঢাকায় বসে ক্যালকুলেটর এ বাংলাদেশের কয় বিঘা জমির লাভ-ক্ষতি হল তা দেখেই খুব কথা বলা শুরু করি কিন্তু সেসব অতি দরিদ্র মানুষদের কাছে এতে কিছুই আসে যায় না; তাদের আসে যায় না তারা বাংলাদেশী না ভারতীয়। কেননা তারা কোনো দিক থেকেই কিছু পাচ্ছে না। আমাদের এই মেকি দেশপ্রেমের কোনো অর্থই নেই এভাবে চিন্তা করলে।

লেখাটি ভালো লাগলো।

দিগন্ত এর ছবি

ভারত প্রথমবারে তিনবিঘা হস্তান্তরে ব্যর্থ হয়েছিল কারণ সুপ্রিম কোর্ট বাধা দিয়েছিল। তিনবিঘা নিয়ে পরের চুক্তি ছিল লিজের - যাতে সুপ্রিম কোর্ট তা নিয়ে ঝামেলা না করতে পারে। করিডোর এখন দিনে ২৪ ঘন্টার জন্য লিজ দেওয়া আছে - সুতরাং দহগ্রামের বাসিন্দারা যেমন খুশী যাতায়াত করতে পারেন সেখানে। এই ব্যাপারটা আরো চল্লিশ বছর আগেই হওয়া উচিত ছিল কিন্তু হয়নি প্রতিবেশী ভারতীয় গ্রামগুলোর আপত্তিতে। তাদের জন্য বিকল্প রাস্তা না হওয়া অবধি দু-দেশের জন্যই করিডর খোলা থাকবে এখন।

ছবিতে দেখবেন ধাপারহাট থেকে মেখলিগঞ্জ যাবার রাস্তা তিনবিঘার ওপর দিয়ে যায়। এই রাস্তার জন্য একটা ফ্লাইওভার বানানো হচ্ছে, যা তিনবিঘার ওপর দিয়ে যাবে।

বাকি ছিটমহল বিনিময় নিয়ে কংগ্রেসের সাথে বিজেপির কথা হয়েছে বলে সংবাদে প্রকাশ। সুতরাং এবারে পার্লামেন্টের সংবিধান সংশোধনীর সমস্যা হওয়া উচিত নয়। ছিটমহল আসামের ইস্যু নয় - পশ্চিমবঙ্গের ইস্যু, আরও ভাল করে বললে কোচবিহার জেলার ইস্যু। সুতরাং আসামে কি হচ্ছে তার প্রভাব এতে পড়বে না, মমতা ব্যানার্জী রাজী থাকলে বাকি কোনো পার্টির অমতের কারণ নেই। ছিটমহল বাসিন্দারা বিনিময় প্রস্তাবে যথেষ্ট খুশী ও এতে মমতারও অমতের কারণ দেখি না। সুতরাং, ছিটমহল বিনিময় হচ্ছেই - আগামী বছর দুই-তিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

১। আসলে লিজ কোন সমাধান নয়। আপনি জানেন, লিজ যেমন দেয়া যায় তেমন তা বাতিলও করা যায়। আজকে ভারত সরকার তিন বিঘা বাংলাদেশকে লিজ দিয়েছে, আগামীকাল অভ্যন্তরীন কোন চাপে পড়ে ভারত সরকার তা বাতিল করতে বাধ্যও হতে পারে।

২। তিন বিঘা বাংলাদেশকে দিয়ে দিলে ধাপারহাট-কুচলিবাড়ি যে ছিটমহল হয়ে পড়বে সেটা জানি। ফ্লাইওভার তার একটা ভালো সমাধান। কারণ, এরচেয়ে ভালো সমাধান আপাতত জানা নেই। তিস্তার গতিপ্রবাহ বদলে গেলে বা নদী ভাঙন বৃদ্ধি পেলে এই সমাধানটিও টিকবে কিনা কে জানে!

৩। আসামের সমস্যাটি ছিটমহল নিয়ে নয়, সীমানা নির্ধারণ নিয়ে। সেটি অন্য প্রকার সমস্যা। তবে তরুণ গগৈ সরকারকে আগামী নির্বাচনে বিপদে ফেলার জন্য অগপ-আসু এই ইস্যুটাকে বড় করে তোলার চেষ্টা করছে।

৪। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে একবার ছিটমহল ইস্যু যখন তুঙ্গে তখন এক রাজনৈতিক সম্মেলনে ফরোয়ার্ড ব্লকের এক নেতাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন, তার দল বাংলাদেশকে বিরতিহীনভাবে তিন বিঘা ব্যবহার করতে দেবার পক্ষে। আমি বললাম, কিন্তু আপনার দল এর বিরুদ্ধে সীমান্তে ডেমোনেস্ট্রেশন করেছে বলে পত্রিকায় পড়েছি। তিনি কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলেন, ওগুলো স্মল লোকাল ফ্যাকশনের কাজ। ভারত বিশাল দেশ, সেখানে রাজনৈতিক সংগঠনের সংখ্যাও অনেক। সুতরাং পার্লামেন্টেও বড় দলের আনা পাশার দান ছোটরা উলটে দিতে পারে।

আশা আমরা করতেই পারি, তবে র‍্যাটিফিকেশনের ব্যাপারটাতে আমি আপনার মতো নিশ্চিন্ত নই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দিগন্ত এর ছবি

১) lease in perpetuity মানে ভবিষ্যতে পরিবর্তন করার সুযোগ নেই, অন্যভাবে বললে পরিবর্তন মানে চুক্তিভঙ্গ। আপনি পুরো টার্মস পড়তে পারেন।
২) নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সমস্যা সারা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তেই আছে। সেগুলোর জন্য সামগ্রিক সমাধান ভাবতে হবে, প্রয়োজনে তাদের জন্য আবার কিছু করিডরের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩) এটাতে সঠিক কি সমস্যা আছে আমার কাছে পরিষ্কার না। আমার কাছে চুক্তি ঠিকই মনে হয়েছে। তবে এর ফলে ছিটমহলের কোনো ইস্যু তৈরী হবে না।
৪) ওনার বক্তব্য সঠিক - কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো ছোটো দল - এমনকি বাসিন্দারাও খুব একটা প্রতিবাদ করছে বলে মনে হয় না তিনবিঘা বা ছিটমহল নিয়ে। সেই কারণেই আমি আশাবাদী।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

৩। সর্বশেষ সীমান্ত চুক্তিটাতে অসমের সাথে বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণ নিয়ে ঠিক কী আছে তা জানতে পারিনি। তাই অগপ-আসু'র ক্ষোভের কারণটাও স্পষ্ট নয়। ফাঁকতালে অগপ-আসু কংগ্রেসের উপর একহাত নেবার চেষ্টা যে করবে সেটা স্বাভাবিক।

৪। পরিস্থিতি আপাতত ভালো আছে বলে বোধ হচ্ছে। তবে আমি এই রাজনীতিবিদদের ওপর ঠিক ভরসা করতে পারি না। সব কিছু যদি ঠিকমতো যায় তাহলে সেটা আনন্দের ব্যাপারই হবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দিগন্ত এর ছবি

৩) গগৈ-এর বক্তব্য নিয়ে রিপোর্টে দেখতে পারেন।
৪) একমত।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

রিপোর্টটার জন্য ধন্যবাদ। আমি কয়েকদিন "দৈনিক যুগশঙ্খ" পড়লাম, পার্টিজান পত্রিকা। তারা এমনতর রিপোর্ট করছে যে, ভারত সরকার আসামের বিপুল এলাকা বাংলাদেশকে উপহার দিয়ে দিয়েছে। আয়রনিটা হচ্ছে এই যে, এরপরও বিষয়গুলোর সমাধানের জন্য আমাদেরকে এইসব রাজনীতিবিদদের উপরই নির্ভর করতে হবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তানিম এহসান এর ছবি

দহগ্রাম আঙ্গরপোতায় আমি গিয়েছি দুইবার, পথে একদিকে বিডিআর আর আরেকদিকে বিএসএফ বন্দুক, কামান ফিট করে বসে থাকে! মানুষ যে মানুষকে কতটা অসহায় করে তুলতে পারে,না দেখলে বিশ্বাস করা যাবেনা। আর কিছু বলতে ইচ্ছে হচ্ছেনা .....

আপনাকে ধন্যবাদ বিষয়টির উপর তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনার জন্য।

কর্ণজয় এর ছবি

মনযোগী সময় কাটলো...

বন্দনা এর ছবি

আচ্ছা পাণ্ডবদা, এই ছিটমহল প্রব্লেম কি পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে, না শুধু আমাদেরই। আমার খুব একটা ধারনা ছিলনা, লিখাটা পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম দাদা।আর দিগন্ত ভাইয়ের দেয়া ম্যাপটা দেখে বুঝতে পারাটা অনেকটা সহজ হোল।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

নিচে ধৈবতের দেয়া লিঙ্কটা দেখুন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ফাহিম হাসান এর ছবি

ছিটমহল সম্পর্কে আমার আবছা মতন একটা ধারণা ছিল। পোস্টে একবার চোখ বুলিয়েই তাই সরাসরি প্রিয়তে। আপনার বিশ্লেষণ ভাল লেগেছে। সীমান্তের মানুষদের এত কষ্ট!

অফটপিক: গল্প দেন না অনেক দিন হল রেগে টং

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

অটঃ শীঘ্রই গল্প দেবার চেষ্টা করছি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ধৈবত(অতিথি) এর ছবি

এ ধরণের পলিটিকাল প্যাঁচগোচালো বিষয় নিয়ে, আপনার কাছ থেকে আরো পোস্ট চাই। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জন্য। এ দায়িত্ব আপনাদের মতো বসদের যারা খুব সাবলীল ভাবে লেখনীতে ফুটিয়ে তুলতে পারে। সংবাদপত্র পড়ে সবকিছু ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা।

পোস্টের সাথে এই লিঙ্কটা হয়তো কাজেও লাগতে পারে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

দরকারী লিঙ্কটার জন্য ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

তথ্যবহুল, উপকারি, সচেতনতার একটি পোস্ট। অনেক কিছু জানলাম। অনেক ধন্যবাদ।

উচ্ছলা এর ছবি

অনেক তথ্যবহুল এই লেখাটির জন্য ধন্যবাদ আপনাকে। অনেক কিছু বিস্তারিত জানতে পারলাম।

'রাজনীতি' এখন আর জনস্বার্থে চলে না। তবুও আশা করছি, শিঘ্রই রাজনীতিবিদেরা এই সমস্যাটির সমাধান করবেন। জনগনের সমস্যা দূর করার ন্যই তো তাঁরা মাস শেষে বেতন পান।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

রাজনীতিকদের মাথার ছিট ছুটুক সাততাড়াতাড়ি!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সচেতন জনগণকে এই ব্যাপারে রাজনীতিবিদদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

কুটনীতির কাছে মানবিকতা যুগ যুগ ধরে মার খেয়ে আসছে। কেয়ামত তক গ্যারান্টি সহকারে মার খাবে কোন সন্দেহ নেই। আঙ্গরপোতা দহগ্রামেও সেই মানবিকতা মার খেয়ে যাচ্ছে অনেক যুগ ধরে। সাম্প্রতিক চুক্তির পর পরিস্থিতি উন্নত হয়েছে কিছুটা। তবে এটাও কোন স্থায়ী সমাধান না। অবশ্য সচল 'দিগন্তদা যে ফ্লাইওভারের কথা জানালেন ওটাই আপাতত সর্বোত্তম সমাধান মনে হচ্ছে। আশা করা যায় ওটা সত্যই বাস্তবায়িত হবে।

এখন এই প্রসঙ্গে পুরোনো একটা চিন্তা শেয়ার করি।

ছিটমহলগুলো তৈরীর জন্য কতোটা স্যার রেডক্লিফ দায়ী কতোটা উপমহাদেশের রাজনীতি দায়ী তা জানি না। একটা দেশের পেটের ভেতর আরেকটা দেশ, তার ভেতরে আরেকটা দেশও থাকতে পারে(চন্দ্রছিট)। ছিটমহল কতোটা বিদঘুটে ব্যাপার আমি তিনবিঘা করিডোর যাবার পথে পথে টের পেয়েছি যেখানে বাংলাদেশের মধ্যে টুকরো টাকরা ভারতীয় জমি দেখা যাচ্ছিল পিলারে চিহ্ন দেয়া আছে। আমার গাইড ভ্যানঅলা জানিয়েছিল, ওখানে কেউ চাষ করতে আসে না। বছর বছর এমনি পড়ে আছে।

ভারতের পেটের মধ্যে কতোটা বাংলাদেশ আছে জানি না, তবে বাংলাদেশের পেটের মধ্যে ভারতের বেশ কয়েকটা টুকরা দেখেছি যার সাইজ পাঁচ-দশ কাঠার বেশী হবে না। বাংলাদেশের ভেতরে অবস্থিত এত ছোট ছোট জমি কেন অন্য দেশের মালিকানায় যাবে। এইরকম অবাস্তব সীমান্ত ভাগাভাগি করলো কেন? তার মানে কি দেশ ভাগাভাগিটা জমি দিয়ে হয়নি, মানুষ দিয়ে হয়েছিল? দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছিল। সেই ভাগ নিশ্চয় রহিম সলিম, হরিশ, গোপালকে কেটেছিল। তাদের যার যেখানে জমি আছে সেটাই তাদের দেশের মালিকানায় গেছে। নাকি?

এখানেই আমার সংশয়। স্যার রেডক্লিফ তাইলে কি কাটাকুটি করলেন? শোনা গিয়েছিল তিনি নাকি তরমুজের ফালির মতো কেটে ভাগ করেছিলেন দেশটাকে। ফলে কোন বাড়ির বৈঠকখানা ভারতে আর রান্নাঘর পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল। সেরকম যদি হতো তাইলে তো ছিটমহল সৃষ্টি হবার কথা না। অনেকদিন ধরে এই রহস্যটা ঘুরছিল মাথার ভেতরে। আপনার এই লেখাটা সেটাকে আবার জাগিয়ে দিল।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সুমন তুরহান এর ছবি

তথ্যবহুল লেখাটির জন্যে ধন্যবাদ আপনাকে। অনেক কিছু জানলাম।

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।